পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

হকার সরাতে বুলডোজার?: অপারেশন সানশাইন ২.০!!

  • 04 July, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 777 view(s)
  • লিখেছেন : বহ্নিহোত্রী হাজরা
অপারেশন সানশাইন বিরোধী আন্দোলনের কালজয়ী নেতৃত্বও আজকের এই উচ্ছেদ নিয়ে নিঃশর্ত ভাবে হকারদের পাশে নেই। কেন? দাবার চালে অন্য খেলায় কি মগ্ন তাঁরা? অপারেশন সানশাইনের সময় আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া বুলু পোদ্দারের কথা কি তাঁরা ভুলে গেছেন? তাঁরা কি ভুলে গেছেন লকডাউনের সময় কীভাবে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন এই শহরেরই তিন হকার।

আপনার-আমার ব্যবহারের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য, খাদ্য, পানীয়, সাবান, প্রসাধনী এবং ঘরের টুকিটাকি জিনিসপত্রের ছোট ছোট উৎপাদন এবং বিপণন ব্যবস্থা এ দেশে গড়ে উঠেছে বহু বহু বছর ধরে। জয়নগরের মোয়া, মাদুপুরের মাদুর, ফুলিয়ার তাঁত, গামছা বা কাশ্মীরের শাল ফেরিওয়ালার কাঁধে চেপে পৌঁছে যায় গ্রামের হাটে, শহরতলির বাজারে বা হকারদের হাত ধরে ব্যস্ত শহরের ফুটপাথে বা রেলে-স্টেশনে ক্রেতাদের হাতে গিয়ে ওঠে। বিশ্বায়নের যুগে আমরা বেশীরভাগ মধ্যবিত্তরা এই ব্যবস্থার কথা প্রায় ভুলতে বসেছি। শপিং মল থেকে বা ঘরে বসে অর্ডার করে যাঁরা কর্পোরেটের পণ্য কিনে থাকেন তাঁদের কাছে এ আরেক ভারতবর্ষ। সেই আরেক ভারতবর্ষের ওপর আজ আঘাত নেমে আসলে আপনি-আমি কি নিশ্চিন্তে বাতানুকূল শপিং মলের শাইনিং পরিবেশে বসে পাশ কাটিয়ে যাব, বলব বেশ হয়েছে? নাকি ভাবতে হবে, যে সমান্তরাল দেশ-তার অর্থনীতি সত্যিই কিভাবে দিনের পর দিন আমাদের সকলকে বাঁচিয়ে রেখেছে- তাদের উচ্ছেদ করে, কার জন্য এই উন্নয়ন?    

আজ তৃণমূল সরকারের পুলিশ যখন হকারদের উচ্ছেদ করতে রাস্তায় নামল শহর সৌন্দর্যায়নের নামে, তখন আবারও প্রশ্নগুলো উঠল- এ শহর কার? শহরের ফুটপাথ কার? রাস্তা কি শুধু বাবুদের মোটরগাড়ি চলার জন্য? মনে পড়ে ৯৬-এ হকার উচ্ছেদের প্রোগ্রামের নাম দেওয়া হয়েছিল 'অপারেশন সানশাইন'-অর্থাৎ হকারদের উপস্থিতিই ছিল সরকারের চোখে-কর্পোরেট বাবুদের চোখে অন্ধকারময়। বিশ্বের তাবড় তাবড় কর্পোরেটদের নিয়ে আসা প্ল্যানডেমিক আর লকডাউন পরবর্তী সময়ে একদিকে দেখা যাচ্ছে আরো বিপুল সংখ্যক মানুষ এই পেশার ওপর নির্ভরশীল হয়েছেন। আজ এবং আগামীদিনেও এই নির্ভরশীলতা বাড়তেই থাকবে, আর একদিকে উন্নয়নের নাম করে আবারো তাদের ওপরই নামিয়ে আনা হচ্ছে খাঁড়ার ঘা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের বাইরে ফুটপাথ এবং স্টেশন সংলগ্ন রাস্তায় হকারদের সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখা গেল, চূড়ান্ত আতঙ্কের পরিবেশ, পসরা সাজিয়ে বসতে ভয় পাচ্ছেন অনেকেই। তাঁরা মুখে চোখে আতঙ্ক নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন চত্বরে, কার সাথে কথা বললে সুরাহা মিলতে পারে তাই নিয়ে অনেকেই দিশেহারা। আগামী দিনে পেট চলবে কি করে প্রশ্ন করছেন হকার বন্ধুরা সকলেই। বিগত প্রায় ৪০ বছর বারুইপুর থেকে যাদবপুর এসে ফল বিক্রি করেন মৃত্যুঞ্জয়। তিনি বললেন ৩ দিন আগে ৩০-৪০ জনকে তাঁর চোখের সামনে থেকে থানায় তুলে নিয়ে যায়, টাকা নিয়ে পরে পুলিশ ছেড়ে দেয়। তাঁর দাঁড়িপাল্লাও তুলে নিয়ে যায় ওরা। যাদবপুর ৪ নম্বর গেটের পাশে রামকৃষ্ণ দাসের খাবারের স্টল। তাঁকে পুলিশ ভ্যানে তুলে নিয়ে যায়। সেদিনের তাঁর রান্না করা খাবার সবটাই নষ্ট হয়। তিনি প্রশ্ন করেন-"যে ভ্যানে চোর-ডাকাত অপরাধীদের তোলা হয়, সেখানে আমায় তোলা হবেই বা কেন? আমার অপরাধ কোথায়? আমি হকারি করি সেটাই কি আমার অপরাধ? মুখ্যমন্ত্রী মিডিয়ার সামনে এক কথা বলছেন, এদিকে পুলিশ বলছে ওপরওয়ালার নির্দেশ আছে তুলে নিয়ে যাবার, তাহলে কার কথা বিশ্বাস করব? এক দিনে আমার যে বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হতে হল, তার দায় কার?"  

