কয়েক বছর আগেও আমাদের কাছে সমাজ মানে পাশের বাড়ি, বন্ধু অথবা পাড়া ছিল।এখন সেই সংজ্ঞা বদলে গিয়েছে। লাইক, শেয়ার, কমেন্ট, টুইট করে আপনি এখন পৌঁছে যেতে পারেন এক বৃহৎ সমাজের কাছে। সেখানে মানুষের মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করার এক তীব্র তাগিদ লক্ষ করা যায়। মানুষকে এই মাধ্যম কিছুক্ষণের জন্য হলেও মুহূর্তে বিখ্যাত করে দিতে পারে। ফলে, দৈনন্দিন আমরা নিজেদের জীবন যাপনের বহু ব্যাক্তিগত খুঁটিনাটি ভাগ করে নিই চেনা-অচেনা মানুষের সঙ্গে। আমাদের এই প্রবণতা মহামারির অন্তরীণ অবস্থায় আরো বেশি প্রকট ভাবে দেখা দিয়েছে।সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠার আরেকটি বিশেষ কারণ হল, এই মাধ্যম আজ রাজনীতি এবং সংবাদমাধ্যমের পরিপূরক হয়ে উঠেছে।
১৪ অগাস্ট ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের একটি সংবাদে প্রকাশিত হয় যে, ভারতবর্ষের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কোনও কোনও ব্যক্তি ঘৃণা, বিদ্বেষের রাজনীতি ছড়াতে ফেসবুক ব্যবহার করছেন। ফলে খুব দ্রুত মানুষের মনে সন্ত্রাস,ধর্মান্ধতা, হয়রানি, নিগ্রহ ছড়িয়েছে। এইভাবে দৈনন্দিন উচ্চ স্তরের নেতারাও সোশ্যাল মিডিয়াকে ভয়ংকর ভাবে ধর্মান্ধতা ছড়ানোর কাজে ব্যবহার করে চলেছেন তার ফলে সমাজে সংখ্যালঘু নিগ্রহ বাড়ছে।
আঁখি দাস ভারতের ফেসবুক পাবলিক পলিসি এক্সিকিউটিভ। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় টি.জে রাজা সিং এর একটি পেজ সরিয়ে নিতে প্রত্যাখ্যান করেন। টি.জে রাজা সিং ভারতীয় জনতা পার্টির সদস্য। তিনি রোহিঙ্গা মুসলিম পরিযায়ীদের গুলি করে মারতে চেয়েছেন, মুসলিমদের বিশ্বাসঘাতক বলে তাঁদের মসজিদ ধ্বংস করার হুমকি দিয়েছেন। আঁখি দাস স্পষ্ট জানিয়েছেন ''শাসক দলের কোনো রাজনীতিবিদকে ফেসববুক আইন উল্লঙ্ঘনজনিত শাস্তি দিতে গেলে, ভারতবর্ষে ফেসবুকের ব্যবসায়িক সম্ভবনার ক্ষতি হতে পারে।''
অধিকাংশ ফেসবুক ইউজাররা এই বিষয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। ২০১৪ সালে সোশ্যাল মিডিয়ার ভুয়ো খবর এবং প্রচারের মাধ্যমে ভারতবর্ষের ২০০ কোটি মুসলিমদের আক্রমণ করে জয়ী হন আজকের এই শাসক দল। বি জে পি এবং তাঁর নেতাদের ফেসবুক পেজে কপিল মিশ্র ধারাবাহিক ভাবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়েছেন। তারপর এই ঘৃণা পরিণত হয়েছে হিংস্রতায়। যেমন দিল্লির মুসলিমদের আক্রমণ।বিগত কয়েক দশক ভারতবর্ষের রাজধানী এমন সাম্প্রদায়িক হিংসা প্রত্যক্ষ করেনি।
ইন্সটাগ্রামে ৩৪ লক্ষ ফলোয়ার নিয়ে @HindustaniBhau নামে একটি আকাউন্ট তৈরি হয় ।ইদানীং এই পেজে একটি ভিডিওতে দেখানো হয় যে, যাঁরা হিন্দু ধর্ম বিশ্বাসের বিরুদ্ধাচারণ করবে তাঁদের উচিত শিক্ষা দেওয়া হবে।কয়েকদিন বাদে এর তীব্র সমালোচনা এবং প্রতিবাদের পর ইন্সটাগ্রামের ওই অ্যাকাউন্ট সাসপেন্ড করা হয়। ঠিক এই একই ভাবে দৈনন্দিন হাজার হাজার আকাউন্ট জন্ম নিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
সংসদের তথ্যপ্রযুক্তি কমিটির প্রধান শশী থারুর ফেসবুকের কর্তাদের তলব করায় বিজেপির একাধিক সাংসদ যে ভঙ্গিতে আপত্তি জানিয়েছেন,তাতে সংশয় হয়, তাঁরা এই অভিযোগের গুরুত্ব বুঝতে আদৌ সক্ষম কিনা !
সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে অন্যান্য সমাজমাধ্যমের একটা প্রধান ফারাক রয়েছে।ফেসবুকে কে কী লিখছেন, তার সম্পাদকীয় দায় ফেসবুক কর্তৃপক্ষের উপর বর্তায় না। প্রথাগত সমাজমাধ্যমকে প্রকাশিত লেখার দায়িত্ব নিতে হয়। তাঁদের যেখানে আইনের কাছে একটা দায়বদ্ধতা থেকে যায়, সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের দায় শুধু স্বঘোষিত নীতির কাছে। সে ক্ষেত্রে সামাজিক স্তরে সোশ্যাল মিডিয়ার স্বপ্রবৃত্ত নিরপেক্ষতার দায় থাকে। অন্তত প্রত্যেক নাগরিকের বাক্স্বাধীনতার স্বার্থে।
এইভাবে দিনের পর দিন শাসক দলের পক্ষে মতামত প্রকাশ করতে করতে,মানুষ আইনের বিরুদ্ধাচারণ করায় অভ্যস্ত হয়ে যাবে না তো ? আমরা কী আরেকটু সংবেদনশীলভাবে মাধ্যমটিকে ব্যবহার করতে পারি না?
নিজের পোস্ট, বিশেষ করে সমাজ-রাজনীতি-ধর্মের মতো সংবেদনশীল বিষয়ে করা কোনো মন্তব্যের ব্যাকগ্রাউন্ড ইনফরমেশান জেনে তবে পোস্ট করুন।দিল্লির ভয়াবহ দাঙ্গার সূত্রপাত একটি হোয়াটস্যাপ চ্যাট গ্রুপ থেকে হয়। যদি কোনো মতবাদ, কোনও রাজনৈতিক অথবা ধর্মীয় মতাদর্শ আপনি মানেন, তা আপনার ব্যাক্তিক বিষয়। কিন্তু তা নিয়ে পোস্ট করা টুইট করার ক্ষেত্রে আমাদের অনেক বেশি দায়িত্ববান হতে হবে।
কম্বোডিয়ার এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী লুয়ান সোভাথ প্রায়ই স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য পোস্ট করতেন ফেসবুকে। কয়েকদিনের মধ্যে ওই সন্ন্যাসীকে দেশ ত্যাগ করে চলে যেতে হয়। কারণ, তাঁর নামে ফেসবুক পাতায় একটি ভুয়ো ভিডিও ছড়ানো হয় যা দেখে মনে হবে যে,এই সন্ন্যাসী মা এবং তিন বোনের সঙ্গে যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হয়েছেন। মানহানি এবং গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে সন্ন্যাসী লুয়ান দেশ ত্যাগ করেন।
ডিউক ইউনিভার্সিটির টম ট্রাসকট এবং জিম এলিস মিলে তৈরি করেছিলেন ইউজনেট। ইউজনেট ছিল এমন একটি ডিসকাশন মাধ্যম যেখানে ইউজাররা পাবলিক মেসেজ পোস্ট করতে পারেন। এইভাবে পরবর্তীকালে বিশ্বজুড়ে হাইস্পিড ইন্টারনেট থেকে উৎপত্তি হয় এই ফেসবুকের (২০০৪) - এর মতো সোশ্যাল মিডিয়া।
প্রথাগত সংবাদপত্রের তুলনায় অনেক বেশি জনমত গড়ে তলা সম্ভব সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্যে।তার একটি বড় কারণ হল মাধ্যমটি ইন্টেরাক্টিভ। এর মধ্যে অডিও,ভিসুয়াল, প্রিন্ট,এমনকী লাইভ স্ট্রিমিং এর মতো এতগুলো প্ল্যাটফর্ম রয়েছে!
আত্মবিস্মৃতির কবলে পড়ে নিজেকে সেলেব্রিটি প্রমাণ করার তাগিদে যা-ইচ্ছে-তাই লেখা, যেমন-খুশি-তেমন ছবি অথবা ভিডিও পোস্ট করার প্রবণতা কম বেশি আমাদের সকলের মনের মধ্যে ভিড় করেছে। এবং এইভাবেই ক্রমাগত সোশ্যাল মিডিয়া আজ আমদের দিন যাপনের খেলাঘর হয়ে উঠছে।
তবে এই মাধ্যম ব্যবহার করা আমরা কেউই ছাড়ব না! এর প্রভাব আমাদের মনে,মস্তিকে গাঢ় দাগ কেটে দিয়েছে। সমাধান তাহলে কী? এই মাধ্যমে আপনি কতটা নিমজ্জিত হবেন, কতটা সময় ব্যয় করবেন, সেটা সম্পূর্ণ আপনার নিজের বিবেচনা।নিজেরই তো মন! আমাদের নিজের মনের ওপর এইটুকু দখল নিশ্চয়ই আছে।
ফেসবুকের পাতায় যা-আপনার,তা শেয়ার করে,সব হেলায়ফেলায় ছড়াছড়ি যাচ্ছে না তো ? আমাদের পুরনো দিনগুলো এমন ছিল না। সেই সময় হাসতে গেলে আলাদা করে হোয়াটস্যাপ জোকস লাগতো কী ? তখন তো মাটির ঢেলা দিয়েই ঘর গড়েছি।বালি দিয়ে পাহাড়। আবার সেই বালি কেটে জল ঢালতেই অমনি মনের খরস্রোতা নদী বয়ে গেছে।সে-ই তো সেরা খেলা! মনে পড়ে? আর এই নতুন খেলার যে জন, যা-আপনার বলে কিছুই নয়, যা পুরোটাই পাবলিক, সে আপনার মন্দ-ভালর ভাঙা জীবন জোড়া দেবে কিসের মন্তরে?