পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ভারতীয় জ্ঞান পদ্ধতি প্রসঙ্গে (প্রথম ভাগ)

  • 15 November, 2023
  • 6 Comment(s)
  • 1423 view(s)
  • লিখেছেন : শংকর
রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদী গৈরিক ফ্যাসিবাদীরা অবশ্য চিরকাল এমনই হয়। ইতিহাসের পাতা খুঁড়ে তারা সব থেকে প্রতিক্রিয়াশীল ভাবনাচিন্তাগুলোকেই তুলে নিয়ে আসে বর্তমানের জমিতে। আসলে এরা প্রকৃত অর্থেই অতীত প্রতিক্রিয়ারই পতাকা বয়, তারই ধারাবাহিকতাকে রক্ষা করে। তাই ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম (Indian Knowledge System) বা ভারতীয় জ্ঞান পদ্ধতির আদলে বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবার ঝাঁপিয়ে পড়েছে গোটা উচ্চশিক্ষাকে এই তথাকথিত ভারতীয় জ্ঞান পদ্ধতির ছকে গুছিয়ে তুলতে।

নয়া শিক্ষানীতি ২০২০ ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই এই কথাটা সরকারি স্তরে আজকাল খুবই শোনা যাচ্ছে কথাটা হল ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম (Indian Knowledge System) বা ভারতীয় জ্ঞান পদ্ধতি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি (UGC) প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে গোটা উচ্চশিক্ষাকে এই তথাকথিত ভারতীয় জ্ঞান পদ্ধতির ছকে গুছিয়ে তুলতে। ইতিমধ্যেই তারা প্রায় সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে নির্দেশ দিয়েছে অবিলম্বে বাছাই করা প্রফেসর/ফ্যাকাল্টিদের নামের তালিকা পাঠাতে, যাতে করে ইউজিসি তাঁদের ভারতীয় জ্ঞান পদ্ধতি আয়ত্ত্ব করার তালিম দেওয়ার কাজ শুরু করতে পারে। চলতি শিক্ষাবর্ষে তারা এক হাজার ফ্যাকাল্টিকে তালিম দেবার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়কে কম করে দুইজন ফ্যাকাল্টির নামের তালিকা পাঠানোর নির্দেশ তারা দিয়েছে। একইভাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সিলেবাসকেও ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্কুলস্তরেও নিশ্চয়ই তারা শিক্ষকদের ঐ তথাকথিত ভারতীয় জ্ঞান পদ্ধতির তালিম দেওয়ার কাজ শুরু করবে। 

 

কিন্তু কী এই ভারতীয় জ্ঞান পদ্ধতি? কোন্ কোন্ বিষয় এতে শেখানো হবে? এসবের উত্তর এখনও পর্যন্ত খুব একটা পরিষ্কার নয়। কিন্তু বিভিন্ন সূত্রে কিছু কিছু আন্দাজ আমরা পাচ্ছি। যেমন আরএসএস (RSS) -এর মুখপত্র 'দ্য অর্গানাইজার' এর একটি লেখা১ থেকে যা জানা যাচ্ছে তা মোটের ওপর এইরকম যে, ঔপনিবেশিক সময়ে ব্রিটিশরা ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়েছিল তাদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য। এই ব্যাপারে প্রধান পুরোহিত ছিলেন লর্ড ব্যারিংটন মেকলে। মেকলে প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দিক থেকে অনেকেই করেছেন। আরএসএস লিখেছে যে, মেকলে অত্যন্ত সচেতনভাবে অত্যুন্নত ভারতীয় জ্ঞান-পদ্ধতিকে অবহেলা করেছিলেন, দূষিত করেছিলেন এবং বিনষ্ট করেছিলেন। কেন করেছিলেন? আরএসএসের মত হল, ইংরেজরা জানত যে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন, শিল্প, সঙ্গীত, সাহিত্য, বিচার-ব্যবস্থা, দর্শন, স্থাপত্য, ভাষ্কর্য, যোগ, ধাতুবিদ্যা, বস্ত্রবয়ন, রসায়ন, গণিত, মহাকাশবিদ্যা, হস্তরেখাবিদ্যা, চিকিৎসা, কৃষি এবং আরও বহু বিষয়ে ভারতীয়দের জ্ঞান ও শিক্ষা অত্যন্ত সুগভীর। সুতরাং, ঐ শিক্ষাগুলিকে ধ্বংস করতে না পারলে ভারতীয়দের সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ও অধীনস্ত করে তুলতে তারা সক্ষম হবে না। পাশাপাশি, নিজেদের ঐতিহ্য সম্পর্কে হীনমন্যতাও জাগ্রত করা যাবে না। এই লক্ষ্যে মেকলে ভারতীয়দের প্রাচীন জ্ঞান-পদ্ধতিকে সচেতনভাবে ধ্বংস করতে ব্রিটিশ শিক্ষার প্রচলন করেছিলেন। 

 

