গুজরাট নির্বাচন ক্রমশ হয়ে উঠছে, বিদ্বেষ ছড়ানোর নির্বাচন। একদিকে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফিরিয়ে আনছেন গুজরাট গণহত্যার ‘কৃতিত্বের স্মৃতি’, বলছেন, দাঙ্গাকারীদের সেই সময়ে উচিৎ শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল; অন্যদিকে নারোদা পাটায়ার অন্যতম অপরাধী, মনোজ কুকরানির কন্যা, পায়েল কুকরানিকে প্রার্থী করার মধ্যে দিয়ে বিজেপি বুঝিয়ে দিয়েছে, তাঁদের স্বপ্নের ‘গুজরাট মডেল’ আসলে কী? পাশাপাশি তাঁদের দলের হয়ে যাঁরাই গুজরাটে প্রচারে যাচ্ছেন, তাঁরাই সেই মঞ্চকে ব্যবহার করছেন, কী করে এই নির্বাচনের প্রচারকে আরো বিদ্বেষপূর্ণ করে তোলা যায়। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছেন, যদি বিজেপি গুজরাটে না জেতে, তাহলে ‘লাভ জিহাদ’ বাড়বে, আফতাব পুনাওয়ালার মতো হত্যাকারীদের সংখ্যা বেড়ে যাবে। এখানেই শেষ নয়, বলিউডের অভিনেতা পরেশ রাওয়াল গতকাল একটি সভায় বলেছেন, যে বাঙালীরা যেহেতু মাছ খায়, তাই গ্যাসের দাম নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে খুব বেশী লাভ নেই, আসল সমস্যা, অবৈধ বাংলাদেশী এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে এবং যাঁরা মাছ খায়, তাঁদের নিয়ে।
এই বক্তব্যের প্ররিপ্রেক্ষিতে, দেশের এবং বিশ্বের নানান প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাঙালীরা একযোগে প্রতিবাদ জানান, নানান সামাজিক মাধ্যমে, যে এই বক্তব্য তো সরাসরি একটি নির্দিষ্ট ভাষাভাষী মানুষের খাদ্যাভাস নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। এই বক্তব্য তো তাঁদের যে ‘হিন্দি-হিন্দু- হিন্দুস্তানে’র মডেলকেই মান্যতা দেয়। একটাই ভাষা, হিন্দি, একটাই জাতি হিন্দু এবং তাঁদের একটাই দেশ হিন্দুস্তান, যেখানে হিন্দি ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় কেউ কথা বলবে না, হিন্দু ছাড়া অন্য কোনও ধর্মালম্বী মানুষের স্থান নেই, খাদ্যাভ্যাসও হবে একইরকম, অর্থাৎ নিরামিষ। এই নিয়ে যখন বিতর্ক শুরু হয়, তখন পরেশ রাওয়াল দেখেন যে বিষয়টা অন্য দিকে যাচ্ছে, তাই তিনি আর দেরি না করে বলেন, বিতর্কটা মাছ খাওয়া নিয়ে নয়, অবৈধ বাংলাদেশী এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের যাতে চিহ্নিত করা যায়, তাই তিনি ওই কথাগুলো বলেছেন। কিন্তু প্রাথমিক ভাবে একটা কথা এসেই যায়, বাঙালীরা কিংবা সেই অর্থে যে কোনও মানুষ মাছ খাবে, কাঁটা বেছে খাবে না শুঁটকি খাবে, তা কি ওঁরা ঠিক করতে পারে? কোনো মানুষই কী খাবে, কী পরবে, তা কি অন্য কেউ ঠিক করতে পারে?
