আমার এক পরিচিত দাদা যিনি এক ড্রাইভার সেন্টারে কাজ করেন প্রতি সপ্তাহে দু-বার করে পূর্ব কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে যান এক রুগীকে নিয়ে। ঐ হাসপাতালে গেলেই উনি টিফিন করতেন হাসপাতালের সামনের খাবারের দোকানগুলিতে। হাসপাতালের রুগীর অনেক আত্মীয়, নার্স, কর্মচারী ও ডাক্তারদের একাংশও ঐ দোকানে যেতেন। আর কিছুর জন্য না হোক সিগারেট আর চা-বিস্কুটের জন্য তো বটেই। কাল সকালে গিয়ে দাদা দেখেন যে খাবারের দোকানগুলো আর নেই। অনেক দূরে গিয়ে একটা দোকানে গিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করেন। উনি চিন্তিত হয়ে ভাবলেন, সারা কলকাতা জুড়ে যেখানেই উনি ডিউটি করেন সর্বত্রই ওর সহায় ছিল এই ফুটপাথের দোকানগুলি, এরপর কোথায় খাবেন?
খবর এখন ছড়ায় মোবাইল ফোনে দেখা ফেসবুক রিলে। ইউটিউব ভিডিও-য়। ফেসবুকে রাজনৈতিক দলগুলির পেজে গিয়েও দেখে নেওয়া যায় রাজনীতির কারবারিরা কি বলছেন। ফলে ড্রাইভার সেন্টারের গাড়ির চালক আমার পরিচিত ঐ দাদা দেখে নিয়েছেন রাজ্য জুড়ে কি চলছে। ভোটের ফল ঘোষণার পরে প্রায় আকস্মিক ভাবেই মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন বাংলার ফুটপাথ থেকে ‘বহিরাগত’ দখলদারদের উচ্ছেদের। তার পরে বুল-ডোজার এসে ভেঙে দিয়েছে সারা বাংলা জুড়ে প্রত্যেক পুরসভায় একের পর এক হকারের দোকান। তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ডালা। নেমেছে পুলিশ। কেন্দ্রীয় বাহিনী। মিডিয়ায় উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শোনা গেছে। আর, খানিক আকস্মিক ভাবেই সেই উচ্ছেদ পর্ব সাময়িক ভাবে থেমেও গেছে। যদিও বোলপুর ও অন্যান্য দু-একটি জায়গায় সেই উচ্ছেদ স্থগিত, ঘোষণার পরেও চলেছে। দাদা এই সব কিছুই জানেন। এও জানেন যে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু বলেছেন যে হিন্দুদের উচ্ছেদ করা হলেও মুসলিম বহুল এলাকায় উচ্ছেদ করা হচ্ছে না। সে কথাও খানিক বিশ্বাস ও করেন। আবার, ওঁর ভাষায় দিদি যে ‘বিহারি’দের তাড়ানোর কথা বলেছেন সেও জানেন। যদিও এটা লক্ষ্য করেছেন যে মোটেই শুধু ‘বহিরাগত’ বিহারীদের উচ্ছেদ হচ্ছে না। দোকান ভাঙছে সবার। যা ছিল উচ্ছেদের গল্প তা এই পর্বে হয়ে গিয়েছে নানান আত্ম-পরিচিতির সংঘাতের গল্প। নিজের দলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর আপাত জিহাদ। আর সেটাই কি কারণ যে এইবারে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্বর এত মৃদু? এই প্রশ্নে যাওয়ার আগে এই হকার উচ্ছেদের পক্ষের মোদ্দা যুক্তি গুলিকে খানিক যাচাই করে নেওয়া যাক।
হকার উচ্ছেদের বা নিয়ন্ত্রণের পেছনে যে যুক্তি সেটি বৈধতার যুক্তি ও নাগরিক নিয়মের যুক্তি। পথ তো পথচারীদের জন্য সেখানে কেউ জিনিষ বিক্রি করবেন কেন? কথাটা মোটেই ফেলে দেওয়ার মত নয়। সত্যিই তো পথ জোড়া ডালা নিয়ে বসলে পথিকদের হাটতে অসুবিধা হওয়ারই তো কথা। কিন্তু, যুক্তি সেখানেই আটকে থাকে না।এর পরের যুক্তি সৌন্দর্যায়নের। হকারি অসুন্দর। যেমন, মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন সুন্দর নিউ টাউনে হকারদের ঝুপড়ি দেখতে মোটে ভালো লাগে না। এই দুই যুক্তির সাথে আসলে মিলে মিশে আছে বৈধতার যুক্তি।কেন কেউ অনুমতি ছাড়া কোনও জায়গায় ডালা নিয়ে বসেই যাবেন? সেটা তো অবৈধ। বে-আইনি। আর, বৈধতার ধারনার সাথেই যুক্ত হয়ে আছে দুর্নীতির ধারণা। যেহেতু, অবৈধ জিনিষ সম্ভব হয় দুর্নীতির ফলে। তাই হকারি বিষয়টাই দুর্নীতির সাথে যুক্ত। পুলিশের বা স্থানীয় নেতারা টাকা নিয়ে হকারদের বসান সেই জন্যেই কি, এবারের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরুর কারণ হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী এই দুর্নীতির প্রশ্নকেই সামনে এনেছেন?
