পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

আমাকে খুঁজে দে জলফড়িং

  • 13 November, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1648 view(s)
  • লিখেছেন : অনিন্দিতা দে
টার্গেটের সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে আর ইয়েতির মত বসটার লাল চোখ দেখে কোনোমতে রাতজাগা কফিময় সপ্তাহটা কাটলো। রবিবারের ক্যাবলা বিকেলটার মাদকতাই আলাদা,অনেকটা অবৈধ প্রেমিকের মত! অন্য সপ্তাহগুলোর মত ল্যাদ খেয়ে পড়ে না থেকে নিজেকে বললাম--"জাগো বাঙালী জাগো,কবে আর বাঁচতে শিখবে...." ইত্যাদি! গুগলদা আসার পর থেকে দিকশূন্যপুরে হারিয়ে যাওয়ার বিলাসিতা করা হয়নি অনেকদিন,তাই ফোনটাকে বাড়ি রেখে "দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া" গোছের একটা হাবভাব করে গলি খুঁজতে বেরিয়ে পড়লাম!

নাহ ! অলিগলির আঁকেবাঁকে চুমু খাওয়ার ইচ্ছে (পড়ুন সুযোগ) আমার একেবারেই নেই,আমি নিপাট সিঙ্গল,একদম স্লেট-পেন্সিলের মত সরল !
আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে,প্রত্যেকটা রাস্তার একটা নিজস্ব গল্প থাকে! ঝরাপাতার মানচিত্র দেখে, চায়ের দোকানীর কর্মব্যস্ততা দেখে, ভুলো কুকুরটার ঘুমোনোর ভঙ্গি দেখে, অভিমানী কৃষ্ণচূড়ার মুখ ফিরিয়ে নেওয়া দেখে সেই গল্পগুলোই খোঁজার চেষ্টা করি আমি !
তবে বলাই বাহুল্য,বাঙালীর হিউ-এন-সাঙ মোড বেশীক্ষণ স্থায়ী হয় না,বাঙালীর পরিব্রাজকতা ম্যালেরিয়া জ্বরের মতই, মানে মরশুমি আর কি !

রাস্তার মোড়ে আইসক্রিম পার্লারটা দেখে অনেক আগেই আমার হাঁটার গতি কমে গিয়েছিলো ! গতমাসেই দু-কেজি ওজন বেড়েছে,কিছুক্ষণ দোলাচলে থাকার পর "একটাই তো জীবন....ইত্যাদি" ভেবে ঢুকে পড়লাম! পার্লারের কাউন্টারে কেউ নেই। বারকয়েক 'এক্সকিউজ মি","কেউ আছেন" বলার পর দুজন উঁকি মারলেন! মহিলাটির অবিন্যস্ত চুল আর ঘেঁটে যাওয়া লিপস্টিক দেখে যা বোঝার বুঝলাম ! ইস, এমন সময়ে কেউ ডিসটার্ব করে!
-"বলুন ম্যাডাম?"
-"এই ফ্লেভারটা একটু টেস্ট করবো"
ইটালিয়ান বাটার-স্কচের দিকে ইশারা করলাম আমি।
-"অবশ্যই ম্যাডাম,এই নিন!"
চামচে বেলজিয়াম ডার্ক চকলেট এগিয়ে দিলো আমার দিকে!

মেয়েটা এই দুনিয়াতেই নেই,চোখে প্রেম প্ৰেম ঘোর, এই ঘোর লাগা চোখ আমার খুব চেনা,আয়নায় দেখেছি অনেকবার ! বেশী আর ঘাঁটালাম না,সিঙ্গল বলে অন্যের প্রেম দেখে হিংসুটেপনা করতে নেই! চুপচাপ চার স্কুপ বাটার-স্কচ অর্ডার দিয়ে বসে পড়লাম(আমার একার জন্যই)!

পার্লারের কাঁচের বাইরে তখন সূর্যাস্তের নরম আলো,গোধূলী বেলার ফাউন্ডেশনে খুব সুন্দর লাগছে আমার শহরকে,ছোট্ট লাল টিপের মত সূর্যটার ঘুম পেয়েছে, হাই তুলছে বেচারা!
মনটা উদাস হয়ে গেছিলো,"কিচ্ছু চাইনি আমি আজীবন ভালোবাসা ছাড়া" সবে দুকলি গেয়ে উঠেছিলাম,হঠাৎ পাশ থেকে কে বলে উঠলো-" এরম বেসুরো গলায় গাইলে ভালোবাসার আর দোষ কি!"
তাকিয়ে দেখি উজালার মত নীল রং,বাঁশি হাতে এক ভদ্রলোক!
-"একি কৃষ্ণদা, তুমি?"
কৃষ্ণ ততক্ষণে উল্টোদিকের চেয়ারে বসে দু-চামচ বাটার-স্কচ মুখে চালান করে বললো-"এজন্যেই তোর কিছু হয়নি,হবেও না!"
-"আমি কি করলাম আবার?"
-"সব মেয়ের আমি সখা,আর তুই কিনা আমাকে ব্রো-জোন করছিস!"
-"আরে বস, তুমি তো টি-টোয়েন্টি প্লেয়ার, আমি টেস্ট ম্যাচ প্লেয়ার চাই!"
-"ন্যাকামো যত"একটু মুখ বেঁকিয়ে কৃষ্ণদা বললো-"তা আগের বসন্তেও তুই বারিস্তায় বসে একা কফি খাচ্ছিলি না?"

