বাংলায় এই ধরনের বই আমার চোখে পড়েনি। সে দিক থেকে এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে নতুন। ‘গঙ্গা যামুনি তেহজিব: হিন্দুস্তানের মিশ্র সংস্কৃতি’ কেমন বই? মুখবন্ধে লেখক জানাচ্ছেন, ‘…আমি ‘আলমগীর’ লেখার ফাঁকে সে লেখার টুকরো-টাকরা, নানা ভাবনাখণ্ড, ইতিহাসের গল্পগুলো একত্র করে হিন্দুস্তানের মিশ্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের, যা গঙ্গা যামুনি তেহজিব-সংস্কৃতি বলে পরিচিত, সেই মহান প্রবাহের কোলাজ চিত্র পেশ করেছি।’ মুখবন্ধের গোড়াতেই লেখক বিনয়ের সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আলমগীর’ নামের একটি বড়োসড়ো সাহিত্যিক-ঔপন্যাসিক প্রকল্পে তিনি নিয়োজিত আছেন। যতদূর বুঝতে পারলাম, ওই কাজটি করতে গিয়ে বিস্তর পড়াশোনা এবং নোট নেওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে। তার থেকেই কিছু কিছু নোট তিনি একত্রিত করে এই বইটি নির্মাণ করেছেন।
বইটার বিষয় বিন্যাস দেখেই টের পাওয়া যায় লেখকের পড়াশোনা এবং গবেষণার বহর। ভারত ইতিহাসের যে কালখণ্ডকে তিনি তাঁর প্রকল্পের জন্য নির্বাচন করেছেন তার আলোচনা এবং তাকে আজ সাধারণ মানুষের সামনে সহজ করে হাজির করা অত্যন্ত জরুরি। সে কথা অবশ্য ‘কথামুখ’-এ পরিস্কার করে বলেছেন অভিজিৎ মজুমদার। তাঁর স্পষ্ট চেতাবনি, ‘শতবর্ষব্যাপী অভিষ্ট হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণে মরিয়া এই গৈরিক শিবির এখন গঙ্গা যমুনি তেহজিব নিকেশে তৎপর। এই সাম্প্রদায়িক প্রকল্পের অধীনে ইতিহাসের পাঠক্রম থেকে মোঘল আমলকে ছেঁটে ফেলা চলছে আর কোম্পানি রাজের পুররুজ্জীবনে রাষ্ট্রীয় সম্পদ হস্তান্তরিত হয়ে চলেছে আদানি-আম্বানির মতো কর্পোরেট প্রভুদের কাছে। অসহনীয় এই প্রকল্পের প্রতিক্রিয়ায় উপল মুখোপাধ্যায় প্রণীত বইখানি আমাদের উজ্জল উদ্ধার।’
এই বইয়ের পরিচিতি এর চেয়ে সহজ করে আর সম্ভব নয়। মাত্র ৯০ পৃষ্ঠার ছোট্ট বইটি জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে ভারতের ইতিহাসের মণিমুক্তো। কিন্তু সম্ভবত কোনও সাহিত্যিক-ঔপন্যাসিক প্রকল্পের কাজ করার জন্য পড়াশোনার সময় তৈরি ব্যক্তিগত নোট হওয়ার কারণে লেখাগুলো প্রায়শ সম্পূর্ণ নয়। প্রায় প্রত্যেকটি লেখাই পড়তে গিয়ে মনে হতে পারে আরও অনেক কিছু পাওয়ার ছিল এ লেখা থেকে। একটা অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে লেখাগুলোয়। যেমন ‘সিপাহী বিদ্রোহের তথাকথিত পশ্চাতগামী মতাদর্শ’ লেখাটিতে হরখা বাই, নূর জাহান, জাহানারা বা জেব উন্নিসার মতো মহিলারা সিপাহী বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন নাকি তাঁরা দিল্লির ব্যবসায়ী ছিলেন যাঁরা ‘বিপুল বৈদেশিক লেনদেন করতেন’? বইয়ে এরকম বহু জায়গা আছে, আমাদের মতো যারা ইতিহাসের ছাত্র নয় বা ইতিহাস চর্চায় কালাতিপাত করে না, তাদের অসুবিধেয় পড়তে হয়। অবশ্য লেখকের ব্যক্তিগত নোট নিজে বোঝার জন্য, অন্যকে বোঝানোর দায় থাকে না। কিন্তু সেই নোট যখন বই হয়ে বেরোয় তখন আমাদের মতো অর্বাচীন পাঠকের কথা ভেবে প্রসঙ্গ বিস্তারের কাজটা করে দিতেই হবে। কারণ কোনও প্রকাশিত বই যতটা লেখকের, ততটাই বা তার চেয়ে অধিক পাঠকের।
তারপরেও ‘মুঘলদের ব্যুরোক্রেসি’ চমৎকার লেখা। অন্য কোন বিকল্পের সন্ধান করতে না পেরে আমি এগুলোকে লেখা বলছি— নিবন্ধ, প্রবন্ধ বা আখ্যান বলছি না। এগুলো আসলে তাঁর ব্যক্তিগত নোট। যে নোটের অন্তর্বস্তু তাঁরই বোঝার কথা। যেমন ‘আলমগীর উপন্যাস প্রসঙ্গে’-তে পাই, ‘…মনিটাইজেশন অব রেভনিউ যে ভাবে সুবা-সরকার-পরগনা স্ট্রাকচারের মধ্যে আকবরের নিসিটারি-এক্সপ্যানসানিস্ট ব্যুরোক্রাসি লাগু করে তার বীজ সমাজে থাকলেও স্ট্রাকচার তৈরির নৃশংসতম কাজটা আকবর আর তাঁর লোকজনই করেন।’ এমন বহু প্রসঙ্গই আমার বোধগম্য হয়নি। কারণ এগুলো তাঁর ব্যক্তিগত নোট। পুস্তকাকারে প্রকাশ করার সময় প্রসঙ্গগুলো বা রাষ্ট্রনৈতিক, অর্থনৈতিক, সমরনৈতিক বা ব্যবসায়িক পরিভাষাগুলো অন্তত ফুটনোটে বুঝিয়ে বললে আমাদের মতো পাঠক বিষয়ের মধ্যে প্রবেশের অধিকার পেত। তারপরেও বলব উপলবাবুর এমন একটা কাজ বাংলার মননচর্চার পরিধিকে অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। ‘নূর জাহানের সার্জিকাল স্ট্রাইক’, রিচার্ড ম্যাক্সওয়েল ইটনের প্রাসঙ্গিকতা’, মোঘল সম্রাটদের জ্যোতির্বিজ্ঞান আর জ্যোতিষ চর্চা’, ‘অশোকের সময়ের অখম্ড ভারতের ন্যারেটিভ’, ‘মোঘল তীর-ধনুক ঘোড়সওয়ার-তীরন্দাজির কায়দা’ বা ‘মোঘলদের বারুদ আর আগ্নেয়াস্ত্র’ সমেত সব লেখাই তথ্যে ঠাসা। অনেক কিছুই আমাদের কাছে আনকোরা। এই বই আমাদের কাছে নতুন এক পাঠ-পরিক্রমা। কিন্তু ‘আমি আর জ্যাঠামশাই’ গদ্যটা পড়ে কিছুই উদ্ধার করতে পারিনি। আমার মনে হয়েছে এটা সুরিয়ালিস্ট গদ্যের একটা যথার্থ নমুনা। এটাকে অন্তত নোট মনে হয়নি— বোধহয় ব্যক্তিগত গদ্য।
বইটিতে ছবিগুলো মূল্যবান সংযোজন। ছবিগুলো এ বইয়ের ওজন বাড়িয়ে দিয়েছে। কেবল লেখা নয় ছবিগুলোর জন্যও বইটা সংগ্রহ করা যেতে পারে। নতুন প্রকাশককের অসংখ্য সাধুবাদ প্রাপ্য এমন একটা সাহসী প্রকাশনার জন্য।
গঙ্গা যামুনি তেহজিব: হিন্দুস্তানের মিশ্র সংস্কৃতি। প্রথম খণ্ড
উপল মুখোপাধ্যায়
চেতনা প্রকাশনী, বারাসত, উত্তর ২৪ পরগনা
দাম: ১৫০ টাকা