যখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামে, তখন মনে হয় যদি মা পাশে থাকত, মাথায় হাত বুলিয়ে দিত, কি ভালোই না হত! মায়ের স্মৃতিগুলো বড্ড ঝাপসা ওর কাছে।বাবা-মাকে যখন হারিয়েছিল সেই বয়সে ও "মৃত্যু" শব্দটার মানেও ঠিকঠাক বুঝতে শেখে নি।
ওদের উপজাতির সব লোকজন এই জঙ্গলেই থাকে। পশুশিকার করে। প্রকৃতি ওদের শিক্ষক, প্রকৃতিই ওদের মা। ঘন অরণ্য ভেদ করে পুঁথিগত শিক্ষার আলো এখনো এসে পৌঁছায়নি ওদের আঙিনায়। ওদের গায়ের রঙ কালো ।গাছের ছাল বা পশুর চামড়া পরে, দুবেলা দুমুঠো খেয়ে দিন কাটে ওদের। "সভ্য" সমাজের নিয়ম-কানুন জানেনা ওরা,তাই পাহাড়ের ওপারের দেশের "ভদ্র" মানুষেরা ওদের রাক্ষস বলে।
হিড়িম্বার দাদা হিড়িম্ব এই উপজাতির সর্দার। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে ওর দাদার হাতে কত যে মৃত্যু দেখেছে হিড়িম্বা তা গুনে শেষ করা যাবেনা। দাদার এই অত্যাচারী রূপ দেখতে একটুও ভালো লাগে না ওর। মাঝে মাঝে যখন দাদা মেয়েদের তুলে নিয়ে আসে, জোর করে দখল করতে চায়, ওদের আর্ত চিৎকারে কেঁপে ওঠে অরণ্যের মাটি। হিড়িম্বা ভয়ে কাঁপে। মনে মনে দাদার মৃত্যু কামনা করে। কিন্ত জোর যার মুলুক তার। হিড়ীম্বর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস কারোর নেই।
২
জন্মের পর থেকে এই জঙ্গলের বাইরে কখনো পা রাখেনি হিড়িম্বা। পাহাড়ের ওই পারে নাকি রঙিন একটা পৃথিবী আছে, সেখানে মানুষ পাকা ঘরে থাকে, কতরকম বাহারী পোষাক পরে! বুড়িমার কাছে ও কত শুনেছে সেইসব গল্প। সে এক অলীক জগৎ,পরীর রাজ্য!
-"আর একবার শোনাও না ওই রাণীর গল্পটা!"
-"আ মোলো যা! কতবার বলেছি আগে,তাও সাধ মেটে না ছুঁড়ির!"
-"বলো না,আর একটি বার, বলো না!"
আবোলতাবোল কত কি বকতে থাকে বুড়িমা! জঙ্গলের ঐপারের রাজা-রাণীর গল্প,রাম-রাবণের যুদ্ধ, সুর্পনখার নাক কাটার গল্প,সীতার পাতালপ্রবেশ আরো কত কি! হিড়িম্বার ডাগর ডাগর চোখদুটোতে উপচে পরে বিস্ময়! সীতা, সূর্পনখা দুজনের জন্যই খুব কষ্ট হয় ওর!
প্রকৃতির নিয়মেই সময় বয়ে যায়। কিশোরী হিড়িম্বার শরীরে মনে যৌবনের রঙ ধরে। নদীর জলে নিজের ছায়া দেখে ও অবাক হয়ে যায়! গাঢ় শ্যামবর্ণা, কাজল কালো চোখ,পিঠ ছাপানো এলোকেশী মেয়েটাকে ও ভালোবেসে ফেলে। নদীর জলে ও অস্তগামী সূর্যের সোনারঙ দেখে,পাখিদের সাথে বন্ধুত্ব পাতায়, চুপিচুপি কত কথা বলে গাছেদের সাথে,এভাবেই দিন কাটতে থাকে ওর.......
