সেই সময়ে বিশেষ আর্থিকে অঞ্চল বা সেজ নিয়ে দেশে যথেষ্ঠ আলোড়ন উঠেছে, আমাদের রাজ্যে ঘটে গেছে নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাব নিয়ে প্রস্তাবিত সেজ নিয়ে আন্দোলন, যেখানে সরকারের পক্ষ থেকে গুলি-গোলাও চলেছে।
সেপ্টেম্বর ৩০, ২০০৯। ইউপিএ-২ সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে গুজরাটের আদানি গোষ্ঠী গুজরাটের কচ্ছ অঞ্চলে, আরব সাগরের গায়ে মুন্দ্রা বন্দর ও বিশেষ আর্থিক অঞ্চল গড়ার বরাত পায়। এই বেসরকারি বন্দর গড়ার জন্য গুজরাট সরকার ( বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি তখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী এবং বহু-বিজ্ঞাপিত “গুজরাট মডেল”-এর নায়ক) আদানি গোষ্ঠীকে “রাইট-টু-ইউজ” ভিত্তিতে “সেজ” ও বন্দরের জন্য ১০০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল ( প্রায় ২০০৮ হেক্টর) বরাদ্দ করে। এই পুরো জমিটি আসে সংরক্ষিত অরণ্য ধ্বংস করে।
এই জমির দাম সরকার ঠিক করে ৯৬ কোটি টাকা। সরেস বনাঞ্চলসহ উপকূলবর্তী অঞ্চলের জন্য সরকারি বদান্যতায় আদানি গোষ্ঠী জলের দরে বিশাল পরিমাণ জমি পেয়ে যায়, আদানির জন্য দাম পড়ে প্রতি বর্গ মিটারে ১০ টাকার মতো। গুজরাটের মোদি সরকার আদানিকে কতটা আর্থিক ভরতুকি দিলো, তার একটা হিসেব আমরা পেতে পারি। মুন্দ্রা অঞ্চলে, যেখানে আদানির বন্দর নির্মিত হয়েছে তার ঠিক আশপাশের জমি সরকার কত দরে বেচেছে তার একটা হিসেব নিই। সেই পরিমাণটি হলো আদানি-র কাছ থেকে নেওয়া দামের ৭০ থেকে আশি গুণ, অর্থাৎ বর্গ মিটার পিছু ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। এই প্রকল্পে চাষীদের মালিকানায় থাকা যেসব জমি এই “সেজ”-এর অন্তর্ভূক্ত হয়েছে, গুজরাট সরকার ব্রিটিশ আমলের ১৮৯৪ সালের জমি অধিগ্রহণ আইন মোতাবেক অধিগ্রহণ করে আদানি গোষ্ঠীকে দিয়ে দেয়। এই আইনে চাষীদের জমির ক্ষতিপূরণের পরিমাণ যৎসামান্য, এই টাকায় ভারতের কোথাও চাষীরা খুশি হন নি, এমন কি পশ্চিমবঙ্গের সিংগুরের ক্ষেত্রেও নয়।
এই অঞ্চলে চাষী ছাড়াও আছে এক বিশাল সংখ্যায় মৎসজীবী। তাঁদের পরম্পরাগত মাছ ধরার জায়গাগুলি আদানি গোষ্ঠী পাঁচিল দিয়ে ঘিরে বন্দর এলাকাভুক্ত করে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়। এই মুন্দ্রা বন্দর এবং “সেজ”-এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়, দেখা যায় যে প্রায় হাজার পরিবার এই প্রকল্প দ্বারা বিরূপভাবে প্রভাবিত হবেন। কাজ শুরু হতে না হতেই দেখা যায় যে উপকূল অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ অরণ্য আদানির ঠিকাদারেরা সাফ করে দিচ্ছে, প্রাকৃতিক সমুদ্র-খাঁড়িগুলি বুজিয়ে দিয়ে তারা বেআইনিভাবে বাড়তি জমির সংস্থান করে নিচ্ছে। এই দুটি কাজই ভারতের তৎকালীন কোস্টান জোন রেগুলেশন আইন মতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মৎসজীবীদের কয়েকটি সংগঠন ভারতের সুপ্রিম কোর্টে এই অনাচারের বিরুদ্ধে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে। সুপ্রিম কোর্ট তৎক্ষণাৎ এই সব কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং এই বিষয়টি নিয়ে আরও তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি কমিটি গড়ে দেয়। কিন্তু তত দিনে আমাদের দেশে ভুবনায়নের রথের চাকা চলতে শুরু করেছে গড়গড়িয়ে, কোনও ধরনের আইনি বা প্রাতিষ্ঠানিক বাধাকে উপেক্ষা করার এবং জনমানসে সেগুলি মেনে নেওয়ার ও সম্মতি আদায়ের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে পুরো দমে। তাই আমরা দেখি, সুপ্রিম কোর্ট আচমকাই আদানি সংস্থার মুদ্রা বন্দরের ওপর জারি করা তার নিজের দেওয়া নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। অবশ্য কোর্ট বলে যে তার ব্যবসার ক্ষতি না করে আদানি সংস্থা যেন কোস্টাল রেগুলেশন আইনের যতটা সম্ভব মান্যতা দেয়! পরে গুজরাট হাইকোর্ট দেখে যে এই মুন্দ্রা বন্দর ভারতে কোস্টাল রেগুলেশান জোন সংক্রান্ত আইন পুরোপুরি ভঙ্গ করেছে।
এইবার আসা যাক হাজিরা পোর্ট প্রাইভেট লিমিটেড বা এইচপিপিএল এর কথায়। এই সংস্থাটির জন্ম হয় শেল গ্যাস বিভি এবং ফরাসি দেশের টোটাল গাজ ইলেক্ট্রিসিটে-র যৌথ উদ্যোগে। গুজরাট সরকারের উন্নয়ন মডেলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গুজরাট সরকার ২০০২ সালে, অর্থাৎ গুজরাট দাঙ্গার বছরেই, হাজিরা পোর্টকে ৩০ বছরের জন্য তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস খালাসের অধিকার দিয়ে দেয়। এই অধিকার দেওয়ার সঙ্গে অবশ্য একটি
“ছোটো শর্ত” ছিলো, যার গুরুত্ব তখন বোঝা যায় নি! হাজারি পোর্ট প্রাইভেট লিমিটেড, এই তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা মাল, যা বন্দরের ভাষায় কার্গো, খালাসের পাশাপাশি অন্যান্য কার্গো খালাসের পরিকাঠামো গড়ে তুলবে এবং তার জন্য গ্লোবাল টেন্ডার ডাকতে হবে। গুজরাট সরকারের মদতে এবং প্রবল চাপের মুখে পড়ে হাজিরা সংস্থা, আদানি গোষ্ঠীর সদ্য নির্মিত মুন্দ্রা পোর্ট ও সেজ সংস্থা, বা এমপিএসইজেড সংস্থাকে সেই কাজের বরাত দেয়!
হাজিরা সংস্থার জন্য যে কৌশলটি আদানি গোষ্ঠী অবলম্বন করে, সেটি তারা এর আগে কয়েকবার ব্যবহার করে সেটিকে তারা সূক্ষ্ম শৈল্পিক স্তরে নিয়ে যায়। হাজিরা-র ঘটনা ঘটার মাত্র কয়েক বছর আগে তারা গুজরাটেরই দাহেজ বন্দরের ক্ষেত্রে এই মডেলটি প্রয়োগ করে। গুজরাটের দাহেজ-এ একটি বেসরকারি বন্দর, পেট্রোনেট এলএনজি লিমিটেড মারফৎ গুজরাট সরকার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস কার্গো খালাসের বরাত দেয়। সঙ্গে একটি শর্ত জুড়ে দেয় যে তাদের অতিরিক্ত জমিতে অন্যান্য কার্গো খালাসের পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। বলাই বাহুল্য, এই অন্যান্য কার্গো খালাসের বরাত পায় আদানির এমপিএসইজেড সংস্থা। আদানির পরের শিকার গুজরাটের ধলেরা বেসরকারি বন্দর, যেটি আদানি গোষ্ঠী, জেকে গোষ্ঠীর সহায়তায় নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্ব কব্জা করে।