দুটো বাচ্চা গোলাপ বিক্রির চেষ্টা করছে অনেকক্ষণ ধরে! কাপল দেখলেই মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে বলছে-"দিদি,দুটো ফুল নাও না!" জানে,প্রেমিকার আবদার ফেলবে না প্রেমিক,কি মারাত্মক ব্যবসায়ী বুদ্ধি এই বয়সেই ! প্রেমিকার চুলে ফুল আটকে দিতে থাকা প্রেমিককে আড়চোখে দেখতে দেখতে খানিক অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম, কৃষ্ণদা রেফারিদের মত বাঁশিটা হুইসেলের মত করে বাজিয়ে মুহূর্তের মধ্যে আমার ঘোর কাটিয়ে পান্তাভাত মার্কা বাস্তবের মাটিতে আবার নিয়ে এলো আমায়।

-"কিরে,মনটা কি মঙ্গলগ্রহে?"
-"কি? নানা,এই তো,বলো!"
-"আচ্ছা একটা কথা বল,ওই ডাক্তারটার সাথে ডেটে গেলি দুদিন,ওটার কি হল?"
-"বলে পথের পাঁচালী সত্যজিৎ রায়ের লেখা,এরপর আর সহ্য করা যায় বলো?"
-"বড় বড় মানুষের এসব ছোট ছোট ভুল হতেই পারে সেনোরিটা!"
-"ধুর, এইসব গাধাদের সাথে প্রেম করা যায় নাকি? বলে কিনা, যারা বেশী সাহিত্য পড়ে তারা নাকি আঁতেল হয় ! ইচ্ছে হচ্ছিল এক চড়ে কানটা কানপুরে পাঠিয়ে দি!"
-"নারায়ণের অবতারের সামনে বসে নারায়ণের কপি করতে লজ্জা করে না তোর? কিন্ত ভালো ছেলে ছিলো, মোটা প্যাকেজ, সুখে থাকতিস!"
-"আর তারপর সারাজীবন অর্গ্যাজম ফেক করতাম তাইতো? ভালো আর সুখ দুটোর সংজ্ঞাই যে বড্ড আপেক্ষিক কৃষ্ণদা !"
-"দাবিটা কি তোর?গাধা বলে কি প্রেমিক হওয়ার যোগ্যতা নেই?"
-"না নেই, একটুও নেই। দাবিটা হচ্ছে যে প্রেমিক এমন হবে যার সাথে কাফকা থেকে কালিদাস,বৈষ্ণব পদাবলী থেকে আফ্রিকান সাহিত্য, ফেলুদা থেকে নেরুদা সবকিছু আলোচনা করা যাবে....."
কৃষ্ণদা কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে রইলো আমার দিকে!
-"তুই সিঙ্গলই মরবি"
-"আমার দাবিটা কি ভুল? ডালে নুন কম হয়েছে কিনা আর ফ্যানে কতটা ধুলো জমেছে এছাড়া যদি আলোচনার টপিক না থাকে তাহলে তো মুশকিল!"
-"সংসার তো ডালভাত জীবনই"
-"উহু,ডালভাত পার্ট অফ সংসার,এগুলোও দরকার!"
-"নেরুদাকে ভুলে ডেরিদা পড়, আর নিজের ডিকনস্ট্রাকশন কর ,নইলে কেউ জুটবে না!"
-"মানেটা কি?"
-"নর্মাল হতে শেখ!"
-"নর্মাল হওয়ার সংজ্ঞা কি?"
-"একটা ঠিকঠাক ছেলে,স্টেবল জীবন,পার্লার-শপিং-রেস্তোরাঁ-গিফ্টস এসব নিয়ে খুশি থাক! কালিদাস চন্ডীদাস এত দাবি কেন জীবন থেকে?"
-" মানে বসন্ত উৎসবের দিন আবিরে ফুঁ দিয়ে ডিপি দেয় যারা ওদের মত ন্যাকা মামণি হতে হবে তাইতো? পারছিনা,সরি!"
-" সিঙ্গল মরবি,বেঘোরে মরবি!"
-"তোমার মত ওয়ো কালচারকে আপন করার থেকে একা মরা ভালো!"
-"খুব ক্লান্ত লাগে রে মাঝে মধ্যে, গল্পগুলো একই থাকে, শরীরগুলো শুধু পাল্টে যায়!"
-"সেইজন্য এরকম জনসংখ্যা বাড়ার মত একটা সন্ধ্যেবেলা তুমি আমার সাথে সময় নষ্ট করছো?"
-"না না, তুই তো স্পেশাল"
সবে একটু ব্লাশ করতে যাচ্ছি,তখনই কৃষ্ণদা বললো-" একদম মিউজিয়ামে রাখার মত!"
-"সেই তুমি আর ভালোবাসার কি বোঝো!"
কৃষ্ণ হাসে,যমুনার জলে এখনো লেগে আছে রাধার গন্ধ,সেই বৃষ্টি-ভেজা রাতের পাগলামী, রাধা কি কোনোদিনও ক্ষমা করেছিল ওকে?
-"ক্যাসানোভারাও ভালোবাসতে পারে রে!"