৩
সেদিন দুপুরে বুড়ো বটের ডালে বসে আকাশ পাতাল ভাবছিল হিড়িম্বা। চারিদিকে এমন অদ্ভুত নিস্তব্ধতা কেন আজ? কোন এক অজানা কারণে পাখিরাও চুপ! জঙ্গল জুড়ে শুধু ঝিম ধরানো ঝিঁঝিঁর ডাক। বেশীক্ষণ শুনলে কেমন যেন নেশা ধরে যায়।
দূরে কাদের দেখা যাচ্ছে? গভীর অরণ্যের দিকে হেঁটে আসছে কেন ওরা? এত সুন্দর দেখতে মানুষ তো ওদের উপজাতির নয়! এখানে ওদের কি কাজ? হঠাৎ অজানা ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে হিড়িম্বার। দাদা যদি জানতে পারে তো ওদের ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে।গাছ থেকে লাফ মেরে নীচে নেমে হিড়িম্বা ছোটে ওদের দিকে।
"আপনারা ফিরে যান, এখানে অনেক বিপদ" ওদের পথ আটকে দাঁড়ায় হিড়িম্বা!
-"আমরা দীর্ঘ পথশ্রমে ক্লান্ত,কিছু খাবার পাওয়া যাবে এখানে?"
সাদা শাড়ী পরা বৃদ্ধা ভদ্রমহিলাটি জিজ্ঞাসা করেন!তার সঙ্গে আরো পাঁচজন যুবক,সদ্যযুবতী হিড়িম্বা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে। এত সুন্দর মানুষ হয়?
-"এ মনেহয় বোবা,কথা বলতে পারে না! চলুন মা!" তীর ধনুক কাঁধে যুবকটি মৃদু স্বরে বলে ওঠে।
-"খাবার মানে... আমরা তো পশুর মাংস খাই ঝলসিয়ে...সে কি আপনাদের... মানে..." আমতা আমতা করে বলতে চায় হিড়িম্বা!
-"এই অসভ্য রাক্ষসীর সাথে কথা বলতে যাওয়াই ভুল হয়েছে,উফ,খিদেতে পেট জ্বলে গেল রে!"
পাশ থেকে গমগমে গলায় আর একজন যুবক বলে ওঠে। হিড়িম্বা আড়চোখে তাকায় ওর পেশীবহুল শরীরের দিকে ! এক অদ্ভুত শিরশিরানী অনুভূতি খেলে যায় ওর স্নায়ু বেয়ে, গলার কাছটা কেমন শুকনো শুকনো লাগে। নিজের অজান্তেই হিড়িম্বা মাটিতে চোখ নামায়।
-"কতবার বলেছি মহিলাদের সন্মান দিয়ে কথা বলতে হয়? ক্ষমা চাও ভীম!"
পাশ থেকে আরেকটি যুবক বলে ওঠে, মনে হয় ওদের দাদা।
হৃষ্টপুষ্ট, পালোয়ান গোছের লোকটা এগিয়ে আসে হিড়িম্বার দিকে!
"ইয়ে মানে কিছু মনে করো না,খিদে পেলে আমার মাথা একটু খারাপ হয়ে যায় আর কি..."
হিড়িম্বা মুখ টিপে হাসে!
৪
হিড়িম্বা ওর সাধ্যমত অতিথী-সৎকারের ব্যবস্থা করে। ওর প্রিয় যুবকটি এই আয়োজনে সন্তুষ্ট নয়, তা ওর শুকনো মুখ দেখেই বোঝা যায়। হিড়িম্বার মায়া হয় ওর জন্য, একইসঙ্গে ভয়ঙ্কর রাগ হয় নিজের উপর। আর্যদের মত সুখাদ্য রান্না করতে যে ও পারে না।
খেতে খেতে আলাপ-প্রলাপ চলতে থাকে।কথায় কথায় হিড়িম্বা জানতে পারে জ্যেঠতুতো ভাইরা বাড়িতে আগুন লাগিয়ে মারতে চেয়েছিলো ওদের। শেষ মুহূর্তে সব জানতে পেরে ওরা পালিয়ে বেঁচেছে। সব শুনে ও অবাক হয়ে যায়!
"সভ্য মানুষেরা এত খারাপ কাজ করে? তাহলে আমাদের অসভ্য বলে কেন ওরা?"