এর পর আদানি গোষ্ঠী তার শুঁড় বিস্তৃত করে সরকারি বন্দরগুলির দিকে। পশ্চিম উপকূলে, দক্ষিণ গোয়াতে ভারত সরকার তার নিজস্ব মালিকানায় কয়লা খালাসের জন্য একটি নতুন বন্দর নির্মাণ করে, বন্দরটির নাম মোর্মুগাও বন্দর। সময়কাল ২০০৯। এটি এখন আদানির দখলে।
ভারত সরকারের নিজের হাতে রয়েছে ১২ টি বড়ো মাপের বন্দর, যার মাধ্যমে জলপথে দেশের বহির্বাণিজ্যের ৭২ শতাংশ নির্বাহ হয়ে থাকে। ভারত সরকারের সঙ্গে দোস্তির সম্পর্কে বাঁধা পড়া অন্যতম দোসর পুঁজি, আদানি সংস্থা আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর রাজনৈতিক দল, ভারতীয় জনতা পার্টির মাধ্যমে এখন দেশের ৯০ শতাংশ কার্গো যে সব সমুদ্র বন্দর মারফৎ আমদালি-রপ্তানি হয়, সেগুলি কব্জা করতে চলেছে।
আদানি এখন প্রাথমিকভাবে হাত বাড়িয়েছে রাজ্য সরকারগুলির হাতে থাকা বন্দরগুলিতে, যেগুলি রাজ্য সরকার বেসরকারি হাতে তুলে দিয়ে বেসরকারি সংস্থা মারফৎ “বন্দর উন্নয়ন ও পরিচালনা” করতে চাইছে। এই বিষয়ে প্রাইভেট সংস্থাগুলি খুবই খুশি, কেননা ভারত সরকারের কার্গো খালাস সংক্রান্ত যে সব আর্থিক নিয়ম কানুন আছে, বেসরকারি সংস্থার সেগুলি মেনে চলার কোনও দায় বা দায়িত্ব নেই, যেমন নেই বন্দরের শ্রমিকদের জন্য শ্রম সংক্রান্ত আইন মেনে চলার দায়।
আট বছরেরও কম সময়ে এই মুন্দ্রা পোর্ট ও “সেজ” সংস্থা কার্গো লেন-দেন-এ ভারতে অষ্টম বৃহত্তর সমুদ্র বন্দরের স্থান দখল করে নেয় আর পিছনে ফেলে দেয় ভারত সরকারের অধীনে থাকা কোচি, এনমোর, তুতিকোরিন, নিউ ম্যাংগালোর এবং মোরমুগাও-কে। ইউপিএ সরকারের শেষ বছর, ২০১৩তে এসে আমরা দেখছি যে মুন্দ্রা বন্দরের কার্গো লেনদেন-এর ক্ষমতা দাঁড়িয়েছে অন্তত ১০০ মেট্রিক টন! মোদির গুজরাট সরকারের বদান্যতায় মুন্দ্রা বন্দরের এই বাড়-বাড়ন্ত দেখে কেন্দ্রের মনমোহন সরকার তার অধীনে থাকা নিকটবর্তী বন্দর, কান্ডলা-র ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন এই বন্দরটি এতদিন দেশের বৃহত্তর কার্গো চলাচল ও মাল লেনদেন-এর বন্দর ছিল।
২০১৩র মার্চ মাসেও এই বন্দরটি ৭২.২ মেট্রিক টন কার্গো সামলেছিল, আয় করেছিল ৫০০ কোটি টাকার ওপরে। অন্য দিকে, মুন্দ্রা বন্দরের অবস্থান কান্ডলা থেকে মাত্র সামান্য কিছু নটিক্যাল মাইল ( ১/২ নটিক্যাল মাইলে এক কিলোমিটার) দূরত্ব, অথচ সেই একই সময়ে মুন্দ্রা বন্দরে মাত্র ৩৫.8 মেট্রিক টন কার্গো সামলিয়েছে। অথচ, গুজরাট সরকার দ্বারা শুল্ক ছাড়, উচ্চ হারে মাল খালাসের দর ইত্যাদির কারণে এই মুন্দ্রা বন্দরটি ২০১৩ সালের মার্চ মাসে ১১৪০ কোটি টাকা আয় করেছে, কান্ডলার দ্বিগুণেরও বেশি!
সরকারি বন্দরে মাল খালাসের বিভিন্ন কাজ বিভিন্ন সংস্থা করে থাকে, কিন্তু মুন্দ্রা বন্দরে মাল খালাসের যাবতীয় কাজ করে মুন্দ্রা বন্দর ও “সেজ” সংস্থা। ফলে পরিকাঠামো খাতে তার লগ্নির এক বিরাট অংশ সে দ্রুত তুলে নিতে সক্ষম হয়। বন্দরে খালাসের একটি পরিকাঠামো নির্মাণ বা টার্মিনাল নির্মাণের সংগে একটা গোটা বন্দর নির্মাণের জটিলতার কোনও তুলনাই চলে না। গুজরাট সরকারের বদান্যতায় সাধারণ গুজরাটবাসীর করের টাকার মুন্দ্রার মাধ্যমে আদানি একটি চালু বন্দর তৈরির অভিজ্ঞতা সামান্য হলেও অর্জন করতে সক্ষম হয়!