কৃষ্ণদার মুখে অনেকগুলো রঙ খেলা করতে থাকে! চোখে আনন্দ,না বিষাদ নাকি নস্টালজিয়া বুঝে উঠতে পারি না!

আবহাওয়া হাল্কা করার জন্য বলি-"আর একটু বাটার স্কচ খাবে?"
-"নাহ,তবে একটু স্কচ হলে মন্দ হয় না, খাবি?"
-"সঙ্গে চিকেন তন্দুরি ? হুম চলতেই পারে !"
-"আর যতদিন না তোর কেউ জুটছে ততদিন আমাকেই না হয় ব্যাক-আপ হিসেবে..."
-"ছাব্বিশ কোটি এক নম্বর হওয়ার কোন শখ নেই বস,চললাম আমি!"
-"আরে রাগছিস কেন!"
-"বন্ধু,তাও বেনিফিট ছাড়া,চলবে?"
মুখটাকে ডিমভাজার মত করে কৃষ্ণ বললো-"ঠিক আছে,দ্রৌপদীর পর তুই-ই নাহয় আমার দ্বিতীয় প্লেটোনিক সখী হলি ! তবে কালিদাস-কাফকা যাই কর,চণ্ডীদাস একদম না,ব্যাটা আমার আর রাধার প্রাইভেট মোমেন্টগুলো পাবলিক করে গেছে!"
-"তথাস্তু!"
-"তা তোর কাছে প্রেম মানে আর কি?"
-"এমন কেউ যাকে সব বলা যায়,ছোটবেলা, বড়বেলা,সব দুঃখ-কষ্ট-ভয়, অন্ধকার লেগে থাকা সিক্রেট যা আর কারোর সাথে শেয়ার করা যায় না... আবার রামায়ণ-মহাভারত-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম-ইথিওপিয়ায় মেয়েদের অবস্থান নিয়েও কথা বলা যায়...রাজনীতি নিয়ে তর্ক করা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা...যার সাথে নিয়ম ভাঙা যায়, মাঝরাতে হারিয়ে যাওয়া যায় পাহাড়ে বা জঙ্গলে, বা সমুদ্রের ধারে বসে বেসুরো গলায় গান গাওয়া যায়...."
-"ওহে,থাম থাম,আগে আমার সন্দেহ ছিলো, এখন নিশ্চিত হলাম..."
-"কি?"
-"তুই সিঙ্গল মরবি!"
-"উফফ,বাকি কথাগুলো তো শুনলেই না!"
-"কি? চুমু,আদর? সে তোর কথা শুনেই বুঝে গেছি তুই প্লেটোনিক লাভে বিশ্বাসী না!"
-"প্লেটোনিক লাভ চিনিছাড়া চায়ের মত,প্রেম হবে পাগলপারা-বাঁধনহারা..."
-"তুই জীবনে প্রচুর কষ্ট পাবি।"
হেসে বললাম-"জানি!"
-"যাকগে,চল অলিপাব যাওয়া যাক,ক্যাব বুক করি!"
-"তার আগে আমার একটা আবদার রাখবে?"
-"কি?"
-"একটু বাঁশি বাজিয়ে শোনাবে?"
কৃষ্ণদা ইমন রাগ বাজায়, বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে তখন! বৃষ্টি আর বাঁশির ককটেল,বাইরে নিয়ন আলোর আইশ্যাডোতে অভিমানী শহর,বড্ড মায়াবী লাগে সবকিছু,অনেকটা হারিয়ে যাওয়া প্রথম প্রেমের মত!

0 Comments

Post Comment