পনেরোই এপ্রিল কেরালার কোচিতে গাজায় প্যালেস্তিনিয়ান নাগরিকদের উপর চলা গণহত্যার প্রতিবাদে স্টুডেন্টস ইস্লামিক অর্গানাইজেশন-এর (এসআইও) বানানো একটি মুর্যাল ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেন অস্ট্রিয়া থেকে আগত এক শ্বেতাঙ্গ পর্যটক। তার সফর-সঙ্গী এই কুকর্মটি ক্যামেরা-বন্দী করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দুই মহিলাকে স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়াতে দেখা যায়। এসআইও-র প্রতিনিধিদের বিক্ষোভের চাপে ফোর্ট কোচি থানা পরের দিন দুই অস্ট্রিয়ান নাগরিকের বিরুদ্ধে এফ-আই-আর নিতে বাধ্য হয়।
প্যালেস্তাইনের উপর ইসরায়েলি আগ্রাসন নিয়ে বেশীরভাগ ভারতীয় নাগরিকের আপাত উদাসীনতা এবং দক্ষিণপন্থীদের প্রকাশ্য নেতানিয়াহু প্রীতির আবহে কেরালার প্রো-প্যালেস্তিনিয়ান সক্রিয়তা ব্যাতিক্রমই বলা চলে। প্রায় লাইভ সম্প্রচার হতে থাকা ধ্বংসযজ্ঞ সমগ্র বিশ্বে প্রবল যুদ্ধ বিরোধী জনমত গঠন করেছে। কমবেশী প্রতিটি দেশেই যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনে হাজারো মানুষ সামিল হচ্ছেন। ইসরায়েলি সেনার নিরন্তর হত্যালীলা এবং পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক নেতাদের ইসরায়েলকে নিঃশর্ত আর্থিক ও কূটনৈতিক সমর্থন প্রদান জনমানসে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। নৈতিক এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই গণহত্যার বিরোধিতার সাথে সাথে আমজনতা যুদ্ধাস্ত্র বাবদ বিপুল পরিমান সরকারী অর্থ ব্যয়ের যৌক্তিকতাকেও প্রশ্ন করছেন। সঙ্গত কারণেই তারা জানতে চাইছেন তাদের করের টাকায় গড়ে ওঠা এই তহবিল সার্বজনিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, খাদ্য ইত্যাদি খাতে খরচ করা হচ্ছেনা কেন। সমস্ত ইহুদী ধর্মালম্বীদের ঐতিহাসিক প্যালেস্তাইনের মাটিতে ডেকে এনে ইসরায়েল রাষ্ট্র বানানোর জায়নবাদী মতাদর্শ যে আদতে একটি ঔপনিবেশিক প্রকল্প সেই সম্বন্ধেও আরো বেশী সংখ্যক মানুষ ক্রমশ শিক্ষিত ও সজাগ হয়েছেন।
এর বিপরীতে, ভারতের মতো বিশালাকায় দেশের জনসাধারণের মধ্যে এই নরসংহার তেমন কোন সাড়া জাগাতে না পারার কারণ বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। একথা সত্যি যে দেশের কিছু প্রথম সারির সরকারী এবং বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্যালেস্তিনিয়ানদের উপর ইসরায়েল রাষ্ট্রের দমন পীড়নের নীতি, বর্তমান সংঘাতের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ইত্যাদি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করা হয়েছে বা করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সেই প্রচেষ্টার কারণে উদ্যোক্তাদের কর্তৃপক্ষের এবং দক্ষিণপন্থী ছাত্রদের রোষানলে পড়ার ঘটনাও