জাপানি মার্শাল আর্টস-এর আধুনিক সংস্করণ আইকিদো। এই মার্শাল আর্ট জীবনী শক্তির সঙ্গে একীভূত হওয়ার উপর জোর দেয়, জীবনের সুরেলা ছন্দের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। উদ্দেশ্য হল, নিজেকে রক্ষা করার পাশাপাশি আক্রমণকারীও যেন গুরুতর আঘাত না পায় তা লক্ষ্য রাখা; প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক আজহারউদ্দিন যখন বলের পেস বা গতি লক্ষ্য করে হাতের জোড়া কব্জি দিয়ে ব্যাটিং করে দ্রুত ছুটে আসা বল বাঁদিকে ক্লিক করে দিতেন, তখন তিনি আসলে ক্রিকেটে আইকিদোর দর্শন প্রয়োগ করতেন।
প্রকৃতি থেকে সৃষ্ট শক্তিগুলি অনেক বেশি ক্ষমতাশালী হয়। এই শক্তিগুলিকে ব্যবহারের সময় মিতব্যয়ী হতে পারলেই সম্পদের অর্থনীতি বিকশিত হবার সুযোগ থাকে। তার জন্য দরকার বিজ্ঞান চেতনার সঙ্গে শিল্পসত্তার মিলন। প্রকৃতির জৈবিক শক্তিগুলি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বিবর্তিত হয়ে ‘হোমো সেপিয়েন্স’দের বেঁচে থাকা এবং আরও বিকশিত হবার সুযোগ করে দিয়েছে। তারই পাশাপাশি, মানুষের নানান্ উদ্ভাবন এই বেঁচে থাকার সুযোগকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু যেকোনও শক্তিশালী অস্ত্রের মতোই, আমরা যদি উদ্ভাবনগুলোকে যথোপযুক্তভাবে ব্যবহার না-করি তাহলে তাতে ভালোর ক্ষতিই হয় বেশি। ঠিক এমনটাই ঘটেছে বর্তমান অতিমারির ভ্রান্তিবিলাসে।
মানুষের হাতে প্রকৃতির শক্তিগুলিকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আছে, এই উদ্ধত, আত্মম্ভরী বিশ্বাসই অতিমারির শুরু থেকে সর্বনাশের বীজ রোপণ করে দিল। আমাদের সেই অস্বস্তিকর, আনাড়ি হস্তক্ষেপগুলো মানুষকে চরম দুর্দশায় ফেলে দিয়েছে, প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় করা হয়েছে। অথচ এ সবই এড়িয়ে যাওয়া যেত।
ক্রিকেটে একজন ব্যাটসম্যান যদি মারাত্মক শর্টপিচ বাউন্সার থেকে চোখ সরিয়ে নেয় তাহলে সে আহত হবে। চোখ না-সরিয়ে আসলে ব্যাটসম্যানকে সরাসরি বলের দিকেই চোখ রাখতে হবে আর জানতে হবে, কীভাবে এই ধরনের বল এলে নিজেকে সরিয়ে রাখতে হয়। জনস্বাস্থ্যের শৈল্পিক পদ্ধতিও ঠিক তেমনই -- প্রাকৃতিক জৈবিক শক্তিগুলোর উপর কড়া নজর রাখা। সেই শক্তিগুলি যখন হুমকি দেয় তখন তাকে এড়িয়ে বরং সেই শক্তির পরিবর্তনশীলতা, গতিশীলতা অনুসরণ করে তাদেরকে মানুষের সুবিধার জন্য ব্যবহার করাই জনস্বাস্থ্যের কাজ।
Like our Facebook Page
এই অতিমারির সংগৃহীত তথ্য থেকে প্রমাণিত হয়েছিল যে যারা শারীরিকভাবে দুর্বল, যারা গুরুতর অসুখবিসুখে ভোগেন তাদের বেলায় ভাইরাসের প্রভাব ছিল বিপজ্জনক। কিন্তু যাদের বয়েস কম, তরুণ এবং সুস্থ, তাদের বেলায় বিপদ নেই বললেও চলে। একজন ভাল অধিনায়কের কাজ হল দুর্বুলদের আগলে রাখা আর অন্যেরা যাতে স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারে তার বন্দোবস্ত করা। এইটা হলে শিক্ষাব্যবস্থার ভয়াবহ বিপর্যয় আর অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রতিরোধ করা যেত।