কান্ডলা বন্দরের মাধ্যমে যে সব জাহাজ সংস্থা তাদের মাল চলাচল করত, গুজরাট সরকারের আদানির প্রতি পক্ষপাতিত্বকারী নীতির জন্য তারা অসুবিধার সন্মুখীন হতে শুরু করে। এই রকম একটি সংস্থার নাম ঋষি শিপিং। এই সংস্থাটি কান্ডলা বন্দরের সর্ব বৃহৎ কার্গো লেন-দেন-এর সংস্থা ছিল বহু বছর ধরে। এই সংস্থার কর্ণধার এক সময় সাংবাদিক সন্মেলন করে অভিযোগ করেন যে কান্ডলা পোর্ট-এর ম্যানেজমেন্ট-এর দায়িত্ব থাকা দুজন ম্যানেজার প্রকাশ্যেই মুন্দ্রা পোর্ট ব্যবহারের জন্য বন্দর ব্যবহারকারীদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। মুন্দ্রা এবং কান্ডলা-র ব্যালান্স শিট দেখলেই বোঝা যায় যে কান্ডলার ক্ষেত্রে ঠিক যত টাকা ক্ষতি হয়েছে, মুন্দ্রা পোর্ট ঠিক সেই পরিমাণে অর্থ মুনাফা হিসেবে জমা করেছে।
দু একটা উদাহরণ দেওয়া এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ২০০০ সালে অস্ট্রেলিয়ার মান্য জাহাজ ও বন্দর ব্যবসার সংস্থা ভারত সরকারের মাধ্যমে গুজরাট সরকারকে প্রস্তাব দেয় যে তারা কান্ডলা বন্দরে একটি কন্টেনার কার্গো টার্মিনাল নির্মাণ করবে ও চালাবে ৩০ বছর ধরে এবং তারপর সেটি তারা গুজরাট সরকারকে দিয়ে দেবে। এই পদ্ধতিটি “বিল্ট, অপারেট এন্ড ট্রান্সফার” বা “বোট” (BOT) নামে বহুদিন হলো চলে আসছে। গুজরাট সরকার এই প্রস্তাব মেনে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার পি এন্ড ও পোর্টস সংস্থাকে সম্মতিসূচক চিঠিও দিয়ে দেয়।
আচমকাই একদিন গুজরাট সরকার অস্ট্রেলিয়ার এই সংস্থার কাছ থেকে সম্মতিসূচক চিঠিটি প্রত্যাহার করে নেয়। পরে দেখা যায় অস্ট্রেলিয়ার সংস্থাটি সেই একই প্রস্তাব নিয়ে মুন্দ্রা পোর্ট-এর কাছে গেছে এবং রেকর্ড সময়ে অস্ট্রেলিয় সংস্থাটি মুন্দ্রা পোর্ট-এ সেই একই কাজ শুরু করেছে! ফলে আমরা দেখি যে ২০১২-১৩ সালে কান্দলা যেখানে ১,১৮,০০০টন কন্টেনার খালাশ করেছে, সেখানে মুন্দ্রা পোর্ট খালাশ করেছে ১৭ লক্ষ টন কন্টেনার, যার একটা বড়ো অংশই করেছে অস্ট্রেলিয়ার সংস্থাটি! দ্বিতীয় উদাহরণটি আরও সাঙ্ঘাতিক। যে কোনও পোর্টের আয় নির্ভর করে সেই পোর্টটি কত দ্রুত তার ক্ষমতা, অর্থাৎ নতুন নতুন বার্থ ও টার্মিনাল বন্দরে যোগ করতে পারছে। ১৯৯৭ সালে কান্ডলাতে সর্বমোট আটটি জলহীন বা “ড্রাই” বার্থ ছিল। ২০১৩তে সেখানে মোট ১৩টি “ড্রাই বার্থ” তৈরি হয়। পরে সেখানে আরও ৬টি তেল খালাসের বার্থ, বা অয়েল বার্থ নির্মিত হয়।
পাশাপাশি আমরা তুলনা করি মুন্দ্রা পোর্ট-এর। ১৯৯৭ সালে সেখানে একটাও ড্রাই বার্থ ছিল না, আর সেই একই সময়সীমায় সেখানে নির্মিত হয়েছে ২৮টি ড্রাই বার্থ এবং ৪টি তেল খালাসের বার্থ! কান্ডলার ক্ষেত্রে এই আপেক্ষিক ধীর গতিতে ক্ষমতার উন্নতির কারণ হলো, মূলত গুজরাট সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরণের ছাড়পত্র দানের ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত দীর্ঘসূত্রিতা। লাল ফিতের ফাঁসে এই বন্দরটিকে কেন্দ্রীয় সরকার কম নাজেহাল করে নি! অথচ, কান্ডলার ভাগে রয়েছে প্রায় ৬৯ কিমি-র মত সাগরের বেলাভূমি বা “কোস্ট-লাইন”, ২,৪৪,০০ একরের মত জমি, যা তাকে এক সর্ব বৃহৎ বন্দরের তকমা দেওয়ার জন্য যথেষ্ঠ।
তৃতীয় একটি বিষয় এই কান্ডলা বন্দরের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, তা হলো বন্দরের জন্য মাটি সরানো বা “ড্রেজিং”। একটি বন্দরের নাব্যতা নির্ভর করে সমুদ্রের তলদেশ থেকে সমুদ্রের জলতলের উচ্চতার ওপর। কান্ডলার ক্ষেত্রে এই উচ্চতা বা “ড্রাফট” ১২ মিটারের মত, যেখানে মুন্দ্রা জন্য তা ১৪ মিটার। কিন্তু নানা আছিলায় কান্ডলায় ড্রেজিং বন্ধ বেশ কয়েক বছর, আর গুজরাট সরকার সেই পরিকাঠামো মুন্দ্রাকে ব্যবহার করতে দিচ্ছে নিয়মিত, ফলে মুন্দ্রা পোর্ট-এর “ড্রাফট” বজায় থাকছে!
