এই পর্যন্ত বলে থেমে গেলাম –কথা এগোলো না। আমার কথাগুলো যেনো আমার গলায়ই ঢুকতে চায় কিন্তু ঠোঁটবন্ধ। স্তব্ধতা কাটিয়ে হাওয়া নড়েচড়ে ওঠে- মেয়েটি নীরব।একবার আমার দিকে তাকিয়ে সে পথ হাঁটতে থাকলে আমিও বিপরীতে চলে গেলাম।
এক-দুদিন পরেই তার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হলে সে কাছে এসে বললো- এখন তো করোনা-মাখা হওয়া বাত্যাস। কতু না জুয়ায় ভালো। কুনুদিন সুবাই হককথা কইলে যেউ না হয়।
মেয়েটির মুখে একথা শুনে ঠায় দাঁড়িয়ে গেলাম। প্রশ্ন করলাম আপনি কি আমাকে বলছেন? এ প্রশ্নে সে উত্তর দিলো না। একটু কাছে এসে বললো-তুমার উড়নিট লাকে বেঁন্দেলাও কেনে। গাঁয়ের লোকে খেরাপ বলব্যে জি। চারিদিকের হাওয়া-বাত্যাস খেরাপ হুয়ে গেছে।
সে আমাকে চোখের ইশারায় বললো-চ্যোখের পাতনি খসে তুমার গালে লেগ্যে আছে। বেজায় আমুদে মেয়ে তুমি। গাল থেকে উটোকে ছাড়িন লাও কেনে। ছাড়িনে উটোকে তলহাতে লিয়ে তিনকুল পড়ে ফুঁক দাও। মুনেমুনে খুদাকে কও। মুনের বাস্যোনা সব পিঁয়ে যাবে। লোকে খেরাপ কইতেই থাকে। সে তুমি ভালোকাজ-ই করো আর খেরাপ কাজই করো।
কথাগুলো একটা ছন্দে বলে যায়। কথা বলে তারপর কিছুক্ষণ থেমে যায়। কারো প্রত্যুত্তরের আশা না করেই নিজের অভিব্যক্তি ব্যঞ্জনা করে। আচ্ছা যাও যিতা যেচ্ছিলে। আচ্চা শুনো-তুমি ছুটুতে মহজিদ যেলছিলে কুনুদিন? মুকতবে পড়তে উস্তাজির কাচে? যাওনি তাআলি! না জুয়ারই কতা বটে। তাআলি ‘কুল’ বুজব্যে কি করে? মাকে বল্যো শিক্যিন দিব্যে-“কুলহুল্লাহু আহাদ” অইটো পড়ে ফুঁক দিয়ো।
তার কথা বোঝার উপায় নেই। হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছি।কি বলছে কিছুই বুঝি না। এক গো-লে কাদাপথ ধরে চলে যাচ্ছি। পিছন থেকে সেই মেয়েটি একটু উঁচুস্বরে বলল-প্যাছু ডেকা খেরাপ। ই-কথা লোকে কই। আমি বলি না।
তুমি এতো আনাড়্যি কেনে? কাদা ম্যাখতে ম্যাখতে কুলি হাঁটছ্যো! তুমার ছামুতে কত্যো লুক চল্যে যেলছে, ঢলঢলে কাদার অপর যে পাওঠ্যি পড়েছে। পাওঠ্যিতে পাওঠ্যিতে পা ফেলিনে যেইয়ো কেনে।
পিছনের ডাক শুনে আমি পিছন না ফিরে অবিচল থাকি ক্ষণকাল। তার সব কথা শুনে আবার চলতে থাকি।
