পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

“বাড়ির কাছে আরশিনগর, সেথা পড়শি বসত করে”

  • 25 July, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1832 view(s)
  • লিখেছেন : মনসুর মণ্ডল
সোশ্যাল মিডিয়ায় চর্চা শুরু হয়েছে, মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তরপত্রে পরীক্ষার্থীর নাম থাকার সুযোগে একশ্রেণির শিক্ষকরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও দলিত ছাত্র-ছাত্রীদের নম্বর দেওয়ায় বৈষম্য করছেন। দাবি উঠেছে, এটা থামাতে উত্তরপত্রে নাম না লিখে শুধু রোল নম্বর ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর লেখার নিয়ম করা দরকার। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকেও একথা বলা হচ্ছে।


বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় চর্চা শুরু হয়েছে, মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তরপত্রে পরীক্ষার্থীর নাম থাকার সুযোগে একশ্রেণির শিক্ষকরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও দলিত ছাত্র-ছাত্রীদের নম্বর দেওয়ায় বৈষম্য করছেন। দাবি উঠেছে, এটা থামাতে উত্তরপত্রে নাম না লিখে শুধু রোল নম্বর ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর লেখার নিয়ম করা দরকার। উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে পরীক্ষায় এই নিয়ম চালু আছে বলে শোনা গেলেও কথাটা কতটা সত্যি তা নিয়ে সন্দেহ আছে । বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকেও একথা বলা হচ্ছে।

ভালো প্রস্তাব। কিন্তু তাতে হিমশৈলের চূড়া ভাঙার কাজটা মাত্র হবে। জাত-ধর্ম দেখে পরীক্ষায় নম্বর কম দেওয়া একটা মানসিকতার প্রতিফলন। এই মানসিকতা শুধু পরীক্ষায় নম্বর কম দেওয়াতে আটকে থাকতে পারে না। বিদ্যালয়ে পঠন-পাঠন, এই বর্গের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি ঐ শিক্ষকদের আচরণ, ভুক্তভোগী ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে অন্য ছাত্র-ছাত্রীদের সম্পর্ক, সব ক্ষেত্রেই প্রতিফলিত হওয়ার কথা। এ নিয়েও ভাবা প্রয়োজন।

এ প্রসঙ্গে আমার এক ঘটনা মনে পড়ছে। তখন ২০১৮-র উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। এক আবাসিক মুসলিম মিশনের পরিচিত একজন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীকে তার সম্ভাব্য রেজাল্টের কথা জিজ্ঞেস করে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। ছেলেটি বলেছিল, রেজাল্ট তেমন ভালো হবে না। পরীক্ষার হলে তিন-চারজন হিন্দু টিচার আমাদের মার্ক করে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করে গেছিল। তিনটে সাবজেক্টে ফল ভালো হবে না। মার্কস সেভেন্টি পার্সেন্টের বেশি হবে না হয়তো।

মিশন কর্তৃপক্ষ বিষয়টা জেনেও প্রতিবাদ করতে পারেননি। মিশনটির কাউন্সিলের থেকে স্বীকৃতি নেই। এক গভর্নমেন্ট এইডেড স্কুলের ছাত্র হিসেবে এই মিশনের ছাত্রদের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ানো হয়। সমস্যাটা নিয়ে উচ্চবাচ্য করলে পাছে ঐ স্কুল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা হারাতে হয়, তাই মেনে নেওয়া ও মানিয়ে নেওয়া। অন্যথায় পরের বছর মিশন কর্তৃপক্ষ এক অদ্ভুত উপায় বের করলেন। পরীক্ষার্থীদের স্কুল ড্রেস পাল্টে ফেলা হ’ল। পরীক্ষায় ছেলেরা মিশনের স্কুল ড্রেস না পরে যে স্কুলের নামে পরীক্ষা দিচ্ছিল সেই স্কুলে চালু স্কুল ড্রেস পরে গিয়েছিল,যাতে মিশনের ছাত্র বলে কোনো শিক্ষক শনাক্ত করতে না পারেন। কতটা অসহায়তা ও হীনম্মন্যতায় তাড়িত হলে এই আত্ম-প্রবঞ্চনা সম্ভব, ভাববার বিষয় বড়। আরও ভাববার বিষয় যে, সমস্যাটার ব্যাপ্তি জানান দেয়, এটা শুধু শিক্ষাঙ্গনে সীমাবদ্ধ নয়। এটা সামাজিক সমস্যা।