তাহলে কী করতে হবে? আরএসএসের থিঙ্কট্যাঙ্ক নিদান দিয়েছে যে, প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সমস্ত স্তরে সিলেবাসকে ঢেলে সাজাতে হবে এবং ভারতীয় জ্ঞান-পদ্ধতির আলোকে পুনর্গঠিত করতে হবে। সে তো না হয় বোঝা গেল কিন্তু প্রশ্ন হল তার জন্যে নির্দিষ্টভাবে কী কী করতে হবে? এই নির্দিষ্ট কথাগুলো এখনও পর্যন্ত কেউই বলতে পারছেন না। ইউজিসি-ও এখনও পর্যন্ত বিস্তারিত গাইডলাইন দিতে পারে নি। কিন্তু তাতে করে আমাদের দুশ্চিন্তা কম হবার কোনো কারণ নেই। বরং এই অবস্থা আরও বেশি বিপজ্জনক। কারণ, ঐ সাধারণ গোল গোল কথাগুলোর আড়ালে আসন্ন দিনগুলিতে যা ইচ্ছা তাই করার পুরোদস্তুর সম্ভাবনা রয়েছে। 'অর্গানাইজার'-র কথাগুলোকে 'ও তো সরকারের কথা নয়, বা নির্দেশ নয়, ও তো দলের কথা', এই বলে উড়িয়ে দেওয়া বোকামী হবে। সেই অর্থে আরএসএস কোনো রাজনৈতিক দল নয়, দলের পেছনে কাজ করা একটি থিঙ্কট্যাঙ্ক। আর বর্তমানে আরএসএসের লোকেরাই সমস্ত সরকারি প্রশাসনের মাথায় বসে রয়েছে। সরকারি নীতি নির্ধারণ করছে তারাই। রূপায়ণও তারাই করছে। 'অর্গানাইজার' জানাচ্ছে,

 

"The National Education Policy places special emphasis on the study and teaching of the Indian knowledge system. The University Grants Commission (UGC) is taking a significant initiative to connect the new generation with the Indian knowledge system. Across all subjects and courses, from school education to higher education, chapters and topics related to the Indian knowledge system are being incorporated."২

 

অর্থাৎ, জাতীয় শিক্ষানীতি ভারতীয় জ্ঞান-পদ্ধতির চর্চা এবং এই বিষয়ে শিক্ষা দেবার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। ইউজিসি-ও ভারতীয় জ্ঞান-পদ্ধতির সাথে নতুন প্রজন্মের পরিচয় ঘটানোর কাজে তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। সমস্ত বিষয় এবং স্তরে, স্কুলশিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত ভারতীয় জ্ঞান-পদ্ধতির সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। পরিষ্কারই বোঝা যাচ্ছে যে, আজ যে এইএমস-এর মত চিকিৎসা বিজ্ঞানে সমর্পিত এবং সম্ভ্রম উদ্রেককারী প্রতিষ্ঠানও যে তথাকথিত 'দৈব ওষুধ'-এর বিভাগ খুলে বসেছে তা সরাসরি আরএসএসের নির্দেশে। আবার আইআইটি খড়গপুরের মত প্রখ্যাত ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠানও যে তাঁদের ২০২১ শিক্ষাবর্ষে ভারতীয় জ্ঞান-পদ্ধতি নিয়ে ক্যালেন্ডার প্রকাশ করে যেখানে বলা হয়েছে যে, প্রাচীন ভারতের সাতজন বৈদিক ঋষি যাদের একত্রে সপ্তর্ষি বলা হয় তারা ১২ কোটি বছর আগেই ('বৈবস্বত মন্বন্তরে') সৃষ্টিতত্ত্ব, জ্যোতির্বিদ্যা, মহাজাগতিক বিদ্যা, অঙ্ক, জ্যামিতি, আয়ুর্বেদ প্রভৃতি জ্ঞান আবিষ্কার ও সূত্রপাত করেছিলেন, এসবও লেখা হয়েছে আরএসএসেরই নির্দেশে এবং পরিচালনায়। 

 

'অর্গানাইজার'-এর লেখা থেকে আরও জানা যাচ্ছে যে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচলিত বিষয়গুলির পাশাপাশি কিছু নতুন বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত হবে। কীরকম ব্যাপারটা? 'অর্গানাইজার' লিখছে:

 

Numerous ancient knowledge traditions encompass various fields such as Yoga, Ayurveda, Architecture, Ritual Karma, Priesthood, Handicraft, Agriculture, Animal Husbandry, and Horticulture. These traditions can prove highly valuable from both an employment perspective and in revitalising India’s traditional sources of livelihood. It is essential to acknowledge that, for a populous country like India, these traditional livelihoods hold their own significance."৩

 

অর্থাৎ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এবার থেকে যোগা, আয়ুর্বেদ, পশুপালন প্রভৃতিও শেখান হবে। কোতুহলোদ্দীপক এবং হাস্যকর ব্যাপার হল দুটি বিশেষ বিষয়ের অন্তর্ভুক্তির কথা বলা, সেটা হল যাগযজ্ঞাদিকর্ম (ritual karma) এবং পুরুতগিরি। হাস্যকর মনে হলেও হাসার কোনো কারণ নেই। যে কোনো সময়ে এই বিষয়গুলি স্কুল, কলেজ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়স্তরে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এমনই আজকে বিজেপি/আরএসএস পরিচালিত শিক্ষাব্যবস্থার অবস্থা। 

 

