বড়বাবু , মিস্ত্রিরা এসেছে।
নিয়ে আয়।
পেন্নাম কত্তাবাবু।
হুম্ , তা ক'দিন লাগবে?
কত্তা………।
বলছি বাড়িটা রঙ করতে ক'দিন লাগবে?
তা ধরুন গিয়ি মধ্যিখানি বন্ধ না করলি দিন পঁচিশেক।
ঠিক আছে ঠিক আছে। বন্ধটন্ধ নয়। টানা-ই করবে।ওই সময়ের মধ্যেই শেষ করা চাই।শুরু করে দাও। আজ-ই। যা যা প্রয়োজন সরকার মশাই-এর সঙ্গে কথা বলে নাও।
পাঁচ মহলা। পুরোনো আমলের, কারু কাজে ঠাসা।কাজ শুরু হ'ল। বাড়িটাও গায়ে বাঁশের চাদর জড়ালো। সারাদিনমান ধরে চললো মহাদেবদের কাজ। অবশেষে বৃদ্ধা ফিরে পেল নবযৌবনার রূপ। উজ্জ্বল অফ হোয়াইটের ওপর গাঢ় নীল খয়েরি আঁচড়। ফুটে উঠলো যুবতীর মনোলোভা হাসি।ছুটি হ'ল মহাদেবদের। সরকার মশাই প্রাপ্য বুঝিয়ে দিলেন। বিদায় নিতে বড়বাবুর কাছে যেতে তিনি বললেন, শোন তোমাদের কাজ আমাকে খুশি করেছে। আগামী রোববার বাড়িতে উৎসব। একমাত্র নাতির বউভাত। তোমরা সেদিন এসো।
আইচ্ছা আসবো খন্ আইজ চলি।
হ্যাঁ এসো।
মাটির বাড়ি। খড়ের চাল। বাঁশের বেড়া। মাটি গোবরে লেপা। মেঝে দাওয়া টান টান করে নিকানো। শান বাঁধানো মেঝেকেও হার মানায়। উঠোনে এক পাশে ধানের গোলা। আর এক পাশে ছোটো ঢেঁকি-ঘর। মাঝখানে মাটির বেদিতে তুলসি গাছ। পিছনে গোয়াল, হাঁস মুরগীর খোঁয়ার। সীমানা বাঁশের কঞ্চি আর পাটকাঠি দিয়ে ঘেরা। সদর দরজায় বাঁশের ঝাঁপ। দিনের আলো পশ্চিমে ঢলে পড়ার আগে ঢেঁকি-ঘরে লুকুচুরি খেলছে। তাই সেখানে আলোর খেয়ালীপনা বেড়েছে বই কমেনি।
দু'হাত ওপরে বাঁশের আড় ধরা, এক পা মাটিতে, আর এক পা ঢেঁকিতে রেখে ধান পার দিচ্ছিল বিন্তি খুড়ি। দু'দিকে কলা বেণী বাঁধা, টিয়ে রঙের শাড়ি পড়া, কপালে বড় বিন্দির টিপ, বেশ দেখাচ্ছিল মনোরমাকে। ঢেঁকিতে ধান তোলানামা করছিল। সতেরো বছরের মনোর মুখ হাত সমান চলছিল।
তা খুড়িমা মহাদেবদাদা কবে আসবে গো? এ'বার অনেকদিন বাইরে। হাঁ গো খুড়িমা মাসখানেক হবে?
তা খুব কম দিন নয়। পেরাই মাস খানেক তো হ'ল।
তোমার একা থাকতি ভয় করে না?
পেথম পেথম কইরতো।এখুন আর করে না।
হঠাৎ বাঁশের ঝাঁপে মচমচ আওয়াজ। মনো চেঁচিয়ে ওঠে, ওই তো মহাদেবদাদা। বিন্তিখুড়ির চোখের তারা নাচে। সবেধন নীলমণি। অনেক সন্তান হারিয়ে তবে এই দেবা। দাওয়ায় বসে মার সঙ্গে নানান সুখদুখের আলাপন সহ মুড়ি বাতাসা খায় দেবা।এক সময় ধুতির কোঁচড় থেকে টাকা বের করে। মার হাতে দিয়ে বলে, মা এই ট্যাকাগুলো তুলি রাখো।বুঝিসুজি খরচ করবা। আবার কব এমনধারা কামকাজ হইবো ক্যাডা জানে।
এ'বার চালটা ছাইয়ে নে বাপ।
থামো দিকি। পরে হইবো খন। কিছু ট্যাকা হাতি না থাকলি বৃষ্টি নামলি খাবা কী?
শোন বাপ মাথা গরম করিস নি। চালা ছাইয়ে ঘরের বউ নে আয় দিকি। বউ-এর ভাগ্যি অনেকের উন্নতি হয় রে বাপ।
থামো থামো নিজেদের খাওন জোটে না তার ওপর আর একজন!
আমার যে বাপ খুব সাধ ছেলো মরার আগে বউ নাতিপুতির মুখ দেকার।
ধ্যাৎ সেই এক ঘ্যানর ঘ্যানর। চুপ করো বলছি। নইলে কিন্তু...। গোঁয়ার ছেলের এক ধমকে বিন্তিখুড়ি চুপ।
প্রায়-ই বাবার কথা মনে হয় দেবার। এক যুগ হ'ল বাবা নেই । কিন্তু তার কাছে মনে হয় , এই তো সেদিনের কথা ।শেষ যাত্রার দিনটি আজও স্পষ্ট মনে আছে ।কয়েকজন মাঝির সঙ্গে বাবা-ও গিয়েছিলো । বাবা-ও গিয়েছিলো নদীতে মাছ ধরতে । এক সময় সবাই ফিরে এল বাদে বাবা ।কিন্তু দেবার ভিতর ঘরে বাবার নিত্য যাওয়া আসা ।বিরাট লম্বা হাত । ছোট্ট দেবার শরীরটা নিয়ে শূন্যে লোফালুফি ।তারপর সজোরে জাপটে ধরা ।পরম শান্তি । এক সময় বাবার চওড়া বুকে হারিয়ে যাওয়া ।সব মনে আছে দেবার ।
চৌধুরী বাড়ির উৎসব । সোনাডাঙা গ্রাম থেকে রাজাবাজার । দূরত্ব অনেকটাই। তাই সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লো । পাশের বাড়ির মনো এই পথেই আসছিলো , কলকলিয়ে উঠলো - ও মহাদেবদাদা ,তুমি কি বে করতে চললে ? বর বর লাগতিছে গো !
- দূর হ ফাজিল মেইয়ে । বে করতি নয় বে খাতি চলেছি । খাটো ধুতির ওপর ফতুয়া । মাথায় জবজবে তেল । পরিপাটি সিঁথি । পায়ে হাওয়াই চটি । ফের মনো বলে - তোমার সাজের সঙ্গে চটিটা কিন্তু মানানসই হচ্ছে নে ।
- রাখ তোর চটি । যা আছে ঢের ।
প্রায় মাইল তিনেক হেঁটে লক্ষীকান্তপুর স্টেশন । সেখান থেকে ট্রেন । নেমে আবার কিছুটা পথ হাঁটা । গ্রামের পথ ধুলোয় ভরা । পায়ের দিকে চোখ পড়তেই আঁতকে ওঠে মহাদেব । হাঁটু অব্দি ধুলোর মোজা । খাটো ধুতিতেও ধুলোর
পাড় বসানো । এ'ভাবেই পথ চলা । পথের সাথি হারু ননীদেরও একই দশা ।
একে উজ্জ্বল রঙ , তাতে রঙীন আলোয় ঝলমল করছে বাড়িটা । বিয়ে বাড়ির একজন গেটে দাঁড়িয়ে । ডেকে বললেন - এই , এই এদের ও'দিকে বসিয়ে দাও তো । ভরপেট আহার । সদরে বড়বাবুর ঘর । বিদায় নিতে সে'দিকেই যাওয়া । হঠাৎ লন দিয়ে যাবার সময় , হাতের ধাক্কায় চমকে ফিরে তাকায় মহাদেব । ননী বলে - এ'দিকে তাকাও বরকে দ্যাখো ! কী সুন্দর লাগতিছে ! বর বেশে মলয় বন্ধুদের সঙ্গে গালগল্পে মত্ত । চোখ পড়তেই চোখ গেলো আটকে । গিলে করা দামি মখমলের ধুতি পাঞ্জাবী , সোনালী ফ্রেমের চশমা , টকটকে ফরসা পাগায়ের রঙ । এক মাথা কালো ঢেউ খেলানো চুল । টিকোলো নাক । টানা চোখ । পায়ে এক জোড়া দামি এক জোড়া পাম্পশু । হার আংটি বোতাম ঘড়ি চোখ ধাঁধানো চমক । হারু বলে
উঠলো - এক্কেবারে মরদের মত মরদ । মহাদেবের সপ্ততারে বাঁধা মনের একটা তার হয়তো বা একটু বেজে উঠলো ।
মাটির দাওয়ায় বসে , হাতপাখা নাড়তে নাড়তে , মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে যায়। সুখদুখের অনুভূতিতে বাবার মুখ ভেসে ওঠে । হঠাৎ একটা ঘটনা মনে পড়ে । বছর দশেকের দেবা । দৌড় প্রতিযোগিতা । পনেরো ষোলো বছরের অন্য সব প্রতিযোগী ছেলদের হারিয়ে প্রথম হয় । পুরষ্কার পায় । ছুটে এসে বাবার কোলে ঝাঁপিয় পড়ে । হাসতে হাসতে বাবা বলেন - সরমা , তোমার ছেলে একদিন মনিষ্যির মত মনিষ্যি হবে ।
কালবৈশাখী । ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে দাপুটে বৃষ্টি । ফুটো চালে জল আটকায় না । অঝোর ধারায় ঝরে জল । মেঝে জলে জলাকার । সেদিকে তাকিয়ে বোবা কান্নায় মহাদেবের গলা বুজে যায় ।
পরের দিন রাতে দাওয়ায় শীতলপাটি আর বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকে মহাদেব । ছোটবেলার অভ্যাস । মা পরে মশারি টাঙিয়ে দিয়ে যান । এই সময়টা তার খুব প্রিয়। এই সময়টা সে হয় এক সুন্দর স্বপ্নপুরীর বাসিন্দা । মায়াবী জোৎস্না তার সঙ্গে বিছানায় লুটোপুটি খায় । নরম আলোয় ভাসতে ভাসতে মনটা অতলে ডুব দেয় । দামি দামি মণিমুক্তোর সন্ধান পায় । হয়তো বা তুলেও আনে । ভোরের আলোয় চারধারে দ্যাখে সব-ই নুড়িপাথর ।
জোরকদমে কাজে লেগে পরে । কোনো কাজেই অবহেলা করে না । অবস্থার একটু উন্নতির জন্য সারাদিন ধরে চলে কাজ আর কাজ । রাতে ক্লান্ত শরীরে এলিয়ে পড়ে । এলিয়ে পড়ে দাওয়ায় । স্বপ্নে বাবা আসেন । মাথায় হাত রেখে কাজে উৎসাহ দেন । কয়েকদিন হ'ল সে এক নতুন স্বপ্ন দেখে । শেষ রাতে আলো আঁধারিতে ঘুরে ফিরে সেই এক-ই স্বপ্ন । রাজবাড়ির সামনে পক্ষীরাজ ঘোড়া হাজির । উঠে বসে রাজপুত্র । কিন্তু এ কী ! রাত বেশী তো নয় । আধুনিক পোশাকে । দুধসাদা মখমলের গিলে করা ধুতি পাঞ্জাবী । গলায় সোনার হার বোতাম । সোনালী ফ্রেমের চশমা । দামি ঘড়ি আংটি চকচকে পাম্পশু । উড়ে চলে স্বপ্নের পক্ষীরাজ , তেপান্তরের ধূ ধূ মাঠ পেরিয়ে…….।
বন্ধু যোগেন ভালো মিস্ত্রি । কলকাতায় বেশ কয়েকটা মাল্টিস্টোরেড বিল্ডিং তৈরি করেছে । এখনও একটার কাজ চলছে । যেখানেযেখানে কাজ করে , সুযোগ পেলেই মহাদেবকে রঙের কাজ দেয় ।
সেদিন নতুন একটা কাজের খবর নিয়ে এসেছিল । প্রিয় বন্ধুর কাছে দেবা অকপটে মনের কথা বলে । প্রতি রাতে প্রায় এক-ই স্বপ্ন । মনকে অস্থির , বিচলিত করে তোলে । সব শুনে যোগেন বলে - স্বপ্ন হ'ল গিয়ে বন্ধ মনের আগল খোলা । কাজে মন দে । সব সময় কাজের কথা ভাব , চিন্তা কর । সব ঠিক হয়ে যাবে ।
যোগেনকে বেশিরভাগ সময় কলকাতায় থাকতে হয় । তাই কথা-ও ওখানকার মত। মনোরমা ঠাট্টা করে বলে - ও কোলকাত্তার বাবু , তুমি এখানে ক্যানে গো ? একদম মানাচ্ছে নে । আরও কী সব বলতে যাচ্ছিলো । মহাদেবের ধমকে পালায় ।
স্বপ্নের কথাটা একসময় মাকে বলে দেবা । মা হেসে বলেন - তোর এ'বার সংসার করার বয়স হইছে । বে-র বয়সে , বে না করলি লোকে এমন ধারা কত স্বপন দ্যাখে ! বে-র
যুগ্যি মেইয়ে দেখি । অমত করিস নে বাপ । দেবা বলে - আর ক'টা দিন সময় দাও দিকি । তোমার সেই এক ঘ্যানঘ্যানানি ।
দেবা অপেক্ষা করে থাকে । সে জানে যদি বাবার সন্মতি থাকে তবে তিনি স্বপ্নে দেখ দেবেন-ই । জীবনের সব বদলের সময়ই তিনি আসেন । প্রায়-ই দেবার মনে হয় বাবা যেন বেঁচে আছেন । রাতে ঘুমঘোরে দেবা তার বাবার অস্ত্বিত্ব টের পায় । মা বলেন - তোর বাপ তোরে খু-উ-ব ভালোবসতো । তাই তুই স্বপনে বাপকে দেখতে পাস । তোর বে-তে বাপের মত আছে রে খোকা । তাই কাইল রাতে স্বপনে বাপকে দেখেছিলি । আমি তবে এখুন ব্যবস্থা করি ? কী রে চুপ মেরে আছিস যে বড় ? কিছু বলার থাকলি বল ।
- যেমন খুশি কর । আর ভাববু নি । হঠাৎ মনের চোরা স্রোত মাথায় চাড়া দেয় । চোখ দুটো চকচক করে ওঠে । আধুনিক বেশে রাজপুত্র পক্ষীরাজ ঘোড়ায় ……। আনমনে দেবা বলে - বরের সাজ , ধুতি পাঞ্জাবী , ঘড়ি , আংটি , বোতাম , হার , পাম্পশু -- সব সব দিতি হবে কিন্তু । মা ছেলের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে টেনে টেনে বলেন - ও'সব দিয়ি কী হবে বাপ ? মুখ ফসকে বেরিয়ে যায় দেবার - না দিলি বে করবু নি ।
কয়েকটা গ্রাম পেরিয়ে দোলনচাঁপা গ্রাম । সেই গ্রামেরই মেয়ে কলাবতী । অনেক খুঁজেপেতে তাকেই মার মনে ধরলো । বাপের অবস্থাও ভালো । মনোর মা সুপুরি কাটতে কাটতে বলে - হাঁ গো দিদি মেইয়ে তো পছন্দি হ'ল । তা তোমার ছেইলেকে তাদের মনে ধইরবে তো ? দেবার মা ফোঁস করে - ক্যানে ধরবি নি ? ছেইলে কি আমার ফেলনা ? নিজের বলি বলছি নে , দেবা আমার সোনার ছেইলে । দেখতি শুনতি মন্দ নয় । ভিটে মাটিও আছে । ময়ে পোয়ে ছোট্ট সংসার । অমন ঘর ক'জনা পায় ?
