দিনটা ছিল ১৯৪২ সালের ২০ জানুয়ারি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুনে তখন সারা ইউরোপ জ্বলছে। বার্লিনের অনতিদূরে ওয়ানসির এক সুরম্য অট্টালিকায় রাইখের নিরাপত্তা অফিসের প্রধান রেইনহার্ড হেড্রিকের আমন্ত্রণে জরুরি সভায় উপস্থিত ১৫ জন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। হেনরিখ মূলার,রুডলফ ল্যাঞ্জে,অ্যাডলফ ইচম্যান সহ সেই দলে ছিলেন নাজি প্রশাসনের উচ্চপদস্থ তরুণ আধিকারিকরা। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এই বৈঠকের গুরুত্ব হল তৎকালীন জার্মানের নাজি প্রশাসন বিদেশ মন্ত্রক, পরিবহন ও স্বরাষ্ট্র দপ্তরের আধিকারিকদের নিয়ে ইহুদিদের নিকেশের এক সুসংহত পরিকল্পনা তৈরি করে যার নেতৃত্বে থাকবে হেড্রিক স্বয়ং।বৈঠকে বিশেষ ভাবে আলোচিত হয় ইউরোপের ইহুদি সমস্যার স্থায়ী নিরসনের লক্ষ্যে এক চূড়ান্ত সমাধান ( ফাইনাল সলিউশন)।মনে রাখতে হবে সে সময় ইউরোপ নিবাসী ইহুদিদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ।১৯৪৭ সালে নুরেমবার্গ ট্রায়াল চলাকালীন ওয়ানসির কথা প্রকাশ্যে আসে।তবে বৈঠকের বিস্তারিত আলোচনার বিবরণী পাওয়া যায় না। ১৫ পাতার একটা মাত্র মিনিটস পাওয়া গেছে।বহু বছর পর জেরুজালেমে বিচার চলাকালীন অ্যাডলফ ইচম্যান স্বীকার করেছিলেন সম্মেলনে কি কি ভাবে ইহুদিদের দ্রুত হত্যা করা যায় তা নিয়ে বিশদে আলোচনা হয়।ঠিক হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে বসবাসকারী ইহুদিদের সড়ক ও রেলপথে তখন জার্মান অধিকৃত পোল্যান্ডে এনে খতম করা হবে।
সম্প্রতি হরিদ্বার ধর্ম সংসদের ' সুবচনী' ওয়ানসির সেই হাড় হিম করা ইতিহাসকে আজকের ভারতের প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। যতি নরসিংহানন্দ,স্বামী প্রবোধানন্দ গিরি, সাধ্বী অন্নপূর্ণা প্রমুখ হিন্দু ধর্মের স্বঘোষিত অভিভাবকরা তাদের কল্পিত হিন্দু রাষ্ট্রের বাস্তবায়নে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়কে নিকেশ করার ফতোয়া দিয়েছেন। আর সেই ফতোয়ার মূল কথা হল অস্ত্রের বলে সংখ্যালঘু হত্যা।হয় মারার জন্য প্রস্তুত হও নয়ত মরতে-- এই আহ্বান আজ তাদের ধর্মযুদ্ধের কেন্দ্রীয় শ্লোগান। কোন রকম ভনিতা না করেই তারা বলেছেন পবিত্র হিন্দু রাষ্ট্র গঠন করার জন্য সাফাই অভিযান চালানো বিশেষ জরুরি। এই ধর্মসংসদগুলির রণহুংকারকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই কারণ ইতিহাস সাক্ষী আজ থেকে বহু বছর আগে উত্তর ভারতে অনুষ্ঠিত একের পর এক ধর্ম সংসদ থেকে বাবরি মসজিদকে গুড়িয়ে রামমন্দির নির্মাণের আহ্বান জানানো হয়েছিল। এই স্বঘোষিত ধর্মরক্ষকদের টিকি কোথায় বাঁধা তা আমাদের অজানা নয়।সংখ্যাগুরুর মৌলবাদ আজ এদেশের চালিকা শক্তি ফলে প্রকাশ্যে গণ হত্যার ডাক আজ ন্যায্যতা পেয়ে যায়।শুধু নিকেশ নয়,ইসলামোফোবিয়াতে আক্রান্ত দেশে প্রকাশ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মহিলাদের ধর্ষণ ও গর্ভবতী করার হুমকি নিয়মিত দেওয়া হয়।
সবচেয়ে অস্বস্তির কারণ ওয়ানসির সময়কালীন জার্মানির সঙ্গে আজকের ভারতের সাদৃশ্য। অনেকে মনে করেন ওয়ানসির সম্মেলন থেকে হলোকাস্টের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছিল। কিন্তু ঘটনা প্রবাহ ততটা সরল নয়।তার বহু আগে থেকেই ইহুদিদের দেশের মানুষের কাছে গণশত্রু প্রতিপন্ন করার কাজটা শুরু হয়ে গেছিল।ইহুদিদের উপর আক্রমণ, তাদের সম্পত্তি লুঠ,ধর্ষণ, তাদের জাতি হিসাবে নীচ প্রতিপন্ন করার কাজ সরকারি মদতে করা হচ্ছিল। আর সংখ্যা গরিষ্ঠ জার্মানরা প্রকাশ্যে বা নিরুচ্চারে এই আগ্রাসনকে সমর্থন করেছিলেন।বিশিষ্ট জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্র্যাস তাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে শুধুমাত্র হিটলারকে দায়ী করে জার্মানীর শিক্ষিত সমাজ তাদের সমষ্টিগত পাপের বোঝা লাঘব করতে পারে না।
ভারতেও এই হিংস্র মৌলবাদের উত্থান এক দিনে হয় নি।ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জন্মের সময় থেকে আজ পর্যন্ত নরম হিন্দুত্ব থেকে আগ্রাসী হিন্দুত্বের যাত্রাপথে অনেক আলো- আঁধারি রয়েছে।সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্থান গুঁড়িয়ে দিয়ে,তাদের খাদ্যাভাসে হস্তক্ষেপ করে,মুসলমান শাসকদের স্মৃতি বিজড়িত জায়গার নাম বদলে দিয়ে,প্রকাশ্যে ধর্মাচরণের বিরোধিতা করে এবং মুসলিম মহিলাদের নীলাম করার অ্যাপ বানিয়েও বিষয়টা হিন্দুত্বের কারবারিদের ঠিক মনঃপূত হচ্ছিল না তাই একেবারে গণহত্যার হুমকি,ফাইনাল সলিউশনের ব্যবস্থাপত্র।কিন্তু তার চেয়েও বিপজ্জনক আমাদের সমবেত নীরবতা,নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান। বিরোধীদের নাম কা ওয়াস্তে বিবৃতি, আইন রক্ষকদের ঘটনার বেশ কয়েকদিন পর এফ আই আর দায়ের করা,দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন মানুষদের হিরন্ময় উদাসীনতা প্রমাণ করে ' ধর্মনিরপেক্ষ ' ভারত আজ এটা মেনে নিয়েছে যে সংখ্যালঘুরা আজ দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রজাতন্ত্রে তাদের উপস্থিতি অভিপ্রেত নয়।ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে আমরা পারি নি তাই বোধহয় ওয়ানসির ভয়াবহ ইতিহাসই আমাদের ভবিতব্য।