ভারতীয় জ্ঞান-পদ্ধতির ওয়েবসাইট এবং অন্যান্য সূত্র থেকে বিভিন্ন জিনিস জানা যাচ্ছে। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল, প্রাচীন ভারতের শিল্প, সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, আইন, অর্থনীতি ইত্যাদি নিয়ে যাঁরাই কাজকর্ম করবেন তাঁদের বিশেষ সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে। তাদের ডেটাবেস রাখা হবে, ফেলোশিপ দেওয়া হবে, অর্থকরী সহায়তা করা হবে। এককথায় তাঁদের মালামাল করার ব্যবস্থা হচ্ছে। কিন্তু সব থেকে সুদূরপ্রসারী এবং উদ্বেগজনক যে বিষয়টাতে হাত দেওয়া হচ্ছে তা হল শিক্ষার সর্বস্তরে পাঠক্রমকে ভারতীয় জ্ঞান পদ্ধতির আলোকে পুনর্গঠিত করা হবে। ২০২২ সালেও আইআইটি খড়গপুর ভারতীয় জ্ঞান-পদ্ধতি নিয়ে আর একটি ক্যালেন্ডার প্রকাশ করেছিল।৪ সেখানে তাঁরা ঘোষণা করেন যে, ভারতীয় জ্ঞান-পদ্ধতিকে পুনরুদ্ধার করার জন্যেই ক্যালেন্ডারের প্রকাশ। এখন এর সাথে আইআইটি খড়গপুরের কাজের ক্ষেত্রের কী সম্পর্ক তা আমরা জানি না কিন্তু যেটা আমাদের কাছে কৌতুহলোদ্দীপক তা হল এই তথাকথিত ভারতীয় জ্ঞান-পদ্ধতির পুনরুদ্ধার বলতে তাঁরা কী ভাবছেন। সেখানে এই পুনরুদ্ধার বলতে তাঁরা মূলত তিনটি বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন। যেমন, বেদের রহস্যের স্বীকৃতি, সিন্ধুসভ্যতার নতুন করে ব্যাখ্যা এবং আর্যদের অনুপ্রবেশের গল্পকথার খন্ডন।৫

 

উপরের আলোচনা থেকে আমরা বর্তমান সরকার ভারতীয় জ্ঞান-পদ্ধতি বলতে কী বোঝাতে চাইছে এবং কীভাবে তাকে পুনরুদ্ধার করতে চাইছে এবং দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় কী ধরণের পরিবর্তন আনতে চাইছে তার একটা ভাসাভাসা আন্দাজ করতে পারি। আমাদের আশংকা যত দিন যাবে ততই এই আজগুবি এবং অবৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও ভাবনাচিন্তাকে ছাত্রছাত্রীদের মগজে প্রোথিত করার জন্যে আরও সুনির্দিষ্ট বক্তব্য ও পদক্ষেপ আমাদের সামনে আসবে। সুতরাং, এ ব্যাপারে একটা সাধারণ বোঝাবুঝি (general understanding) আমাদের তৈরি করা প্রয়োজন যাতে করে আগামী দিনে নির্দিষ্ট বিষয়গুলিকে নিয়ে আমাদের অবস্থান নির্ণয় সহজ হয় এবং জনগণের কাছে বিজেপি তথা আরএসএসের মিথ্যাচার এবং বৈজ্ঞানক ভাবনাচিন্তা ও মানসিকতাকে পুরোপুরি ধ্বংস করার ভয়ঙ্কর পরিকল্পনার স্বরূপ সঠিকভাবে তুলে ধরা যায়। 

 

তবে এই বিষয়ে ঢোকার আগে একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন, তা হল ভারতীয় জ্ঞান-পদ্ধতির নামে আরএসএস আজগুবি ধ্যানধারণা ও প্রচারের বিপরীতে আমাদের সমাজের বুদ্ধিজীবি অংশের মধ্যে, বিশেষ করে বামপন্থী ও যুক্তিবাদী অংশের মধ্যে, একটা জনপ্রিয় বক্তব্য আছে। সেটা হল প্রাচীন ভারতের বৈষয়িক ও বৈচারিক অগ্রগতি এমন কিছুই ঘটে নি। সমস্তটাই হিন্দুত্ববাদীদের বানানো কথা। পৃথিবীতে প্রকৃত অগ্রগতি, তা সে বৈষয়কই হোক আর বৈচারিকই হোক, তা ঘটেছে ইউরোপে। সুতরাং, জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই ইউরোপের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে। অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বলা দরকার যে, এই ধারণাও সমান পরিমাণে ভ্রান্ত, মিথ্যা এবং আজগুবি। একথা সত্যিই যে, এই ধারণা ঔপনিবেশিক শিক্ষার ফলাফল। কথাটা "অর্গানাজার"-এর মুখ থেকে বেরিয়েছে বলেই তা মিথ্যা হয়ে যায় না। মেকলে প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্যই ছিল এই ধরণের ধ্যানধারণা তৈরি করে ভারতীয়দের মধ্যে একদিকে হীনমন্যতা তৈরি করা অন্যদিকে বৌদ্ধকভাবে ব্রিটিশদের প্রভু হিসাবে মেনে নেওয়ানো। "অর্গানাজার" এই সঠিক কথাটা বলেছে একটি বেঠিক উপসংহারে পৌঁছনোর জন্যে। "বেদে সব আছে" এই আজগুবি ও অবৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তে আসার পটভূমিকা তৈরি করার জন্য। মনে রাখতে হবে, "অর্গানাইজার"-এর হোতারা নিজস্বার্থে মুখে এই কথা বললেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরদ্ধে কখনই লড়াই করেন নি বা সেই লড়াইকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনেও করেন নি। অন্যদিকে এই "বেদে সব আছে" জাতীয় বক্তব্যের বিপরীতের বক্তব্য যে, প্রাচীন ভারতের জ্ঞানচর্চায় তেমন উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই, এই ধারণাও বাস্তবের সঙ্গে মেলে না। তাই এই ধারণা অনৈতিহাসিক। 

