এই সহস্রাব্দের গোড়ার দিকে পশ্চিমবঙ্গের শহর মফস্বলে সন্ধের দিকে ছোট ছোট দোকানগুলোর সামনে ভিড় দেখা যেত। লোটো অনলাইন লটারির সেদিনের ফল বেরোবে। আট, নয় কি দশ অঙ্কের সংখ্যা মিলে গেলেই স্বর্গের দরজা খুলে যাবে। টেনেটুনে সংসার চালানো মুদি হয়ে যেতে পারেন লক্ষপতি, এমনকি কোটিপতি। খবরের কাগজে মাঝে মধ্যেই তেমন খবর পড়াও যেত। রিকশাচালক পঞ্চাশ লক্ষ টাকা জিতেছেন বা বেকার যুবকের ভাগ্যে দশ লক্ষের শিকে ছিঁড়েছে --- এমন ঘটনা পড়ে আরো কিছু মানুষ ছুটতেন নিকটস্থ লোটো কাউন্টারের সন্ধানে। কিন্তু যত দিন গেছে, দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে দশ অঙ্কের সংখ্যার শেষটা না মেলায় আশাহত মানুষের সংখ্যা। এবার জিততে পারিনি, পরেরবার জিতবই --- এমন আশায় তিলে তিলে কপর্দকশূন্য হয়ে যাওয়া মানুষের ছবি ক্রমশ উঠে এসেছে কাগজের প্রথম পাতায়। তারপর, আর সব হুজুগের মত, লোটো উন্মাদনাও থিতিয়ে পড়েছে। আরো আগে, ১৯৮০ বা ৯০ এর দশকে কাগজের দ্বিতীয় পাতা প্রায়শই ভরে থাকত নানা রাজ্যের লটারির বিজ্ঞাপন আর ফলাফলে। সরকারী এবং বেসরকারী --- দুরকমই। সিকিম রাজ্য লটারির বিশেষ জনপ্রিয়তা ছিল। মার্কসবাদী সরকারের লটারি করানো উচিৎ কিনা, সে বিতর্কও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য লটারি নিয়ে হয়েছে সেইসময়।
পৃথিবী বদলে গেছে, যা দেখি নতুন লাগে। এখন পঞ্চাশ লক্ষ বা এক কোটি তেমন বড় অঙ্ক নয় অনেকের কাছেই। আগে উচিৎ অনুচিৎ, সাদা টাকা কালো টাকা নিয়ে নানারকম দ্বন্দ্ব ছিল। এখন তুমি আমি একই নেই দুজনে যা ছিলাম আগে। এখন ধনী হলে তবেই কল্কে পাওয়া যায়, অতএব কী উপায়ে ধনী হলাম সেটা বড় কথা নয়। লোটোয় লুটোপুটি খেয়ে যখন আত্মহত্যা শুরু হয়েছিল, প্রশ্ন উঠেছিল সরকার কী করছে? এসব আটকানো সরকারের দায়িত্ব নয়? এখন আর সেসব প্রশ্ন ওঠে না। যে দেশে জুয়া খেলা বেআইনি, সে দেশের বিখ্যাত মানুষরা প্রকাশ্যেই বিভিন্ন ফ্যান্টাসি লিগ, গেমিং অ্যাপের বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। দেশের জনপ্রিয়তম ক্রিকেট লিগের টাইটেল স্পনসর হয়েছে একটি ফ্যান্টাসি লিগ। বিজ্ঞাপনে তারকা ক্রিকেটাররা বিভিন্ন পেশার, বিভিন্ন বয়সের মানুষকে বলছেন “আপনি যেটা করছেন সেটা আমাকে করতে দিন, আপনি ফ্যান্টাসি টিম বানান।” মেলাতে পারলেই টাকা।