যাদবপুর ১ নম্বর গেটের উল্টোদিকে জামা কাপড় বিক্রি করেন হকার দেবী হালদার। তিনি স্পষ্ট জানালেন তাঁদের ক্ষোভের কথা- তাঁদের পাশে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক দল যে দাঁড়ায়নি, বরং মিটিং ভরানোর জন্য তাঁদের দিনের পর দিন ব্যবহার করেছে তাও বললেন তিনি। এভাবেই আতঙ্ক অসহায়তা ঘিরে রয়েছে তাঁদের। ঐক্যবদ্ধ হবার চেষ্টাও তাঁরা করছেন, যদিও এখনও আশায় বুক বাঁধার মতো কোনও শক্তির সন্ধান পান নি তাঁরা। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে খোঁজা দরকার তাঁদের জোরের জায়গা। ক্রমাগত তাঁদের কোনায় ঠেলার এই প্রক্রিয়া কাদের স্বার্থে তাও বোঝা দরকার। তাই কর্পোরেট বাজার অর্থনীতির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এই সামগ্রিক বিকেন্দ্রিভুত উৎপাদন এবং বিক্রির ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু আলোচনা বোধহয় জরুরি।

আজও ছোট উৎপাদন, হকারি সহ বিকেন্দ্রীভূত উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে কম করে হলেও বাংলায় ৬০ লক্ষ বা তারও বেশি মানুষ যা কমবেশি জনসংখ্যার ৬%। এই বিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা, প্রতিদিন ৮০ কোটি টাকার টার্নওভার সহ একটি সমান্তরাল অর্থনীতি। অধ্যাপক অরুণ কুমার একটা হিসেব দিয়েছেন যে আজ দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্র ৯৪% কর্মশক্তি নিযুক্ত করে এবং ৪৫% উৎপাদন করে। এর মধ্যে ৪৮% মানুষ অকৃষি অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন এবং জিডিপিতে তার ৩০% ভূমিকা থাকে। এই ৪৮ % যারা কৃষির বাইরে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন তাদের মধ্যে হকার বন্ধুরা আছেন অনেকটা অংশ জুড়ে। এর থেকেই পরিষ্কার যে বিশাল ভিড় জমেছে অসংগঠিত কাজের ক্ষেত্রে। প্রায় ১১ কোটি মানুষের ভিড় সেখানে। আর তাঁদের পরিবারে জনপ্রতি ৪ জন করে ধরলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৪৪ কোটিতে। কমবেশি করে যদি ৫০ কোটিই ধরে নেওয়া যায়, তাহলে অসংগঠিত পরিষেবা ক্ষেত্র এই বিশাল জনসংখ্যাকে রোজগার দিচ্ছে। এবার বলবো পথ হকার আর ফুটপাথের ধারের ছোট দোকানদারের কথা। ভারতের বিভিন্ন শহর মিলিয়ে এদের সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। এরা হলেন শহুরে কর্মীবাহিনীর ১৫ শতাংশ। চমকে যাওয়ার বিষয় হল কৃষির পরই ভারতের বৃহত্তম কাজের জায়গা হল শহরের এই ফুটপাথ।