সৌমিত্র দস্তিদার ‘মুসলমানের কথা’ নামে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানিয়েছেন। তাতে প্রান্তিক জায়গায় পড়ে থাকা মুসলিম মানুষজনের জীবনযাত্রা, আশা-হতাশা, ব্যর্থতার চালচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। মানুষের প্রত্যক্ষ জবানিতে ফুটিয়ে তোলা জীবন-আলেখ্য নিয়ে বানানো সে ছবি। সেখানে এক মেয়ের কথা আছে, যিনি আক্ষেপ শোনাচ্ছেন, স্কুল সার্ভিস পরীক্ষায় প্যানেলে তাঁর ছ- নম্বরে নাম ছিল। কিন্তু আগে-পরের সবার চাকরি হলেও তাঁর হ’ল না। কারণ তিনি মুসলিম। এমএ পাস হালিমা সমাজকর্মী। মুসলিম মেয়েদের ক্ষমতায়নের কাজ করেন। স্রেফ নামের কারণে সরকারি অফিসে নিজের নানা বিড়ম্বনার কথা শুনিয়েছেন। এরকম নানা ঘটনার কথা আছে, যা মুসলমান সমাজের বেদনার ছবি, সমগ্র সমাজের কলঙ্কিত দিক।

সমাজ-বাস্তবতার এইসব বিষম চালচিত্র, এ হ’ল সমাজে বয়ে চলা ধর্মীয় সংখ্যাগুরু বা আধিপত্যবাদী মানসিকতার চোরাস্রোত। যেখানে যেমন, কোথাও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি অবজ্ঞা ও অজ্ঞতা, কোথাও জাতপাতের দ্বন্দ্বের চেহারায় এই মানসিকতা নিজেকে জাহির করে। দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটিতে, চলনে-বলনে তার প্রকাশ। কখনও কোথাও তা চরম সিদ্ধান্তে চাপা বিদ্বেষ। এই আচার-বিচারকে আপাত বিচারে মনে হতে পারে ছোটোখাটো অসংগতি। কিন্তু সমগ্রে সমাজে তার ফলাফল গুরুভার ও সুদূরপ্রসারী। ভুক্তভোগী সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর সামনে এই মানসিকতা বাধা ও ব্যবধানের প্রাচীর খাড়া করে রেখেছে। পরিস্থিতির পাকচক্রে এই প্রবণতা কোথাও ক্রূর চেহারা নিতে পারে। পরীক্ষায় নম্বর কম দেওয়া বা পরীক্ষা-বিভ্রাট ঘটানো কি সেরকমই ব্যাপার নয়?

যদি এই বাস্তবতা কাটাছেঁড়া করা হয়, দেখা যাবে, মুসলমান সম্প্রদায় তার সহজ শিকার। অন্যান্য ভুক্তভোগী বর্গের প্রতি যদি বা কিছু অনুকম্পা করা যায়, মুসলমানের প্রতি তা নৈব নৈব চ। সূক্ষ্ম বিভেদের কাঁটাতার ডিঙোবার ইচ্ছে মনে কণামাত্র জাগে না, এই-ই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের। এ হ’ল অভ্যাস আর অহংকারের এক অচলায়তন। তা ভাঙতে এক অন্তর্নিহিত রক্তক্ষরণ আছে। যারা বিনি সুতোর মালা গাথতে হাত লাগায়, তাদের ক’জনই বা রক্তক্ষরণের বেদনা সইতে রাজি?

সামাজিক বিভাজনের আগ্রাসী রাজনীতি আজ হিন্দু-মুসলমানের স্বাভাবিক সামাজিক সম্পর্কের সামনে শাসানির মতো নামিয়ে আনছে। সেখানে সংখ্যাগুরুর মনে পুষে রাখা এই বিরূপতা-অবজ্ঞার মানসিকতা কি ইন্ধন হয়ে পড়ছে না? এদিকে বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধ উচ্চারণ বড়ই ম্রিয়মাণ। আসলে সমাজ-দেহে চিরাচরিত অঙ্গাভরণ এই মানসিকতা রাজনৈতিক ক্ষমতার অলিন্দে আস্তিনের নীচে লুকানো তাস। আর যেখানে যেটুকু আন্তরিক প্রচেষ্টা, তার পরিসর সীমিত।

সহাবস্থানের ঐতিহ্য, ধর্মনিরপেক্ষ বুনিয়াদ—এই বিশাল দেশের পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ, তার ব্যাপ্তি কম নয়। কারা অন্তর দিয়ে আগলে রাখে এই ঐতিহ্য? মনে-প্রাণে ধারণ করে এই বুনিয়াদ? তারা প্রান্তিক মানুষ। তাদের পরিশীলিত কণ্ঠস্বর নেই। বিপরীতে এই সংখ্যাগুরু মানসিকতার রকম-সকম পরিশীলিত ও প্রগলভ। তাই, লোকায়ত বিচারধারাতেই পরিত্রাণের উপায় খোঁজা চাই। এ এক সাংস্কৃতিক উন্মেষের পন্থা।

0 Comments

Post Comment