কথায় কথায় বেলা গড়িয়ে যায়। কিন্তু সন্ধ্যের আগে এই জঙ্গল পেরোতে হবে। হিড়িম্বা ওদের রাস্তা দেখিয়ে দেয়। বিদায় নেওয়ার আগের মুহূর্তে কুন্তী-মা ওর গাল টিপে দিয়ে বলেন--
"পুঁথি পড়লেই কি শিক্ষা পাওয়া যায় মা? সবটাই নিজের উপর নির্ভর করে। তাইতো জঙ্গলে থেকেও তুমি এত সভ্য, মার্জিত, আর প্রাসাদে থেকেও কৌরবরা বর্বর!"
"এবার চলুন মা,এগোতে হবে!" বড় ভাইটি বলে ওঠে।
"হ্যাঁ মা, তোমার তো আবার হাঁটতে সময় লাগে,আমি আর ঘাড়ে করে বইতে পারবো না আগে থেকে বলে দিচ্ছি বাপু!"
পাশ থেকে ফোড়ন কাটে ভীম।
যুধিষ্ঠির চোখ পাকায়, বলে মায়ের সাথে এভাবে কথা বলতে নেই। দাদার কথা গায়ে মাখে না ভীম,এরকম বকুনি খেতে সে যে অভ্যস্ত বেশ বোঝা যায়!
হিড়িম্বাকে ধন্যবাদ দিয়ে এগোতে যাবে ওরা,ঠিক তখনই ঝড়ের মত আবির্ভাব হয় হিড়িম্বর। পলকের মধ্যে আবহাওয়া পাল্টে যায়।
-"এরা কারা? এখানে কি দরকার?"
পরিচিত কর্কশ স্বরটা শুনে ভয়ে কেঁপে ওঠে হিড়িম্বা! দাদা দাঁড়িয়ে আছে ওদের পথ আটকে,এবার কি হবে?
(৫)
হিড়িম্বার জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। ওর নিস্তরঙ্গ জীবন কয়েক ঘন্টায় এভাবে উথাল-পাথাল হয়ে যাবে কে জানত!
হিড়িম্ব আর পাণ্ডবদের মধ্যে যখন বচসা শুরু হল, একপাশে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছিল ও। মৃদু স্বরে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছিল যেন এই নির্দোষ মানুষগুলো প্রাণে বেঁচে যায়। ভগবান ওর কথা শুনলেন, কিন্ত তার বিনিময়ে হিড়িম্বাকে অনাথ করে দিয়ে গেলেন। ওর সাথে রক্তের সম্পর্ক আছে, এমন একজনও আর জীবিত রইল না এই পৃথিবীতে। ওর মহা শক্তিশালী দাদাকে নগরের কোনো যুবক হারানোর ক্ষমতা রাখে হিড়িম্বা কল্পনাই করতে পারেনি।
ভীমের একের পর এক ঘুঁষিতে তখন নিস্তেজ হয়ে আসছিল হিড়িম্ব, অরণ্যের মাটি লাল হয়ে যাচ্ছিল ওর রক্তে। রক্তবমি করতে করতে হিড়িম্ব যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল আর ভীম নিজের বীরত্বের আস্ফালন করতে লাগলো, মাথাটা কেমন টাল খেয়ে গেল হিড়িম্বার। ঠিক কোন মুহূর্তে ও জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল ও নিজেই জানে না।
জ্ঞান ফেরার পর কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ও। বুড়িমার কোলে ওর মাথা রাখা। ওর চোখে মুখে জল দিচ্ছিল বুড়িমা!
-"ঠিক আছিস,মা?"