সেই দুর্নীতির কথায় পরে আসা যাবে। এখন আমরা কিছু নীতির প্রশ্নে আসি। আমাদের রাষ্ট্র এমন ভান করে যেন সে সবার। সে সবার জন্যই কাজ করে। নীতিও তাই সর্বজনীন। সৌন্দর্যায়ন, নাগরিক উন্নয়ন, নাগরিক পরিষেবা নগরে বসবাসকারী সবার জন্যেই। উন্নয়ন সবার। এই শিশুসুলভ ধারনা শুনতে ভালোই লাগে। কিন্তু, নগরায়ন প্রক্রিয়া দাঁড়িয়েই আছে একের প্রয়োজনকে অন্যের প্রয়োজনের থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার মধ্যে। একটা উদাহরণ দেখে নেওয়া যাক। পরিবহন। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে খুব অল্প সংখ্যক মানুষেরই নিজের গাড়ি আছে। কিন্তু, আমাদের কলকাতা শহরে নাগরিক বাজেটের সিংহভাগই খরচ হয় এই অল্প সংখ্যক মানুষের গাড়ির জন্য উপযোগী পথ ও উড়ালপুল বানাতে। শহরের দৈনন্দিন জীবনের এক বড়ো অংশ যান জট। আর তার ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকা। এমন লোকেরাও দাঁড়িয়ে থাকেন যাদের গাড়ি নেই। কিন্তু, এই সব কিছু সত্বেও ব্যক্তিগত গাড়ি সমস্যা নয়। সম্পদ। কারণ, শুধু যে বা যাঁরা গাড়ি চড়েন তারাই গুরুত্বপূর্ণ শুধু নয় যাঁরা গাড়ি বানান তারাও গুরুত্বপূর্ণ। আবার শুধু তাঁরাও গুরুত্বপূর্ণ নয়। যাঁরা রাস্তা ও উড়ালপুল বানান তাঁরাও গুরুত্বপূর্ণ। যঁরা তার কাঁচামাল সরবরাহ তাঁরাও হয়ে ওঠেন গুরুত্বপূর্ণ। উলটো দিকে দেখুন সাধারণ মানুষের চলার জিনিষ সাইকেলের জন্য রাস্তা তো তৈরি হয়ই না। শহরের অর্ধেক রাস্তায় সেই মানুষটির যাতায়াতই বন্ধ। কারণ, তাঁরা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নন। সব মানুষ নয় সমান। আসলে সব সমস্যাও সমান নয়। তাই হকার ‘সমস্যা’। বড় রাস্তায় সাইকেল ‘সমস্যা’। কিন্তু, ব্যক্তিগত গাড়ি সমস্যার নয়। যদি সবার জন্য কম দামের ও খুব ভালো মানের গণ-পরিবহন বানানো যেত। যদি এমন ভাবে নগরের ধারনাকে কল্পনা করা যেত যেখানে পড়াশোনা, কাজ, হাসপাতাল, হাট-বাজার ইত্যাদি সবই হাঁটা বা সাইকেল দূরত্বে থাকত তাহলে কত সমস্যা থেকেই না আমরা মুক্তি পেতাম। কিন্তু, সত্য কাজে কেউ নয় রাজী। কেন রাজি নয় সেটা বোঝার জন্য যদিও খুব বুদ্ধিমান হতে হয় না।
যে কথা পরিবহনের কথা দিয়ে খানিক বোঝা যায় সেই একই কথা আবাসন, নিকাশি, জন স্বাস্থ্য ও পুর-পরিষেবা নিয়েও বলা যায়। দেখানো যায় আমাদের শহরগুলির সম্পদের ও নগর-পরিকল্পনার ঝোঁক কোন দিকে। সেই ঝোঁকের ফলে কী ধরণের সমস্যা হয়। আর তা সত্বেও সেগুলিকে সমস্যা বলে না ধরে আরো আর বাজেট বরাদ্দ করা হয় সেই খাতেই। সৌন্দর্যের কথাই ধরুন না। যে নিউ টাউনের সৌন্দর্যের কথা মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন সেই নিউ টাউনের পাশেই আছে আরেক পরিকল্পিত নগর ‘বিধান নগর’। আর, লাখ লাখ কৃষক ও জেলের