বিজেপি তথা আরএসএসের অতি চালাক মাতব্বতরা প্রাচীন ভারতের জ্ঞান নিয়ে আজকাল প্রভূত মাতামাতি করছেন। অবশ্য তাদের নিজস্ব মহলে এমন মূর্খামি তারা চিরকালই করে এসেছে। কিন্তু এতকাল যা ছিল তাদের নিজস্ব দরবারের লোক হাসানো মূর্খামি তা আজ রাষ্ট্রক্ষমতার দৌলতে এবং অংশত উদারনৈতিক বুর্জোয়া ও কমিউনিষ্টদের ব্যর্থতায় খোলা হাটে এসে পড়েছে এবং যা সব থেকে আশংকার ব্যাপার তা হল এই যে, আমাদের দেশের জ্ঞানচর্চার সমস্ত প্রতিষ্ঠানের ঘাড়ে চেপে বসেছে। আজকাল এমনসব ইতিহাসবিদ, পুরাতত্ত্ববিদ, গবেষক, শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ইতিহাস কংগ্রেসের মাতব্বর, ডাক্তার থেকে শুরু করে ইউটিউবারদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে যারা খুব ভারিক্কীচালে এই মূর্খদের প্রলাপকে বিজ্ঞানে পরিণত করার অপচেষ্টায় নিযুক্ত হয়েছেন। যেমন ধরা যাক চিকিৎসা বিজ্ঞানের কথা। সকলেই জানেন যে, প্রাচীন ভারতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিপুল উন্নতি ঘটেছিল। প্রাচীন সভ্যতার মধ্যে যেগুলিতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের চোখ ধাঁধানো অগ্রগতি ঘটেছিল তার মধ্যে একটি হল ভারত। এই ক্ষেত্রে মিশর এবং গ্রিসের সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে ভারতের নাম উচ্চারিত হয়। ভারতের প্রাচীন চিকিৎসকদের অগ্রগণ্য হিসাবে চরক এবং সুশ্রুত অধিক পরিচিত। রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদীরা প্রায়ই এটা দেখানোর চেষ্টা করে চরক বা সুশ্রুত আসলে তাদেরই লোক এবং বর্তমানে এই ব্রাহ্মণ্যবাদী ফ্যাসিবাদীরা গোটা দেশে যে ধরণের খাদ্য প্রায় বাধ্যতামূলক করার ফরমান জারি করছে তা আসলে ভারতের চিকিৎসাশাস্ত্রের কিংবদন্তি হিসাবে পরিচিত এইসব ব্যক্তিত্বের কথারই প্রতিধ্বনি মাত্র। সুতরাং, প্রাচীন ভারতের গৌরবগাথাকে চাগিয়ে তুলে এই মিথ্যেবাদী ফ্যাসিবাদীরা তাদের বর্তমানের কুকীর্তিকে যুক্তিসিদ্ধ প্রমাণ করতে চাইছে। প্রাচীন ভারতের চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে মাহাত্ম্য প্রচার তারা করছে সেটা পুরোপুরি এই উদ্দেশ্যেই। সুতরাং, আমরা এবার সংক্ষেপে চরক সংহিতা নিয়ে কিছু আলোচনা করব।
চিকিৎসা বিজ্ঞান—- চরক সংহিতা
প্রাচীন ভারতের প্রায় সমস্ত ব্যক্তিত্বের মতই চরকের সময়কাল নিয়েও প্রভূত বিতর্ক আছে। তবুও সংখ্যাধিক্যের মতানুযায়ী এটা বলা যেতে পারে খ্রীষ্টপূর্ব ২০০ থেকে ২০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যেকার কোনো একটি সময়ে চরকের উত্থান। পাঠকের স্মরণে থাকবে যে, এটা হল মনুরও সময়কাল। অর্থাৎ, কাছাকাছি সময়ের মধ্যে মনু সংহিতা এবং চরক সংহিতা উভয়ই রচিত হয়েছিল। কোনটি আগে কোনটি