জানুয়ারি, ২০২৩-এ মার্কিন আর্থিক গবেষণা সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ তার প্রতিবেদনে আদানি গ্রুপকে কোম্পানির শেয়ারের দামে এবং আর্থিক হিসেব নিকেশে কারচুপির জন্য অভিযুক্ত করে । এই অভিযোগ নিয়ে তোলপাড় হয় ভারতের রাজনীতি। যদিও স্বাভাবিক নিয়মেই আদানি গোষ্ঠী সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছিল, বর্তমান সময়ে তীব্র গতিতে ধাবমান ভারতীয় অর্থনীতির গতিরোধ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ। আদানির বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই মোদী-শাহ সরকার কারচুপির অভিযোগকে ভারতের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের উপর আন্তর্জাতিক চক্রের আঘাত বলে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টকে চিহ্নিত করেছিল। ।গোটা বিষয়টাকে ধামাচাপা দিতে সরকার দায়িত্ব দেয় শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (সেবি) কে। বিরোধীরা সুপ্রিম কোর্টে যায় আদালতের নজরদারিতে আদানি কেলেঙ্কারির তদন্তের দাবি নিয়ে। বিরোধীদের বক্তব্য ছিল শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সেবি , একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করার জন্য যথেষ্ট যোগ্য বা স্বাধীন নয়। সুপ্রিম কোর্ট তদন্তের জন্য ২০২৩ সালের মার্চে বিচারপতি বিচারপতি অভয় মনোহর সাপ্রের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে। মে মাসে সুপ্রিম কোর্টের সেই কমিটি তার রিপোর্টে বলে, হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের কোনো সারবত্তা নেই। আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার কারচুপির তদন্তে শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সেবি-র ব্যর্থতার কোনও প্রমাণ নেই। বেশ কয়েকবার শুনানির পর চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট আদানি গোষ্ঠী এবং সেবি-এর পক্ষে রায় দিয়ে, তদন্ত অন্য তদন্তকারী সংস্থায় স্থানান্তর করার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। আদালত হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টটিকে অবিশ্বস্ত বলে মনে করেছে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্য, এর (হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট) উদ্দেশ্য ছিল বাছাই করা বিকৃত তথ্যের মাধ্যমে শেয়ার বাজারকে প্রভাবিত করা । সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং হিন্ডেনবার্গের অভিযোগগুলির ক্ষেত্রে সেবি-র কোনও পদক্ষেপ না থাকায় বিষয়টি সার্বজনিক আলোচনা থেকে হারিয়ে যেতে থাকে।
তবে হারিয়ে যেতে দিলোনা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ। সুপ্রিম কোর্ট যার উপর আস্থা রেখে আদালতের নজরদারিতে আদানি কেলেঙ্কারির তদন্তের দাবি খারিজ করে দিয়েছিলো, এবার সেই সেবির চেয়ারপার্সন মাধবী পুরি বুচ এবং তার স্বামী ধবল বুচকে অভিযুক্ত করেছে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ। আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বার্থের সংঘাত তৈরি হয়েছে। হুইসেলব্লোয়ার নথির উদ্ধৃতি দিয়ে, হিন্ডেনবার্গ বলেছে যে সেবি চেয়ারম্যান মাধবী বুচ এবং তার স্বামী ধবল বুচের আদানি অর্থ অপব্যবহার কেলেঙ্কারিতে ব্যবহৃত