রুটি রুজি ও জমি কেড়ে নিয়ে গড়ে উঠেছে এই সুন্দর দুই উপনগরী। অনেক মধ্যবিত্ত মানুষ মাথা গোজার জায়গা পেয়েছেন। সুন্দর দেখতে দুই পরিকল্পিত নগরী। কিন্তু, এর ফলে মরে গেছে কত লক্ষ গাছ। হারিয়ে গেছে পাখি পশু মাছ মানুষ নিয়ে তৈরি এক বাস্তুতন্ত্র। শুধু কি তাই! কলকাতার বর্ষার জল বেরোবার পথ গেছে চিরতরে বন্ধ হয়ে। প্ল্যানড টাউনশিপের স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই সরকার বুজিয়ে দিয়েছে এই সব অঞ্চলের অসংখ্য ভেড়ি, পুকুর, ঝিল, জলাজমি। কেটে ফেলেছে সব গাছ, এক চিলতে মাটি রাখেনি, গরম কংক্রিট ঢেলে দিয়েছে মাটির ওপর। একগাদা ফ্লেক্স লাগালেই পূর্ব কলকাতা জলাভূমির প্রতি দায়দায়িত্ব মিটে যায় না। বর্ষাকালে জল জমা, হাঁসফাঁস গরম, এক চিলতে ছায়া নেই কোত্থাও। এই তাহলে সৌন্দর্যায়ন। কেউ বলবেন এই তো উন্নতি। এই ইতিহাসের গতি। যো হুজুর জনাব। মেনে নিলাম। কিন্তু, আপনিও মেনে নিন, সবার জন্য উন্নয়ন হয় না। শহুরে সব উন্নয়নই কিছু সমস্যা তৈরি করে কিছু মানুষের জন্য। আবার তা কিছু মানুষের কাজে লাগে। কোনটা আপনার কাছে সমস্যা আর কোনটা উন্নয়ন ও প্রগতি সেটা ঠিক হয় নগরায়ন নামক এই অদ্ভুত ঢেঁকি খেলায় আপনি কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন তার ওপরে।
সে সব না হয় থাক। একটু অন্য কথায় আসা যাক। হকারের ফলে পথ চলতি মানুষের সমস্যা হয়। সমস্যা তো বুঝলাম কিন্তু আমাদের দেশের সিংহভাগ মানুষের কাছে যদি সেই সমস্যাটাই সব থেকে বড়ো হয়ে উঠত তাহলে হকাররা করে কম্মে খেতেন কি? প্রবন্ধের শুরুতে যে গাড়ি চালকের কথা বলেছিলাম যিনি প্রতিদিনের খাওয়ার জন্য নির্ভর করেন রাস্তার স্টলের খাবারের ওপর। তেমনি শুধু খাবার নয় ওঁর মতো শহরের সিংহভাগ মানুষের প্রয়োজনের পোশাক- জুতো থেকে আলপিনের জোগান দিচ্ছেন এই হকাররা। ফলে এই সমস্যাকে মেনে নিতেও তারা শেখেন। আবার, যেহেতু সমাজের মাথাদের ভাবনা নীচেও নামে। কখনও মানেন ও না। কিন্তু, যারা ওদের থেকে প্রতিদিনের জিনিষ কেনেন না তারা শুধুই পথ চলার সমস্যাই দেখবেন। কিন্তু হকার-কারিগর-ছোট ব্যবসায়ী কেন্দ্রিক যে এক বিপুল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের শহরের সিংহভাগ নাগরিকদের জীবন সেই উপযোগিতাকে না বুঝলে বোঝা যাবে না কেন হকারের সংখ্যা বাড়ছে। কেন কোনও দোকান ঘরের টাকা না দিয়ে, অনেক ক্ষেত্রে কোনও কর্মচারী না রেখে শুধু পরিশ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই ব্যবসায়ী শ্রেণি, সিংহভাগ মানুষের প্রয়োজনের জোগান দিচ্ছেন। আর, সব ব্যবসারই যেমন থাকে কিছু নিয়ম কিছু ভালো বা মন্দ দিক। তেমনই হকার অর্থনীতি বিক্রির জন্য খুঁজে নেবে এমন জায়গা যেখানে মানুষ বেশি থাকে। আর বেশি যাতায়াতের জায়গা খুঁজে নেবে বলেই সে সমাজের কিছু অংশের মানুষের চক্ষুশূলও হবে। সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত ও হবে।