সামনে এসেছে। একদিকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনার পরিসর সঙ্কুচিত হয়েছে, অন্যদিকে বৃহত্তর নাগরিক সমাজকেও গাজায় কার্যত বন্দী একটি জনজাতির উপর অবিরত বোমাবর্ষণ বিশেষ উদ্বিগ্ন করেনি। অন্যান্য দেশে গাজা গণহত্যার বিরোধিতায় রাস্তায় মানুষের ঢল নামার যে ছবি প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে সেই নিরিখে ভারতের রাস্তা- কলকাতা এবং কেরালার কিছু জায়গা বাদ দিলে- বেশ শান্ত শিষ্ট ভদ্র রূপ নিয়েছে। যুদ্ধবিরোধী মতবাদের পরিবর্তে বরং একটি আগ্রাসী ভাবধারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
সংঘাত শুরুর পর্বেই উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের ভিড় দিল্লীতে ইসরায়েলি এমব্যাসির সামনে জমায়েত করে ইসরায়েলের হয়ে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার আর্জি পেশ করে। তাঁদের লক্ষ্য ‘জিহাদীদের’ নাস্তানাবুদ করা। ভারতীয় সোশ্যাল মিডিয়ার অন্ধকার কূপে (পড়ুন আই-টি সেল) মুসলিম ঘৃণার উর্বর জমিতে প্রতিনিয়ত প্যালেস্তাইন বিদ্বেষী অভিমত চাষ করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে যে অ্যান্টি-প্যালেস্তিনিয়ান ভুয়ো খবর ছড়ানোয় ভারতীয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা সবার শীর্ষে। একদিকে প্যালেস্তাইনের প্রতি যে কোন রকম সমর্থনকে যখন ক্ষমতার চোখ- রাঙানি সহ্য করতে হচ্ছে তখন ইসরায়েলের সমর্থনে বজ্রংদল সহ হিন্দু দক্ষিণপন্থীদের তর্জন-গর্জন নিয়ে অবশ্য প্রশাসন নিশ্চুপ। বিগত দশ বছর ধরে কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা হিন্দুত্ববাদী দলের কাছে নতজানু ‘গোদি’ মিডিয়া সাধারণ মানুষকে ইস্লামোফোবিয়ার বিষ পান করিয়েছে। ফলস্বরূপ, ‘ভালো’ ইহুদী ইসরায়েল এবং ‘খারাপ’ মুসলিম প্যালেস্তাইন- জনসংখ্যার একটি বড় অংশের কাছে এই সরলীকরণ করা সহজ হয়ে গেছে। প্যালেস্তাইন থেকে ইসরায়েল হওয়ার রক্তাক্ত ইতিহাস না জানাও হয়তো এই পক্ষপাতদুষ্টতার কারণ।
হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির বাড়বাড়ন্তের এই যুগে কষ্ট করে বই ঘেঁটে ইতিহাস চর্চা আর কে করতে যায়? বস্তু নির্ভরতা জলাঞ্জলি দিয়ে আমাদের ইতিহাস ধারণা এখন মূলত আবেগ নির্ভর। সনাতন, নিরবচ্ছিন্ন ভারতীয় সভ্যতার কষ্টকল্পিত উপাখ্যান আর ১৫০০ বছরের ইসলামিক আধিপত্যের ভিত্তিহীন কাহিনীর উপর নতুন ভারতের ইতিহাস লেখার কাজ শুরু হয়েছে। যে কুযুক্তির ভিত্তিতে ভক্তগণ প্রতিটি মসজিদের তলায় মন্দিরের সন্ধান পাচ্ছেন সেই একই ফর্মুলায় মধ্যপ্রাচ্যের জমিতে ইউরোপিয়ান ইহুদীদের অধিকারকে স্বাভাবিক মনে করতে তাঁদের হয়তো বিশেষ অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সঙ্ঘ পরিবার প্রস্তাবিত হিন্দুরাষ্ট্রের সঙ্গে জায়নবাদের ইহুদী