পরে তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে মনু সংহিতার কিছু পরে চরক সংহিতা রচিত হয়েছিল বলেই মনে হয়। চরক সংহিতাই প্রথম মানব শরীর এবং তার বিভিন্ন ব্যাধি ও তার চিকিৎসা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করে। যদিও চিকিৎসা ব্যাপারটা নতুন কিছু ছিল না। তারও বহু আগে থেকেই বৈদিক রচনাদিতে আমরা চিকিৎসার কথা পাই। আর লাগাতার যুদ্ধরত মানবগোষ্ঠীতে এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপারই হবার কথা। আর কিছু না হোক, অন্তত যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসা তো করতেই হবে। ফলত বেদে আমরা অশ্বিনী ভ্রাতৃদ্বয়কে ধ্বন্বন্তরি চিকিৎসকের ভূমিকায় দেখতে পাই। ইন্দ্র বহু যুদ্ধে চিকিৎসার জন্যে এই ভ্রাতাদের সাহায্য নিচ্ছেন তা বৈদিক সাহিত্যে পরিলক্ষ্যিত হয়। বৌদ্ধরাও চিকিৎসার ওপর সবিশেষ নজর দিয়েছিলেন তা আমরা বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে জানতে পারি। স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ ভেষজগুরু নামে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু চরক সংহিতাই প্রথম খুবই বিস্তৃতভাবে চিকিৎসাশাস্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করে।
চরক সংহিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল সেখানে চিকিৎসার ব্যাপারে দেবতাদের কোনো ভূমিকা নেই। মূলত চারটি বিষয়ের ওপরই চরক তাঁর মনোযোগ নিবদ্ধ করেছেন। সুতরাং এই চারটি বিষয় নিয়েই তাঁর আলোচনা। ডাক্তার, ওষধ ও পথ্য, শুশ্রূষাকারী বা নার্স, এবং রোগী। এখানে একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন। চরক সংহিতা খুবই বিস্তৃত রচনা। আয়তনে এটি প্রাচীন গ্রিসের হিপোক্রিটিক রচনাবলীর তিনগুণ। প্রখ্যাত মার্কসবাদী দার্শনিক দেবীপ্রসাদ লিখেছেন, "On a rough calculation, it is about three times in bulk of what survives as the medical literature of ancient Greece, the so called Hippocratic corpus." (১) দেবীপ্রসাদ দেখিয়েছেন যে, চরক সংহিতার টেক্সটের ভাষাও সর্বত্র একই সময়ের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে না। সুতরাং এর মধ্যে কিছু অংশ প্রক্ষিপ্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। চরক সংহিতার টেক্সটে আমরা স্থানে স্থানে ভক্তির কথাও পাই। যেমন গোরুকে অনেক জায়গাতেই পূজ্য বলা হয়েছে। কিন্তু চিকিৎসা নিয়ে যখনই আলোচনা হয়েছে তখনই কিন্তু তাতে এই ভক্তি, দেবতা, পূজা এসবকে কোনো জায়গা দেওয়া হয় নি। তখন সেখানে একেবারেই ভৌতিকবাদী, হেতুবাদী এবং দ্বন্দ্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গীকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে এবং চিকিৎসা ও পথ্যের প্রয়োজনে গরুর মাংসকেও কাজে লাগানোর কথা বলা হয়েছে। সুতরাং, চরক সংহিতার টেক্সটের মধ্যে দুইটি পাঠ একে অন্যের সাথে জড়িয়ে রয়েছে। প্রধান পাঠটি হল বিশুদ্ধ চিকিৎসা শাস্ত্রের দৃষ্টিকোন থেকে দ্বান্দ্বিক ও হেতুবাদী পাঠ এবং অন্যটি হল স্থানে স্থানে দেবতা, পূজা ও ভক্তিমূলক পাঠ। নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয় যে, এর কারণ কী? এ কি প্রক্ষিপ্ত হবার কারণে নাকি তৎকালীন সময়ে (মনুর উত্থান) চিকিৎসকদের কোনঠাসা অবস্থাকে সামাল দিয়ে নিজেদের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার স্বার্থে তা আমরা জানি না। কিন্তু দেবীপ্রসাদ দেখিয়েছেন যে, মনুবাদী ব্রাহ্মণ্য পুরোহিততন্ত্রের দাপটে সেই সময়ে কীভাবে বৈজ্ঞানিক চিকিৎসাবিদ্যা ও চিকিৎসাবিদরা কোনঠাসা ও একঘরে হয়ে গিয়েছিলেন। সে কথায় আমরা পরে আসব।
চরক সংহিতার প্রধান এবং মূল পাঠ দাঁড়িয়ে রয়েছে দ্বান্দ্বিক ও হেতুবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর ওপর। সঠিক চিকিৎসকের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যেমন বলা হয়েছে, তীব্র বিষও সর্বোৎকৃষ্ট ওষুধ হতে পারে যদি তা সঠিক সময়ে সঠিক রোগীর ক্ষেত্রে সঠিক পরিমানে প্রয়োগ করা যায়। আবার সর্বোৎকৃষ্ট ওষুধও কার্যক্ষেত্রে তীব্র বিষ হয়ে যেতে পারে যদি তা ভুলভাবে প্রয়োগ করা হয়। সমস্তটাই নির্ভর করছে চিকিৎসকের জ্ঞান ও পারদর্শীতার ওপর। তাই সঠিক চিকিৎসক নির্বাচন করা চিকিৎসার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় (২)। বস্তু যে প্রায়শই তার বিপরীতে বদলে যায় এই বোধ চরক সংহিতার প্রতিটি ছত্রে আমরা পাই। মনু সংহিতার মতো স্মৃতিশাস্ত্র বা ধর্মশাস্ত্রগুলি যেভাবে সঠিক ও বেঠিক, পবিত্র এবং অপবিত্র ইত্যাদি কাজগুলির অনড়, অচল শ্রেণিবিভাগ করেছে এবং যুগ যুগ ধরে যে কোনো সময়ে যে কোনো পরিস্থিতিতে বিশেষ বিশেষ কাজকে অবশ্যপালনীয় এবং বিশেষ বিশেষ কাজকে অবশ্যত্যজ্য হিসাবে তুলে ধরেছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গী আমরা দেখতে পাই চরক সংহিতায়।
খাদ্য নিয়ে মনু সংহিতা এবং চরক সংহিতার তুলনামূলক আলোচনা বেশ কৌতুহলোদ্দীপক লাগতে পারে। খাদ্য নিয়ে মনু সংহিতার গোটা আলোচনাটাই যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে অন্ধ, ব্যাখ্যাহীন, কুসংস্কারগ্রস্থ ও অবৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর সেখানে চরক সংহিতা খাদ্যের গুণাগুণকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। অবশ্যই আজ থেকে দুই হাজার বছরেরও অধিক কাল আগে যতটা বৈজ্ঞানিকভাবে এই আলোচনা করা যেত সেভাবেই। আমাদের কাছে বিজ্ঞানের