তথাকথিত আধুনিক ঝাঁ চকচকে 'বিশ্বায়নী' ভদ্রলোকেদের শহুরে চোখে রাস্তার ধারের হকারদের জীবন-জীবিকার সংগ্রাম মানেই নোংরা, কেউ বলছেন জবরদখল। বাবুদের ড্রয়িংরুম থেকে মিডিয়ার সরগরম আলোচনার আসরে একই সুর। তাই বারে বারেই শহর সাজাতে  'অপারেশন সানশাইন' প্রকল্প ফিরে ফিরে আসে। সেই ১৯৯৬ সালের কথা আগেও বলেছি। তখন হকার উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। বেশ কিছু জায়গায় বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল হকারদের স্টল। তবে অতটা সহজ হয় না বিষয়টা। একজোট হয়েছিলেন হকাররা। সংহতি জানিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সেদিন ছাত্র-ছাত্রী বুদ্ধিজীবিদের একাংশও, নাগরিক উদ্যোগ এবং অধিকার রক্ষার সংগঠনগুলোও। জোরদার আন্দোলন করে উচ্ছেদকে রুখে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল সেদিন। হকার আন্দোলনের সাফল্যে গড়ে উঠেছিল উচ্ছেদ বিরোধী যুক্ত মঞ্চ। এই উচ্ছেদের রূপরেখা কেবল '৯৬-এই আসে তা কিন্তু নয়। ১৯৫২ সালে বিধান রায়ের আমলেও মিউনিসিপালিটি বলে- "রাস্তা কেবল পথচারীদের"; ফলে হকার উচ্ছেদের নোটিশ ঝোলে। এর পরে ১৯৭৫ সালে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের আমলেও কিন্তু হকার উচ্ছেদের এই ধারাবাহিকতাই বজায় থাকে। আজ একদিকে রাস্তায় হকার উচ্ছেদে নেমেছে বুলডোজার আর ওদিকে রেল হকারদের ওপর আর পি এফের নির্যাতন আর কর্পোরেটদের দাপাদাপি বেড়েই চলেছে। কদিন আগেই একজন হকারকে চলন্ত ট্রেন থেকে ঠেলে ফেলে খুন করেছে আর পি এফ। তবে একতরফা অত্যাচার নয়। প্রতিবাদও কিন্তু হচ্ছে। এই সমস্ত অন্যায়ের জবাব দিয়ে বাংলার মাটিতে উচ্ছেদ বিরোধী লড়াই বারে বারেই চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে এই উন্নয়নের মিথকে। হকারদের সংগঠিত আইনি লড়াইয়ের একটি বড় সাফল্য ২০১৪ সালে পাশ হওয়া "Street Vendors (Protection of livelihood and regulation of street vending) Act of 2004. এই আইন হকারদের লাইসেন্স দিয়ে তাদের এক ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক ছাঁচে নিয়ে আসল। তবে কর্পোরেট আগ্রাসনের অক্টোপাসকে এভাবে আদৌ রোখা গেল কী?  এই আইন নিয়েও বেশ কিছু প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। বার বার বলা হচ্ছে আইন মোতাবেক টাউন ভেন্ডর কমিটির নির্দেশিত হকাররা বাদে নতুন হকার বসতে পারবে না। যেখানে ডিমনিটাইজেশন-জি এস টি এবং লকডাউন- এই তিন ধাপ কর্পোরেট আক্রমণের পর মানুষের রুটি-রুজি-জীবিকার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব ধাক্কা নেমে এসেছে, কোটি কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা করার দায়টুকু সব সরকারই ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে, সেখানে দাঁড়িয়ে আরও বহু মানুষ আগামীদিনেও এই পেশায় আসছেন এবং আসতে পারেন। যাঁরা এই আইনকেই চাওয়া-পাওয়ার সর্বোচ্চ শিখর হিসেবে দেখছেন তারা এই নতুন হকারদের ওপর উচ্ছেদ হলে কি আন্দোলনে রাস্তায় নামবেন না?