এখন জাহাজের ব্যবসার মেজাজ বদল ঘটেছে, এখন জাহাজ কম্পানিগুলি বড় এবং ভারি জাহাজ বন্দরে আনছে, যার জন্য প্রয়োজন অন্তত ১১ মিটার “ড্রাফট”। কান্ডলা-র ১২ মিটার “ড্রাফট”-এর কারণে অনেক বড়ো ও ভারি জাহাজ এই বন্দরে আসতে ভয় পায়, তারা মুন্দ্রাতে চলে যেতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। কান্ডলা যে এখনও টিকে আছে তার কারণ তার ভৌগোলিক অবস্থান, এখান থেকে উত্তর ভারতে পণ্য চালান সবচেয়ে সুবিধাজনক, তাই আদানি চায় এটিকে রুগ্ন করে এক সময়ে এই বন্দরটিকে জলের দরে দখল করতে। গল্পকথা নয়। সম্প্রতি কান্ডলা পোর্ট তার কার্গো ও কন্টেনার ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বেসরকারি সংস্থার কাছে নিলামে দর নেয়। সব কটি নিলামই আদানি কোম্পানি কুক্ষিগত করেছে!!
এইবার আমরা ফিরে আসি গুজরাট থেকে সারা ভারতের প্রেক্ষিতে। ২০১৪ সালে এবং ২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদি পরপর দুবার ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করলেন। ২০১৭ সালেই লোকসভায় বিরোধী দলের সদস্যরা অভিযোগ তোলেন যে আদানি গোষ্ঠীকে অন্যায্য সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য ভারত সরকার “সেজ” আইনে আদানির সুবিধার্থে নানা সংশোধন এনেছেন। আদানি গোষ্ঠী বড় রকমের ব্যবসায়িক লগ্নি শুরু করে ১৯৮৮ সাল থেকে। আদানি পোর্টস এন্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেড ভারতের বৃহত্তম বন্দর নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনার কোম্পানি। দু দশক বাদে, অর্থাৎ ২০০৮-এ, মোদি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী, তখন এই সংস্থাটি সারা ভারতের একগুচ্ছ সরকারি বন্দর কিনে নেয় বা সরকারি বন্দরের উন্নয়নের বা পরিষেবাদানের দায়িত্ব পায়। এই সময়ে যে ১০টি পোর্ট তাদের মালিকানাধীনে আসে, সেগুলি মিলিতভাবে ভারতের বন্দরের সক্ষমতার ২৪ শতাংশ। আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আর্থিক নয়ছয়ের অভিযোগও নতুন কিছু ঘটনা নয়, তবে কোনও ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর মাথায় যদি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদ থাকে তো তার সাত-খুন মাপ। আমরা যদি ২০১৭-১৮ সালের ভারতের কম্পট্রোলার এবং অডিটর জেনারেলের বা চলতি ভাষায় সিএজি রিপোর্টে চোখ বোলাই, তাহলেই বিষয়টি মালুম হবে। এই রিপোর্টটি কেরালায় অবস্থিত আদানি-র ভিজিনজ্যাম বন্দর নিয়ে মন্তব্য করেছে যে এই প্রকল্পটির বরাত আদানি-র সংস্থাকে দেওয়াতে স্পষ্টতই দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এই কাজ করা সম্ভব হয়েছে, কেননা ভারতের লোকসভা এবং রাজ্যসভা, এই উভয় কক্ষেই প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদির প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে বিশেষ আর্থিক অঞ্চলে থাকা বন্দরগুলির বেসরকারিকরণের নিয়ম-কানুনে এমন সব পরিবর্তন আনা হয়েছে যার সাহায্যে আদানি গোষ্ঠীর পক্ষে এই সব বরাত পাওয়া সম্ভব হয়। এই বন্দরটি ভারতের প্রথম “ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট”, যেখানে একটি জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে মাল খালাস হয়, সেই পোর্টটি নিয়ে পরিবেশ ধ্বংসের অগুনতি অভিযোগ আছে। সারা পৃথিবীর এই জাতীয় বন্দরের জন্য সমুদ্রের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। এই পোর্টটির সমুদ্রের একটি বড়ো অংশ কেরালার ভাগে পড়েছে। কেরালার পরিবেশবাদী সংস্থাগুলি এই বিষয়ে অনেকদিন ধরেই সরব। আদানি যে কেবল কেরালার মত রাজ্যে পরিবেশ ধ্বংসকারী বলে চিহ্নিত হয়েছে তাই নয়, এই বিষয়ে তার কুখ্যাতি দেশের সীমান্ত পেরিয়ে সেই সুদূর অস্ট্রেলিয়াতেও পৌঁছেছে। অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড-এ আদানি কারমাইকেল নামে একটি কয়লা-খনি চালানর সিদ্ধান্ত নেয়। আইনি লড়াই এবং বিশ্বব্যাপী বিরূপ প্রতিক্রিয়াকে উপেক্ষা করে এই কয়লা প্রকল্পটি চালাতে গিয়ে আদানি সংস্থা স্থানীয় মানুষের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে শেষ পর্যন্ত পেছিয়ে আসতে বাধ্য হয়।