তখনই বাস্তবটা খেয়াল হতেই এক পলকে ওর বুক ফাঁকা হয়ে গেল। দাদা আর নেই মনে পড়তেই ডুকরে কেঁদে উঠলো ও! কতদিন এমন হয়েছে, নিজেই ও অত্যাচারী, খারাপ লোকটার মৃত্যুকামনা করেছে ! কিন্ত, হাজার হোক, নিজের দাদা তো, কোথাও না কোথাও একটা অদৃশ্য টান হয়ত থেকেই যায়।
আর একটা কথা মনে হতেই ভয়ে শিউরে উঠলো হিড়িম্বা। ওর আর কোন পুরুষ অভিভাবক নেই, ও অরক্ষিতা। এতদিন সর্দারের বোন বলে কেউ কাছে ঘেঁষার সাহস পেত না, কিন্ত এখন? যদি একদল পুরুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর উপর কিম্বা ওকে দেহব্যবসা করতে বাধ্য করে? কি হবে ওর?
অজানা ভবিষ্যতের আশঙ্কায় বুড়িমাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে হিড়িম্বা।
(৬)
হিড়িম্বর মৃত্যুর পর কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন। ভীমের শক্তির নমুনা পেয়ে তাকে জঙ্গলের সর্দার হওয়ার অনুরোধ করা হয়েছিল, ভীম সবিনয়ে সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে।
"কিন্তু....মানে ইয়ে...."দু তিনবার আমতা আমতা করার পর বলেই ফেলে গাঁওবুড়ো।
-"ওর দাদাকে যে তুমি মেরেছ বাছা, অভাগী মেয়েটার দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে যে!"
-"বেশ তো, কি করতে হবে বলুন?"
ভীম না বুঝলেও বৃদ্ধা কুন্তী ঠিকই বোঝেন দায়িত্ব নেওয়ার মানে!
-" ভীম, তোমাকে ওই মেয়েটাকে বিয়ে করতে হবে। নইলে ওর জীবন শেষ হয়ে যাবে যে বাছা।"
-"পাগল নাকি,ওই জংলী মেয়েকে আমি বিয়ে করতে পারবো না মা! কিছু অর্থ দিয়ে যদি ঝামেলা চোকানো যায়...."
-" ঘন জঙ্গলের মধ্যে স্বর্ণমুদ্রা কোন কাজে আসবে ওর? তাছাড়া মেয়েটা তো মন্দ না। এটা আমার আদেশ ভীম,যা বলছি চুপচাপ শোনো!"
মায়ের এই ঠান্ডা বরফ স্বরকে ভীমের মত পালোয়ানও ভয় পায়! কিন্ত এরকম একটা জংলী মেয়েকে বউ হিসেবে ও ভাবতেই পারে না! কোথায় দুধে-আলতা গায়ের রং, সোনা দিয়ে মোড়া, পরমাসুন্দরী কোন রাজকুমারীর সাথে ওর বিয়ে হবে! তা না, যত উটকো ঝামেলা!
দাদার মনের কথা বুঝতে পারে অর্জুন। কুন্তীকে বোঝানোর শেষ চেষ্টা করে ও।
-"কিন্তু মা, ওই মেয়েকে বউ হিসেবে ভীমের পাশে কি মানায়? আমরাই বা ওকে বৌদি হিসেবে মানব কি করে? তাছাড়া প্রাসাদে ওই জংলী মেয়েকে কিভাবে তুলবে? এ তো সভ্য সমাজের আদব-কায়দা কিছুই জানে না।"
-"ক্ষত্রিয়দের একাধিক বিয়েতে তো দোষ নেই অর্জুন, পরে নাহয় ভীমের পছন্দমত কোনো মেয়েকে...." পাশ থেকে যুধিষ্ঠির বলে ওঠে।
কুন্তী মাথা নেড়ে বড়ছেলের কথাকে সমর্থন জানান। হিড়িম্বার চিন্তায় বিগলিত হয়ে উনি ভীমকে বিয়েটা করতে বলছেন, তা তো নয়।কূটনীতিতে অভিজ্ঞ কুন্তী ঠিকই জানেন যে কৌরব-পাণ্ডবদের যুদ্ধ বাঁধবেই সুদূর বা অদূর ভবিষ্যতে! এই শক্তিশালী উপজাতির সমর্থন পেলে পাণ্ডবদেরই লাভ হবে। যুধিষ্ঠিরের সাথে এই নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করে তবেই এই সিদ্বান্ত নিয়েছেন উনি। ভীমটা মাথামোটা, শরীরটাই যা শুধু বেড়েছে, কিছুই বোঝে না !