২০০০ সালের পর থেকেই সব সরকারই ক্রমাগত সওয়াল করেছে খুচরো ব্যবসায় বিদেশী বিনিয়োগকে সম্পূর্ণ ছাড় দেওয়ার জন্য। প্রায় ৪ কোটি মানুষকে খাদের কিনারে ঠেলে দিতে পারে এই পলিসি। গত কয়েক বছরে খুচরা ব্যবসার ক্ষেত্রে এফডিআই নিয়মগুলি সহজ করে সরকার স্পষ্টতই তাদের লক্ষ্য পূরণের দিকেই এগিয়েছে। ধারাবাহিক প্রতিরোধের মুখে আইন করে আনতে না পারলেও ইতিমধ্যে বহু কর্পোরেট রাঘববোয়ালরা ঢুকে পড়েছে খুচরো বাজারে। আই টি সি বা রিলায়েন্স রিটেল খুচরো ব্যবসায় ঢুকে পড়ায় ৩০% মতো লোকসান হয়েছে হকারদের। দেশকে লুঠ করার অস্ত্র এই প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ। আর লুঠের পথ মসৃণ করতেই ডিমোনিটাইজেশন- জি এস টি এবং লকডাউনের মতো আঘাত। বহু ছোট ব্যবসায়ীর ব্যবসা লাটে উঠে গেল। ডিজিটালাইজেশনের জোয়ার, প্রতিযোগিতা থেকে ক্রমাগত দূরে ঠেলছে হকারদের। রাস্তার ফুড হকারদের থেকে খাবার না নিয়ে 'করোনার' ভয়ে যবুথবু হয়ে ঘরে বসে থাকা ভদ্রলোকেরা সুইগি/জমাটো থেকে খাবার অর্ডার করছেন। অথচ রাস্তার খাবার কিন্তু যথেষ্ট স্বাস্থ্যকর। এ প্রসঙ্গে একটা সার্ভে রিপোর্টের কথা বরং উল্লেখ করি। ১৯৯৩-৯৪ সালে ইন্দিরা চক্রবর্তী ইউ এন ডি পির পক্ষ থেকে একটা সার্ভে রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন যেখানে তথ্য প্রমাণ সহ দেখিয়েছিলেন স্ট্রিট ফুড অনেক বড় বড় পাঁচতারা রেস্তরাঁর চেয়েও বেশী স্বাস্থ্য সম্মত।এদিকে লকডাউনের সময় শুধু রান্না করা খাবারই নয় শাক-সবজি সহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসও অনেকে কিনতে শুরু করেছিল রিলায়েন্স, বিগ বাস্কেট ইত্যাদি থেকে। এবার তাহলে ছোট ছোট দোকানদারের চলবে কি করে?