২০১৪ থেকে ২০১৯, প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদিজি-র প্রথম দফার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তিনি প্রায় সারা পৃথিবী পরিভ্রমণ করেছেন ৪১ বার, গেছেন সর্বমোট ৫২টি বিভিন্ন দেশে, সব মিলিয়ে বিদেশে সময় কাটিয়েছেন ১৬৫ দিন। তাঁর এবং তাঁর স-পারিষদ ভ্রমণের খরচা মিটিয়েছে ভারতে করদাতা জনগণ, মোট খরচ টাকার অঙ্কে ৩৫৫ কোটি টাকা। সংসদে এবং তথ্য জানার অধিকার আইন প্রয়োগ করে দেশের “প্রতিরক্ষার বিষয়ক” এই সব “স্পর্শকাতর” তথ্য জানা গেছে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে এই সব তথ্যের অবতারণার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রধানমন্ত্রীর পরিযায়ী পাখির মতো এই বিশ্ব পরিভ্রমণে ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে সরকারি খরচে তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন গৌতম আদানি এবং ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আম্বানি ভ্রাতৃদ্বয়।
এই সব বিদেশী সফরে, প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ও সুপারিশে আদানি ও আম্বানি-র বিভিন্ন সংস্থা ১৬টি দেশে ১৮টি ব্যবসায়িক চুক্তি সম্পাদন করে। এই ১৮টি চুক্তির মধ্যে আদানি গোষ্ঠী কব্জা করে ১৩টি, বাকি ৫টির দখল নেয় অনিল ধীরুভাই আম্বানি গোষ্ঠী।
দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠানের পর মোদিজি অগস্ট ৩০ থেকে সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৪, মোট ৫ দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে জাপান যান। এই সফর আদানি এবং আম্বানি গোষ্ঠী-র প্রতিনিধিরা ছিলেন। ঠিক দু বছর পর, নভেম্বর ১১-১২, ২০১৬ এক ঝটিকা সফরে তিনি দ্বিতীয়বার মাত্র একদিনের জন্য জাপান সফরে যান, এবার সঙ্গে স্রেফ আদানি। প্রথম সফরে আদানির সংস্থা, আদানি লজিস্টিক্স জাপানের সঙ্গে এক বিরাট দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে। জাপানের দিকের পার্টনার এনওয়াইকে অটো লজিস্টিক্স। দ্বিতীয় সফরে চূড়ান্ত হয় যে এই দুই সংস্থা মিলে ভারতে পণ্যবাহী অটোমোবাইল ট্রেন চালাবে। আমাদের মনে পড়বে, ২০১৫ থেকেই মোদি সরকার যাত্রীবাহী ট্রেনের সুবিধা কমিয়ে দিয়ে ভারতীয় রেলের পয়সায় “ফ্রেট করিডোর” বানানোয় উঠেপড়ে লাগে। এখন দেশের মুখ্য রেলওয়ে জংশন গুলি, যেগুলির মাধ্যমে পণ্য চলাচল মসৃণ হবে, সেগুলি আদানিকে ভারতীয় রেল বেচে দিয়েছে, যেমন দক্ষিণ-পূর্ব রেলপথের খড়্গপুর জংশন।
২০১৪ সালের জি-২০ নামক দেশগুলির শীর্ষ বৈঠক বসে অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন শহরে। এই উপলক্ষে এই জোটের সদস্য হিসেবে ভারত সরকারে এই বড়ো প্রতিনিধি দল নভেম্বর ১৪ থেকে ১৮তে অনুষ্ঠিতব্য এই সম্মেলনের উদ্দেশে যাত্রা করে এই দলে ভারতীয় শিল্পপতিদের প্রতিনিধি হিসেবে আরও কয়েকজনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গী হন শ্রী গৌতম আদানি মহাশয়। গুরুগম্ভীর আলোচনার ফাঁকে নভেম্বর ১৮তে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড সরকারের সঙ্গে, স্বল্প সময়ের মেয়াদে, রেল ও পোর্ট পরিষেবা নির্মাণ ও উন্নতির বরাতের