অগ্রগতির স্তরটি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় নি। গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে দৃষ্টিভঙ্গীটি। আজকেও আমরা যাকে বিজ্ঞান বলে জানি, আজ থেকে দুই হাজার বছর পর তা নিতান্তই সাধারণ জ্ঞান বলেই হয়ত মনে হবে। কিন্তু একটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী বিজ্ঞানের অগ্রগতির সকল স্তরেই তার পরিচয় ও ছাপ রেখে যায়। আর এই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর এক অপূর্ব ঝলক আমরা চরক সংহিতায় পাই। যেখানে মনু সংহিতা পরিপূর্ণ উৎকট অবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীতে।
মনু সংহিতার পঞ্চম অধ্যায় সঠিক খাদ্য নিয়ে আলোচনা করেছে। তাতে কী বলা হচ্ছে? একটি সূত্রে (৩) বলা হচ্ছে:
"রশুন, গৃঞ্জন (গাজর), পলান্ডু (পেঁয়াজ), কবক অর্থাৎ ছত্রাক (ব্যাঙের ছাতা), এবং মলমূত্রাদিপরিপূর্ণ দূষিত স্থানে উৎপন্ন শাকপ্রভৃতি দ্রব্য ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য এই বর্ণত্রয়ের (দ্বিজ) পক্ষে অভক্ষ্য (কিন্তু শুদ্র যদি এইসব ভোজন করে, তাহলে দোষের হয় না)।।"
কী অদ্ভুত বিষয় দেখুন। খাদ্যের সাথে যোগাযোগ মানব শরীরের। সেখানে "দ্বিজ"দের সাথে "অদ্বিজ"দের কি কোনো পার্থক্য থাকতে পারে? রোগী ভেদে, রোগ ভেদে ফারাক হতে পারে। কিন্তু তা মনু সংহিতার ধর্তব্য নয়। মনু পড়েছেন বর্ণজাতি নিয়ে যা সম্পূর্ণভাবেই কল্পিত এবং আরোপিত বিষয় এবং অন্যান্য কিছু ধর্মের মতই খাদ্য চয়নের ওপর ব্যাখ্যাহীন অবৈজ্ঞানিক নির্দেশ গায়ের জোরে চাপানো হয়েছে। "দ্বিজ"রা যদি এই খাদ্যগুলি খায় তাহলে কী হবে? যদিও এই সূত্র থেকে তা আন্দাজ করে নেওয়া যায় তবুও মনু তা পাঠকের আন্দাজের ওপর ছেড়ে রাখেন নি। কয়েক সূত্র পরেই (৪) তা খোলসা করে বলে দিয়েছেন। সেখানে আমরা পাচ্ছি:
"ছত্রাক (ব্যাঙের ছাতা), গ্রাম্য শূকর, রশুন, গ্রাম্য কুকুর, পলান্ডু (পেঁয়াজ), গৃঞ্জন (গাজর) —- এগুলি জ্ঞানপূর্বক ভক্ষণ করলে দ্বিজাতি পতিত হন।" বোঝাই যাচ্ছিল, এবার পরিষ্কার হয়ে গেল। জাতিবর্ণের মতো একটি কল্পিত, আরোপিত বিষয়কে রক্ষা করার জন্যে কল্পিত, আরোপিত, ব্যাখ্যাহীন, অবৈজ্ঞানিক নির্দেশ এল। এগুলি খেলে কেন "দ্বিজ" পতিত হবেন, তার তথাকথিত দ্বিজত্বের কোন গুণ কীভাবে এগুলি খাওয়ার ফলে নষ্ট হবে তার কোনো ব্যাখ্যা মনু সংহিতার কোথাও নেই। মনুর কথাই শেষ কথা। এই হল প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রজ্ঞানের একটি দিক। ভারতীয় জ্ঞান-পদ্ধতির একটি দিক।
ভারতীয় জ্ঞানের অন্যদিকটির প্রতিনিধি হল চরক সংহিতা। সেখানে কী বলা হচ্ছে এই খাদ্যগুলির বিষয়ে? দেখা যাক। গাজরের বিষয়ে চরক সংহিতায় (৫) বলা হচ্ছে:
