পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণ চলছে

  • 14 January, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 580 view(s)
  • লিখেছেন : মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়
২০০৯ সালে এ দেশে বিনামূল্যে ছয় থেকে শুরু করে একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত শিশুদের বাধ্যতামূলক শিক্ষার অধিকার আইন চালু হয়। এই আইনের ফলে দেশ জুড়ে শিক্ষাব্যবস্থায় বেশ খানিকটা নাড়াচাড়া পড়ে এবং কমবেশি ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুল আসার বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা হয়। ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে আসুক এটাই ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু ২০২৪ সালে আমরা লক্ষ্য করছি একটি বিশেষ ধর্মের ছাত্রছাত্রী স্কুল না এলেই ভালো এরকম একটি পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে।‌ এটাই হয়তো হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণের একটা পদক্ষেপ।

সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের আমরোহীর একটি বেসরকারি স্কুলের প্রিন্সিপাল তিনটি ছাত্রকে বহিষ্কার করেছেন।‌ ছাত্রগুলি কেজি ওয়ান, ক্লাস ওয়ান এবং থ্রিতে পড়ে।‌এই ছেলেরা যে ভয়ঙ্কর অপরাধ গুলি করেছে তা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেখলেই বোঝা যাবে। ধর্মীয় উস্কানি, ধর্মান্তকরণের চেষ্টা, ধর্মস্থল ভাঙার ষড়যন্ত্র ইত্যাদি।‌ এই ভয়ঙ্কর অপরাধটি আসলে হল এই যে তাদের টিফিনে নাকি আমিষ খাবার ছিল। বিষয়টা নিতান্ত হাস্যকর বলে ভাবা যেতে পারে কিন্তু আসলে ‍ আজকের ভারতে এটাই বাস্তব। এক ধরনের জাদু বাস্তবতাও বলা যেতে পারে। প্রিন্সিপাল বলেছেন এই বাচ্চাদের থেকে কেউ যেন খাবার না খায়। যে ক্লাস থ্রিতে পড়ে তাকে মৌলবাদী বলে ঘরে আটকে রাখা হয়। অবশেষে ছাত্রদের পরিবার আদালতে যান এবং আদালত ছাত্রদের পক্ষেই রায় দেয় ‌। ‌ কিন্তু শেষ পর্যন্ত যা ঘটে তা হল এই যে ওই ছাত্ররা ঘর থেকে আর  বেরোচ্ছে না।
 
একশ বছর আগে যে সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এই হল তাদের  স্বপ্নের হিন্দু রাষ্ট্র। এখানে হিন্দী, হিন্দু, হিন্দুত্ব ছাড়া আর কোনো যুক্তি নেই।‌


২০০৯ সালে এ দেশে বিনামূল্যে ছয় থেকে শুরু করে একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত শিশুদের বাধ্যতামূলক শিক্ষার অধিকার আইন চালু হয়। এই আইনের ফলে দেশ জুড়ে শিক্ষাব্যবস্থায় বেশ খানিকটা নাড়াচাড়া পড়ে এবং কমবেশি ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুল আসার বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা হয়। ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে আসুক এটাই ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু ২০২৪ সালে আমরা লক্ষ্য করছি ‌ কিছু কিছু ছাত্র ছাত্রী স্কুল না এলেই ভালো এরকম একটি পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে।‌


আচ্ছা, আমরা কি ভাবছি আমরা কোন্ দেশে বাস করছি!কোন্ মহান চেতনা আমাদের বাধ্য করছে ট্রেনে নামাজরত মুসলমান ভক্তের কানের কাছে গিয়ে জয় শ্রীরাম বলা! যাদের খাবার জোটে না তাদের খাবারের কথা না ভেবে কে কী খাচ্ছে তা দেখতে লাফিয়ে পড়ছি! দল বেঁধে মানুষকে তার পোশাকের জন্য অপমান করছি। আর প্রতিদিন ভুয়ো পোস্ট দিয়ে উত্তেজনা ছড়াচ্ছি!


কিছুকাল আগে উত্তরপ্রদেশের একজন জজ সাহেব বলেছিলেন যে ভারত সংখ্যাগুরুর ইচ্ছায় চলবে। কোথায় বলেছেন? বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্মশালায়। একজন বিচারক হঠাৎ বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কার্যশালায় কেন? সেখানে তার আলোচ্য বিষয় ছিল কমন সিভিল কোড কিন্তু ইদানীং সব রচনাই গরুতে গিয়ে ঠেকছে।‌। আমাদের দেশে সংখ্যালঘুর কথায় কীভাবে চলতে হবে ‌‌ তার একটি নমুনা আমরা ইতিমধ্যেই দেখতে পেলাম।  বস্তুতপক্ষে এ দেশের যে রাজ্য থেকে সবচেয়ে বেশি সাংসদ আসে সেই রাজ্যে মুসলমানদের কোনরকম অধিকার থাকবে না এমন ব্যবস্থাই করা হচ্ছে। এই আশ্চর্য বিচারক এর আগে বলেছেন যে গোরক্ষা হিন্দুদের মৌলিক অধিকার এবং গরুকে দেশের জাতীয় পশু ঘোষণা করা হোক। এছাড়াও তিনি মনে করেন গরুই একমাত্র প্রাণী যে অক্সিজেন নেয় ও ছাড়ে এবং পঞ্চগব্য অর্থাৎ গরুর দুধ দুই ঘি মূত্র ও গোবর দিয়ে তৈরি ওষুধ‌ বহু দুরারোগ্য ব্যাধি ভালো করতে পারে। এলাহাবাদ হাইকোর্টের এই বিচারপতি শেখর কুমার যাদব কে অভিযুক্ত করার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছে। কপিল সিব্বালের নেতৃত্বে ৫৫ জন সাংসদ রাজ্যসভার সাধারণ সচিব কে আবেদন করেছেন যেন এই বিচারককে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু রাজ্যসভার চেয়ারপারসন জগদীপ ধনখড়ের কোনো হেলদোল নেই।


‌ কাশিতে গান্ধীবাদীদের প্রতিষ্ঠান ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ১০০ দিন ধরে বহু মানুষ অনশন করছিলেন। সেখানে দেখা হল বুনকর সম্প্রদায়ের নেতা আলিমুদ্দিন আনসারীর সাথে। তিনি স্পষ্ট করেই বললেন প্রত্যেকদিন সকালে উঠে এই আশঙ্কায় থাকি যে আজ মুসলমানদের উপর নতুন কোন নির্দেশ জারি হবে। কখনো ক্লাস থেকে বের করে দেওয়া, কখনো সহপাঠীদের দিয়ে থাপ্পড় মারানো, বাড়ি ভাড়া না দেওয়া, যে কোনো প্রসঙ্গে দেশদ্রোহী বলা,  পাকিস্তান যেতে বলা, জঙ্গি বলা, অপমানের শেষ নেই। আমেরিকায় কালো মানুষের উপরেও হয়তো এত ঘৃণা বর্ষিত হয়নি।

সংখ্যাগুরুর সংজ্ঞাটি ধর্ম দিয়ে মাপা যেতে পারে, ধর্মকেই জাতি ভাবা হয়েছে এদেশে, দ্বিজাতি তত্ত্বের দুই প্রবক্তা সাভারকর এবং জিন্না এমনটাই মনে করতেন কিন্তু হিন্দু ধর্মের ভিতরে জাত অনেক আর সেখানে পাত নিয়ে সমস্যা আছে অর্থাৎ আমিষ খেলেই মৌলবাদী এমনটা অধিকাংশ হিন্দুই মানবেন না।

হিন্দুদের এই দলিত অংশটি ভোটের রাজনীতিতে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি সংসদে বেফাঁস মন্তব্য করে বিপুল সমস্যায় পড়েছেন স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।‌যিনি উইপোকার মতো সংখ্যালঘুদের দেখেন, ‌ আম্বেদকার নিয়ে তিনি বিশবাঁও জলে। কিন্তু তাঁর কৌশলগত অবস্থান যাই থাকুক উত্তর প্রদেশ সরকার হিন্দু রাষ্ট্র অভিমুখেই থাকবে।  বড়দিনের দিন মনুস্মৃতি পুড়িয়েছিলেন আম্বেদকার ৯৭ বছর আগে। এই ঘটনাটিকে স্মরণে রেখে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির কিছু ছাত্র-ছাত্রী একটি অনুষ্ঠান করেছিল।‌ তাদের বেশ কয়েকজনকে গুরুতর ধারায় গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন ধর্ম সংক্রান্ত সব ধারাই দেশদ্রোহের সাথে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে।‌ এক বন্ধু বলছিলেন কতজন হিন্দুর বাড়িতে মনুস্মৃতি খুঁজে পাওয়া যাবে? অথচ তার ফতোয়া মেনে চলতে হবে যুগ যুগ ধরে!

 

বড়দিনের দিন বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে একটি অবশ্যই ফতোয়া জারি করা যে ওই দিন কোনো হিন্দু চার্চে গেলে বজরঙ্গ দল তাদেরকে রেহাই দেবে না।‌ হয়তো বা সে কারণেই উৎসাহিত হয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্মীরা গির্জায়  প্রার্থনা চলাকালীন বাইরে রামের নাম নিয়ে বিরাট চেঁচামেচি করেছে। আর একজন ‌ জোমাটোর কর্মী যিনি কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী বড়দিনের দিন সানগ্লাসের পোশাক পড়ে খাবার দিতে গিয়েছিলেন তাকে পোশাক খুলতে হয়েছে। কোন এক জায়গায় মার খেতে হয়েছে।‌ অবশ্য দেশের প্রধানমন্ত্রী গির্জায়  গিয়েছেন। সেখানে অবশ্য বজরঙ্গ এর হাত পৌঁছায় না।


বড়দিনের দিনেই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর শততম জন্মদিবসে উপলক্ষে পাটনায় আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে একজন বিশিষ্ট ভোজপুরি গায়িকা গাইছিলেন।। বাজপেয়ীর গান্ধী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার স্মৃতিতেই  রঘুপতি রাঘব রাজা রাম গানটি গেয়েছিলেন।‌ ঈশ্বর আল্লাহ ‌ তেরো নাম  এখানে পৌঁছতেই ভয়ঙ্কর গোলমাল বাধে।‌ গান বন্ধ হয়।‌ মহিলাকে ক্ষমা চাইতে হয়। ‌ অথচ তথ্য বলে বাজপেয়ী নিজে কিন্তু গান্ধীর ধর্মের সমন্বয়বাদী ধারাটির যথেষ্ট অনুরাগী ছিলেন।

এ দেশের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা তার বহুত্ববাদী সংস্কৃতি এবং তার নিরন্তর চর্চা। কিন্তু আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি সংকীর্ণ অমানবিক বিভেদকামী চেতনা গ্রাস করছে সমাজকে। সবটুকু ধর্মীয় বিকৃতিকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক লাভের চেষ্টা। কোনো আর্থসামাজিক সমস্যার এখানে গুরূত্ব নেই। নেতা ও মন্ত্রীরা উল্লসিত হচ্ছেন একটি সম্প্রদায়ের ক্ষতিতে। তাদের রাজনীতি সবাই  বহন করছেন।‌ ২০০৬ সালে সাচার কমিটির রিপোর্ট চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রান্তিক অবস্থান। তারপর সরকারি প্রয়াস ছিল সংখ্যালঘুর উন্নয়নে। কিন্তু আজ সবকা সাথ সবটা বিকাশ ফাঁপা বুলির মতন। হিন্দু ধর্মের ভিতরে সংখ্যাগুরু কিন্তু দলিত অংশ ,বারবার প্রমাণিত হচ্ছে যে এদের উপর বিবিধ অত্যাচার বাড়ছে। সংরক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন টালবাহানাই তার প্রমাণ।

কিন্তু হিন্দু বিপন্ন বলে দেশে বিদেশে আওয়াজ তুলে এক অদ্ভুত অসহিষ্ণু পরিস্থিতি সৃষ্টি করা চলছে।‌ আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলাদেশের পটপরিবর্তন নিয়ে যাবতীয় মিথ্যা খবরে এখানে সমাজ মাধ্যম পরিপূর্ণ। সেখানে হিন্দু মহিলারা শাঁখা সিঁদুর পরতে পারছেন না এই প্রচার চলছে জবরদস্ত। সেখানে সংখ্যালঘুদের দুঃখে এপারে সরকার কাতর কিন্তু এখানে সংখ্যালঘু মেয়েরা হিজাব পরলে স্কুলে ঢুকতে পারবে না এমন নিয়ম নিয়ে কোনো কথা নেই।
আপাতত এই দেশে গণতন্ত্রের সবকটি স্তম্ভই নড়বড়ে। সেই আসিফা কান্ডের সময় থেকে আমরা উকিলদের হিন্দুত্ব দেখেছি যারা ধর্ষণকারীর পক্ষে মিছিল করেন, বিচারক যিনি যাবজ্জীবন দন্ডিত শিশু হত্যাকারী ও গণধর্ষণ কারীদের ব্রাক্ষণ বলে মুক্তি দেন, আমলারা গুরুজীদের পায়ে মাথা ঠেকান, প্রধান বিচারপতি দৈব প্রেরণায় মন্দির মসজিদ ভাগ করেন আর সংবাদমাধ্যম সারাদিন চিৎকার করে মসজিদ খোদাইএর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে থাকে।

সবকিছুর পরেও হাতে যাদের পেন্সিল রয়ে যায়, তারাও যদি সংখ্যালঘুর উপর বিষ ছড়িয়ে হিন্দু রাষ্ট্রের জন্য গর্ব করেন, তখন গণতন্ত্র কোথায় থাকে?

0 Comments

Post Comment