প্রতিশ্রুতি আদায় করে আদানি গোষ্ঠী। এক্ষেত্রে আর্থিক দায়ভারের দায়িত্ব বর্তায় ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্কের ওপর। এই মর্মে ঐ প্রতিনিধি দলে স্টেট ব্যাঙ্ক-এর তৎকালীল মুখ্য আধিকারিক শ্রীমতী অরুন্ধতী ভট্টাচার্য এই চুক্তিতে সই দেন। ঠিক হয় ভারতীয় স্টেট ব্যঙ্ক এই প্রকল্পে আদানি গোষ্ঠীকে ৬২০০ কোটি টাকা “ঋণ” দেবে। এই রেল ও পোর্ট-এর মুখ্য উদ্দেশ্য, কুইন্সল্যান্ড অঞ্চলের সরেস কয়লা রপ্তানির জন্য পরিবহনের উন্নত পরিষেবা দেওয়া, আদানি যে এই কয়লাখনি আগেই পেয়েছিল এবং তার রহস্য ও সেই প্রকল্প থেকে পেছিয়ে আসার কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। আদানি সংস্থা তো নিশ্চিন্তে “ঋণ” নিয়ে তার প্রকল্প গুটিয়ে নিল। যে সব আমানতকারী তাঁদের রক্ত জল করা টাকা নিশ্চিন্তে স্টেট ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রেখেছিলেন তাদের কী দুর্দশা হলো একবার দেখে নেওয়া যেতে পারে। স্টেট ব্যাঙ্ক এই টাকা একটি বেসরকারি ব্যাঙ্ক মারফৎ আদানিকে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। ঐ ব্যাঙ্কটি এখন দেউলিয়া, স্টেট ব্যাঙ্ক ২০২০-২১ সালের তার “নন-পারফর্মিং অ্যাসেট” তালিকায় এই ঋণটিকে ঠেলে দিয়েছে। আমানতকারীরা পড়েছেন গভীর গাড্ডায়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিজি-র মালয়েশিয়া সফরকে ভারতের কর্পোরেট দুনিয়া এই দুই দেশের আর্থিক সম্পর্কের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ দিক-চিহ্ন হিসেবে বর্ণনা করে। ২০১৫ সালের ২১-২২ স-পারিষদ মোদি শ্রী গৌতম আদানিকে নিয়ে এই দেশ সফরের সময় সর্বমোট ৩১টি এমওইউ-তে সই দিয়ে আসেন। ২০১৭তে ভারত ও মালয়েশিয়া ভারতের আদানি গোষ্ঠী ও মালয়েশিয়ার এমএনসি পোর্ট সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে মালয়েশিয়ার ক্লাং বন্দর-এর সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে “ কেরি আইল্যান্ড পোর্ট প্রকল্প” নামক একটি নতুন প্রকল্পের সম্ভাব্যতা নিয়ে সমীক্ষার বরাত পায়। এই ক্লাং বন্দরটি কন্টেনার বন্দর হিসেবে বিশ্বের ১১ তম বৃহৎ বন্দর। ২০১৮তে মালয়েশিয়ার সরকার, ভারত সরকারের আদানি সংস্থার পক্ষে দেওয়া “গ্যারান্টি”-র ভিত্তিতে কেরি দ্বীপে একটি বন্দর শহর গড়ার জন্য ভারতের আদানি গোষ্ঠী, এবং মালয়েশিয়ার এমএনসি পোর্ট ও সাইম ডার্বি প্রপার্টি-র সঙ্গে যৌথ ভাবে গড়ার বরাত দেয়। বরাতের পরিমাণ ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া মোদির সফরের পাশাপাশি আদানি আরও যেসব বরাত কুক্ষিগত করে তার তালিকা বিরাট, এখানে আমরা আর গুটিকয়ের কথাই মাত্র বলবো। ২০১৬ সালে ইরানের ছাবাহার বন্দর ( যেটি দখল করেছে আদানির সংস্থা, আদানি পোর্ট এন্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেড, আদানি বরাত পেয়েছে ভারত সরকারের কাছ থেকে ঋণ গ্যারান্টি নিয়ে ৬৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের)। আফ্রিকার মোজাম্বিকের ঘটনাটি দোসর পুঁজির বিষয়টি একেবারে বেপর্দা করে দিয়েছে। মোদি তাঁর মোজাম্বিক সফরের সময় ( আদানিকে সঙ্গে নিয়ে, জুলাই ৭, ২০১৬ ) মোজাম্বিক থেকে দানা শস্য কেনার এক চুক্তি করেন, চুক্তি হয় দুই সরকারের মধ্যে। মোদির মোজাম্বিক সফরের এক বছর আগেই ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে সরকারি পরিকাঠামো ব্যবহার করে মোজাম্বিক থেকে ভারতে দানা শস্য আমদানি করা হবে। মোজাম্বিকের সঙ্গে দানা শস্য আমদানির চুক্তি হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে ভারতীয় সরকারি সংস্থা, ইন্ডিয়া পালস, এই আমদানির বরাত দিয়ে দেয় আদানি পোর্টকে!