কুন্তীর কথামতই হয় সবকিছু। বাংলার পাঁচের মত মুখ করে ভীম বিয়ের মন্ডপে বসে,বিয়ে হয়ে যায়! লাল নীল সংসার পাতে হিড়িম্বা। জংলী মেয়েটা সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করে স্বামীর ভালোবাসা পেতে। শারীরিকভাবে ঘনিষ্ঠও হয় ওরা। কিন্ত অদ্ভুত লোকটার মনের তল পায়না হিড়িম্বা। ও যত চেষ্টা করে ভীমের মন পাওয়ার ততই যেন ভীম দূরে পালাতে থাকে ওর থেকে!
কিছুদিন পরে নববধূর কপালে চুম্বন করে কুন্তী বলেন-"এবার আজ্ঞা দাও মা,আমাদের যে যেতে হবে..."
-" যেতে হবে মানে? আমার কি হবে এবার?"
শুকনো মুখে বলেই ফেলে হিড়িম্বা,জংলী মেয়েটা জানেনা মনের কথা মুখে আনতে নেই সবসময়।
"কৌরবদের সাথে বোঝাপড়া যে বাকি আছে মা,তারপর আমরা এসে আমাদের নতুন বৌমাকে সসম্মানে নিয়ে যাব!"
হিড়িম্বা লজ্জায় মুখ নামায়। কটাদিনের অপেক্ষা মাত্র! আর ও কি না কি ভেবে ভয়ে কাঁপছিল। বুড়িমা ঠিকই বলে,ও একটা পাগলী!
চলে যায় ওরা। অরণ্যের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে হিড়িম্বা ওদের যাওয়া দেখে। একবারও পিছনে ঘুরে তাকায়না হিড়িম্বার স্বামী।
(৭)
কচ্ছপের গতিতে এক মাস কেটে যায়। রোজ বুড়ো বটের মগডালে উঠে দূরের পথের দিকে চেয়ে বসে থাকে হিড়িম্বা। কবে আসবে ওরা?
দিন কেটে যায়,গাছের শুকনো পাতা পড়ে থাকে রাস্তা জুড়ে,কেউ আসে না!
কিছুদিন পর হিড়িম্বা বুঝতে পারে ও আর গাছে চড়তে পারবে না। গ্রামের দাই জানায় ওর মধ্যে একজন এসেছে।
(৮)
কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। হিড়িম্বার বয়স হয়েছে,গাছে উঠতে ওর বেশ কষ্ট হয় এখন। তবে বয়সের ভারের থেকেও অভিজ্ঞতার ভারে ও অনেক বেশী বৃদ্ধ।
কিভাবে কেটে গেল একটা গোটা জীবন! পিছনে ফিরে তাকালে স্বপ্নের মত মনে হয় সবকিছু। সুখের স্বপ্ন নাকি
দুঃস্বপ্ন বুঝে উঠতে পারে না ও!
তখন হিড়িম্বা গর্ভবতী, সরল জংলী মেয়েটা তখনও ভাবে ওর স্বামী ওকে নিতে আসবে!
-"আচ্ছা বুড়িমা,এমনও তো হতে পারে ওদের খুব বিপদ হয়েছে?"
যখন খুব মনে পড়ে ভীমের কথা,ইচ্ছে করে এক ছুটে চলে যেতে ওর কাছে! কিন্তু জংলী মেয়েটা যে ঠিকানা নেয়নি! ও যে ভরসা করেছিল!
বুড়িমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে হিড়িম্বা। বুড়িমা সান্ত্বনা দেয় না ওকে। শকুন্তলার গল্প শোনায়। দুষ্মন্ত ছেড়ে চলে যাওয়ার পর শকুন্তলা কিভাবে ছেলেকে একা মানুষ করেছিল সেই কথা বলে!
সময়ের সাথে সাথে হিড়িম্বার মন শক্ত হয়। অল্প সময়েই অনেকটা বড় হয়ে যায় ও!