আমার প্রতিদিনের পথ ল-পুকুরের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া কৃষিখামারে। আমাদের বাড়িটি গ্রামের শেষে। গ্রামের শুরু দক্ষিণপূর্ব দিক থেকে। গ্রামের প্রবেশ পথ ওই ভাবে গিয়ে মানুষের যে-যার ঘরে সে পথকে ঢুকিয়ে রেখেছে। করোনাকাল পরিযায়ী-শ্রমিকের সঙ্গে আমার খুব একটা ফারাক নেই। আমাকেও চলে যেতে হয় গ্রামের বাইরে। যদিও গ্রামের আর পাঁচটা মানুষের মতো গ্রামে থেকে গেলেই পারতাম কিন্তু পারিনি। চলে যায় বাইরে কিসের টানে! কিসের মোহে জানি না! তবে এবারে গ্রামে এসে আটকে গেছি। বেশভূষা আরো পাঁচটা মানুষের মতোই। তবে পাঁচটা মেয়েদের মতো না। কাজের সুবাদে পায়জামা পরি তবে গ্রামসমাজ যেমন ডিজাইন দেয় সেই রকম না। যেটা পরলে কাজ করতে সুবিধা হয় আবার সে পাজামা পরে আরাম হয় এমন পোশাকই পরি। কুর্তাতে কোনো উলুরিঝুলুরি নেই, দোপাট্টা বা উড়ুনি খুবই ছোটো। মাথায় বাঁধার জন্য রোদের প্রকোপ থেকে মাথা বাঁচাতে। মাথায় কখনো কখনো গামছাও থাকে। খালি-পা মশ-মশ করে হেঁটে চলে আসি। কখনো কখনো সাইকেলটা আমার সঙ্গী হয়।
রাস্তার মোড় ঘুরতে অথবা ইঁদারার পাড়ে দোকানের দাওয়ায় বা পুকুরের ঘাটে কোন পুরুষ কি চোখে তাকায়। কোন পুরুষের সবে বেড়েওঠা পুরুষ-বাচ্চা-পাবজি খেলতে খেলতে নোংরাশব্দ ঝরায় –বলে- মার মার মার শালীকে। সে-সবে ভ্রুক্ষেপ করি না। মাঝে মাঝে তাদের বুলি থেকে দোজোকের আঙ্গার ছুটে আসে আমাকে পোড়াতে।কি আশ্চর্য! সে আগুন আমাকে দেখেই নিভে যায়। তাতে ওই লোকদের আরো গোসা হয়। ওরা সশব্দে থুতু ফেলে বলে-“ফিনারে জাহান্নামা খালেদিনা ফিহা। (যাহারা কুফরি করে তারা স্থায়ী ভাবে জাহান্নামের আগুনে বাস করেবে,ইহারা সৃষ্টির অধম)।”
এই সমস্ত শব্দে আত্মতুষ্টি করতে করতে তারা নারী বিদ্বেষের কীর্তন করে এবং সেই কীর্তনের আমিই একমাত্র জ্বালানি। সে উত্তাপ ঘরে ঘরে গোপনে জেগে থাকে। তাতে আমার কিবা আসে কিবা যায়। ওই একই ভাবে গ্রামকে এফোঁড় ওফোঁড় করে সেলাই করতে করতে যায় আর আসি নিত্যদিন নিরন্তর।
আরে আমিতো ভুলেই গেছি সেই একা-নারীর কথা। যাকে কেউ পছন্দ করে না। যাকে একঘরে করে দিয়েছে গ্রামের মানুষ। না না গ্রামের মানুষ তাকে ওই ভাবে রাখে নি। বলা যেতে পারে সে নিজেকে লুকিয়ে নিয়েছে। এমন বেকায়দার সময়ে পড়েছি! কাজ নেই উপার্জন নেই বাইরে যাবো তার বাহন নেই। ভাবছিলাম ঘোড়াটাকে ফিরিয়ে আনি ওই বাহনটাই এখন বড়ো কাজে দেবে। হলে কি হবে!