বিদেশী তহবিলে অংশীদারিত্ব রয়েছে। ১০ এবং ১১ আগস্ট দু'দফায় হিন্ডেনবার্গ এই অভিযোগ এনেছে। সেই অভিযোগের বিস্তারিত বিশ্লেষণে যাবার আগে অফশোর ফান্ড বা বিদেশী তহবিলের বিষয়টা একটু বুঝে নেওয়ার দরকার। বিভিন্ন ছোট দেশ বা দ্বীপ রাষ্ট্র, অঞ্চল কর ফাঁকি দেবার জন্য সার্বিক পরিষেবা প্রদান করে। এই সব দেশ, দ্বীপপুঞ্জ বা অঞ্চল 'ট্যাক্স হেভেন' নামে পরিচিত। এই ট্যাক্স হেভেনে বিদেশী ব্যক্তি এবং ব্যবসার জন্য অনুকূল করের শর্ত প্রদান করা হয়। এখানে সাধারণত কম বা শূন্য কর্পোরেট ট্যাক্স রেট, নম্র নিয়ন্ত্রক পরিবেশ এবং দৃঢ় গোপনীয়তা আইন অফার করা হয়। অর্থাৎ যারা এই পরিষেবাগুলি ব্যবহার করবে তাদের পরিচয় আইনের মাধ্যমে গোপন রাখা হয়। সিঙ্গাপুর, পানামা, কেইম্যান দ্বীপপুঞ্জ, বারমুডা, লুক্সেমবার্গ, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, আইল অফ ম্যান, বাহামা, মরিশাস এবং সুইজারল্যান্ড সবচেয়ে সুপরিচিত ট্যাক্স হেভেন। বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক পলিসি এবং অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক ফরাসি অর্থনীতিবিদ গ্যাব্রিয়েল জুকম্যানের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ৮.৭ ট্রিলিয়ন ডলারের আর্থিক সম্পদ এই সব ট্যাক্স হেভেনে রাখা হয়েছিল।টাকার এই পরিমান বিশ্বব্যাপী জিডিপির প্রায় ১০% । অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) অনুমান করে যে বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলি দ্বারা কর ফাঁকি দেওয়ার কারণে সরকারগুলির বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার থেকে ২৪০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়। এটি বিশ্বব্যাপী কর্পোরেট আয়কর রাজস্বের ৪-১০% এর সমতুল্য। ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্কের ২০২০ সালের একটি প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়েছে যে কর্পোরেট ট্যাক্স কারচুপি এবং ট্যাক্স হেভেনগুলির সাহায্যে ব্যক্তিগত কর ফাঁকির কারণে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ৪২৭ বিলিয়ন ডলার ট্যাক্স রাজস্ব নষ্ট হয়।এই সব ট্যাক্স হেভেনে কোম্পানি খুলে কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়া চলে। কোম্পানিগুলির প্রতিষ্ঠিত মিউচুয়াল ফান্ড বা তহবিলে নানা ঘুরপথে জমা হয় কালো টাকা। সেই টাকা আবার বিদেশী বিনিয়োগ হয়ে ফিরে যায় নানা দেশে।
মরিশাসে রেজিস্ট্রিকৃত এরকমই একটি তহবিল "আইপিই প্লাস ফান্ড", যা ফান্ড ম্যানেজমেন্ট সংস্থা ইন্ডিয়া ইনফোলাইন (আইআইএফএল, বর্তমানে যার নাম '৩৬০ ওয়ান') এর মাধ্যমে আদানি গোষ্ঠীর একজন ডিরেক্টর অনিল আহুজা দ্বারা তৈরী করা হয়েছিল। জার্মান কোম্পানি ওয়্যারকার্ড-এর অভিযোগের ভিত্তিতে এই আইআইএফএল-এর বিরুদ্ধে জালিয়াতির মামলা চলছে লন্ডনের আদালতে। সে অন্য কাহিনী। আমরা ফিরে আসি হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে বলা হয়েছে, শিল্পপতি গৌতম আদানির ভাই বিনোদ আদানি "আইপিই প্লাস ফান্ড" ব্যবহার করতেন ভারতীয় বাজারে বিনিয়োগের জন্য। আদানি গোষ্ঠীর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলির জন্য আমদানি করা সরঞ্জামের ওভার ইনভয়েসিং করে সংগৃহীত টাকা জমা করা হতো "আইপিই প্লাস ফান্ড"-এ। এখানে