 

এখন কেন্দ্রীয় সরকার ও শাসকদল ও তাদের থিঙ্কট্যাঙ্ক দ্বারা উত্থাপিত এই ভারতীয় জ্ঞান-পদ্ধতি নিয়ে বর্তমানে যেটুকু বোঝা যাচ্ছে তার ওপর ভিত্তি করে কিছু প্রশ্ন আমাদের তোলা উচিৎ এবং সার্বিকভাবে এই ভয়ঙ্কর পদক্ষেপের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করার জন্যে নাগরিক জীবনে এর ব্যাপক চর্চাও হওয়া প্রয়োজন। এবারে আমরা কিছু নির্দোষ প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করব। 

 

সৃষ্টিতত্ত্ব

 

তথাকথিত ভারতীয় জ্ঞান-পদ্ধতির প্রণেতারা জানাচ্ছেন যে, প্রাচীন ভারতে সৃষ্টিতত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন ভারতের মুনিঋষিরা। বর্তমান পৃথিবীতে এই নিয়ে যতকিছু আবিষ্কার হচ্ছে তা প্রাচীন ভারতেই আবিষ্কৃত হয়ে গেছিল। সুতরাং এবারে নিশ্চয়ই বিগব্যাং, কৃষ্ণগহ্বর, মহাবিশ্বের ক্রমপ্রসারণতা ইত্যাদি কিছুর পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের বেদের নাসাদীয় সুক্ত৬ এবং হিরণ্যগর্ভ সুক্ত৭ পড়ানো হবে। ব্যাপারটা শুনতে আজকে হাস্যকর মনে হলেও আদপে তা নয়। এই নিয়ে রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদীরা অনেকদিন ধরেই লেখালিখি করছে। হিরণ্যগর্ভ সুক্ততে বলা হয়েছে এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের আদিতে ছিল হিরণ্যগর্ভ অর্থাৎ সোনার ডিম। সেখান থেকেই সকল কিছুর উৎপত্তি হয়। 

 

"হিরণ্যগর্ভ সমবর্তনাগ্রে ভূতস্য জাতঃ.."

অর্থাৎ, সমগ্রের অগ্রে বা আদিতে ছিল হিরণ্যগর্ভ।

 

আধুনিক বিজ্ঞানের বিগব্যাং তত্ত্বানুযায়ী বলা হয় যে, আদিতে বিশ্বব্রহ্মান্ডের সকল কিছু একটি বিন্দুতে ছিল। সেখানে থেকে এক প্রবল বিস্ফোরণের পর তৈরি হয় আজকের এই মহাবিশ্ব। হিন্দুত্ববাদীরা অনেকদিন থেকেই বলে আসছে যে, এই বিগব্যাং তত্ত্ব আসলে বেদের হিরণ্যগর্ভ সুক্তের সঠিকতাই প্রমাণ করে। হিরণ্যগর্ভই হল সেই বিন্দু যার কথা এতদিন পর আজকের বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন। 

 

বেদ নিয়ে যাঁরাই সামান্য চর্চা করেছেন তাঁরাই জানেন যে, বেদের হিরণ্যগর্ভের ধারণা আর আধুনিক বিজ্ঞানের আদিবিন্দু (Singularity) মোটেই এক জিনিস নয়। আদিবিন্দু হল এমন এক বিন্দু যেখানে বিশ্বব্রহ্মান্ডের সকল পদার্থ চরম ঘনত্বে লীন ছিল। অর্থাৎ তা হল পদার্থই। অন্য কিছু নয়। কিন্তু হিরণ্যগর্ভ তা নয়। বেদে এই হিরণ্যগর্ভকেই অন্যত্র প্রজাপতি বলা হয়েছে। বেদ যত এগিয়েছে ততই একে ব্রহ্ম বলা হয়েছে। এই ব্রহ্মই হলেন জগতের সৃষ্টিকর্তা। তাই হিরণ্যগর্ভ পদার্থ নয়, তা এক মহাচেতনা। তা হল সকল আত্মার পরম রূপ। তাই তাকে পরমাত্মাও বলা হয়েছে। ব্রহ্ম বা পরমাত্মা থেকে যেহেতু এই জগত-সংসারের সৃষ্টি তাই বেদান্তের এই সৃষ্টিতত্ত্বকে ব্রহ্মবাদী বা আত্মাবাদী সৃষ্টিতত্ত্ব বলা হয়। এই আত্মাবাদী সৃষ্টিতত্ত্ব থেকেই ধীরে ধীরে ভারতীয় ভাববাদ বিকশিত হয়। বলা বাহুল্য যে, এই দার্শনিক প্রতিজ্ঞা পোষণ করত এবং প্রচার করত শাসকশ্রেণির দার্শনিকরা। এই তত্ত্ব ছিল শাসকশ্রেণির হাতিয়ার যা জনসাধারণকে শাসক ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় জোটের কাছে বশ্যতা স্বীকার করানোর কাছে বহুল ব্যবহৃত হয়েছে। 