আমার মামা সেই যে ঘোড়া মরে যাবার শোকে মুহ্যমান হয়েছিলো সেই ঘোড়া আর আনতে দেবে না। এমনিতেই আমার কাজের জন্য আমাদের পরিবার নাকি ফুলসুরাতের ব্রিজে ঝুলছে তার উপরে ঘোড়া কিনলে সে ব্রীজ ভেঙে এক্কেবারে আগুনের শ্রোতে গোবাং। তারপর এক অদ্ভুত প্লাস্টিকের মতো আকাঁড়া চেহারা নিয়ে বেঁচেই থাকবে।যাকগে সে কথা বরং আপনাদের সেই একাবুড়ির ছবি দেখায়। এখন আমি এসেছি আমার এক মামীর খালাতো ভায়ের বাড়িতে। তারা খুব খাতির করছে আমাকে,কেনো কি জানি! তারা হয়তো বা ওই শব্দ জানে না আমার সম্পর্কে “ফিনারে জাহান্নামা –।”
যাইহোক ভালোই হয়েছে আমাকে ওরা গাজর আলুভর্তা ভরা নানরুটি খাইয়ে গেছে। একমগ দুধ দিয়েছে সব খেয়েছি। এখন ওরা আমাকে খাওয়াবে রোষ্টেট দেশিমুরগি-পোলাও। মুরগীর পেটের ভিতরে নাড়িভুড়ি বের করে চটোইমুখি খোসবু চালের পোলাও ভরে তার পেট সেলাই করে আস্ত মুরগিটাকে দগদগে আগুনে রোস্ট করবে সেটা আমার পাতে আসবে।ভাবছি কেমন হবে সেটা! মনে মনে ভাবতেই মগজ সুগন্ধে ম-ম করে উঠলো।নার্ভ গুলো কিলবিল করে উঠোলো-আর যাইহোক সেকাজ করতে ঢের সময় লাগবে। মামীও তার খালাতো ভাই ভাবীদের সঙ্গে মহিত হয়ে আছে।
জানি আপনারা অপেক্ষায় আছেন একাবুড়ির গল্প শুনবেন বলে- ইস দেরি করেদিলাম তাই না!আহা! আর একটু ধৈর্য ধরুন।হ্যাঁ আমি এই ফাঁকে বলি সেই গল্প। এই যে আপনারা যদি এদিক-ওদিক দেখেন তাহলে গল্প বলে কি হবে?আমি তো কিছু বলছি না কি!ওদিকে আপনারা কি ভেবে উদাস হচ্ছেন? এই এক রোগ ভালো মানুষদের। হাতে মোবাইল আছে কাছের মানুষের সঙ্গে বিছড়্গেয়ি আওর সে কোন অচীনপুরের বন্ধুর সঙ্গে গুলতানি আর কোন্দোল চালাচ্ছে। ওহে – আমার হাসি পাচ্ছে – যায় হোক আপনারা হাত তুললেন গল্প শুনবেন বলে – কবরস্থানের পাশদিয়ে যখন হেঁটে যায় দেখি আসলেই এখি সেই সব ফেরেস্তারা আমার চারপাশে উঁকিঝুকি মারে।মৌতেরা পথ আগলে দাঁড়ায় আর বলে “আমাদের জন্য তোমরা কি করছো? কি এনেছো?”
বিশ্বাস করো আমি সব দেখতে পাই -সব শুনতে পাই ওদের চলাফেরা ওদের আহ্বান।আমি বলি-চাষ করতে যাচ্ছি।ওরা বলে-কিছু গাছ আর কিছু পাখিদের বাসা-কিছু ফুলের চারা আর শিশুদের হাসা-গিঁঠে বেঁধে রেখো। আমরা এখন মাটি হয়ে আছি গো! এখন সকলের আঘাত সহ্য করতেই হবে- এখন মাটি হয়ে গেছি!
এসব শুনে মাথা বিগড়ে যায়।ভাবি এইতো কয়দিন আগে আমাকে বলেছিলে ফিনারে জাহান্নামা--! কিন্তু কবর ভূমি হয়ে ওরা আমার কথার উত্তর দেয় না। ভাই একটা জীবন পেয়েছি উপোভোগ করতে দাও। ভয় দেখিও না দোজখের। কিছু কাজ করতে দাও লোভ দেখিয়ো না জান্নাতের হুরপরীদের!
দয়া করে হাসবেন না-হাসবেন না। আমি তা বলতে চাইনে – আমি সেই তার কথা বলছি।
জানেন-একদিন তার বাড়ি গেলাম। সে আমাকে বলল-তুমি পড়া ল্যাখা অনেক করেছো। কত কিতাব পড়্যেছো। তা বলি তুমি মাতার চ্যুল অমনি করে কেটে দাও কেনে? তুমি কি কতু ধরা পড়্যেছিলে কুছু চুরিটুরি কত্তে যেইয়ে?
শুনুন কথা! আমি হাবিব থেকে চুল কেটে চুলের ডিজাইন করেছি রীতিমত দাম দিয়ে আর সে বলে কিনা ধরা পড়েছি! হাসছেন! হাসিরই কথা বটে বৈকি!
আমি তার মাথার দিকে তাকিয়ে তাকেই প্রশ্ন করি-তা তুমি কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছো কেনো মাথা? তোমার চুল তো দেখতে পাই না। তুমিকি পর্দা করেছো?
মেয়েটি নীরব -কিছু বলে না। সে পুদিনাপাতা বেঁটে তাতে মধু ঢেলে এক গ্লাস শরবৎ বানিয়ে আমার দিকে এগিয়ে বলে-আমি ত্যো তুমার মতুনি ভ্যালতে জান্যে না?আমার ঘরে কেহুই এসেন্যি কুনুদ্যিন। কেহুই ই-কতা শুনতে চাইন্যি কুনুদ্যিন। তা তুম্যার সাউস দ্যাখ্যে আমি একজেরা ঠাওরায়তে শিকল্যাম। বল্যি কি একেলা বাঁচতে আরো এনেক মাগীরা শিকচ্যে তাআলি?
একটু জিরিয়ে নেয়। আমি তার দেওয়া শরবৎ পান করি। সে গ্লাসটা নেবার জন্য হাত বাড়ায়। গ্লাস হাতে নিয়ে বলে-আমি তো নেকা পরি কত্তে পেরেনি। আম্যার সগুলি আচ্যে, ভাই- ভাইপো, বুন-বুঞ্জি তা উয়োরা আমাকে বড্ডো ঢেসিনে ঢেসিনে কত্যা কয়। আমার ঘরে এসেন্যা তারা কুনুদিন! দুক্ষু কলিজাতে সেলের পারা বেন্দে।
লজ্জা পেলাম তাকে এমন ভাবে তাকে আঘাত করে। ভাবছি এ কেমন মেয়ে! যার বাড়িতে এসে বসলাম আর অমনি সে আমাকে বলল চুরিটুরি করে ধরা পড়েছি কি না?না আমিতো চুরি করিনি! করলেও ধরা পড়িনি। তাহলে!
বয়সের ভার তার হয়নি সে ঝুঁকেও পড়েনি। তবে কেনো সে এমন গুঁড়িগুঁড়ি হাঁটে! মনের মধ্যে প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। যাই হোক আপনারা ধৈর্য ধরুন অপেক্ষা করুন। আর একটু পরেই ফেরেস্তারা আসবে সে মেয়ের চারি দিকে। আমার মুখোমুখি বসে বললো-আমি এই ফাঁকা মাঠের হওয়া-বাত্যাসে থাকি। আম্যার দেহের হাড়ে ঘুণপোকা নাই। আমি আঙ্গুল দিয়ে কাদা-মাটি মাখ্যি আমার আঙ্গুলের নুখে কুণ্যি নাই। হাত আমার সগসুময়ে ঝকঝকে।
যা বাবাঃ! এসব তো সকলেই করে। তবে সে এমন ঠাই ঠাই কথা বলে কেনো! কথা গুলো যেনো এক একটা মাটির চাঁই।যেন আমাকে ঢিল মেরেই যাচ্ছে। আমি কালবিলম্ব না করে বললাম-আপনার বাড়িতে এলাম কিছু শিখবো বলে-তা আপনি এমন প্রশ্ন করলেন আমাকে!
একথা শুনে তার গাল ঝুলে গেলো-ঠোঁট দুটো জোড়া লাগিয়ে নাক বরাবর তুলে মাথার ঘোমটা ফেলেদিয়ে বললো-দেখ্যো কেনে আমার মাতায় কত চ্যুল।
তাকিয়ে দেখি লম্বা লম্বা চুল আলোক লতার মতো হলদেটে হয়ে মাটিতে লুটাতে যায়। তাতে ছেঁড়াছেঁড়া রতিরতি ন্যাকড়া জড়ানো। চুলে এতো জট! দেখে মনে হয় বুঝি অজন্তা ইলোরার গুহা ঢেকে রেখেছে। আলোকলতা স্বর্ণলতার জঞ্জাল সরালেই দেখা যাবে সে অপূর্ব চিত্র তারকার আকাশ।
প্রশ্নরা সভাবের স্রোতে সাঁতার দেয়।সহসা মুখতুলে জানতে চাই-আচ্ছা আপনি চুল আঁচড়ান না কেনো?
সে উত্তর না দিয়ে বলে -তুমি চ্যুল বাড়িন লাও না কেনে? যেনত্যান নারী-দাঁতে ক্যেশে শিরি। চ্যুল বাড়াও বাড়াও।
আমি তার ভাবনায় অঙ্কুর হতে দিই না।প্রশ্ন করি আপনি চ্যুল বাঁধেন না, আঁচড়ান না অমন জীর্ণ ন্যাকড়ায় জড়িয়ে রেখেছেন মনে হচ্ছে যেনো তামাকের পাতা। কেনো কি হয়েছে আপনার?
মেয়েটি তার ময়লা কাপড় মাথায় ঢেকে নিয়ে বলে,মানুষকে লিজের কুনু দোষ খুলে দেখাইতে নাইখো।দিহাটের লককে বল্যে দিব্বে। হতমান করে! শুন্যো আমি তুমাখে কুছু বল্যচি না-খো। তবে কি জ্যানো তুমার হতে আমি এনেক বয়িসে বড়ো-মুরুব্বি হুয়ে যেলছি।দুটো ছেঁচা-খপ্পর বল্যোবো তুমাখে।শুনতে হব্যে।
ঘাড় হিলিয়ে বললাম-আচ্ছা বলুন। শুনবো বলেই তো এলাম।
সেই বললো-তখুন আমি সবে খাঁকু-পিন্দা বালিক্যা। বে হোয়ে ছ্যেলো বাঁন্দের পাড়ের মড়োলদের বাড়িতে। প্যাট্যে কোঁখে বাল্বাচ্চ্যা দ্যেয়নি উপরুয়ালা।
লাচার হুয়ে চল্যে আস্যা আমার ছ্যেলো নাখো। মাটিকে শান্তি দিতে হয়। তাই লিজেকে ভালোব্যেসে চলে এলাম। জানের ভ্যাঁতর আশ্যা এনেক।সবে কান পেতেছি-কি শুনছি সে এতো বড়োলোক ঘরের বৌ ! আরো কিছু ভাবতে শুরু করেছি অমনি উল্টো কথা- তুমিকি লাশ-লোউয়ায়তে জান্যো?
তার এমন প্রশ্ন শুনে শরীর শিউরে উঠলো।লাশের স্নান! মানে লাশ নাওয়ানো! না না না না। কেমন কথা বলেন!এই বললেন মনে আশা অনেক আবার এখুনি বলছেন লাশের স্নান!
একলা নারী হেসে গড়িয়ে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে খি খি করে হেসেই যাচ্ছে।
মনে মনে ভাবি ধুত্তেরিকা কার মাঝে এলাম। আস্ত পাগোল!
হাসি থামিয়ে বলল-ওরে পাগলী এক দিন চল্যে যাত্যেই হব্যে।তাই বেশি না ডুবে খালি পানির অপরে ভেসে ভেসে মাঝে মাঝে থেকে সব জেনে লিলেই হবে।আসলে তুখে দেখে আমার ভারি চিন্তা হয়!
আমি আধীর হয়ে উঠলাম-আমাকে নিয়ে তার চিন্তা কিসের! আমিতো তাকে নিয়েই ভাবি।একলা নারী! সে কি ভাবে বাঁচে! এখন জানতে পারলাম-সে নাকি আমাকে নিয়ে ভাবে!এ কথা শুনে যৌবনের জৈলুসর তরঙ্গ এলোমেলো হয়ে গেলো। পাল্টা প্রশ্ন করে কিছু লাভ নেই। ফালতু ভাবনা। যাইহোক যাইহোক করেও এড়াতে পারলাম না সেই প্রশ্ন।
আমাকে নিয়ে তোমার কিসের ভাবনা? কেনো তোমার রাতের ঘুম ভেঙে যায় বারবার? এ কি ভাবনার কথা তুমি ভাবো গো?
ঠাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে-অপলক চাওনি তার। ভ্রু বেঁকে বেঁকে জোঁকের মতো নড়ে ওঠে। একি! তার কপালের রেখাগুলো সূচ-সুতো হয়ে কপাল সেলাই করে যেনো। আমি বেশিক্ষণ তার চোখে চোখ রাখতে পারলাম না। তার চোখে যেনো একটা সরু চুল-রেখা হয়ে উত্তাপ বয়ে এনে আমার চোখের তারায় ঝলকায়। কিছুক্ষণ চোখবুজে থেকে বলি-কি দেখছো অমন করে? আগে তো শুনলাম আমার জন্য ভাবনায় তোমার ঘুম আসে না নাকি!
একলা নারী উত্তর দেয়-তুমি হাম্বুড়ি জানো?
না জানি না। এসব শব্দ আমাদের পড়ার বইএ দেখিনি। কেনো? বলো হাম্বুড়ি নিয়ে তুমি কি করবে? হাম্বুড়ির মানে কি?
ও-মা! সেকি করলো জানো? মুখটাকে আকাশের দিকে তাকিয়ে একডাব মেঘ হাতে নিয়ে মুখে ভরে তার কি হাসি! সারা দাঁতে মেঘের গুঁড়ো লেগে সূর্যের আলোয় ঝিকিয়ে উঠেছে দাঁতের সারি। তার দাঁতের বাঁধন বিন্যস্ত সাদা বেলফুলের মতো সাদা,মেঘসাদা দাঁত সাদা কতই না কারুকার্য!ওয়াও! মেঘ এমনি করে ধরা যায় বুঝি!কতো বড়ো তার হাত!
আসলে তা না। সে এমনই ভান করলে আমার দেখে তাই মনে হলো। আমি আবার প্রশ্ন করলাম-হাম্বুড়িকি?
ঠোঁট দুটো বিড়ির টান মারার মতো টাইট করে বললো-সব রেওয়াজ কি পড়ার কিতাবে থাকে গো! কি উদোঃ মেয়ে তুমি!
খুব রাগ হয়। একলা নারীর এসব কথা শুনে। আমাকে কী না বলে যাচ্ছে! কখনো ধরা পড়া তো কখনো উদো কখনো কুলপড়া তো কখনো হাম্বুড়ি। ধুস! একে পাত্তাদিলে আরো কতো খারাপ কথা বলে ফেলবে।
মনেমনে রাগে গজগজ করছি। এগিয়ে যাবো এমন সময় সে বলে-পেছা ডেকা ভালো লয়। আমি বলি না ই কতা। লোকে বলে। তমু বলছি-বলি কি লাশ লুয়ায়লছো কুনুদিন?
লে বাবা! এবার লাশ এনে হাজির! আচ্ছা তোমার কি আর কোনো কথা নেই? খালি ভয়-খালি সতর্ক-মরার তালি মারো!
একলা নারী আবার থমকে যায়। কি করবো এটোইতো শিখেছি গো। আচ্ছা তুমি খুব গোসাদার মেয়ে বটো। যেও তাআলি এখুনে।পরে কথা হবে।
আপনারা কি কেউ জেগে আছেন? সাড়া শব্দ না দিলে বুঝবো কি করে? ওহো আমি তো এখন রেডিও হয়ে গেছি। আমাকে গল্প বলতে লাগিয়ে দিয়ে কে কোথায় চলে গেছে। কেউ কি আছো?
চারি দিক থেকে সাড়া এলো জোনাকির মতো। খুশিতে উথলে পড়লাম গল্প বলার জন্য। শোনো তাহলে সেই সব শব্দ সেই সব কুলহুল্লা সেই সব ফেরেস্তা এক দিন আমার পথ আগলে দাঁড়ালো। আমি বললাম ‘ফি নারে জাহান্নামা খালেদিনা ফিহা।’ সে সবে কাজ হলো না। অনেক জোরে ফুঁক দিলাম কাজ হলো না। ফেরেস্তারা আমার পথ আগলে বলে - চারিদিকে করোনাকাল-তুমি লুকিয়ে থেকে পারপাবে না। এখন তো কাজের সময় চলো লাশ পড়ে আছে তাকে গোসল দিতে হবে। আমার ঘুম ভেঙে গেছে এমন শব্দে। কতবার যে কুলহুল্লা পড়ে বুকে ফুঁক মারলাম, আর মনে মনে সেই একলা নারীকে খুঁজতে থাকলাম ডাকতে থাকলাম গুণগুণ করে। আমাকে অনেকটা খোয়াড়েভরা ছাগলের মতো আগলবাঁধ করতে করতে সোজা মরা ঘরে এনে দিলে দেখি সেই একলা নারী বসে বসে সাতটা কুলের পাতা তুলছে, সাতটা নিমের কাঠি নিচ্ছে সাতটা মাটির ছোট্ট টুকরা নিচ্ছে একটা সাল পাতা নিচ্ছে। কেনো গো এমন মরার জন্য তুমি এত গুনতি পাতা এতো গুণতি কাঠি গুণে গুণে কাজ?
একলা নারী আমাকে ইশারায় কাছে যেতে বললো। আমি গেলাম। আমি ভিতরে ঘেমে যাচ্ছি। আচ্ছা কেনো আমাকে ডেকে আনলে এখানে! কিছু বলতে পারছি না। আমার মুখে কথা নেই।
মেয়েরা মেয়েলাশ নাওয়াবে। এই নাওয়ানো কথাটা লোয়াবে হয়ে গেছে। মসজিদের মৌলোবি মাইকে হাঁক দিয়েছে জোহরের নামাজের পরে জানাজার নামজ এবং মাটি হবে মৌতের।
তাই এবারে লাশ ওঠানো হবে। দেখছি মেয়েরা কি দক্ষ একাজে! এক এক করে পরতে পরতে স্নান দিচ্ছে লাশের। বদনা ঘুরছে সাত নারীর কাছে কুল-তিন কুল পড়ে ফুঁক দিচ্ছে সে বদনার পানিতে। বাহ!সুন্দর-তো! এবার কাফন পরাচ্ছে।একজন বলে উঠোলো হাম্বুড়ি বাঁধো হাম্বুড়ি বাঁধো-হাসরের মাঠে হাম্বুড়িই নারীদের ইজ্জত বাঁচাবে। আশ্চর্য!হাম্বুড়ি কি!
দেখি নারী-লাশের মাথার পরিচ্ছন্ন চুল দু ভাগ করে কাঁধ বেয়ে বুকের উপরে বিছিয়ে দেয় জ্যান্ত নারীর হাত। মৃত নারীর কেশরাশি বুক ঢেকে- পেট থেকে তল পেট বেয়ে উরুর দিকে টনে নিয়ে যায় কল্পনার রংতুলিতে। লাশের স্নানরত মেয়েরা চঞ্চল হয়ে উঠলো-না না হল্যো না আরো নামবে তোমার আঙুল আরো একজেরা ডাইনে একটুকুনই বামে করে দাও-হাসরের মাঠের কথা ভেবে। সেদিন গাছও সরে যাবে আপনার ইজ্জত আপনি ঢাকবে চুলে। হাম্বুড়ি বাঁধো হাম্বুড়ি বাঁধায় ভুল করো না-ক্ষমা পাবে না হাসরের ময়দানে।
একি! যাদের ভাবতাম কিচ্ছু জানে না। আপন অঞ্চলের ভাষায় মুখরিত জীবন-সেই তারাই এতো শুদ্ধ ভাষায় এমন পরিচ্ছন্ন লেবাসে আতরের শিশি যেন! ভাবনায় ডুবে যাই-সেই সেদিনের একলা নারীর প্রশ্নে চুল কাট্যো কেনে? মৃতের স্নান দিয়েছো কুনুদিন! হাম্বুড়ি বাঁধতে জানো? কতই না প্রশ্ন করেছিলো-ভাবছি কেবল- একলা নারী লাশর সপ্তম কাফনি সেলাই বিহিন জামা পরিয়ে ছে, ঘুমন্ত চোখে সুরমার টান চোখ দুটোকে অদৃশ্যপূর্ব করে তুলেছে। সাদা কাফুনে পোশাক লাশকে মেঘময় করে তুলেছে-সকলেই পাঠ করতে থাকলো দুয়াদরুদ। খালাস দাও তবে এবার-নাকি তার কাছে চেয়ে নেবে খালাস! সকলের চোখ থেকে বৃষ্টির ফোটায় মৌতের ভ্রু থেকে ঝরে পড়ে লাওয়ানোর পানি। মৌতের মুখ ঢেকে একা নারী হুলিয়া গেয়ে উঠলে উপস্থিত কাপড় আড়াল করে শাড়ি ধরে থাকা সকল মেয়েরা গলা মেলালো
ধরণীর মা গো তুমি
ওপারেতে গেলে-
মরণের স্বাদ তুমি একাই মাখিলে
এই গোসল দিলাম তোমায় দরিয়ারো জলে
পাকসাপ করে দিলাম মা-মাটির কোলে
হাম্বুড়ি বেঁধে দিলাম চুলেরো তুমার
মাগো ফেরেস্তা করিবে সয়াল বার তিন বার
হাম্বুড়ি দেখে দেখে বুঝেলিবে সার
কপালে আছে মাগো জান্নাতো তুমার।
লাইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লা।
লাশ নিয়ে চলে গেলে মৃতদের আঙিনা যেন লাশের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা গিয়ে রাস্তা ব্যাঁক নিয়ে পুকুরে নেমে গেলো। আমি দাঁড়িয়ে আছি দেখি সেই একলা নারী হুলিয়া গাইতে গাইতে মাটিতে শুয়ে পড়েছে। তাকে ধরে তুলতেই আমিও উপুড় হয়ে পড়লাম মাটিতে। হাম্বুড়ি–হাম্বুড়ি কেনো কোথায় সেই হাম্বুড়ি? এমন শীতল অনুভূতি!অসাড় হয়ে পড়ে আছি!
কেনো এমন দেখলাম! এই একলা নারী কেনো আমার পিছনে পড়েছে! এই করোনার লকডাউনে আমি এক গ্রামে একপ্রকার বন্দি হয়ে আছি। সারা বেলা বিষণ্ণ মন!
পথে বেরিয়ে পড়েছি ভোরের ছেঁড়া আঁধার গুলো ভেসে আসে-ভেসে যায় আমার মুখ স্পর্শ করে। বিহান! কাকজুনুকির স্রোতে ভাসমান এমন অপূর্ব বিহান! চারিদিকে গরম ভাতের বাস্পের মতো উদ্বায়ী প্রভাত।আবাবিলদের ওড়া একসঙ্গে দূরে কোথাও আর এক আকশের তলে উড়ছে একটি গোটা একলা নারী এক মাথা হাম্বুড়ির চুল উড়ছে উড়ছে আকাশময়।
কভার ছবি রানা দে।