এখানেই আবারও সেই প্রশ্নটা আসে, যা বহুদিন আগেই যেকোনো সাধারণ নাগরিকের করা দরকার ছিল, যখন ২০১৬ সালে ৮ই নভেম্বর নোটবন্দী করা হয়েছিল। অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন, এই মাছেভাতে বাঙালী নিয়ে বিতর্কে হঠাৎ নোটবন্দী কী করে আসছে? যদি খেয়াল করা যায়, যখন এই ঘোষণা হচ্ছে, তখন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এইবার ‘কালো টাকা’র বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। সমস্ত নাগরিকেরা দৌড়তে শুরু করলেন নিজেদের অর্জিত টাকা বদল করে নতুন টাকা আনতে, অথচ কেউ একবারও প্রশ্ন করলেন না, ‘কালো টাকা’ কাকে বলে? আজকে যখন বিভিন্ন বিজেপির নেতামন্ত্রী থেকে শুরু করে পরেশ রাওয়ালের মতো অভিনেতারা অবৈধ বাংলাদেশী এবং রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করার কথা বলেন তখনও কি সেই প্রশ্নটা করা উচিৎ নয়, ‘অবৈধ বাংলাদেশী’ কীভাবে চেনা সম্ভব? কী থাকলে বোঝা যাবে, যে তিনি একজন ভারতীয় নাগরিক? তাহলে ভারতীয়ত্বের পরিচয় কী করে পাওয়া সম্ভব? তাহলে কি একজন নাগরিকের কাছে, সরকারের অনুমোদন প্রাপ্ত কিছু কাগজ থাকাটাই একমাত্র মাপকাঠি? সরকারের কাছে যে তথ্য ভান্ডার আছে, সেই তথ্যে যদি কোনও ভুল থাকে, কোনও ব্যক্তি নাগরিকের যদি নামের বানানে ভুল থাকে, যদি কোনও পরিচয়পত্রের সঙ্গে সরকারী নির্দেশনামা অনুযায়ী, অন্য কোনও তথ্যের সংযুক্তিকরণের সময়ে কোনও ভুল থেকে যায়, তাহলে কি তিনি আর ভারতীয় নাগরিক নন? একজন মানুষ, যিনি এই দেশে জন্মেছেন, এই দেশের জল হাওয়ায় বেড়ে উঠেছেন, এই দেশের মাটিতে তাঁর তো শিকড় আছে, তাহলে তাঁকে কেন প্রমাণ দিতে হবে তিনি ভারতীয়? তাঁকে কেন সরকারী অফিসে হাজিরা দিয়ে প্রমাণ করতে হবে তাঁর নাগরিকত্ব? প্রত্যেক নির্বাচনে তো একজন নাগরিক ভোট দিয়ে তাঁর প্রতিনিধি নির্বাচন করে থাকেন, তাঁর কাছে তো তাঁর ভোটার পরিচয়পত্র অবধি আছে, তিনি তো সেটা দেখিয়েই তাঁর আধার করিয়েছেন, সরকার বলেছিল বলে, এখন তাহলে সেই আধারের সঙ্গে ভোটার কার্ডের সংযোগ না হলেই তিনি আর ভারতীয় নন? এই প্রশ্ন কি পরেশ রাওয়াল কিংবা বিজেপির নেতা মন্ত্রীরা যাঁরা এই কথা বলছেন, তাঁদের করা উচিৎ নয়?
আসলে এই বিষয়টা সেই বিভাজনের রাজনীতি থেকেই আসে, যা গত আট বছর ধরে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার অনুশীলন করে চলেছে। কখনো হিন্দু- মুসলমান বা কখনো বাঙালী অবাঙালী অথবা কখনো উত্তর ভারত দক্ষিণ ভারতের মধ্যে লড়িয়ে দিয়ে এই ভারতবর্ষের কিছু মানুষকে হয়তো সাময়িকভাবে ভুল বুঝিয়ে রাখা সম্ভব, কিন্তু বেশীদিন কি তা সম্ভব? নোটবন্দীর সময়ে যদি ওই প্রশ্নটা করা যেত ‘কালো টাকা’ কিভাবে চেনা সম্ভব, তাহলে আজকে সরকারের পক্ষ থেকে এই কথাগুলো বলার আগে দুবার ভাবা হতো? আসামে ১০ লক্ষ হিন্দু বাঙালী রাষ্ট্রহীন হয়েছে, তাও আমাদের হুঁশ ফেরেনি। আমরা এখনো হিন্দু- মুসলমান করে চলেছি। কিছুদিন আগে বিজেপির এক বড় মাপের নেতা, তাঁর বাড়িতে কাজ করতে আসা রাজমিস্ত্রিরা সকাল বেলা দই চিড়ে খাচ্ছেন এবং বাংলা ভাষায় কথা বলছেন দেখে একটি টুইট করেন, যে নিশ্চিত ওই মানুষেরা বাংলাদেশী মুসলমান। আসলে রাষ্ট্র চায় আমরা এই প্রশ্নগুলো নিয়ে সারাক্ষণ চর্চা করি, তাহলে মূল কিছু প্রশ্ন থেকে দৃষ্টি ঘোরানো যাবে। গতকাল ওঁরা আমাদের ভাষাকে আক্রমণ করেছে, আজ খাদ্যাভ্যাসকে, আগামীকাল আমাদের পোষাক পরিচ্ছদ নিয়ে কথা বলবে, আগামীকাল আমাদের সংস্কৃতিকে আঘাত করবে। এইটাই আসলে ফ্যাসিবাদের চিহ্ন, যা যদি প্রতিরোধ না করা যায় আজকে, আগামীদিনে সমূহ বিপদ, তা কি আমরা বুঝতে পারছি?