ছেলে ঘটোৎকচ জন্মায়। হিড়িম্বা নতুন করে স্বপ্ন বোনে ছেলেকে নিয়ে।
(৯)
কোনকিছুই আর আগের মত নেই। জঙ্গল কেটে বসতি তৈরী হয়েছে বেশ কিছু। হিড়িম্বার উপজাতির অনেক ছেলেই পাঠশালায় যায় এখন। ঘটোৎকচও যায় ওদের সাথে। ছেলেকে কিছুতেই ওর মত জংলী হতে দেবেনা হিড়িম্বা!
এক বিষণ্ণ বিকেলে বুড়িমা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। আছড়ে পিছড়ে কাঁদে হিড়িম্বা। কালের নিয়মে দিন, মাস, বছর গড়িয়ে যায়। শোকের প্রাবল্য কমে গেলেও বুড়িমার কথা খুব মনে পড়ে ওর। বুড়িমার কাছ থেকে শোনা গল্পগুলো গ্রামের মেয়েদের ও শোনায়! ওদের শরীরচর্চা শেখায়, কিভাবে কঠিন পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষা করতে হয় তাও শেখায়। হিড়িম্বা জানে ঘরে বাইরে সর্বত্র মেয়েদের অনেক লড়াই করতে হয়। মেয়ে হয়ে জন্মানোটাই একটা সংগ্রাম।
একদিন গ্রামের সর্দারের কাছে যায় ও।
-"আমি চাই ছেলেদের মত মেয়েরাও পাঠশালাতে যাক"
-"তুমি চাইলেই তো হবে না! মেয়েমানুষ লেখাপড়া শিখলে অনর্থ হবে। রমণীর জায়গা ঘরে!"
-"কিন্তু ওদেরও তো দুনিয়াকে জানার অধিকার আছে!"
সর্দার হা হা করে হাসে।
-"মেয়েরা দুনিয়ার খবর জেনে কি করবে? শোন, বাজে বকিস না,ঘরের বাইরে বেরোয় খারাপ মেয়েরা। "
অনেক চেষ্টা করেও হিড়িম্বা পারেনা সর্দারকে রাজী করাতে।
(১০)
সময় বয়ে যায় সময়ের নিয়মে। হিড়িম্বার মুখেও সময় তার বলিরেখার আলপনা দিয়ে গেছে,বার্ধক্য থাবা বসিয়েছে ওর শরীরে!
কিন্তু ও গর্বিত মা। বিদ্যায়-বুদ্ধিতে ওর ছেলে সবার সেরা,ওর নয়নের মণি ঘটোৎকচ এখন গ্রামের সর্দার! ঘর আলো করা বউ এসেছে ওর-- মৌরভি। তবে বৌমার সাথে ওর তেমন বনে না। জংলী শাশুড়িকে খুব একটা গুরুত্ব দেয় না মেয়েটা। তবে হিড়িম্বা বৌমার দোষ দেখে না এতে। মৌরভি রূপে, গুণে, শিক্ষায়, বংশমর্যাদায় ওর থেকে অনেক উপরে। হিড়িম্বাকে মেনে নিতে ওর সমস্যা হতেই পারে। আর তাছাড়া নতুন প্রজন্মের নতুন চিন্তাধারা, তারা অন্যভাবে জীবনকে দেখে। ছেলের বউ হিড়িম্বার সব কথা মেনে চলবে, এমন অবাস্তব আশা ওর নেই। উপর উপর ভালোভাবে কথা বলে, ভক্তি-শ্রদ্ধা করে, এতেই ও খুশি। হিড়িম্বা গ্রামের বাকি মহিলাদের কাছে বৌমাকে নিয়ে কুৎসা করে বেড়ায় না বা নিজের মতামত জোর করে চাপিয়েও দেয় না ওর উপর। ছেলে-বউয়ের বাড়ি থেকে একটু দূরে একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর বানিয়ে ও একা থাকে। মাঝে মাঝে দেখা হবে, সম্পর্ক ভালো থাকবে, এতেই মঙ্গল।
গ্রামের মধ্যে এখন শিক্ষার আলো প্রবেশ করেছে। রান্না করে খেতে শিখেছে ওরা।এমনকি গ্রামের দুএকটা মেয়ে পাঠশালাতেও যাওয়া শুরু করেছে! হিড়িম্বা দু-চোখ ভরে ওদের দেখে! চোখ জুড়িয়ে যায় ওর।
(১১)
মৌসুমী বায়ুর সহজ আনাগোনা দেখে বিধাতাপুরুষ হাসে। আবার কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে হিড়িম্বার জীবনে। যে স্বামী কোনোদিন কোনো খোঁজ নেয়নি, সেই স্বামী লোক পাঠায়। ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্য না যদিও ! কুরু-পাণ্ডব সংঘাত অনিবার্য। যুদ্ধে সাহায্য চাই,কিছু লোক দরকার!