অথচ আমাদের দেশের সরকার সমস্ত ক্ষেত্রেই দেখা যায় ছাড় দিচ্ছে কর্পোরেটদের। ফুটপাথ দখল করে শপিং মলের গাড়ি বারান্দা হলে কেউ আপত্তি জানায় না। প্রায় বিনামূল্যে জমি, বিদ্যুৎ, কর ছাড় ইত্যাদি যখন বড় সংস্থাকে দেওয়া হয় এই ধরণের মল, মাল্টিপ্লেক্স বানানোর জন্য তখন কেউ প্রশ্ন তোলে না। দ্রুত নগরায়ণ, ডিজিটাইজেশন এবং মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার পরিবর্তন খুচরা ব্যবসার ক্ষেত্রকে একটি বড় পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যা ২০২০ সালের মধ্যে ৬০% বৃদ্ধি পেয়ে ১.১ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর অনুমান করা হয়েছে। এদিকে সরকারও ক্রমাগত ঠেলছে ডিজিটাইজেশনের দিকেই। একদিকে ডিজিটাল কেনাকেটা আর আরেকদিকে শপিং মল কেন্দ্রিক সংকৃতির প্রসার- এই দ্বিফলা আগ্রাসন আজ আর শুধু দিল্লি- কোলকাতা-বোম্বের মতো বড় মেট্রোপলিটন শহরেই নেই, বরং শহরতলীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।  ২০০০ সালের  গোড়ার দিকে সমগ্র দেশে মাত্র তিনটি মল ছিল। ধীরে ধীরে ছাতার মতো গজিয়ে উঠতে লাগল শপিং মল ছোট ছোট শহরেও। ই-কমার্সের বাড়বাড়ন্ত এবং এত ধাক্কার পরেও টিকে থাকা বিকেন্দ্রিভুত অর্থনীতির বিশ্বস্ত বাজার থাকায় মল গুলো কার্যত ক্রেতাহীন বা খুবই কম ক্রেতা নিয়ে চলছে। তবু তাঁরা একটি সম্মিলিত পরিবেশ তৈরি করে এক কর্পোরেট সংকৃতিকে প্রোমট করে চলেছে, যেখানে এই অন্য আবেদনের জন্য এলিট শ্রেণীর মানুষের আনাগোনা। প্রতি ৫ জনের মধ্যে ৪ জনই ক্রেতা নয়, তবু টিকে থাকল এই সংকৃতি, বা টিকিয়ে রাখা হল। আর এই শাইনিং বিনোদনের সংস্কৃতিকে গড়ে তুলতে রাষ্ট্র সর্বদাই বদ্ধপরিকর। তাই শপিং মল হোক বা ই- কমার্স সংস্থা- তাদের জন্য সরকার নানা ছাড়ের ব্যবস্থা রেখেছে। রাষ্ট্র, কর্পোরেট নির্ভর বলেই, কর্পোরেটরা আজ লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা কর বকেয়া রাখে। বকেয়া সহজে মকুবও হয় প্রগতির দোহাই দিয়ে। শিল্পপতি নামক লুঠেরারা ব্যাঙ্কের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা মেরে ইওরোপ আমেরিকা আফ্রিকায় পালিয়ে যায় রাষ্ট্র পোষিত নানান রক্ষা কবচকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে। আজকের মতো ধনি দরিদ্রের বৈষম্য আগে কখনও ছিল না এই দেশে। মাত্র ২১৫টা পরিবার, বিদেশী পুঁজি আর দেশি আমলা-নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে জোট বেঁধে দেশের সমস্ত সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে। লকডাউনের সময়ে কোটি কোটি মানুষ নিজেদের জীবন জীবিকা হারিয়েছেন, ঠিক সেই সময়টাতেই এই লোকগুলো আমজনতার রক্ত চুষে সরকারের সহযোগিতায় প্রতিদিন নিজেরা রোজগার করেছে ৫৫০০ কোটি টাকা। আর এই কর্পোরেটদের স্বার্থে নির্মিত শাইনিং ইন্ডিয়া  মডেলে তাই জায়গা নেই অন্ধকারের প্রতিরূপ হকারদের। ভদ্রলোকেদের মোটরগাড়ি চড়ার জন্যই তো রাস্তা, আর তাদের মনোরঞ্জনের জন্য ঝাঁ চকচকে পেভমেন্ট- আবর্জনাদের অবিলম্বে মুছে ফেলতে হবে- এই কড়া নির্দেশ তাই এল সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের কাছ থেকে যারা এত কাল দাবী করছিলেন তারা খেটে খাওয়া মানুষের সরকার, ছোট-ক্ষুদ্র পুঁজির সরকার। ভুলে গেলে চলবে না, উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলনের হাত ধরে মসনদে চড়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অপারেশন সানশাইন বিরোধী আন্দোলনে যিনি হকারদের পাশে ছিলেন জ্বালাময়ী বিরোধী নেত্রী হিসেবে সেই তিনিই যদি আজ গরীব মানুষের পেটে লাথি মারেন তাহলে কিন্তু ইতিহাস তাঁকেও ক্ষমা করবে  না। শুধু তিনিই নন অপারেশন সানশাইন বিরোধী আন্দোলনের কালজয়ী নেতৃত্বও আজকের এই উচ্ছেদ নিয়ে নিঃশর্ত ভাবে হকারদের পাশে নেই। কেন? দাবার চালে অন্য খেলায় কি মগ্ন তাঁরা? অপারেশন সানশাইনের সময় আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া বুলু পোদ্দারের কথা কি তাঁরা ভুলে গেছেন? তাঁরা কি ভুলে গেছেন লকডাউনের সময় কীভাবে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন এই শহরেরই তিন হকার। যখন আজ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যুযুধান দুই পক্ষ - একদিনে কর্পোরেট আগ্রাসনের অক্টপাসের শুঁড় আর আরেকদিকে হকার-ছোট দোকান- ছোট উৎপাদক-কারিগরদের দাঁতে দাঁত চিপে হার না মানা লড়াই; তখন কোনও এক পক্ষ তো বেছে নিতেই হয়। এখন আপনারা ঠিক করুন কোন দিক বেছে নেবেন? 

 

 

 

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment