পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

গীতার টানে

  • 28 December, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 1023 view(s)
  • লিখেছেন : অভিজিৎ কর গুপ্ত
গীতা এক গভীর ভাবনার বই। গভীর জীবনদর্শন ও সুন্দর সংস্কৃত শ্লোক-এর মাধুর্য শিক্ষিত মনকে আকর্ষণ করবে এই তো স্বাভাবিক। পড়তে হবে, অনুধাবন করতে হবে। তবে, একে নিছক পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হিসাবে পড়ে, হয়তো সাময়িক রাজনৈতিক লাভ পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু শেষ বিচারে খুব বেশী লাভ হবে না।

আমি ভাগবত গীতা পড়ি নি। কখনো সুযোগ হলে অথবা ইচ্ছা করলে নিশ্চয়ই পড়ব। সবাই সব কিছু পড়তে পারে না, পড়ে বুঝতেও পারে না। পড়লেই তো আর হলো না। পড়ে বুঝতে হবে, অনুধাবন কর‍তে হবে, মন ঠিক করে ভাবনার গভীরে ডুব দিতে হবে। তবেই না পড়া! এইরকম একটা গভীর জীবনদর্শনের বই অথবা কোনো ভালো গল্প উপন্যাস কবিতা বা জীবনের কাহিনি পড়লে তার রেশ থেকে যায় মনে, ছাপ ফেলে যায় গভীরভাবে। তখন তা নিয়ে চিন্তা শুরু হয়, মনে হয় এই সংক্রান্ত আরো কিছু পড়ি, আরো জানি, আরেকটু বোঝার চেষ্টা করি। অভিভূত হয়ে পড়ি আমরা! তখন প্রিয়জনদের বলতে থাকি, এটা পড়ো, ওটা পড়ে দ্যাখো। তবে, ইচ্ছা না থাকলে সবাইকে জড়ো করে ঘাড় ধরে বই পড়ানোর কোনো মানেই হয় না। সেসব অন্য ব্যাপার!

 

ভাগবত গীতার পড়তে গেলে ভালো করে সংস্কৃত শিখে নিয়ে পড়লে তবেই পড়ার আসল সার্থকতা। বাংলা বা হিন্দিতে অথবা ইংরেজিতে পড়াই যায় কিন্তু, হয়ত সে হবে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর ব্যাপার! 

 

কিছুদিন আগে একটা সিনেমা নিয়ে বেশ হৈচৈ হলো। ওপেনহাইমার। সেখানে মূল চরিত্র বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমার ধ্বংসের চরম মুহুর্তে কেমন ভাগবত গীতা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছেন, ‘I am become Death, destroyers of worlds” সেসব আমরা দেখলাম। বিজ্ঞজনেরা পরে আলোচনা করেছেন - ওপি কেমন সংস্কৃত জানতেন এবং ভাগবত গীতা পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন এইসব ব্যাপার। পন্ডিত মানুষদের ব্যাপার হলো, মাথায় একবার কিছু ঢুকলে তার শেষ দেখে ছাড়েন তাঁরা। কাজেই তিনি যে সংস্কৃত শিখে নিয়ে ভাগবত গীতা আত্মস্থ করে ফেলবেন এই তো স্বাভাবিক। 

 

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু স্বনামধন্য মানুষ ভাগবত গীতা পড়েছেন, তাকে আত্মস্থ করার চেষ্টা করেছেন, তা থেকে সময় সময় উদ্ধৃতি দিয়েছেন। যেমন আমাদের দেশের মহাত্মা গান্ধী, ঋষি অরবিন্দ, স্বামী বিবেকানন্দ। তেমনি পাশ্চাত্য দেশের হারমান হেস, এলডস হাক্সলে, কার্ল জাং, নিকোলা টেসলা, জর্জ হ্যারিসন-এর মত মানুষেরা। এরকম আরো অনেক নাম পাওয়া যায়। আর একজন অসম্ভব প্রতিভাবান মানুষের কথা পড়ছিলাম, তিনিও ভাগবত গীতার টানে সংস্কৃত শিখে ফেলেছিলেন। নামকরা ফরাসী গণিতজ্ঞ আন্দ্রেঁ ভাইল (André Weil)! 

 

১৯২১ সাল। সারা পৃথিবী জুড়ে আইনস্টাইনের থিওরি অফ রিলিটিভিটি নিয়ে উত্তেজনা তখন তুঙ্গে। কারণ কয়েকবছর আগেই আর্থার এডিংটন এক্সপেরিমেন্টাল ডাটা থেকে দেখিয়ে দিয়েছেন আইন্সটাইনের জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটির ভাবনা এবং ক্যালকুলেশান কতটা অব্যর্থ। পনেরো বছরের আন্দ্রেঁ ভাইল এডিংটনের লেখা বই পড়ে বুঝে ফেলেছিলো আইনস্টাইনের জটিল অঙ্ক এবং ভাবনার বিষয়। ছুটিতে বাবা-মা কে বইটা পড়ে পড়ে বুঝিয়েও দিয়েছিল সে! এরপরের বছর স্বয়ং আইনস্টাইন আসবেন কলেজ দ্য ফ্রান্সে বক্তব্য রাখতে। সেখানে ইউরোপের তাবড় তাবড় পন্ডিত মানুষেরা যাবেন, হাই সোসাইটির লোকজনেরা যাবেন। বিখ্যাত গণিতজ্ঞ অধ্যাপক হ্যাডামার্ড তাঁর প্রিয় ছাত্র আন্দ্রেঁ কে একটা আমন্ত্রণপত্র যোগাড় করে দিলেন। পরম সৌভাগ্য তার। মুগ্ধ হয়ে আন্দ্রেঁ শুনলো আইনস্টাইনকে। হয়ত মনের ভিতর তোলপাড় হচ্ছিল তার। তরুণ এই প্রতিভা এরপর সংস্কৃত শিখতে শুরু করলেন। উদ্দেশ্য একটাই, ভাগবত গীতার শ্লোকগুলো অরিজিনাল সংস্কৃতে পডা। এর আগে অবশ্য গীতার কিছু কাব্যের অনুবাদ পড়েছিলেন তিনি। তবে, এবার একেবারে সরাসরি। অল্পদিনেই আয়ত্ত করে ফেললেন সংস্কৃত ভাষা। কাজেই ভাগবত গীতাও পড়ে ফেললেন আগাগোড়া। অবশ্য এই অসম্ভব প্রতিভাবান তরুণ গণিতজ্ঞ জার্মান ভাষা জানতেন খুব ভালো, এবং আরো অন্যান্য কিছু প্রাচীন ভাষা যেমন গ্রীক ল্যাটিন ও তাঁর জানা ছিল।

 

আন্দ্রেঁ ভাইল সারা জীবন ধরে নানান সময়ে গীতা থেকে উদ্ধৃতি দিতেন, গীতার বাণী থেকে তাঁর জীবনের আধ্যাত্মিক দিক খুঁজে পেতেন তিনি। পরে তিনি গ্রীক ইলিয়াড এবং ল্যাটিন এ লেখা বই পড়তে শুরু করেন একইরকম গভীরতা ও আগ্রহের সাথে। গুণী মানুষদের ক্ষেত্রে বোধহয় এরকমটাই হয়।

 

অঙ্কের জগতের মানুষেরা সবাই জানেন আন্দ্রেঁ ভাইল-এর নাম কিভাবে জড়িয়ে আছে বুর্বাকি ম্যাথম্যাটিকস-এর সাথে। আধুনিক গণিতের ইতিহাসে চিন্তাভাবনার বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন এই বুর্বাকি ম্যাথম্যাটিকস গ্রুপের সদস্যরা। পুরোনো সব পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুনভাবে শুরু করলেন তাঁরা। একটা জেনারেল স্ট্রাকচার, একটা নতুন রকম দর্শন তোলপাড় করে দিয়েছিলো সারা বিশ্বকে, প্রভাবিত করেছিলো অঙ্ক ছাড়াও বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব, শিল্প, সাহিত্য এবং  প্রায় সবকিছুকে। শুরুতে আন্দ্রেঁ ভাইল ছিলেন এই গ্রুপের নেতৃত্বে। সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাল এবং তার পরেও দীর্ঘকাল ধরে চলেছিলো এই বিপ্লবের রেশ। 

 

