লোকসভা নির্বাচনের দিন সমাগত ! বিজেপি দাবি করছে ৩৭০ আসন পাবে ! সন্দেহ নেই সংখ্যাটা প্রতীকি ! অনেকে প্রশ্ন তুলছেন আগে থেকে কোন ভরসায় এই সংখ্যাটা বলছে বিজেপি ! তবে কি নিয়ন্ত্রিত ইভিএমই শেষ কথা বলবে? তবে আসন্ন নির্বাচনে বিজেপি বিরোধী দলগুলি থেকে এখনো যতটা লড়াইয়ের আভাস মিলছে তাতে নরেন্দ্র মোদীকে বেশি চিন্তায় ফেলেছে বলে মনে হয়না ! বিরোধীদের এখনো অগোছালো অবস্থা ! তবে নরেন্দ্র মোদীর দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে তার দলের তথা বৃহত্তর হিন্দুত্ববাদী পরিবারের প্রধান চারটি অন্তর্দ্বন্দ্ব !
ক ) হিসেব করে দেখা যাচ্ছে লোকসভায় বিজেপির বর্তমান লোকসভা সংসদের মাত্র ৪২% আদি বিজেপি ! বাকিরা নব্য ! আদি বিজেপি কারা ? স্বভাবতই যারা বহুদিন ধরে বিজেপি বা সংঘ পরিবারের সঙ্গে যুক্ত ! যেমন ধরুন বাংলার সাংসদ দিলীপ ঘোষ ! তিনি নিঃসন্দেহে আদি বিজেপি ! কিন্তু সাংসদদের প্রায় ৫৮% নাকি অন্য দল থেকে আসা ! তাদের সত্তর জন কয়েক বছর আগেও কংগ্রেস করেছেন ! ক্ষমতায় থাকার জন্য বিজেপি এদের কিনে নিয়েছে ! এই নব্য বিজেপিরাই এখন দলে ভারি ! তারা নাকি আদিদের সম্মান করে না ! সাংসদ দিলীপ ঘোষকে তো দলীয় কার্যালয় থেকেই উৎখাত করা হয়েছে বলে খবর। মোদী-শাহের প্রশ্রয়ে নব্যদের এই দাপাদাপি সংঘ পরিবারের না পসন্দ ! ভুলে গেলে চলবে না আরএসএস একটি শত বছরের পুরোনো শৃঙ্খলাপরায়ণ সংগঠন ! তাদের সদস্যরা দলবদলু নব্য বিজেপি নেতাদের কাছে লাগাতার কোনঠাসা হবে তা স্বাভাবিক ভাবেই সংঘ পরিবার মেনে নেবে না !
খ ) দ্বিতীয় দ্বন্দ্বটা অত্যন্ত জটিল ! ব্রাহ্মণ ও বৈশ্যদের ক্ষমতার লড়াই ! হিন্দুত্ববাদীদের রাজ ধর্মের পরম্পরায় রাজা কখনো ব্রাহ্মণদের অসম্মান করেন না ! বর্ণ শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদের অনুমতি ও আশীর্বাদ নিয়েই রাজত্ব করেন তারা ! বৈশ্যরা রাজা হয় না ! অর্থের জোরে তারা ক্ষমতাবান হলেও থাকেন অন্তরালে ! আরএসএস এর স্বপ্নের হিন্দু রাষ্ট্রে নরেন্দ্র মোদী এই পরম্পরাকে শুরু থেকেই ভাঙছেন ! তাঁর রাজত্বে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা কোনঠাসা হয়েছেন গত একদশক ধরে ! রাজ ক্ষমতা দখল করেছে বৈশ্যরা ! উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা তা মানবেন কেন ! মনে রাখতে হবে জন্ম লগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত যতজন সংঘ পরিচালক হয়েছেন, তাঁদের একজন ছাড়া সবাই ব্রাহ্মণ ! সংগঠনে মহারাষ্ট্রের চিতপাবন ব্রাহ্মণদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি ! মন্ডল কমিশন এর ধাক্কা সামাল দিতে ১৯৯৪-২০০০ সালে সংঘ পরিচালক ছিলেন অব্রাহ্মণ রাজেন্দ্র সিং তোমার ( রাজু ভাইয়া )! সে সময় বেশ কিছু ওবিসি যুব নেতাকে , যেমন নরেন্দ্র মোদী, উমা ভারতী, আরএসএস বিজেপিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়ে আসে ! সেই ক'বছর বিজেপিতে 'মন্ডলী করণ' চলে জোর কদমে ! এই প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হাসিল হলেও দলে ব্রাহ্মণদের আধিপত্য কমতে থাকে ! লাল কৃষ্ণ আদবানি, গোবিন্দচরিয়া, ডঃ মুরলি মনোহর যোশির মত ব্রাহ্মণ নেতা ও তাত্ত্বিকরা দলে কোনঠাসা হয়ে পড়েন।
নরেন্দ্র মোদীর শাসন যত এগিয়েছে বৈশ্যরা তত ক্ষমতাশালী হয়েছে !