"গৃঞ্জন সংগ্রাহী, তিক্ষ্ণ, এবং বাতশ্লেষ্মা ও অর্শ রোগের পক্ষে অতিশয় হিতকর। যে সকল ব্যক্তির দেহে পিত্তের ভাগ অল্প, তাহাদের ঘর্ম্যকরণে ইহা ব্যবহৃত হয়।"
পিঁয়াজ ও রসুন প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে:
"পেঁয়াজ শ্লেষ্মাবর্ধক, বায়ুনাশক, পিত্তনাশক নহে, ভোজনযোগ্য, বলকারক, গুরুপাক, শুক্রবর্ধক ও অন্নরুচিকারক। লশুন কৃমি, কুষ্ঠ, ও কিলাসরোগনাশক, বাত-হারক, গুল্মনাশক, স্নিগ্ধ, উষ্ণ, শুক্রবর্ধক, এবং কটুরসবিশিষ্ট ও গুরুপাক। পেঁয়াজ ও লশুনের বীজ শুষ্ক হইলে উহা বায়ু ও কফনাশক হইয়া থাকে। এই ষষ্ঠ হরিৎ বিষয় বর্গ বর্ণিত হইল।" (৬)
খুব সহজেই লক্ষ্য করা যাবে চরক সংহিতার দৃষ্টিভঙ্গীটি কিন্তু মনু সংহিতার একেবারেই বিপরীত। চরক কিন্তু মনুর মত খাদ্যগ্রহণকারীর জাতবর্ণ বিচার করে এগুলি খাওয়ার ফল ভিন্ন তা বলছেন না। তার ধর্তব্য হল মানবশরীর যেখানে একজন ব্রাহ্মণ বা তথাকথিত দ্বিজের সাথে একজন শুদ্রের কোনো ফারাক নেই। খাদ্যের যোগাযোগ মানবশরীরের সাথে, জাতবর্ণের সাথে নয়। সেখানে কোন খাদ্য কী ভূমিকা পালন করে তা একেবারে চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন থেকে তিনি নির্দেশ করে দিচ্ছেন। চরক হয়তো এই নির্দেশগুলির রাসায়নিক ব্যাখ্যা দিয়ে যেতে পারেন নি কিন্তু আজ থেকে দুই হাজার বছরের অধিক কাল আগে তিনি খাদ্যগুলির যে গুণাগুণ বর্ণনা করেছিলেন তা আজও মোটের ওপর সত্য বলেই ধরা হয়। অন্যদিকে মনুর ওই আরোপিত, অবৈজ্ঞানিক ও কুসংস্কার গ্রস্থ কথাগুলি আজ সুস্থমস্তিষ্কের লোকদের কাছে হাসিতামাশার বিষয়মাত্র। মজার ব্যাপার হল, এই যে "জ্ঞান"গুলি ইত্যবসরে হাসিতামাশার বিষয়ে পরিণত হয়েছে সেগুলিকেই আরএসএস/বিজেপি ভারিক্কীচালে প্রকৃত ভারতীয় জ্ঞান বলে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে।
মাছ মাংস খাওয়া নিয়েও মনুর হাজার রকম বাধানিষেধ রয়েছে। অনেক ব্যাখ্যাকারই বলেছেন যেহেতু প্রাণীহত্যা অন্যায় তাই মনু সাধারণভাবে মাছমাংস খেতে বারণ করেছেন। কিন্তু মনু সংহিতায় যাগযজ্ঞে পশুবলি দিতে কোনো বাধা নেই। বরং বারবার বলা হয়েছে যে বলির মাংসই একমাত্র খাওয়া যেতে পারে। যজ্ঞে পশু বলি দেওয়ার ক্ষেত্রে কিন্তু আর প্রাণীগণের প্রতি কোনো সহানুভূতি দেখানো৷ হয় নি।
"মন্ত্রের দ্বারা যার সংস্কার করা হয় নি এমন পশুর মাংস ব্রাহ্মণ যেন কখনো ভোজন না করেন। তবে শাশ্বত বৈদিক বিধি আশ্রয় করে মন্ত্রসংস্কৃত পশুর মাংস খাওয়ার কোনো বাধা নেই।।" (৭)
"যজ্ঞ করে মাংস ভোজন করবে, কারণ যজ্ঞের হুতাবশিষ্ট যে মাংস তার ভোজনকে দৈব প্রবৃত্তি বলে। এ ছাড়া অন্য প্রকারে সংগৃহীত মাংস-ভোজনকে রাক্ষসের আচার বলা যায়।।" (৮)
মনুর মতে মাছ খাওয়া মহাপাপ কারণ তাতে সর্বমাংস খাওয়ার পাপ হয় (৯)। কিন্তু আবারও ঐ। দেবকার্যে ও পিতৃকার্যে নিবেদন করে মাছ খাওয়া যেতে পারে। আর কেন মনু মাংস খেতে বারণ করছেন আর যজ্ঞে বলি দিয়ে খাওয়া যেতে পারে বলছেন? মনুর মতে ইহলোকে মাংস ভোজন করলে পরলোকে সেই পশুর দ্বারা ভক্ষিত হতে হয়, এটাই নাকি "মাংস" কথাটির অর্থ (মাং = আমাকে, সঃ = সে ভক্ষণ করিবে) বলে পন্ডিতরা বলে গেছেন (১০)। আর যজ্ঞে বলি/আহূতি দিয়ে মাংস ভোজন করলে কেন এটা ঘটে না? কারণ, তার ফলে উভয়েরই স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটে থাকে! (১১)
তাহলেই বুঝে দেখুন। এবারে পরলোক, ইহলোক এসবও চলে এল। জাতিবর্ণ, ইহলোক, পরলোক এই সমস্ত কল্পিত, আরোপিত, অবৈজ্ঞানিক চিন্তার জটাজালের উপরই মনুর সমস্ত শিক্ষাদীক্ষা জ্ঞানগম্যি দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই হল প্রাচীন ভারতের 'জ্ঞানভান্ডার'-এর একটা দিক।
অন্যদিকে মাংস নিয়ে চরকের বক্তব্য কী? চরক বলছেন, "শরীরপোষকের মধ্যে মাংসাপেক্ষা অন্য কোনো খাদ্য শ্রেষ্ঠ নহে" (১২)! এরপর চরক ধরে ধরে বিভিন্ন পশুপাখীর মাংস নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং প্রতিক্ষেত্রেই মাংসের অনেকগুলি গুণকে চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে গোরু ও মোষের মাংসও আছে। মোষের মাংস সম্পর্কে বলেছেন, "মহিষের মাংস স্নিগ্ধ, উষ্ণ, মধুর, বৃষ্য, গুরু, তর্পণ, দেহের দৃঢ়তা, ও বৃহত্বকারী, উৎসাহজনক ও নিদ্রাকর (১৩)।" আর গোরুর মাংস সম্পর্কে বলেছেন, "গো মাংস বায়ুরোগে, পীনস রোগে, বিষমজ্বরে, শুষ্ক কাসে, পরিশ্রমজনিত ক্লান্তিতে, অতিশয় অগ্নিতে, এবং দেহের মাংসক্ষয়ে বিশেষ হিতকর (১৪)।" মাছ সম্পর্কেও চরক উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। যদিও এটাও বলেছেন যে, মাছের অনেক প্বার্শপ্রতিক্রিয়া আছে। চরক এটা শুধু মাছ নিয়েই নয়, সকল খাদ্যেরই প্বার্শপ্রতিক্রিয়ার কথাও উল্লেখ করতে করতে গেছেন। যাতে করে উক্ত খাদ্যগুলি গ্রহণ করার উপযুক্ত সময় ও পরিমাণের দিকেও দৃষ্টি দেওয়া হয়।
চরকের বক্তব্যের মধ্যে কোথাও জাতিবর্ণের ভেদ, পাপ-পূণ্য, ইহলোক-পরলোক এই জাতীয় কোনো কথা নেই। এসবের ভিত্তিতে খাদ্যের উপর কোনো বাধানিষেধের কথা নেই। তিনি প্রকৃত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে খাদ্যগুলির গুণ ও দোষ ব্যাখা করেছেন এবং কোন রোগে কোন খাদ্য উপযোগী বা কোন খাদ্য রোগ ব্যাতিরেকেই শরীরের কোন কাজে আসে তা নিয়ে বিস্তৃত চর্চা করেছেন। এক অর্থে মনু সংহিতা এবং চরক সংহিতা উভয়ই বৈদিক শাস্ত্র। উভয়ের সময়কালও প্রায় একই। উভয় রচনাই প্রাচীন ভারতের জ্ঞান-পদ্ধতি। এখন, আজকে এসে যারা প্রাচীন ভারতের জ্ঞান-পদ্ধতির আলোকে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবার কথ্য বলছেন তাদের কাছে আমাদের বিনীত প্রশ্ন হল, আপনারা মনু আর চরকের মধ্যে কাকে বেছে নেবেন? কাকে প্রাচীন ভারতের প্রকৃত জ্ঞানের ধারক বলে চিহ্নিত করবেন? মনুকে নাকি চরককে? দুজনকে একসাথে নিয়ে তো আর চলা যাবে না। যায় না।