আন্দ্রেঁ ভাইল বলতেন গীতার সংস্কৃত শ্লোকের মাধুর্য তাঁকে কিভাবে আকর্ষণ করত। এই টানেই একদিন তিনি এসে পড়লেন এই দেশে! তাঁর স্বপ্নের দেশ ভারতবর্ষে। দেশটাকে ঘুরে বেড়িয়ে দেখবেন তিনি। গণিতে ডক্টরেট থিসিস জমা দিয়েই বেরিয়ে পড়তে চাইলেন। ১৯২৯ সাল। একটা সুযোগ এসে গেল। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্কের অধ্যাপকের একটা পোষ্ট খালি হলো। ইটালিয়ান এক জাহাজে করে পাড়ি দিলেন ইন্ডিয়ার উদ্দেশ্যে। আলিগড়ে পৌঁছবার আগে এদেশের অনেক শহর জনপদ ঘুরে দেখলেন, বোঝার চেষ্টা করলেন এখানকার সাধারণ মানুষদের। কালেচক্রে মাত্র ২৩ বছর বয়সে দেশের এই বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের চেয়ার প্রফেসর হয়েছিলেন তিনি। এদেশের এক গণিতজ্ঞ বিজয়রাঘবনের সাথে কাজ করেছেন একই বিভাগে, বন্ধুত্বও হয়েছিল তাঁর সাথে। প্রসঙ্গত: বিজয়রাঘবন ছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ জি এইচ হার্ডির ছাত্র। পাঠকের মনে থাকতে পারে, অধ্যাপক হার্ডির কাছেই কেমব্রিজে রামানুজান গিয়েছিলে্ন দুজনে একসাথে কাজ করার জন্য। 

 

আন্দ্রেঁ বছর দুয়েক ছিলেন এদেশে। সে অনেক কাহিনি! নিজের মতো করে ঘুরে বেরিয়েছেন কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, মাদ্রাজ দিল্লী সব জায়গায়। এদেশে এসেও বারবার গীতা পড়েছেন, বোঝার চেষ্টা করেছেন। দেখা করেছেন সেসময়ে এদেশের প্রায় সমস্ত লিডার এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাথে। মহাত্মা গান্ধীর সাথে বসে চা খেয়েছেন, তাঁর প্রার্থনা সভায় যোগ দিয়েছেন। গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করেছেন গান্ধীকেও। ভারতবর্ষের মানুষের জীবন দেখেছেন, মেলানোর চেষ্টা করেছেন। একসময় নিজের দেশ ফ্রান্সে ফিরে গেলেন তিনি। একসময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তখনকার ফরাসী সরকারের আইন অনুযায়ী সবাইকে ফ্রন্টে যোগ দেওয়া আবশ্যক ছিল। কিন্তু, পুরোদস্তুর গীতা পড়ে আর গান্ধীজীর সাথে কথা বলার পর আন্দ্রেঁ নীতিগত দিক থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। গীতার পথ অনুসরণ করে তিনি  তাঁর নিজস্ব ধর্ম (dharma) ঠিক করে ফেললেন। যুদ্ধ করা তাঁর ধর্ম নয়। অঙ্ক করা, জ্ঞান অর্জন করা বা জ্ঞানের সাধনা করাই হ’ল তাঁর ধর্ম! অবশ্য এইরকম প্রতিজ্ঞার জন্য তাঁকে বেশ বিপদেই পড়তে হয়েছিল। পাঁচ বছরের কারাদন্ড-এর সাজা হয়েছিল তাঁর। এরও পর বিশ্বযুদ্ধের দামামা যখন তুঙ্গে, হিটলারের নাৎসী বাহিনীর অত্যাচার শুরু হয়েছে, সেই সময় ইউরোপ ছেড়ে তাঁকে চলে যেতে হয়েছিল আমেরিকায়, আইনস্টাইনেরই মত। কেননা, ইহুদি লিংক ছিল তাঁর পরিবারে, বাবা ও মা দুদিকের ফ্যামিলির দিক থেকেই।

 

গীতা এক গভীর ভাবনার বই। গভীর জীবনদর্শন ও সুন্দর সংস্কৃত শ্লোক-এর মাধুর্য শিক্ষিত মনকে আকর্ষণ করবে এই তো স্বাভাবিক। পড়তে হবে, অনুধাবন করতে হবে। তবে, একে নিছক পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হিসাবে পুজোর বেদিতে তুলে রাখলে অথবা না বুঝে তা থেকে উদ্ধৃতি দিলে তা হবে এক বিষম অপচয়।

 

0 Comments

Post Comment