আরও একটি ফান্ডের কথা জেনে রাখা প্রয়োজন। ২০০৩ সালে বারমুডায় প্রতিষ্ঠিত অ্যাপেক্স ফান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড। এরা একটা ফান্ড পরিচালনা করে, যার নাম "গ্লোবাল অপারচুনিটিজ ফান্ড বা জিওএফ । এই ফান্ডের আর একটি উপ-সংস্করণ আছে, তার নাম গ্লোবাল ডাইনামিক অপারচুনিটিজ ফান্ড। ব্রিটিশ সংবাদপত্র ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের একটি পৃথক তদন্তে দেখা গেছে যে বারমুডা-ভিত্তিক গ্লোবাল অপারচুনিটিজ ফান্ড, আদানি সহযোগীরা "আদানি গ্রুপের শেয়ারে বড় অংশ সংগ্রহ ও বাণিজ্য করতে" ব্যবহার করেছিল। বিনোদ আদানি মালিকানাধীন আদানি ট্রান্সমিশন (ইন্ডিয়া) লিমিটেড (এটিআইএল) বিনিয়োগ করেছিল গ্লোবাল ডাইনামিক অপারচুনিটিজ ফান্ডে। সেখান থেকে আবার এটিআইএল-এর টাকা বিনিয়োগ করা হয় মরিশাসের আইপিই প্লাস ফান্ডে।হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের সাম্প্রতিক রিপোর্টে অভিযোগ করা হয়েছে শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (সেবি) চেয়ারপার্সন মাধবী পুরি বুচ এবং তার স্বামী ধবল বুচ-এরও বিনিয়োগ আছে আইপিই প্লাস ফান্ডে। হিন্ডেনবার্গের উদ্ধৃত নথি অনুসারে, 'মাধবী বুচ এবং তার স্বামী ধবল বুচ প্রথম সিঙ্গাপুরে আইপিই প্লাস ফান্ড 1-এ তাদের অ্যাকাউন্ট খোলেন ৫ জুন, ২০১৫ তে।' হিন্ডেনবার্গ বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছে, 'মূলধারায় হাজার হাজার সম্মানজনক ভারতীয় মিউচুয়াল ফান্ডের অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও, বুচ দম্পতি বহু-স্তরযুক্ত বিদেশী তহবিলে বিনিয়োগ করলেন এমন একটি সংস্থার তত্ত্বাবধানে, যাদের বিরুদ্ধে ওয়্যারকার্ড কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ১০ আগস্ট হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট প্রকাশের পরেই ১১ আগস্ট মাধবী বুচ এবং ধবল বুচ যৌথ বিবৃতি দিয়ে অনৈতিকতার অভিযোগ খণ্ডন করলেও,বিতর্কিত বিদেশী তহবিলে বিনিয়োগের অভিযোগ অস্বীকার করতে পারেননি বুচ দম্পতি।
হিন্ডেনবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে হুইসেলব্লোয়ার এর কাছ থেকে প্রাপ্ত নথি অনুসারে, সেবি প্রধান হিসাবে বুচের নিয়োগের দুই সপ্তাহ আগে, মাধবীর স্বামী ধবল বুচ মরিশাস-ভিত্তিক তহবিল প্রশাসক ট্রাইডেন্ট ট্রাস্ট কে চিঠি লিখেছিলেন। এই ইমেলটি তার এবং তার স্ত্রীর গ্লোবাল ডায়নামিক অপারচুনিটিজ ফান্ডে বিনিয়োগ সংক্রান্ত। তার চিঠিতে, ধবল তাকে অ্যাকাউন্ট পরিচালনার একমাত্র অনুমোদিত ব্যক্তি করার অনুরোধ করেছিলেন। ৬ মে, ২০২৩ তারিখে সুপ্রিম কোর্টের বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে আদানির বিদেশী শেয়ারহোল্ডারদের তহবিল সরবরাহকারীদের বিষয়ে তদন্তে সেবি 'কোন ফলাফল দেয়নি'। বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট উল্লেখ করে হিন্ডেনবার্গ বলেছে, "এটা আশ্চর্যজনক মনে করি না, কারণ সেবি এমন একটি তদন্ত করতে অনিচ্ছুক ছিল যার এক প্রান্ত তার নিজের চেয়ারম্যানের সাথে যুক্ত ছিল।" হিন্ডেনবার্গ অভিযোগ করেছে যে এপ্রিল ২০১৭ থেকে মার্চ ২০২২ পর্যন্ত, 'যখন মাধবী বুচ সেবি -তে পূর্ণ সময়ের সদস্য এবং চেয়ারপারসন ছিলেন, তিনি সিঙ্গাপুরে রেজিস্ট্রিকৃত 'আগোরা পার্টনারস' নামে একটি পরামর্শক সংস্থার ১০০% শেয়ারের মালিক ছিলেন এবং ১৬ মার্চ, ২০২২-এ সেবি চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগের কয়েক সপ্তাহ পর, তিনি নীরবে তার শেয়ার স্বামীর কাছে হস্তান্তর করেন।' হিন্ডেনবার্গ আরও অভিযোগ করেছে যে, মাধবী বুচ বর্তমানে আগোরা অ্যাডভাইজরি নামে একটি ভারতীয় পরামর্শক সংস্থায় ৯৯% অংশীদারিত্বের অধিকারী, যেখানে তার স্বামী একজন ডিরেক্টর এবং এই সংস্থাটি ২০১৯ এবং ২০২৪ এর মধ্যে সক্রিয়ল এবং সেবি -তে পুরো সময়ের সদস্য থাকাকালীন তিনি ৩.৬৩ কোটি টাকা আয় করেছিলেন।যা সেবি-তে তার ঘোষিত বেতনের ৪.৪ গুণ।' এখানেই শেষ নয়।
সেবি-এর পূর্ণ সময়ের সদস্য হিসাবে মাধবী বুচের মেয়াদকালে ব্ল্যাকস্টোনের উপদেষ্টা হিসাবে ধবল বুচের নিয়োগ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে হিন্ডেনবার্গ। অভিযোগ হল যে, মাধবী বুচের প্রকাশ্য বিবৃতি যে তিনি রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট (আর ই আই টি) কে সমর্থন করেন তা ব্ল্যাকস্টোনকে উল্লেখযোগ্যভাবে উপকৃত করেছে।বিভিন্ন শিল্প সম্মেলনে সেবি চেয়ারপার্সন মাধবী বুচ আরইআইটি কে তার "ভবিষ্যতের জন্য প্রিয় পণ্য" হিসাবে উল্লেখ করেছেন এবং বিনিয়োগকারীদের স্থাবর সম্পদে বিনিয়োগের প্রতি "ইতিবাচক" দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। ব্ল্যাকস্টোন, আরইআইটি -এর বৃহত্তম বিনিয়োগকারী এবং স্পনসরদের মধ্যে একজন। আর ই আই টি'র অন্তর্ভুক্ত দুটি সংস্থা মাইন্ডস্পেস এবং নেক্সাস সিলেক্ট ট্রাস্ট যাতে আইপিও'র মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহের জন্য সেবির প্রয়োজনীয় অনুমোদন পায় সেজন্য তাদের স্পনসর করেছিল ব্ল্যাকস্টোন।নিউ ইয়র্ক স্থিত ব্ল্যাকস্টোন ইনকর্পোরেটেড একটি আমেরিকান বিকল্প বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি।গোটা বিশ্ব জুড়ে বাণিজ্যিক রিয়েল এস্টেট (মল, অফিস বিল্ডিং,সুপার মার্কেট ) বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনায় অন্যতম শীর্ষ কোম্পানি। জুলাই, ২০১৯ থেকে ধবল বুচ ব্ল্যাকস্টোনের সিনিয়র উপদেষ্টা।উল্লেখযোগ্য যে, ধবল বুচ এর 'লিঙ্কডইন' প্রোফাইল অনুসারে তিনি আগে রিয়েল এস্টেট বা পুঁজিবাজারে তহবিলের জন্য কাজ করেননি।এইসব ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার অভাব থাকা সত্ত্বেও, একটি বৈশ্বিক প্রাইভেট ইক্যুইটি ফার্ম এবং ভারতে বড় বিনিয়োগকারী ব্ল্যাকস্টোন-এ "সিনিয়র উপদেষ্টা" হিসাবে যোগদান করেন।ব্ল্যাকস্টোনের উপদেষ্টা হিসাবে ধবল বুচের সময়, সেবি আরইআইটি-কে নিয়মাবলী পরিবর্তনের প্রস্তাব, অনুমোদন এবং সুবিধা দিয়েছে।এর মধ্যে রয়েছে ৭ টি পরামর্শপত্র, ৩ টি একত্রিত আপডেট, ২ টি নতুন নিয়ন্ত্রক কাঠামো এবং ইউনিটগুলির পরিচালন বোর্ডে মনোনয়নের অধিকার, ব্ল্যাকস্টোনের মতো প্রাইভেট ইক্যুইটি ফার্মগুলিকে বিশেষভাবে উপকৃত করা।