রাজনীতিবিদদের হয়েছে ঝামেলা। একদিকে এই বিপুল বিশাল হকার-কারিগর-ছোট ব্যবসায়ীদের ওপর ভোটের জন্য নির্ভর ও করতে হয়। আবার বড়ো পুঁজি কেন্দ্রিক নগর পরিকল্পনার চোখে এরা সমস্যার। সমস্যার ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক বা এই জাতীয় ঋণ দানকারী সংস্থার চোখেও। শ্যাম রাখি না কুল রাখি দশায় গিয়ে এরা বলেন পুনর্বাসনের কথা। বলেন নিয়ন্ত্রণের কথা বা বলেন একটা কাট-অফ ইয়ারের কথা। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী যেমন ঘোষণা করেছেন ২০১৫ সালের পরের হকারদের হটিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু হকার-কারিগর-ছোট ব্যবসায়ী কেন্দ্রিক অর্থনীতিকে একটা বছরে বেঁধে ফেলা কী যায়?
আমরা জানি পুঁজিবাদী সমাজে আর্থিক বৃদ্ধিকে আটকে রাখা যায় না। আটকালে পুরো ব্যবস্থাটা থমকে যাবে। আসলে বড়ো পুঁজির অর্থনীতির মত হকার নির্ভর অর্থনীতি একটা বিকল্প ও সমান্তরাল অর্থনীতি। যেমন পুঁজিবাদী অর্থনীতির বৃদ্ধি হয়। হকার - কারিগর - ছোট উৎপাদক - ছোট ব্যবসায়ীর অর্থনীতিরও বৃদ্ধি হয়। তাকে একটা বছরে আটকে রাখব এমন হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই এই দুই অর্থনীতির উপভোক্তা ও উৎপাদক আলাদা নয়। অর্থাৎ, যিনি মেটিয়াবুরুজে জামা তৈরি করেন, আর সেই জামা যিনি গড়িয়াহাটে বেচেন এবং বেচার ফাঁকে রাস্তার দোকান থেকে ভাত মাছ খান। তিনি উৎপাদক ও ভোক্তা দুইই। এর মানে এই নয় যে উনি বড়ো পুঁজির ভোক্তা কখনও নন। কিন্তু, উনি এক ভিন্ন অর্থনৈতিক বাস্তুতন্ত্রে বাস করেন। যে জগতের সৌন্দর্যায়ন, পরিবহন, পরিষেবা নিয়ে বড় পুঁজির টাকায় চলা সরকার ততটাই ভাবে যতটা তার ভোট পেতে কাজে লাগে, যতটা তার বড় পুঁজির মালিকদের ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখতে কাজে লাগে।
তা তো নয় হল। কিন্তু, অনেকের মতো আমার কাছেও প্রশ্ন তৃণমূল সরকার হঠাৎ করে শহরের যে মানুষদের ভোটের ওপর নির্ভর করতেন তাঁদের ওপরেই খড়গহস্ত হলেন কেন? খোলা চোখে দেখা যায় যে বিগত লোকসভা নির্বাচনে শহরগুলিতে খারাপ ফলের পরেই এই ভোল বদল। এই ধারণা থেকে যে নাগরিক পরিষেবা না পাওয়ার জন্যই এক বিপুল সংখ্যক মধ্যবিত্ত মানুষ তার দলের থেকে মুখ ফিরিয়েছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে তার দলের নানান স্তরে বিপুল দুর্নীতি। দুর্নীতির কথা যে সত্য তা সবাই হাড়ে হাড়ে জানে। রাস্তার যে কোনও দোকানদার বা হকারকে জিজ্ঞেস করলেই যে কেউ জানতে পারবে কত টাকা পুলিশ বা শাসক দলের ভাণ্ডারে যায়। কিন্তু, এ তো বাহ্য। মুখ্যমন্ত্রীর হকার উচ্ছেদকে বহিরাগত উচ্ছেদের সাথে এক করে ফেলা তৃণমূলের রাজনীতির এক নতুন বাঁক বদলকেও মনে হয় চিহ্নিত করছে। শহুরে মধ্যবিত্তর মন জুগিয়ে চলা তৃণমূলের মূল ভোট ব্যাঙ্কে ধস নামাবে কি না, তা সময়ই বলবে, কিন্তু, অন্য কথায় আসা যাক। আর সেটাই এ লেখার শেষ কথা।