পাত্র পছন্দ হ'ল । শুভ কাজের দিনক্ষণ ঠিক । বরের দাবিতে কন্যাপক্ষ রাজি । মানে কোন সমস্যাই রইলো না । বিয়ের বাকি কয়েকটা দিন ।
উঠোনে চ্যালা বাঁশের টুকরো রাখা । তারের সঙ্গে বেঁধে বেঁধে ঝাঁপ তৈরি করছিল দেবা । ঝড় বাদলে পুরোনো ঝাঁপটা পড়ে গিয়েছিলো । হঠাৎ মনে পড়ে বাবার কথা । তাই তো বাবা তো আর ঘুমঘোরে আসে না । যেদিন সে বিয়ের ব্যাপারে মত দ্যায় , সেদিনর রাত থেকেই হারিয়ে গেছে বাবার মুখ । আজন্মের সুখদুখের সাথী । কেন এমন হ'ল ? তবে কী তার কোন আচরণে বাবা ক্ষুব্ধ ? ভেবে পায় না দেবা । কাজে মন থাকে না । মনে কেমন খটকা লাগে । চ্যালা কাঠে আটকে থাকে কুড়ুল । কিছুক্ষণ পর আনমনা হয়ে এগিয়ে চলে । যেদিকে দু'চোখ যায় ।
কিছুটা দূরে বৃষ্টির জলে ভরা দিঘি । দিঘির শীতল জলে পা ডুবিয়ে বসে দেবা । এলোমেলো মনটা থমকে দাঁড়ায় । পাশে ক্ষেতে সরু আল । সেখান দিয়ে বাবা শেষবারের মত চলে গিয়েছিল । শূন্য দৃষ্টিতে দেবা সেদিকে চেয়ে থাকে । মনেতে নানান চিন্তা একসাথে জট পাকায় । খোলার চেষ্টা করে , পারে না । দু'হাতে কপালের রগ চেপে ধরে । মাথার যন্ত্রণা বেড়ে যায় ।
হঠাৎ দিঘির জলে লম্বা ছায়া পড়ে । ঘুরে তাকায় দেবা । যোগেনকে দেখতে পায় । হাসতে হাসতে যোগেন বলে - কী রে , এ'খানে কী করছিস ? তোর তো কপাল খুলে গেল !
বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়লো ? তা হ্যাঁ রে পাকা বাড়ি কবে তুলছিস ? বাঃ , রাজ্য আর রাজকন্যা একসাথে !
দেবা দেখে যোগেনের চোখ চকচক করছে । সেই চোখ থেকে লোভের ফুলকি চারধারে ছিটকে পড়ছে । যোগেন আবার বলে - স্বপ্ন তা হ'লে এতদিনে সফল ! বিনা পরিশ্রমে বড়লোক , কী বলিস ? হা হা করে হেসে উঠলো যোগেন ।
তীরের ফলার মতো তার কথাটা দেবার বুকে বিঁধলো । ধীরে ধীরে মহাদেবের মাথার জট খুলে গেলো ।
হঠাৎ মহাদেব উঠে দাঁড়ায় । কঠিনভাবে যোগেনের দিক তাকায় । তার চোয়াল শক্ত হয় । দু'চোখে আগুনের হলকা । চিৎকার করে বলে - আমি কী ভিখিরি ? থু থু করে থুতু ফেলে , হনহন করে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যায় । সদর দরজা থেকেই মাকে ডাকে দেবা । মা এলে শান্ত অথচ কঠিন স্বরে মহাদেব বলে - মা একবার দোলনচাঁপা গেরামে খবর পাঠাও । মেয়ের বে-তে কিছু দিতি হবে না । শাঁখা সিঁদুরেই বে হবে ।
- ক্যানে রে তোর বরের সাজ ? কঠিনভাবে বলে দেবা , বলছি তো কিছু লাগবে নে । আমরা
ভিখিরি নই । নিজে খাটি করি নিব ।
মা কিছু একটা বলতে ছেলের দিকে তাকায় । ছেলের শক্ত চোখমুখের আভাষে কথা থেমে যায় । কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মা । তারপর দু'হাত জড়ো করে শূন্যে তুলে কার উদ্দেশ্যে যেন প্রণাম জানায় ।
মহাদেবের চোখ ছলছল করে । মনের সাতটি তার একসঙ্গে বেজে ওঠে । এতদিনের ঘোর কেটে যায় । বেশ হালকা লাগে ।
রাতে পরম শান্তিতে ঘুম আসে মহাদেবের । শেষ রাতের স্বপ্নমাখা চোখে দেখে - দূরে - আরো দূরে - বহুদূরে তার পক্ষীরাজ ঘোড়া , গিলে করা ধুতি পাঞ্জাবী উড়িয়ে ছুটে চলেছে । ঘড়ি , আংটি , হার , বোতামের ঝিলিক ঝাপসা হ'তে হ'তে হ'তে - একসময় মিলিয়ে যায় ।
ঠিক সেই পরম ক্ষণে তিনি এলেন । মৃদু হেসে পাশে দাঁড়ালেন । সস্নেহে কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন - এতদিনে ছেলে আমার মনিষ্যির মতো মনিষ্যি বনি গেল ।
------------------------------------------------