আদানি গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কযুক্ত বিতর্কিত ট্যাক্স হেভেনে রেজিস্ট্রিকৃত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মাধবী বুচের বিনিয়োগ, সেবি চেয়ারপার্সন হিসাবে তার অফিসিয়াল ভূমিকার সাথে স্বার্থের একটি অত্যন্ত গুরুতর দ্বন্দ্ব উপস্থাপন করে। শেয়ার বাজার বা পুঁজি বাজারে প্রতারণামূলক এবং অন্যায্য বাণিজ্য অনুশীলনের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য সেবি বাধ্যতামূলকভাবে, বাজারের অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য, বাজারের হেরফের থেকে বিনিয়োগকারীদের রক্ষা করার জন্য তদন্ত এবং সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দায়বদ্ধ।হিন্ডেনবার্গের অভিযোগগুলি সেবি-এর নিরপেক্ষতা, এর প্রাতিষ্ঠানিক সততা এবং অবাধ ও ন্যায্য কর্পোরেট শাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এটির ভূমিকা নিয়ে খুব গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করে।সেবি চেয়ারপার্সন প্রাইভেট ইকুইটি ফার্ম, ব্ল্যাকস্টোন-এর পক্ষে প্রচার করছিলেন, যেখানে তার স্বামী একটি উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। মাধবী বুচ খোলাখুলিভাবে এই ট্রাস্টগুলির পক্ষে বিনিয়োগ তৈরির জন্য প্রচার চালিয়েছিলেন এবং অবশ্যই, এটি একটি নিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রক হিসাবে তার ভূমিকাকে লঙ্ঘন করেছিল।নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত 'ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্সিয়াল 'ল রিভিউ' জার্নালে ৬ মার্চ, ২০২৩-এ এক সাক্ষাৎকারে মাধবী বুচ দাবি করেছিলেন যে, "দুই দশক ধরে প্রাইভেট সেক্টরের অংশ হওয়ার কারণে (সেবি) নিয়ন্ত্রকের জন্য যা কিছু জানা প্রয়োজন তা সবই আমি জানতাম।আমি এটাও জানতাম যে ব্যক্তিগত সেক্টরের সমস্ত কঙ্কাল কোথায় লুকানো ছিল, তাই মনে হয়েছিল যে আমি সত্যিই ( সেবির পূর্ণ সময়ের সদস্য এবং চেয়ারপার্সন হিসেবে) একটি পার্থক্য করতে পারি, এবং এটিই আমি উপভোগ করব।" ঐ সাক্ষাৎকারের ১৭ মাসের মধ্যেই হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট জনসাধারণের কাছে নিয়ে এসেছে মাধবী এবং তার স্বামী ধবল বুচের অস্বচ্ছ বিদেশী তহবিলে আর্থিক অংশীদারিত্বের আকারে তার নিজের কথিত "লুকানো কঙ্কাল"। যে "লুকানো কঙ্কাল" সম্পর্কে মাধবী সেবি-র চেয়ারপার্সন হওয়ার আগে সচেতন ছিলেন, তা এখন তার আলমারিতে পাওয়া গেছে বলে হিন্ডেনবার্গের অভিযোগ।সুপ্রিম কোর্ট বলেছে যে আদানির বিদেশী শেয়ারহোল্ডারদের কে অর্থায়ন করেছে সে বিষয়ে তদন্তে সেবি "কিছুই পায়নি।" আসলে সেবি যদি সত্যিই অফশোর ফান্ড হোল্ডারদের খুঁজে পেতে চায়, তাহলে সম্ভবত সেবি চেয়ারপার্সন কে আয়নায় তাকিয়ে তদন্ত শুরু করতে হবে।সেবি এমন একটি পথ অনুসরণ করতে অনিচ্ছুক ছিল, যে তদন্তের একটি গতি ধারা তদন্তকারীদের নিজের চেয়ারপার্সনের দিকে নিয়ে যেতে পারতো।আজ পর্যন্ত, সেবি ইন্ডিয়া ইনফোলাইন দ্বারা পরিচালিত সন্দেহভাজন আদানি শেয়ারহোল্ডারদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সেবিকে আদানি বিষয়ে একটি বস্তুনিষ্ঠ নিয়ন্ত্রক বা তদন্তকারী ভূমিকায় বিশ্বাস করা যায়না।
ট্যাক্স হেভেন এবং বিকৃত পুঁজিবাদ (ক্রনি ক্যাপিটালিজম) গভীরভাবে একে অপরের সঙ্গে জড়িত এমন একটি বিষয় যা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ন্যায্যতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। বিকৃত পুঁজিবাদ ধনীদের কর ফাঁকি দিতে এবং সরকারী নীতি কে প্রভাবিত করতে উৎসাহ দেয়, যা ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং ন্যায্য প্রতিযোগিতার নীতিগুলিকে দুর্বল করে। গত ১০ বছরে ভারতে বিকৃত পুঁজিবাদের অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটছে। তাই বিনা বাধায় আদানি গোষ্ঠীর সম্পদের পরিমান রকেট গতিতে মহাকাশে পৌঁছে যায় । গৌতম আদানির মোট সম্পদ ২০১৪ সালে (যখন এনডিএ ক্ষমতায় আসে) ৪.৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২০ সালে ১১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয় এবং তারপরে ২০২১ সালে নাটকীয়ভাবে ৭৬ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়ে বিস্ময়করভাবে ২০২২ সালে তা ১৫০ বিলিয়ন ডলার পৌঁছে যায় । অর্থনৈতিক পূর্বাভাসের সমস্ত যৌক্তিক তত্ত্বকে অস্বীকার করে একটি পরিবারের এই বিপুল বৃদ্ধি নিয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি কোনো প্রশ্ন তোলেনি। ২০২২- এর ফেব্রুয়ারিতে সেবি'র প্রধান হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর মাধবী পুরি বুচ কে অভিনন্দন জানাতে যাওয়া প্রথম উচ্চ-প্রোফাইল কর্পোরেট ব্যক্তি ছিলেন গৌতম আদানি। সেবি-তে পূর্ণ সময়ের বোর্ড সদস্য হওয়ার দু'বছর আগে মাধবী বুচ এমন একটি বিদেশী অস্বচ্ছ তহবিলে অর্থ বিনিয়োগ করলেন, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে শেয়ার বাজারে আদানি গোষ্ঠীর কারচুপির অভিযোগ। বুচ দম্পতি অর্থ বিনিয়োগের জন্য এমন একজন বন্ধু খুঁজে পেলেন যিনি আদানি এন্টারপ্রাইজের অন্যতম ডিরেক্টর অনিল আহুজা।সবটাই কি কাকতালীয় ? হিন্ডেনবার্গের তোলা কোনো প্রশ্নেরই জবাব পাওয়া যায়নি সরকার বা সেবির থেকে, সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও।২০২২ সালে, বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলির বাজার মূলধন বৃদ্ধির ৮০% -ই মাত্র ৭ টি আদানি গ্রুপ কোম্পানির। শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সেবি কর্মকর্তাদের মনে এই উদ্ভট, অযৌক্তিক বৃদ্ধি নিয়ে সন্দেহ উঁকিঝুঁকি মারেনি। কারণ মন এবং মেরুদন্ড, দুটোই বন্ধক রাখা আছে মোদী সরকার এবং তাদের স্নেহভাজন দু, তিনজন শিল্পপতির কাছে। শাসক দল বিজেপি স্বাভাবিক পদক্ষেপে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট খারিজ করে আদানি গোষ্ঠী, সেবি চেয়ারপার্সন কে রাখা করতে ময়দানে নেমে পড়েছে। দলের মুখপাত্র রবিশঙ্কর প্রসাদ হিন্ডেনবার্গ এর কোনো প্রশ্নের সদুত্তর না দিয়ে আক্রমণ করেছেন হাঙ্গেরিয়ান-আমেরিকান ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী এবং সমাজসেবী জর্জ সোরোস এবং লোকসভায় বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীকে। অভিযোগ করেছেন, মার্কিন সংস্থার রিপোর্ট দেশের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের উপর হিন্ডেনবার্গ-জর্জ সোরোস-রাহুল গান্ধীর মিলিত ষড়যন্ত্রমূলক আক্রমণ। আসলে এসবই বিকৃত পুঁজিবাদের উপাদান। এখানে শাসক ও নির্দিষ্ট দু-তিনজন শিল্পপতি অশুভ আঁতাত গড়ে দেশটাকে লুঠ করে সম্পদের পর্বত তৈরী করবে, আর সেই লুঠেরাদের চিহ্নিত করলেই জাতীয়তাবাদের বর্ম, সার্বভৌমত্বের তরোয়াল নিয়ে ময়দানে নেমে পড়বেন রবিশঙ্কর প্রসাদের মত নেতারা।
( এই নিবন্ধের জন্য যে পত্র-পত্রিকা, পোর্টাল, জার্নালের সাহায্য নেওয়া হয়েছে : দ্য ওয়্যার, ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্সিয়াল 'ল রিভিউ, লাইভমিন্ট, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড)