পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

নিয়োগ দুর্নীতি আর বেহাল শিক্ষাঙ্গন

  • 29 March, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 927 view(s)
  • লিখেছেন : অশোকেন্দু সেনগুপ্ত
কেউ কি জানতে চায় স্কুলে আর ভালো বা যোগ্য শিক্ষক জোটে না কেন? ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালে উপকার হয় কার— ছাত্রের না সমাজের? স্কুল ছেড়ে শিশু কোথায় পালায়, কেন? খাদ্যের অভাবই বা কেন? উত্তর খুঁজেছেন অশোকেন্দু সেনগুপ্ত।

তখন পবিত্র সরকার মহাশয় ছিলেন হায়ার এডুকেশন কাউন্সিলের সহ-সভাপতি (সালটা সম্ভবত ১৯৯৮)। ঘোষিতভাবে তিনি বাংলাভাষায় শিক্ষাপ্রসারের প্রবল সমর্থকদের একজন এবং সেই কারণেই আর এক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সুনন্দ সান্যালের বিরুদ্ধ শিবিরে। একই কারণে আমিও বিরুদ্ধ শিবিরে, আজকাল পত্রিকায় এই বিষয়ে প্রবন্ধও লিখেছি। এই সময় বামফ্রন্ট সরকার নীতি বদলে এই পবিত্রবাবুকেই দায়িত্ব দেওয়া হল। আশা করি, পরের গল্প সবারই জানা। ইংরেজি পড়ানোর যোগ্য শিক্ষকের অভাব সারা রাজ্য জুড়ে। ও-ই বামফ্রন্ট আমলেই ISI, IIM-এর বিশেষজ্ঞরা দেখিয়েছেন ইংরেজি শিক্ষার মোহ কেমনভাবে রাজ্যের অভিভাবকদের মনে ভয়ংকর কুপ্রভাব বিস্তার করেছে। 

এর মধ্যে চালু হয়েছে নয়া বা জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০। সেখানে স্পষ্ট বলা হয় যে ইংরেজির গুরুত্ব কমাতে হবে। এতে অবশ্যই রাজ্য সরকারের খুশি হবার কথা। কিন্তু একই সঙ্গে হিন্দি চাপানোর উদ্যোগে এই রাজ্য সরকার খুশি হতে পারে না। তাও বড় সমস্যা নয়। রাজ্যের শিক্ষা সচিব তো নিজেই বিশেষ আগ্রহী নয়া শিক্ষানীতি চালু করায়। তা হলে বলব নাকি মাভৈঃ। না, তা বলার আগে অন্যদিকও বিবেচনা করতে হয়। অন্যদিক মানে টাকা-পয়সার দিক। 

প্রাথমিক স্তরে শিক্ষক নিয়োগে দূর্নীতি ভুলতে পারি না। সরকারের ক্ষতি হয়েছে অল্পই (শিক্ষকদের মাইনে দিতে হয়নি)। হবু শিক্ষকরা এখন রাস্তায়। যতদিন তাঁরা রাস্তায় থাকেন ততদিন মাইনে বাবদ খরচটা তো বাঁচে। OMR sheet-এ নম্বর শূন্য পেয়েও যে চাকরি পেয়েছে তার তো চাকরি যাবেই। আদালত না থাকলেও যাবে। সকলেই কী শিক্ষক হতে পারেন? মোদ্দা কথাটা হল— নিখরচায় যে ক'দিন শিক্ষক নেই এই তথ্যটা চাপা দেওয়া যায়! 

প্রসঙ্গত মনে পড়ছে অন্য কথাও। তখন শিশু কমিশনের দায়িত্ব সামলাচ্ছি। সবে দায়িত্ব নিয়েছি। কেরালার চেয়ারপারসনের ফোন পেলাম। দালাল মারফত পাচার হওয়া কিছু শিশুকে ওই রাজ্যে আটক করা হয়েছে এবং তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের শিশুও কিছু আছে। রাজ্যের সরকারি দপ্তরের তৎপরতায় দ্রুত তাদের ফেরত আনা এবং মালদা জেলার শিশু সুরক্ষা কমিটির দক্ষতায় সেই শিশুদের ঘরে ফেরানো সম্ভব হয়। হরিশ্চন্দ্রপুর ব্লকের সেই শিশুরা কেমন আছে দেখতে যাই অল্পদিন পরে। 

খুব বৃষ্টি সেদিন। গ্রামের স্কুলে গিয়ে দেখি ৪০০ বা আরও বেশী ছাত্র-ছাত্রী উপস্থিত সেখানে, সবাই ওই স্কুলের ওই ক্লাসেরই ছাত্র। শিক্ষক ৩ জন, একজন ছুটিতে (মোট ৪ জন)। আমার সঙ্গে অন্য আধিকারিক ছাড়াও জেলার বিদ্যালয় পরিদর্শক মহাশয়ও ছিলেন। বিদ্যালয় পরিদর্শক মহাশয় বললেন, জেলার গড় কিন্তু বেশ ভালো (প্রায় ৪০ জন ছাত্র পিছু একজন শিক্ষক)। 

—তাহলে এখানের হাল এতো খারাপ কেন? শিক্ষার হাল ভালো নয় বলেই তো এখানকার অভিভাবকরা দালাল মারফত শিশুকে পাচার হতে সাহায্য করেন, নাকি?