কিন্তু আমাদের নীতিনির্ধারক অধিনায়কেরা খেলার মাঠে বল থেকে তাদের চোখ সরিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁদের নেওয়া কঠোর পদক্ষেপগুলি সংক্রমণ রোধ করতে পারেনি, কিছুদিনের জন্য পিছিয়ে দিতে পেরেছিল মাত্র। আমাদের দেশে (কেরল) এবং বিদেশে (অস্ট্রেলিয়া) কঠোর বিধিনিষেধগুলোর ফলে শুরুতে ভালই কাজ হয়েছিল; কিন্তু শেষের দিকে অবস্থা সঙ্গীন হয়ে যায়। সুইডেনের মতো কয়েকটি দেশ যা কোনও কঠোর পদক্ষেপ চাপিয়ে দেয়নি, স্কুলগুলি খোলা রেখেছিল, তারা অনেক, অনেক ভাল ফল করেছে। সুইডেন মুখোশের ব্যবহারও চাপিয়ে দেয়নি।
এই ক্ষেত্রে ওই দুরন্ত বল অর্থাৎ ভাইরাসটির দিকে ঠিকমতো নজর রাখলে এটি পরিষ্কার হয়ে যেত যে যাবতীয়, কঠোর বিধিনিষেধ খাটানো সত্ত্বেও চিন থেকে চাঁদনী চক পর্যন্ত তার যাত্রা আটকানো যায় নি। ভাইরাস সমগ্র মহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, তার গতিবিধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। আবার একই সঙ্গে, দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়তে গিয়ে, বিশেষ করে ভারতের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে, এই ভাইরাস মানুষের মধ্যে ‘ন্যাচারাল ইমিউনিটি’ বা প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করে দিয়েছে।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে দিল্লিতে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ৯০% এরও বেশি প্রাপ্তবয়স্কদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ছিল। এদের কিছু অংশ ‘ভ্যাক্সিন’ থেকে, কিন্তু বেশিরভাগই সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠার পরে। আরও মজার ব্যাপার হল ৮২% যুবক এবং ১৮ বছরের কম বয়সীদের ‘ভ্যাক্সিন’ না-নেওয়া সত্ত্বেও তাঁদের রক্তে IgG অ্যান্টিবডি আছে। এই গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে তখন থেকেই ন্যাচারাল ইমিউনিটি বা প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ‘ভ্যাক্সিনলব্ধ’ ইমিউনিটির চেয়ে ১৩গুণ বেশি শক্তিশালী।
প্রায় দুই বছর অতিমারির পর আমেরিকার আটলান্টায় অবস্থিত ‘সিডিসি’ও (‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল’) স্বীকার করছে যে প্রকৃতিদত্ত বা ন্যাচারাল ইমিউনিটি ‘ভ্যাক্সিনলব্ধ’ ইমিউনিটির চেয়ে শক্তিশালী। তা সত্ত্বেও, বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে গিয়ে, যাদের এই ন্যাচারাল ইমিউনিটি আছে তাদেরকে নিন্দেমন্দ করা হচ্ছে। বেড়াতে যাওয়া, স্কুল-কলেজে যাওয়া, চাকরি, দোকানে কেনাকাটা করতে যাওয়ার জন্য প্রায় জোর করে ‘ডাবল ডোজ ভ্যাক্সিন সার্টিফিকেট’-এর কথা বলা হচ্ছে।