রাষ্ট্রের চারিত্রিক সাদৃশ্যও নিশ্চয়ই হিন্দুবীরের বিশেষ পুলকের কারণ হয়েছে। ‘ব্যাদে সবকিছু আছে’তে বিশ্বাসীরা বাইবেলের গল্পকেও ইতিহাস বলে মানবেন এ আর আশ্চর্যের বিষয় কী? এর সাথে যদি থাকে মুসলিম বর্বরতার কিছু মুখরোচক, রোমহর্ষক কাহিনী- যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসত্য বা অর্ধসত্য- তাহলে তো গল্প সুপারহিট। অক্টোবর সাতের পরবর্তী সময়ে আমাদের মূল-ধারার চব্বিশ ঘণ্টার খবরের চ্যানেলগুলি এই আগুনেই ঘি ঢেলেছে। কোন ঐতিহাসিক আলোচনায় না ঢুকে প্রশ্নাতীত ভাবে ইসরায়েলকে আক্রান্ত এবং হামাসকে আক্রমনাত্মক, সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী হিসেবে উপস্থাপন করে ভারতীয় মিডিয়া ‘অফিসিয়াল লাইন’ অনুসরণ করেছে। সেই সঙ্গে উপরি পাওনা হিসেবে রয়েছে চ্যানেলের যুদ্ধোন্মাদ অ্যাংকরদের কর্ণ-বিদারক আস্ফালন।
অবশ্য গোদি মিডিয়া শুধু যে ইতিহাস আর নিরপেক্ষতার ধার ধারে না তা নয়; ভুয়ো খবর ছড়ানোতেও তার জুড়ি মেলা ভার। ১৩ অক্টোবর রিপাব্লিক টিভিতে বাইট দিতে আসেন ইসরায়েলের ধর্মীয়-স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘জাকা’র (ZAKA) কর্মী ইয়োসি ল্যান্ডাউ। ১৯৯৫ সালে শুরু হওয়া জাকা একটি গোঁড়া ইহুদী (Orthodox Jewish) সংগঠন। নিজেদেরকে দুর্ঘটনা স্থলে কাজ করা উদ্ধারকারী দল হিসেবে পরিচয় দিলেও এদের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো মৃত ব্যক্তির ইহুদী ধর্মমতে দ্রুত সৎকার সাধন। ধর্মীয় কারণে মৃতদেহের অটোপ্সি-র বিরোধিতা করা, প্রতিষ্ঠাতা ইয়াহুদা মেশি-জাহাভ এর বিরুদ্ধে একাধিক যৌন হয়রানির অভিযোগ ইত্যাদি নানা বিতর্কে জড়িয়েছে জাকার নাম। রিপাব্লিক টিভিতে দেওয়া সাক্ষাতকারে অন্যান্য অতিরঞ্জনের সাথে ল্যান্ডাউ বহুচর্চিত এবং অবশেষে ভুয়ো বলে প্রমানিত হওয়া দুটি চাঞ্চল্যকর হিংসা কান্ডের ব্যাখ্যান করেন। এদের মধ্যে প্রথম দাবীটি হল হামাস শিশুদের শিরচ্ছেদ করেছে এবং পুড়িয়ে মেরেছে। এরপর সঞ্চালকের দ্বারা ‘উৎসাহিত’ হয়ে ল্যান্ডাউ কিব্যুতজ ‘বেরী’তে (be’eri) ‘তার নিজের চোখে’ দেখা একজন অন্তঃস্বত্বা মহিলা এবং তার অজাত শিশুর মৃতদেহের ভয়াবহ দৃশ্য বর্ণনা করেন। পরবর্তী কালে এমনকি ইসরায়েলি মিডিয়াতেও এই মিথ্যা প্রলাপ খণ্ডন করা হয়। রিপাব্লিক টিভির মতো বিকিয়ে যাওয়া কর্পোরেট মিডিয়ার কাছে অবশ্য সাংবাদিক দায়বদ্ধতা আশা করা বোকামি মাত্র।