কেন এবার বাংলা ব্যাপী এই উচ্ছেদ অভিযানের পরেও কোনও উচ্চকিত স্বর নেই? প্রতিবাদ নেই? অনেকেরই মনে পড়েছে ১৯৯৬ সালের ‘অপারেশন সানসাইন’-এর কথা। মনে পড়েছে কিভাবে সেই সময় কলকাতার সিংহভাগ হকার তাঁদের পুরনো ইউনিয়ন ছেড়ে নাম লিখিয়েছিলেন নতুন গড়ে ওঠা মঞ্চে। কীভাবে মমতা ব্যানার্জী সেই আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। সেই উত্তাল আন্দোলনের দিনগুলি। কিন্তু, এবারের উচ্ছেদ যেন কোনও তরঙ্গই তৈরি করল না।
এর পেছনের একটা কারণ অবশ্যই রাজনৈতিক বিরোধীদের এই সমস্যাকে গুরুত্বপূর্ণ না ভাবা। ভাজপা তার চরিত্রের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ভাবেই এই উচ্ছেদকে একটি সাম্প্রদায়িক রঙ দিতে চেয়েছেন। পরিচিত ‘বাম’ দলটির প্রায় নির্বাক ভূমিকা দেখে মনে হয় নব-উদারবাদী উন্নয়ন ধারনা থেকে তারা বেরোতে পারেন নি। অন্যদিকে যে বামপন্থীরা নোনা ডাঙ্গা থেকে শুরু করে এই আমল ও আগের আমলে শহুরে গরীবের প্রতিটি লড়াই-এ পাশে থাকতে অভ্যস্ত তারাও যেন এবার শান্ত। হয়তো আরো বেশি নিপীড়নের জন্যেই সবাই অপেক্ষা করে আছে! তার কারণ কি ভাজপার আগ্রাসনের পরিবেশে এক ধরনের স্থিতি জাঢ্য? না কি এই আন্দোলন না হওয়ার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর এক পা আগে ও দু পা পিছিয়ে যাওয়ার রণ-কৌশল? যেখানে নিজের দল ও পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভকে বিরোধীদের আগেই প্রকাশ করে দিচ্ছেন তিনি। যেখানে বে-আইনি নির্মাণ ও আরো নানান দুর্নীতির সাথে হকার উচ্ছেদকে মিলিয়ে দিচ্ছেন সুকৌশলে যাতে হকার-উচ্ছেদের মূল প্রশ্নটি পেছনে চলে যায়? এই সব প্রশ্নের উত্তর সময় দেবে। কিন্তু, এই উচ্ছেদের বিরুদ্ধে নীরবতা শহুরে গরীবের খেঁড়োর খাতায় লিপিবদ্ধ রয়ে গেল।
উপসংহারের পরিবর্তে - তা হলে কি হকারদের আর পথচারীদের দ্বন্দ্বের নিরসনের কোনও দরকারই নেই? অবশ্যই আছে। কিন্তু, তার জন্যই তো টাউন ভেন্ডিং কমিটি অনেক আন্দোলনের ফলে হকাররা আদায় করেছিলেন। দরকার ছিল আলোচনার। স্বনিয়ন্ত্রনের। যে রিভিউ ধ্বংসযজ্ঞের পরে করার কথা হয়েছে সেই রিভিউ এই ধ্বংসযজ্ঞের আগেই করার দরকার ছিল। আর সবার থেকে দরকার ছিল শোনার। মতামত নেওয়ার। নিজের দলের লাভক্ষতির অঙ্কে এতগুলো মানুষের জীবন নিয়ে ছেলে খেলা করার দাম সম্ভবতঃ ওঁকে দিতে হবে। নিজের উচ্চকিত স্বরকেই একমাত্র বিশ্বাস করলে কি হয় তা এর আগে যিনি ‘ডু ইট নাও’-এর বার্তা দিয়েছিলেন তিনি ভালোই জানেন।