চোখে দেখা সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। অন্যদিকে পরিদর্শক মহাশয় উত্তরে যা বললেন তাও যে সত্য। অনেকে বদলি 'ম্যানেজ' করে নেয়, এমন দুর্গম জায়গায় অধিকাংশ মানুষ আসতে চায় না। (পরে জলপাইগুড়ি  জেলার প্রধান ছিলেন যিনি সেই পৃথা সরকারের কাছেও শুনেছি প্রায় একই কথা।)। 

ভালো শিক্ষকের অভাবে যে শিশুপাচার হয় তা প্রত্যক্ষ করেছি সেদিন।  

ওদিকে, আর এক সত্য এই যে, অভিভাবকরা মিথ্যাই ভাবেন যে অন্য রাজ্যে গেলে শিশু ইংরেজি শিখবে ভালো। এমনও নয় যে সেই ইংরেজি শেখা শিশুরা সব চাকরি পাচ্ছে। হরিশ্চন্দ্রপুর গ্রামের লোকও তা মানল। ভয়ংকর বেকারি সেখানে প্রত্যক্ষ করা গেল।

পাঠক নিশ্চয় খেয়াল করেছেন যে আমি বলেছি ভালো শিক্ষকের অভাবের কথা। তার বদলে পাই যদি অযোগ্য শিক্ষক? যে কেউ শিক্ষক হতে পারেন নাকি?  এখন নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে যা শোনা যাচ্ছে তা তো স্বস্তি দেয় না। আবার এও ঠিক নয় যে, যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন তাঁরা সকলে ভালো শিক্ষক। কিন্তু মানতেই হয় যে তাঁরা যোগ্য শিক্ষক। 

এমন নয় যে, রাজ্যে ভালো ইংরেজি মাধ্যম বা ভালো বা যোগ্য শিক্ষক নেই যথেষ্ট, সে সবগুলিই একমাত্র দায়ী, আরও কারণ আছে।

২০১০-এর পয়লা এপ্রিল থেকে শিক্ষা অধিকার আইন বলে যে কোনও শিশুকে শিক্ষাদানের দায় সরকারের। শুধু কী তাই? স্কুলপ্রাঙ্গণে শিশু এলেই তাকে পুষ্টিকর খাদ্যও দিতে হবে। মিড ডে মিল। কেন্দ্র যা দেয় তাতে যে হয় না  তা সকলেই বোঝে। বিকল্প পুষ্টির আয়োজন কৈ? স্কুলে স্কুলে ছাদ-বাগান বা ছোট আকারের মাছচাষের আয়োজন হতে পারত, হয় না, এ বিষয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি কারোরই যেন কোনও উৎসাহ নেই। কেবল কিছু মাস্টার আর অভিভাবক ঘ্যানঘ্যান করে। শিক্ষকদের অসম বন্টন আছে। আবার এও ঠিক যে মাস্টাররা পোস্টিং ম্যানেজ করে নেয় নানা ছুতোয়। এদিকে মাস্টাররাই স্কুল চালাতে খরচ চায়— ইলেক্ট্রিকের খরচ, স্কুলচত্বর পরিস্কার রাখার খরচ, ছেলেমেয়েদের দৌড়ঝাঁপের খরচ ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ কেউ বুঝেও বোঝে না রাজ্যের সীমাবদ্ধতা। নাকি তারা দেখেও দেখে না বই-পোষাক ইত্যাদির খরচ? নাকি তারা বুঝতে চায় না, কেবল বিরোধী দলের কথায় নাচে? ভাবে বুঝি কেন্দ্র দেয় সব! দেয় না, কেন্দ্র বাগড়া দেয় সবেতেই। ৪২ তম সংবিধান সংশোধন তো ওরাই করেছিল, আমরা রাজ্যে রাজ্যে কেবল সম্মতি দিয়েছি। অন্য রাজ্যের হালও অন্যরকম নাকি? সব এক। অন্যদের মতো আমরাও শিক্ষকদের মাইনে দিই। পার্থক্যও আছে অবশ্যই। 

এই রাজ্যে শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে গ্রামে বা শহরে আর্থিক উন্নতি হয়েছে এবং হচ্ছে। এখানে ক্লাবের ঢাক বাজলে পাদুটি নেচে ওঠে তো? তারপরও চাই নাকি স্কুল! পালটা প্রশ্নও করি তবে। মাস্টার কেন তোমার বাচ্চাকে পাঠাও না সরকারী স্কুলে?  কেন অভিভাবক তুমি খবর নাও না শিশুর ভালোমন্দের? তবে তোমরা কেন খোঁজো বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম এবং ভালো স্কুল। সাধারণ মানুষ দুর্গম জায়গায় যায় কেবল বেড়াতে। জানো না?

নাই বা তুমি (অভিভাবক) হলে স্কুল ম্যানেজমেন্টের কেউ? নাই বা পেলে দলের টিকিট? তোমার আর্থিক অবস্থা ভালো এখন? তবে বেড়াও খুব। দিনে দিনে পর্যটন শিল্প হয়ে উঠুক। স্কুল বন্ধ করে দাও, শিশুরা ভোটার নয়, ওদের জন্য খরচ কমালে কে কী বলবে? যদি বলেও তারা ক'জন আর কতবার বলবে?

কে জানতে চায় দুর্গম অঞ্চলে (নিয়োগ দুর্নীতি সামনে আসার পর বলা যেতে পারে যে, সব অঞ্চলেই) আর ভালো বা যোগ্য শিক্ষক জোটে না কেন? ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালে উপকার হয় কার— ছাত্রের না সমাজের? স্কুল ছেড়ে শিশু কোথায় পালায়, কেন? খাদ্যের অভাবই বা কেন? কে দেবে এসব প্রশ্নের উত্তর? তার চেয়ে সহজ স্কুল বন্ধ করে দেওয়া।

0 Comments

Post Comment