আবার ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি, বাংলার গৌরব সৌরভ, অন্য একটি ফ্যান্টাসি লিগের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। তিনিও হাসিমুখে আহ্বান জানাচ্ছেন। তাঁর পূর্বানুমানের সাথে আপনার অনুমান মেলাতে পারলেই কেল্লা ফতে। কোটি কোটি টাকা ভাসছে অন্তর্জালে। আপনার হাতের মোবাইলটিই উৎকৃষ্ট ছিপ। ফেলুন আর টাকা তুলুন। কোন বিজ্ঞাপনে আবার অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে পাশের জন জিজ্ঞেস করছেন “আপনার স্বামী কী করেন?” তিনি উত্তর দিচ্ছেন “লড়াই করেন।” অর্থাৎ অনলাইন গেমে লড়াই করেন। তা করেই বিলক্ষণ বড়লোক হয়ে যাব আমরা। জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন। শচীন তেন্ডুলকর, মহেন্দ্র সিং ধোনি, রোহিত শর্মা, ঋষভ পন্থ, হার্দিক পাণ্ড্য, যশপ্রীত বুমরা --- সকলে মিলে আপনাকে জগতের আনন্দযজ্ঞে নিমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। আপনি যোগ দেবেন না? দেশের অর্থনীতি তলানিতে, মোট ঘরোয়া উৎপাদন ঋণাত্মক। কিন্তু ওসবে কান দেবেন না। কে বলেছে টাকার অভাব? আপনার চাই শুধু একটা মোবাইল আর আনলিমিটেড ডেটা। নিমেষের মধ্যে বড়লোক হয়ে যেতে পারেন। প্রমাণ স্বরূপ এমন কিছু মানুষকে পর্দায় দেখা যাচ্ছে, যারা অনলাইন গেম খেলে দারুণ উপকৃত। একজন যেমন বলছেন লকডাউনের মধ্যে তাঁর ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বাড়িতে কম্পিউটার না থাকার কারণে। গেম খেলে তিনি এত জিতেছেন যে ছেলেমেয়েকে ল্যাপটপ কিনে দিয়েছেন। যত যা-ই হয়ে যাক, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া তো আর বন্ধ করা যায় না।
ঠিক কথা। ডিজিটাল ডিভাইড ব্রিজ করার এর চেয়ে ভাল উপায় আর কী আছে? গরীব মানুষ সরকারের কাছে শিক্ষার অধিকার দাবী না করে, ভর্তুকি দাবী না করে যদি এরকম স্বনির্ভর হয়ে ওঠেন --- তার চেয়ে ভাল কিছু হওয়া সম্ভব? আনন্দধারা বহিছে ভুবনে। সদ্য মালদার বাসিন্দা পার্থ মণ্ডল পশ্চিমবঙ্গের প্রথম লক্ষপতি হলেন লোটোল্যান্ড অনলাইন বেটিং করে। পার্থ ৪০ টাকার টিকিট কেটে ৫,২৮৬,৯৫৩.৩০ টাকা জিতেছেন। তিনিই লোটোল্যান্ডের খেলায় ভারতের প্রথম লাখপতি।
মুশকিল হল সকলেই পার্থর মত জিতছেন না। দুনিয়ায় জয়ীর তুলনায় পরাজিতের সংখ্যা সবেতেই বেশি। ধনী হওয়ার অনলাইন দ্যূতক্রীড়ায় পরাজিত জনা দশেক ইতিমধ্যেই আত্মহত্যা করেছেন। খবরগুলো সংবাদমাধ্যমের অনীহায় আমাদের চোখে পড়েনি সেভাবে, কিন্তু আদালতের চোখে পড়েছে। মাদ্রাজ হাইকোর্টের মাদুরাই বেঞ্চ বিরাট কোহলি, সৌরভ, অভিনেত্রী তমন্না ভাটিয়া, অভিনেতা রানা দগগুবতী, প্রকাশ রাজ এবং সুদীপকে নোটিশ ধরিয়েছেন অনলাইন গেমিং (যা আসলে আইনের ফাঁক ব্যবহার করে জুয়ার সামিল) এর প্রচার করার জন্য।
তবে তাতে আর কী হয়েছে? শাস্ত্রে বলেছে মহাজন যে পথে চলেন সেটাই সঠিক পথ। এঁরা মহাজন, এঁদের আটকায় সাধ্য কার? অতিমারির ফলে চাকরি বাকরি আগের চেয়েও বেশি অমিল, বহু মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছে। আমাদের ‘ইয়ুথ আইকন’ রা সহজে টাকা রোজগারের রাস্তা দেখাচ্ছেন, সে রাস্তায় না হেঁটে উপায় আছে?