এসব প্রশ্নের আরও পরিষ্কার উত্তর আমরা নিকট ভবিষ্যতেই পেয়ে যাব। কিন্তু এর উত্তর কি অন্যভাবে আমরা ইতিমধ্যেই পেয়ে যাই নি? বিজেপি/আরএসএসের ভেগান বাহিনী আর গোরক্ষা বাহিনীর দাপাদাপি আমরা ইতিমধ্যেই দেখছি না? গোটা উত্তর ভারতের সংস্কৃতিতে মনুবাদের রমরমা। অবশ্যই তথাকথিত উচ্চবর্ণীয় হিন্দুদের মধ্যে। চরকের নাম শুনেছে কয়জনা? যারাও বা শুনেছে তাদের মধ্যে পড়েছে কয়জনা? মনুর কথা যত ছলে যত মুখে প্রচারিত হয়েছে আমাদের দেশে বিজ্ঞানচেতনার তত প্রসার যদি হত তাহলে তো এই একবিংশ শতকে আর বিজ্ঞান আন্দোলনের কোনো প্রয়োজন পড়ত না। এখন আবার চলছে উলটো প্রক্রিয়া। যেটুকু বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানচেতনার বিকাশ এইদেশে হয়েছে তাকেও ধ্বংস করে আবার কট্টর মনুবাদে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে বিজেপি তথা আরএসএস।
বিজ্ঞানের প্রতি ঘৃণা অবশ্য এদের নতুন নয়। অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় দেখিয়েছেন ধর্মশাস্ত্র ও স্মৃতিশাস্ত্রের বিপরীত কথা বলার কারণে সেই প্রাচীনকালেই চিকিৎসকদের কতটা ঝুঁকির মধ্যে কাজ করতে হত (১৫)। আদি বৈদিক যুগ যতই উত্তর বৈদিক যুগে এগিয়েছে, অর্থাৎ সমাজ শ্রেণিতে শ্রেণিতে বিভক্ত হয়েছে তখন থেকেই বিজ্ঞানের কারবারি, বিশেষ করে চিকিৎসকদের প্রতি শাসকশ্রেণির বিতৃষ্ণা আমরা লক্ষ্য না করে পারি না। 'দেবতাদের চিকিৎসক' অশ্বিন ভ্রাতৃদ্বয়, যাঁরা ঋগ্বেদে অত প্রশংসিত, যজুর্বেদে এসে তাঁদের ওপরই আমরা অনেক ধরণের বিধিনিষেধ আরোপিত হতে দেখি, ফলে তাঁদের প্রায়শ্চিত্ত পর্যন্ত করতে হয়েছে। দেবীপ্রসাদ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছিলেন এই ব্যাপারে। তিনি দেখিয়েছিলেন:
"Medical practice demands of the ancient Asvins far more commitment to democratic values than can possibly be tolerated by the social norm which the priests are so anxious to validate. Bloomfield is about the only modern scholar to note this point." (১৬)