-"কোনো দরকার নেই কাউকে পাঠানোর!"
-"না মা,বাবাকে সাহায্য করা আমার দায়িত্ব..."
-"কিসের বাবা? যে বাবা কোনোদিন খোঁজ নেয় নি...."
-"সে খোঁজ নেয়নি বলে আমরাও বিপদের সময় মুখ ঘুরিয়ে নেব? তাহলে ওদের আর আমাদের ফারাক কি রইলো মা?"
বাকবিতণ্ডা চলতেই থাকে,ছেলের জেদ হিড়িম্বা জানে,কিছুতেই থামাতে পারে না ওকে।
-"একান্তই যদি পাশে দাঁড়াতে হয়, কিছু লোক পাঠিয়ে দাও,তোমার যাওয়ার কি দরকার?"
-"আমি যে সর্দার মা,কাপুরুষের মত কাজ করতে পারবো না!"
চলে যায় ঘটোৎকচ।
-"চিন্তা কোরো না মা,তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো আমি...."
হিড়িম্বা কাঁদতে কাঁদতে ছেলের কপালে স্নেহ-চুম্বন এঁকে দেয়। এই প্রথম মৌরভি
ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে।
(১২)
বুড়ো বটের মগডালে উঠে ছেলের জন্য পথ চেয়ে থাকে হিড়িম্বা। মৌরভি আড়ালে চোখের জল মোছে! দিন যায়,মাস যায়। মায়ের অপেক্ষা ফুরায় না............
কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। গ্রামের ছেলেরা লেখাপড়া শিখে সভ্য হয়েছে এখন। তাই হিড়িম্বাকে ওরা পাগলীবুড়ি বলে,ঢিল মারে ওকে দেখলে! সারাদিন সারারাত বুড়িটা গাছে উঠে বসে থাকে। বৃষ্টি হচ্ছে,বাজ পড়ছে,কোনো বিকার নেই পাগলীর!
শুধু একটাই প্রশ্ন-- আমার ঘটো কবে আসবে?
(১৩)
দিকশূন্যপুরের জঙ্গলের মাঝে আমার গাড়িটা খারাপ হয়ে গেল সেদিন। কি উপায় হবে এখন ভাবতে ভাবতে পায়চারি করছি,এমন সময় দেখি, বুড়ো বট বেয়ে নেমে আসছে সাত বুড়ির এক বুড়ি!
সাদা ছেঁড়া একটা শাড়ি পরা, মাথায় শনের নুড়ির মত পাকাচুল,ডাগর ডাগর চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে আসছে,দেহের কয়েকটা অংশ থেকে খসে খসে পড়ছে চামড়া!
আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো-"আমার ঘটোকে দেখেছো? কখন আসবে ও?"
ইচ্ছা হল চিৎকার করে বলি--
"তোমার ছেলে যুদ্ধে মারা গেছে কয়েক শতাব্দী আগে,দুখিনী মাকে ছেলের মৃত্যুসংবাদটুকু জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি কেউ!"
কিছুই বলতে পারি না,জানিনা বলে পালিয়ে আসি!
ফ্যালফ্যাল করে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে জংলী বুড়িটা,ওর চোখ থেকে বলিরেখার পাকদন্ডী বেয়ে গড়িয়ে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা নোনাজল...........