নাগপুরের সাথে মোদীর নেতৃত্বে বৈশ্যদের এই লড়াইয়ে গোরখপুরের গীতা প্রেসকে সঙ্গে নিয়েছেন বৈশ্যরা ! গীতা প্রেস শত বছরের পুরোনো হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ! এটি গঠন করে কলকাতার মাড়োয়ারি সমাজ ! কিছু হিন্দুত্বের তাত্ত্বিক প্রশ্নে বহুদিন ধরেই নাগপুর আর গোরখপুরের একটা অলিখিত লড়াই চলছে ! মোদী বাবু সেই সুযোগটাই কাজে লাগাতে চাইছেন গীতা প্রেসকে গান্ধী পুরস্কারে ভূষিত করে !
গ ) অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ সংঘ পরিবারের অন্তঃকলহে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ! মোদী ও তার বৈশ্য সহযোগীরা চাইছেন অযোধ্যা হবে ভ্যাটিকান বা মক্কার মত এক পবিত্র স্থান ! পৃথিবীর হিন্দুরা অযোধ্যায় ছুটে আসবেন রাম মন্দিরে পুজো দিতে ! হিন্ধুদের শ্রেষ্ঠ ধর্মস্থান হবে অযোধ্যার রাম মন্দির ! সুযোগ বুঝে তাঁর ব্যাবসায়ী বন্ধুরা অযোধ্যায় জমি কিনে হোটেল রিসোর্ট বানাচ্ছে !
সমস্যা এখান থেকেই শুরু ! রাম মন্দির যদি সব ভক্তদের টেনে নেয় তবে ভারতের বাকি সব মন্দিরের কি হবে ? চার ধাম, তিরুপতি মন্দিরের আকর্ষণ কবে গেলে মন্দির কেন্দ্রিক ভারতের অর্থনীতির কি হাল হবে ! বছরে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার লেনদেন ! সব মন্দিরের পুরোহিত নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ! তাঁরা ছেড়ে দেবেন তাঁদের বংশানুক্রমিক অধিকার একজন বৈশ্য রাজার কাছে ! তাই তারা বেঁকে বসেছেন ! রাম লালার প্রাণসঞ্চার অনুষ্ঠান বয়কট করেছেন ! ভুলে গেলে চলবেনা চার ধামের প্রধানরা হিন্দু জনমানসে অত্যন্ত শ্রধ্যেয় ধর্মগুরু বলে আজও পূজিত হন !
মোদী বিরোধী ব্রাহ্মণদের এই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডঃ সুব্রমানিয়াম স্বামী ! এখন অনেকে তাঁকে আগের মত খুব একটা গুরুত্ব না দিলেও চীন ফৌজের ভারতের জমি দখল থেকে হিন্দু মন্দিরের পবিত্রতা রক্ষায় মোদীজির ব্যর্থতার কথা বার বার প্রকাশ্যে তুলছেন ডঃ স্বামী ! তাঁকে মোদীবাবু না পারছেন গিলতে, না পারছেন ফেলতে ! এখন নির্বাচন কমিশনে নালিশ করেছেন বিজেপির সাংগঠনিক নির্বাচন হয় নি ! তাই দলটির নির্বাচনে যোগদান বেআইনি !
ঘ ) সবচেয়ে বড় দ্বন্দ্ব মনে হচ্ছে গুজরাটি ও মারাঠি অস্মিতার লড়াই শুরু হয়েছে ! মোদী সরকার খুব পরিকল্পিত ভাবে মুম্বাইকে পিছনে ফেলে আহমেদাবাদ / গান্ধী নগরকে ভারতের ব্যবসায়িক রাজধানী রূপে গড়ে তুলতে চাইছেন! বিদেশী ও স্বদেশী যাবতীয় বিনিয়োগ গুজরাট মুখী হয়েছে তার জমানায় ! দুর্ভাগ্য বশত মোদী আজও গুজরাটি বানিয়াদের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন নি ! তাই শাসক ঘনিষ্ট গুজরাটি ও মারাঠি পুঁজির লড়াই শুরু হয়েছে ! মারাঠিরা শিবাজী জন্মদিন ঘটা করে পালন করছে ! রাজস্থানের রাজপুতরাও পিছিয়ে নেই ! ইতিহাস খুঁড়ে তুলে এনেছে রানা প্রতাপকে ! আর গুজরাটের আছে বল্লভভাই প্যাটেল ! শোনা যায় গুজরাট বনাম বাকি ভারতের এই লড়াইয়ে নাগপুরে বসে নীরবে মদত দিচ্ছেন মারাঠি বামুন নিতিন গড়কড়ি !
আগামীতে মোদীবাবু এই চারটে অন্তর্দ্বন্দ্বের মীমাংসা কি করে করবেন তার উপর নির্ভর করছে নির্বাচনের ফলাফল ! তবে আশার কথা বর্ণ ও জাতপাতে বিভক্ত হিন্দুত্ত্ব কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় দর্শন রূপে রাষ্ট্র ব্যবস্থার সহযোগী হতে পারেনা বেশিদিন ! বর্ণবাদী হিন্দুত্বের অন্তদ্বন্দ্বই হিন্দু রাষ্ট্রের পতনের কারণ হয় ! এটাই ভরসা !