একথা প্রকৃতই সত্য। বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানচেতনার বিকাশ দাবি করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিস্তৃতি যা ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকরা কোনোদিন মানতে পারেন নি। যজুর্বেদে চিকিৎসকদের ওপর নানা ধরণের প্রায়শ্চিত্তাদির ফরমান জারি হয়েছে। মনু সংহিতায় চিকিৎসকদের কাজকে ঘৃণ্য বলা হয়েছে। চিকিৎসকরা জাত মানে না, ছোঁয়াছুঁয়ি মানে না, সবার গায়ে হাত দিয়ে চিকিৎসা করে, মানুষকে 'অখাদ্য কুখাদ্য' খেতে পরামর্শ দেয়, তাই তাঁদের একঘরে, ত্যজ্য, এবং জরিমানা দিতে বাধ্য করা হয়েছে। আর আজ এই মনুর উত্তরসূরিরাই দেশের ক্ষমতায়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ, বিজ্ঞানের বিকাশ ফ্যাসিবাদীরা মানতে পারবে না সেটাই সত্য। তাই তাদের কাছে চরকের কোনো মূল্য নেই। চরককে বিকৃত করা ছাড়া তাদের উপায়ও নেই।
(ক্রমশ:)
এই লেখার প্রথম অংশটি পড়ুন নীচে
ভারতীয় জ্ঞান পদ্ধতি প্রসঙ্গে (প্রথম ভাগ)
তথ্যসূত্র ও নোট
(১) Science and Philosophy in Ancient India/ Debiprasad Chattopadhyaya/ Aakar Books/ p 105
(২) চরক সংহিতা, সূত্রস্থানম, প্রথম অধ্যায়
(৩) "লশুনং, গৃঞ্জনঞ্চৈব পলান্ডুং কবকানি চ
অভক্ষ্যাণি দ্বিজাতীনামমেধ্যপ্রভবানি চ।।"
(মনু সংহিতা/ ৫/৫)
(৪) "ছত্রাকং বিডবরাহঞ্চ লশুনং গ্রাম্যকুক্কুটম্।
পলান্ডুং গৃঞ্জনঞ্চৈব মত্যা জগ্ধ্বা পতেদ্দিজঃ।।" (মনু সংহিতা/ ৫/১৯)
(৫) "গ্রাহী গৃঞ্জনকস্তীক্ষ্ণো বাতশ্লেষ্মার্শসাং হিতঃ।
স্বেদনেহভ্যবহার্য্যে চ যোজয়েৎ তদপিত্তিনাম্।"
(চরক সংহিতা/ সূত্রস্থানম্/ ২৭তম অধ্যায়)
(৬) "শ্লেষ্মলো মারুতঘ্নশ্চ পলান্ডুর্ন চ পিত্তহৃৎ।
আহারযোগী বল্যশ্চ গুরুর্বৃষ্যোহথ রোচনঃ।।
কৃমিকুষ্ঠকিলাসঘ্নো বাতঘ্নো গুল্মনাশনঃ।
স্নিগ্ধশ্চোষ্ণশ্চ বৃষ্যশ্চ লশুনঃ কটুকঃ গুরুঃ।।
শুষ্কানি কফবাতঘ্নান্যেতান্যেষাং ফলানি তু।
হরিতানাময়ং চৈষাং ষষ্ঠো বর্গঃ সমাপ্যতে।।"
(চরক সংহিতা/ সূত্রস্থানম্/ ২৭তম অধ্যায়)
(৭) "অসংস্কৃতান্ পশূন্ মন্ত্রৈর্নাদ্যাদ্বিপ্রঃ কদাচন।
মন্ত্রৈস্তু সংস্কৃতানদ্যাচ্ছাশ্বতং বিধিমাস্থিথঃ।।" (মনু সংহিতা/ ৫/৩৬)
(৮) "যজ্ঞায় জর্গ্ধির্মাংসস্যেত্যেষ দৈবো বিধিঃ স্মৃতঃ।
অতোহন্যথাপ্রবৃত্তিস্তু রাক্ষসো বিধিরুচ্যতে।।"
(মনু সংহিতা/ ৫/৩১)
(৯) "মৎস্যাদঃ সর্বমাংসাদস্তস্মান্মৎস্যান্ বিবর্জয়েৎ।।" (মনু সংহিতা/ ৫/১৫)
(১০) "মাং স ভক্ষয়িতামুত্র যস্য মাংসমিহাদ্ম্যহম্।
এতন্মাংসস্য মাংসত্বং প্রবদন্তি মনীষিণঃ।।"
(মনু সংহিতা/ ৫/৫৫)
(১১) "এষ্বর্থেষু পশূন্ হিংসন্ বেদতত্ত্বার্থবিদ্ দ্বিজঃ
আত্মানঞ্চ পশুঞ্চৈব গময়ত্যুত্তমাং গতিম্।।" (মনু সংহিতা/ ৫/৪২)
(১২) "শরীরবৃংহণে নান্যদাদ্যং মাংসাদ্বিশিষ্যতে।" (চরক সংহতা/ সূত্রস্থানম্/ ২৭ তম অধ্যায়)
(১৩) "স্নিগ্ধোষ্মং মধুরং বৃষ্যং মাহিষং গুরু তর্পণম্।
দার্ঢ্যং বৃহত্বমুৎসাহং স্বপ্নঞ্চ জনরত্যতি।" (ঐ)
(১৪) "গব্যং কেবলবাতেষু পীনসে বিষমজ্বরে।
শুষ্ককাসশ্রমাত্যগ্নিমাংসক্ষয়রহিতশ্চ তৎ।।" (ঐ)
(১৫) Science and Philosophy in Ancient India/ Debiprasad Chattopadhyaya/ Aakar Books
(১৬) ঐ