 

অন্যদিকে ভারতীয় দর্শনের লোকাশ্রিত ধারা, বা প্রতিবাদী ধারা জগত-সংসারের সৃষ্টির বিষয়ে অন্য ধারণা পোষণ করত। এই ধারার মতে আত্মা থেকে নয়, দেহ থেকেই এই বিশ্বসংসারের উৎপত্তি। "দেহের মাঝে বৃন্দাবন!" (সহজিয়া গান)। আদিসাংখ্য, তন্ত্র এবং চার্বাকরা এই মতের সমর্থক। লৌকিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই যেহেতু এই ধরণের সৃষ্টিতত্ত্ব এসেছিল তাই এখানে সকল উৎপত্তির মূলে নরনারীর বা বিপরীত লিঙ্গের যৌনমিলনকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। সাংখ্য দর্শনে প্রকৃতি ও পুরুষকে এভাবেই বিপরীত উপাদান হিসাবে দেখানো হয়েছে যার মিলনে সকল সৃষ্টি। তন্ত্রে সাধনমার্গ হিসাবে যৌনাচার অতি পরিচিত একটি বিষয় হিসাবে আজও রয়ে গেছে। সৃষ্টতত্ত্ব হিসাবে আত্মাবাদ বনাম দেহবাদ ভারতীয় দর্শনের কসমোগনি (সৃষ্টিতত্ত্ব) বিতর্ক ভারতীয় দর্শনের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের প্রথুম যুগের অতি পরিচিত বাস্তবতা। আত্মাবাদ থেকেই যেখানে পরিপূর্ণ ভাববাদের বিকাশ হয়েছিল, দেহবাদ থেকেই বিকশিত হয়েছিল ভারতীয় বস্তুবাদের। দেহবাদ অভিযোজিত হল ভুতচতুষ্টয় তত্ত্বে। বস্তুবাদী সৃষ্টিতত্ত্ব বলতে শুরু করল চারটি মৌলিক পদার্থই হল আদি এবং সনাতন। তা শ্বাশতও বটে। এর রূপান্তর সম্ভব কিন্তু ধ্বংস সম্ভব নয়। এই চারটি মৌলিক পদার্থ হল, অগ্নি, বায়ু, জল ও মাটি। বৈদিক শিরোমণি মাধবাচার্য স্বয়ং এই তত্ত্বের কথা উল্লেখ করেছেন।৮ চার্বাকরা ছাড়াও সাংখ্য, বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি দার্শনিক ধারাও বিশ্বসংসার সৃষ্টির পেছনে কোনো সচেতন আত্মা বা পরমাত্মাকে আদিকারণ হিসাবে মানতে অস্বীকার করেছে। এঁরাও ভুতচতুষ্টয়কেই আদিতত্ত্ব বলে স্বীকার করেছে। 

 

সুতরাং, খুব স্বাভাবিকভাবেই সাংখ্য, চার্বাক, বৌদ্ধ এবং জৈন সম্প্রদায়ের মানুষরা ব্রহ্ম বা পরমাত্মার অভিযোজিত রূপ হিসাবে জগত-নির্মাতা ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন।৯ যেহেতু তাঁদের মতে জড় থেকেই চৈতন্যের উৎপত্তি সেহেতু জড়ই হল আদিকারণ। চেতনা নয়। তাই তাঁরা যে কোনো ধরণেরই চেতনকারণবাদকে অস্বীকার করেছেন। এখানে আরও কৌহলোদ্দীপক ব্যাপার এই যে, এই ঈশ্বর অস্বীকার শুধুমাত্র এই তিনটি বেদবিরোধী সম্প্রদায়ের দার্শনিকরাই করেন নি। ঘোরতর বেদপন্থী মীমাংসকরাও করেছেন। একথা যদিও বলা হয় যে, বেদ থেকে ষড়দর্শনের উৎপত্তি হয়েছে তথাপি আদতে তা সত্য নয়। সত্য হল বেদ থেকে আদতে দুটি দর্শনের উৎপত্তি হয়েছে। একটি হল পূর্ব মীমাংসা এবং অন্যটি হল উত্তর মীমাংসা। উত্তর মীমাংসাই বেদান্ত নামে পরিচিত যা প্রথম থেকেই ব্রহ্ম বা পরমাত্মাকেই জগত-সংসারের সৃষ্টিকর্তা হিসাবে বিবেচনা করেছে। পৌরানিক যুগে এসে এই মতবাদই ঈশ্বর দ্বারা জগৎ সৃষ্টির কথা বলেছে। সুতরাং, আজকের পৌরানিক হিন্দুধর্ম আসলে বেদান্তেরই ধারাবাহিকতা। অন্যদিকে পূর্ব মীমাংসা বা মীমাংসা দর্শন কট্টর বেদপন্থী হলেও তা জগৎ সৃষ্টির মূলে ঈশ্বরের হাতকে খারিজ করে দিয়েছে, এমনকি ঈশ্বরের অস্তিত্বই মানে নি।১০ এই ধারার দার্শনিকদের মতে একমাত্র কর্মই সকল কিছুর জন্মদাতা, তাই বিশ্বসংসারও কর্ম থেকেই উৎপন্ন হয়েছে।  