এরপর ২৫-এ অক্টোবর আবার রিপাব্লিক টিভিতে আসেন ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোরস-এর একজন প্যারামেডিক। নিজের পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তিও দুটি মিথ্যাচার করেন যার মধ্যে একটি হলো কিব্যুতজ নাহাল-ওজে ডাস্টবিনে মৃত শিশুর উপস্থিতি। অন্যটি দুজন কিশোরীর অর্ধনগ্ন মৃতদেহের বর্ণনা। ডিফেন্স ফোরসের ওই ইউনিটেরই একজন প্যারামেডিক মার্কিনী সংবাদ মাধ্যম সিএনএন-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হুবহু একই দুই কিশোরীর কথা বলেন কিন্তু ঘটনাস্থল হিসেবে উল্লেখ করেন কিব্যুতজ ‘বেরী’র নাম (এই দুজন একই ব্যক্তি কিনা তা জানার উপায় নেই কারণ দ্বিতীয় জনও নিজের পরিচয় গোপন রেখেছেন)। কিব্যুতজ ‘বেরী’র মৃতদের তালিকায় ওই প্যারামেডিকের বর্ণনার সাথে মেলে এমন দুজন কিশোরীর উল্লেখ না থাকার বিষয়টি এবং আরো কিছু অসঙ্গতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে দ্য গ্রেজোন এবং মন্ডোওয়েস এর মতো সংবাদ সংস্থা।
পশ্চিমী দুনিয়ার গণমাধ্যমে ‘হামাসের পরিকল্পিত গণধর্ষণ’-এর কল্পকাহিনী নিয়ে উঠেছে বহু প্রশ্ন। নিজেদের মুসলিম এবং বর্ণ-বিদ্বেষী চিন্তাধারার জন্য পাশ্চাত্য মিডিয়া হামাসের নির্মমতার কথা রঙ চড়িয়ে পরিবেশন করে ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধের সমর্থনে জনমত গঠনে ভূমিকা নিচ্ছে- এমন দাবীও উঠেছে নানা মহলে। উত্তর আমেরিকা, কানাডা এবং ইউরোপের ইসরায়েলকে সীমাহীন প্রশ্রয়দান আসলে যে তাদের ঔপনিবেশিক অতীতের প্রতিফলন সেটাও বুঝতে বাকী নেই ‘তৃতীয় বিশ্বের’ বেশীরভাগ দেশের। এমতাবস্থায় দুশো বছর ব্রিটিশ শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া ভারতবাসীর স্মৃতিহীনতা অত্যন্ত লজ্জাদায়ক এবং দুঃখজনক। ইতিহাস সাক্ষী যে পরাধীন এবং শোষিত মানুষ যখনই স্বাধীনতার লক্ষ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তখন তাদের প্রায় সব কর্মকাণ্ডকেই সন্ত্রাস হিসেবে দাগিয়েছে শোষক শ্রেণী। কিন্তু ইতিহাস বিস্মৃতি, বিকৃতির ও হিন্দু সভ্যতার গৌরব পুনরুদ্ধারের এই গদগদ সময়ে একটি সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণার আফিম সেবনে ব্যস্ত জনতাকে কি বেলফোর ডিক্লারেশন, নাকবা, প্ল্যান ডালেট, অস্লো অ্যাকর্ড, চেকপয়েন্ট ইত্যাদি গভীর কিন্তু শুকনো আলোচনায় আগ্রহী করে তোলা যাবে? ধর্মের চশমা পরে শতাব্দী প্রাচীন ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা বুঝতে চাওয়া হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির স্নাতকদের বিস্তারিত তথ্যের প্রতি কীভাবে মনযোগী করে তোলা যায় সেই নিয়ে ভাবার আশু প্রয়োজন। গত ছয় মাসে বহুল প্রচলিত প্রিন্ট এবং টেলিভিশন মিডিয়ায় প্যালেস্তাইন-ইসরায়েল সংক্রান্ত বাদানুবাদ দেখে, শুনে এবং পড়ে অন্ত্যত মনে হল যে যুদ্ধকে প্রাইম-টাইম বিনোদন বানানো ছাড়া তাদের আর বিশেষ দায়িত্ব নেই।
মুসলিম বনাম ইহুদী-র সরলীকৃত আখ্যানের ধোঁয়াশা কাটিয়ে নব্য-সাম্রাজ্যবাদ এবং পুঁজিবাদের প্রেক্ষিতে এই নিরর্থক প্রাণক্ষয়কে বিশ্লেষণ করা এবং সেই আলোচনার ক্ষেত্র বিস্তৃতি করা তাই এখন আমাদের অন্যতম সামাজিক ও রাজনতিক দায়িত্ব হওয়া উচিৎ।