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি সংসদে এমন একটি বক্তব্য পেশ করলেন যা আসলে সঙ্গতিহীন। তিনি গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করলেন যে ইতিমধ্যে ১৩০ কোটিরও বেশি ভারতীয় নাগরিক ‘ভ্যাক্সিন’ নিয়ে ফেলেছে যাতে অন্যেরা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পায়। এ বড় অদ্ভুত আবদার, কেননা এমনকী, ‘ভ্যাক্সিন’ নির্মাতারাও মনে করে না যে এই ‘ভ্যাক্সিন’ সংক্রমণ আটকাতে পারে! ভারতে যখন প্রায় ৮০~৯০ শতাংশ মানুষ ন্যাচারাল ইমিউনিটি অর্জন করে ফেলেছে তখন এই অন্যায় আবদার মানে, দুষ্প্রাপ্য সম্পদের মারাত্মক অপচয়।
যা হোক, যা হয়ে গেছে তা হয়েই গেছে, এখন আর পূর্বাবস্থায় ফেরা যাবে না। তাই গতস্য শোচনা নাস্তি। তবে এখনও কিছু করার সুযোগ আছে। ১৫~১৮ বয়সীদের জন্য টিকাকরণ চালু হচ্ছে। কাগজে কলমে বলা হচ্ছে যারা নেবে তারা স্বেচ্ছায় নেবে; অথচ বিভিন্ন রাজ্যের স্কুল বোর্ড এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এই টিকাকরণ নিশ্চিত করার জন্য জবরদস্তি করছে। ভয় দেখানো হচ্ছে, ‘ভ্যাক্সিন’ না-নিলে শিশু কিশোরদের লেখাপড়ার সুযোগ কেড়ে নেওয়া হবে।
কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি রাহুল গান্ধী আইকিদো শিল্পে ব্ল্যাক বেল্ট-এর অধিকারী। তিনি তো এই শিল্পভাবনাকে কাজে লাগাতে পারেন। আইকিদো এমন এক দর্শন যা জীবনীশক্তির সঙ্গে একীভূত হতে শেখায়। তাহলে তিনি তো বলতে পারেন যে, আমাদের সিংহভাগ তরুণ-তরুণী এবং শিশুদের অর্জিত ন্যাচারাল ইমিউনিটির সঙ্গে ঐকতান রচনা করতে পারলে দেশের বিপুল সম্পদ নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে।
তা অবশ্য হওয়ার না। বরং সমস্ত বিজ্ঞানভাবনাকে উপেক্ষা করে শিশু কিশোরদের গণটিকা দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে। অথচ তাদের ৮০% এরও বেশি ইতিমধ্যেই ন্যাচারাল ইমিউনিটি অর্জন করে ফেলেছে, টিকা তাদের দরকার নেই। তার মানে, গণটিকার প্রচারে যারা টিকা পাবে তাদের কোনও উপকার হবে না, তবে যারা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কোনও না-কোনও স্বার্থসিদ্ধি হবে। স্পষ্টতই, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বিজ্ঞান উপদেষ্টারা তাঁকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
যাই হোক, এখনও সময় আছে। এই বিলম্বিত পর্যায়েও প্রধানমন্ত্রীকে বিজ্ঞানসম্মত তথ্য জানিয়ে, ঘুরে দাঁড়াবার সুযোগ আছে। কিন্তু সেই কাজ কি কেউ করবেন?
(এই রচনাটি গত ২৭-শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ন্যাশনাল হেরাল্ড পত্রিকার ই-পেপার সংস্করণে প্রকাশিত। লেখক প্রথিতযশা জনস্বাস্থ্যবিদ, বর্তমানে ডাক্তার ডি ওয়াই পাটিল মেডিক্যাল কলেজ, পুনের সঙ্গে যুক্ত। ভারতের সেনাবাহিনীতে জনস্বাস্থ্যবিদ হিসেবে তিনি একসময় কর্মরত ছিলেন, এএফএমসি পুনের মোবাইল এপিডেমিক ইনভেস্টিগেটিভ টিমের পরিচালনাও করেছেন। http://epaper.nationalheraldindia.com//imageview_2952_134110130_4_74_27-02-2022_i_1_sf.html)
0 Comments
Post Comment