 

বামপন্থীদের একটা বড় অংশ এবং পশ্চিমভক্ত র‍্যাডিক্যাল নাস্তিকরা চিরকালই ভেবে এসেছেন যে, ভারতীয় দর্শন বুঝি বা কিছু আধ্যাত্মিক গাঁজাখুরি বক্তব্যের সংমিশ্রন। এখান থেকে আমাদের কিছুই নেওয়ার নেই। মেকলের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্যই ছিল মধ্যবিত্তদের চিন্তাশীল অংশটির মধ্যে এই ধরণের মনোভাব তৈরি করা এবং বলাই বাহুল্য এই লক্ষ্যে তিনি অনেকদূর সফল হয়েছিলেন। প্রকৃত অবস্থা ছিল এই যে, পৃথিবীর যেখানে যেখানে সর্বপ্রথম জড় থেকে জীবনের উদ্ভব অনুমিত হয়েছিল তার একটা হল ভারত। আত্মাবাদী বা ব্রহ্মবাদী দার্শনিকরা যখন এই বিতর্ক করেছেন যে, যদি আত্মাবাদকে অস্বীকার করা হয় তবে চেতনার উদ্ভবকে ব্যাখ্যা করা যাবে কীকরে তখন তার উত্তরে চার্বাকপন্থীরা নির্দ্বিধায় বলেছেন যে জড় থেকেই জীবনের বা চৈতনের উৎপত্তি হয়েছে। যেমন তন্ডুল ইত্যাদি খাদ্যবস্তুর বিশেষ পরিবর্তনের ফলেই মদ তথা মাদকাশক্তির উদ্ভব ঘটে, গাছপালা থেকেই ঔষধাদি গুণের উৎপত্তি হয়, তেমনি ভুতচতুষ্টয়েরই বিশেষ বিশেষ সমুদয় (পারমুটেশন এন্ড কম্বিনেশন) থেকেই জীবন তথা চৈতন্যের উৎপত্তি হয়। আবার প্রাণের বিলুপ্তির সাথে সাথে চৈতন্যেরও বিলয় ঘটে, নিত্যআত্মা বলে কিছু হয় না।১১

 

এখন, তথাকথিত ভারতীয় জ্ঞান-পদ্ধতির প্রণেতাদের কাছে আমাদের একটি প্রশ্ন আছে। আপনারা মহাবিশ্বের উৎপত্তি বিষয়ে ফিজিক্সের আধুনিক আবিষ্কারগুলির পাশাপাশি প্রাচীন ভারতীয় সৃষ্টিতত্ত্ব পড়ানোর কথা বলছেন। শুধু তাই নয়, এর আলোকে সিলেবাসকে পুনর্গঠিত করার কথা বলছেন। বেশ কথা। এখন ভারতীয় পরম্পরায় পরষ্পরবিরোধী সৃষ্টিতত্ত্বগুলির মধ্যে কোনটিকে ভারতীয় বলে ধরা হবে? ব্রহ্মবাদী তথা পরমাত্মাবাদী সৃষ্টিতত্ত্ব, নাকি নাস্তিক ভৌতবাদী সৃষ্টিতত্ত্ব? কোনটি পড়াবেন? কার আলোকে সিলেবাস পুনর্গঠিত করবেন? যদি বলেন, ব্রহ্মবাদকেই আপনারা ভারতীয় বলে স্বীকৃতি দেবেন, তাহলে বলতে হয় যে, আপনারা পক্ষপাতদুষ্ট এবং আনাড়ি। যে বক্তব্য ভারতীয় ভৌতক ও দ্বন্দ্ববাদীরা আড়াই হাজার বছর আগেই খন্ডন করে তাকে মিথ্যা প্রমাণ করেছেন তাকে ফিরিয়ে আনা আর যাই হোক পান্ডিত্যের পরিচয় নয়। আর যদি বলেন, আপনারা ভৌতিকবাদী সৃষ্টতত্ত্বই পড়াবেন তবে বলার দরকার এই যে, তা আর আলাদা করে পড়ানোর দরকার নেই, বা তার আলোকে সিলেবাস পুনর্গঠিত করার প্র‍য়োজন নেই। কারণ আধুনিক ফিজিক্সের সমস্ত অগ্রগতি প্রাচীন বস্তুবাদের ওপর দাঁড়িয়েই হয়েছে। সেই অর্থে আজকের ফিজিক্স প্রাচীন ভারতীয় বস্তুবাদী সৃষ্টিতত্ত্বেরই ধারাবাহিকতা। 

 

রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদী গৈরিক ফ্যাসিবাদীরা অবশ্য চিরকাল এমনই হয়। ইতিহাসের পাতা খুঁড়ে তারা সব থেকে প্রতিক্রিয়াশীল ভাবনাচিন্তাগুলোকেই তুলে নিয়ে আসে বর্তমানের জমিতে। আসলে এরা প্রকৃত অর্থেই অতীত প্রতিক্রিয়ারই পতাকা বয়, তারই ধারাবাহিকতাকে রক্ষা করে। ভারতীয় দার্শনিক সংঘাতের পরিণতি কী হয়েছিল? তাত্ত্বিক দার্শনিক সংঘাতে যখন আজকের আরএসএসের তৎকালীন পূর্বসূরীরা এঁটে উঠতে পারলেন না তখন বলপ্রয়োগের নিদান এল। সাতশো খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে খ্রীষ্টিয় সাতশো সাল, এই হাজার বছরের অবাধ দার্শনিক বিতর্কের পরিমন্ডল দ্রুত ঘুচে যেতে লাগল শংকরের সময়ে। শংকরই প্রথম দার্শনিক যিনি নিদান দিলেন প্রতিপক্ষের "মুখের মত অঙ্কুশ"-এর সন্ধান করতে। তার পরেকার এক হাজার বছরে বৈদান্তিকরা ছাড়া বাকী সবাই লুপ্ত হয়ে গেল। এমনকি তাঁদের পুঁথিপত্রগুলিও পাওয়া গেল না। চার্বাকদের একটা পুঁথিও পাওয়া যায়নি, যদিও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় তার অস্তিত্ব ছিল। বৌদ্ধদের অধিকাংশ পুঁথিই ভারতের বাইরে পাওয়া গিয়েছে। সাংখ্য ও মীমাংসকদের আদি পুস্তকগুলি উবে গেল। সাংখ্য, মীমাংসার নাম করে লেখা হল নতুন পুঁথি, নতুন সূত্র। জ্ঞানচর্চার ওপর এই বৈদিক তান্ডবেরই ধারাবাহিকতা বহন করে আরএসএস। আর এদের মুখেই আজ আবার নতুন করে জ্ঞান-চর্চা, জ্ঞান-পদ্ধতির কথা শোনা যাচ্ছে। হয়ত, আবার নতুন করে লিখিত হতে চলেছে পুরনো ইতিহাস। 

(ক্রমশ)

 

সূত্র ও টীকা

 

১. Impactful Initiative by UGC: Reviving the Indian Knowledge System / July 23, 2023)

২. প্রাগুক্ত

৩. প্রাগুক্ত

৪. 'ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম (IKS)' বনাম প্রাচীন ভারতের প্রকৃত জ্ঞানচর্চা:পর্ব এক: গণিত/ প্রতিভাষ্য, একটি ফ্যাসিবিরোধী স্বর।

৫. প্রাগুক্ত

৬. নাসাদীয় সুক্ত/ ঋগ্বেদ/ দশম মন্ডল/ ১২৯

৭. হিরণ্যগর্ভ সুক্ত/ ঋগ্বেদ/ দশম মন্ডল/ ১২১

৮. Sarva-Darsana-Samgraha of Madhavacharya/ E.B.Cowell & A.E.Gouch

৯. প্রখ্যাত বৌদ্ধ আচার্য নাগার্জুন তাঁর "ঈশ্বরকর্তৃকত্ব নিরাকৃতিঃ" গ্রন্থে ঈশ্বর বিশ্বাসী প্রতিপক্ষের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন যে, ঈশ্বর উৎপন্ন নাকি অনুৎপন্ন? যদি নিজে অনুৎপন্ন হন তাহলে তো অন্যকে উৎপন্ন করতে পারেন না। আর যদি পরতঃ উৎপন্ন হন তাহলে বলতে হয় ইনি সকল উৎপন্নের কারণ স্বরূপ ঈশ্বর নন। আর যদি বলো তিনি স্বতঃ উৎপন্ন তাহলে তাতে করে নিজস্বত্ত্বায় ক্রিয়াবিরোধ ঘটে। সুতরাং ঈশ্বর বলে কিছু হতে পারে না। ("কিঞ্চ অপরমপি দূষণং স্যাৎ। কিং স্বয়ম্ উৎপদ্য পরান্ করোতি, অনুৎপন্নঃ বা। অনুৎপন্নঃ চ স্বয়ং তাবৎ পরান্ কর্তুং ন শক্লোতি। কুথঃ? স্বয়ং এব অনুৎপন্নরূপত্বাৎ। যথা অনুৎপন্নস্য বন্ধাতনয়স্য কুদ্দালপাতনাদিক্রিয়া ন প্রবর্ততে। তথা ঈশ্বরস্য অপি। অথ চ স্বয়ং উৎপদ্য পরান্ করোতি। তদা কস্মাৎ উৎপন্নঃ? কিং স্বতঃ, কিং পরতঃ, উভয়তঃ বা? অত্র স্বতঃ তাবৎ ন উৎপন্নঃ। স্বাত্মনি ক্রিয়াবিরোধাৎ।") 

১০. Sad-Darsana Samuccaya (A Compendium of Six Philosophies)/ by Haribhadra/ translated by K. Satchidananda Murty.

১১. মাধবাচার্য

 
 
 
 
 
6 Comments

ashoke mukhopadhyay

15 November, 2023

ভালো লেখা।

ashoke mukhopadhyay

15 November, 2023

প্রবন্ধটা খুবই সুন্দর হয়েছে। বর্তমান সময়ে এরকম লেখার খুব দরকার আছে। সাগ্রহে পরের কিস্তির অপেক্ষায় থাকব। তবে আমার একটা ছোট আপত্তি আছে। এক জায়গায় লেখক বলেছেন: “… আমাদের সমাজের বুদ্ধিজীবি অংশের মধ্যে, বিশেষ করে বামপন্থী ও যুক্তিবাদী অংশের মধ্যে, একটা জনপ্রিয় বক্তব্য আছে। সেটা হল প্রাচীন ভারতের বৈষয়িক ও বৈচারিক অগ্রগতি এমন কিছুই ঘটে নি। সমস্তটাই হিন্দুত্ববাদীদের বানানো কথা। পৃথিবীতে প্রকৃত অগ্রগতি, তা সে বৈষয়কই হোক আর বৈচারিকই হোক, তা ঘটেছে ইউরোপে। সুতরাং, জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই ইউরোপের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে। অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বলা দরকার যে, এই ধারণাও সমান পরিমাণে ভ্রান্ত, মিথ্যা এবং আজগুবি। একথা সত্যিই যে, এই ধারণা ঔপনিবেশিক শিক্ষার ফলাফল। … মেকলে প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্যই ছিল এই ধরণের ধ্যানধারণা তৈরি করে ভারতীয়দের মধ্যে একদিকে হীনমন্যতা তৈরি করা অন্যদিকে বৌদ্ধকভাবে ব্রিটিশদের প্রভু হিসাবে মেনে নেওয়ানো।” [আরও কথা নীচে]

ashoke mukhopadhyay

16 November, 2023

আমি এই ধারণার সঙ্গে একমত নই। মেকলেকে আমরা বামপন্থীরা অনেকেই খুব শক্তিশালী মনে করি। আসলে মেকলের মিনিটস জমা পড়ার কয়েক হাজার মিনিট পরেই এর প্রভাব কার্যত হারিয়ে যায়। বিদ্যাসাগর ১৮৫৩ সালে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে একটা বড় প্রবন্ধ লেখেন এবং বেথুন সোসাইটিতে পাঠ করেন। অক্ষয় দত্ত ১৮৮২ সালে ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় নামক বইয়ের ২য় খণ্ডের উপক্রমণিকায় ভারতীয় দর্শন পুরাণ ইত্যাদি নিয়ে চমৎকার আলোচনা করেন। তারপর প্রফুল্লচন্দ্র রায় (১৯০২-০৯), ব্রজেন্দ্রনাথ শীল (১৯১৬), বিনয় সরকার প্রমুখরা প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞানের বিকাশ নিয়ে ভালো রকম চর্চা করেন। মেকলে ক্রমশ খারিজ হতে থাকেন। বাংলার বামপন্থী ও যুক্তিবাদীরা এসবের দ্বারা ভালো মতোই প্রভাবিত হন। আমাদের কালে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ও রামকৃষ্ণবাবু এসব নিয়ে ভালো করেই চর্চা করেছেন। আমরাও তাঁদের লেখাপত্র নিয়ে চর্চা করে চলেছি। [আরও কথা নীচে]

ashoke mukhopadhyay

16 November, 2023

বরং এই ব্যাপারে বামপন্থীরা যে কিছুই করে না বা করেনি – এই ধারণাও সঙ্ঘই ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে চলেছে। আর এই কাজ করে যাচ্ছে পোস্ট কলোনিয়াল বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, যারা মেকলের সাহায্যে গোটা উনিশ শতকের নবজাগরণকেই খারিজ করে দিয়ে থাকে। তাই পালটা উদাহরণ দিয়ে আমাদের এই সব ভুল প্রচারের স্বমুখ উন্মোচন করা দরকার। তা সত্ত্বেও লেখককে অর্ধ অভিনন্দন জানিয়ে রাখছি। বাকি অর্ধ জমা থাকছে বাকি অংশ পড়া পর্যন্ত।

ashoke mukhopadhyay

16 November, 2023

বরং বামপন্থীরা যে কিছুই করে না বা করেনি – এই ধারণাও সঙ্ঘই ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে চলেছে। আর এই কাজ করে যাচ্ছে পোস্ট কলোনিয়াল বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, যারা মেকলের সাহায্যে গোটা উনিশ শতকের নবজাগরণকেই খারিজ করে দিয়ে থাকে। তাই পালটা উদাহরণ দিয়ে আমাদের এই সব ভুল প্রচারের স্বমুখ উন্মোচন করা দরকার। তা সত্ত্বেও লেখককে অর্ধ অভিনন্দন জানিয়ে রাখছি। বাকি অর্ধ জমা থাকছে বাকি অংশ পড়া পর্যন্ত।

Gautam Chaudhuri

25 December, 2023

এই মন্তব্য অত্যন্ত যথাযথ মনে হলো। লেখক বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে আরএসএসের মতামতের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।

Post Comment