এই বিষয়ে সর্বশেষ বিষয়টির বর্ণনা দিয়ে আমরা এই পর্বের ইতি টানবো। দিঘি বন্দরটি ভারতের পশ্চিম উপকূলে আরব সাগরের রাজপুরি খাড়ির কাছে অবস্থিত, মহারাষ্ট্রের রায়গাড়া জেলায়, মুম্বাই বন্দর থেকে প্রায় ৪২ নটিক্যাল মাইল তফাতে। মুম্বই শহর থেকে গাড়ি করে পৌঁছতে সময় লাগে চার ঘন্টার মতো, দূরত্ব কম-বেশি ১৭০ কিমি হবে। দোসর পুঁজি নিয়ে আলোচনার সময় হয়তো অনেকেরই ধারণা ( নিঃসন্দেহে ভুল ধারণা) যে কেন্দ্রের ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার বা যে যে রাজ্যে তারা ক্ষমতায় আসীন, কেবল তারাই বুঝি দোসর পুঁজির তাঁবেদার। একথা ঠিক যে মোদি ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর পরই প্রতি বছরের বাজেটে সরকারি বা সরকারি অধীনের সংস্থাগুলিকে ( যাকে পাবলিক সেক্টর আন্ডারটেকিং, বা পিএসইউ বলা হয়) সরাসরি দোসর পুঁজির হাতে তুলে দেওয়ার একটার পর একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মহারাষ্ট্রের শিবসেনা সরকার যতদিন বিরোধী আসনে ছিল, ততদিন তারা সরকারি সম্পত্তির বেসরকারিকরণ এবং আদানি গোষ্ঠী নিয়ে চড়া সুরে বিরোধিতা করেছে। কিন্তু তারা ক্ষমতায় এসেই তারা সরকারের অধীনে এই সামান্য লাভজনক বন্দরটিকে আদানি পোর্ট-কে ১০ হাজার কোটি টাকায় বেচে দিয়েছে ফেব্রুয়ারি ২০২১-এ। এই নিয়ে আদানি ভারতের ১২টি সমুদ্র বন্দরের দখল নিলো। শুধু তাই নয়, এখন থেকে আদানি গোষ্ঠী ভারতের সরকারি বন্দরের শৃঙ্খলটিকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে সারা ভারতের কাঁচা মাল দেশের “ফিনান্সিয়াল ক্যাপিটাল”, মুম্বইতে নিশ্চিন্তে এনে ফেলতে পারবে এবং অচিরেই বন্দর ব্যবসায় প্রায় “মোনোপলি” গড়ে তুলতে পারবে! এই বন্দর কেনার সংবাদে ভারত ও বিদেশের স্টক মার্কেটে আদানির শেয়ারের দাম আগের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ। মজার কথা হলো, ২০২০ সালে শিবসেনার পক্ষ থেকে বন্দর বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রতিবাদ জানানো হয়, এমনকি বন্দর বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে যখন এই দিঘি বন্দরের শ্রমিকরা হরতাল ডাকেন , তখন একাধিক শিবসেনা নেতা গিয়ে শ্রমিকদের ধর্ণামঞ্চে উপস্থিত থেকে তাঁদের পুরো মদত দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। বর্তমান মহারাষ্ট্র সরকারে শিবসেনার জোটসংগী, শারদ পাওয়ারের দল, এনসিপি, জওহারলাল নেহরু বন্দরের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে আন্দোলনও করেছে। এই অতিমারীর সময় ছাড়া এই দিঘি বন্দর কখনোই ক্ষতিতে চলেনি। কেন্দ্রীয় সরকারের বন্দর নীতি ও টারিফ যেমন অন্যান্য সরকারি বন্দরকে বেসরকারি বন্দরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেছিয়ে দিচ্ছে ক্রমাগত, দিঘি বন্দরও তার ব্যতিক্রম নয়।
এই বন্দরের বেসরকারিকরণের পেছনে এক বিরাট আর্থিক কেলেংকারির খেলাও রয়েছে। আমরা আগেই দেখেছি কীভাবে মোদি সরকার ধারাবাহিকভাবে ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্ক-এর আমানতকে আদানির দিকে চালান করেছে। প্রায় সেই একই ধরণের কেলেংকারির দেখা মেলে আমরা যদি অনিল আম্বানির দেউলিয়া হয়ে যাওয়া শিপইয়ার্ড সংস্থা, রিলায়েন্স নাভাল এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড-এর কাহিনির দিকে তাকাই। ভারতের আর এক দোসর পুঁজি, নবীন জিন্ডাল-এর জেওএসপিএল সংস্থা অনিল আম্বানির এই দেউলিয়া সংস্থাটি কিনতে আগ্রহী। কিন্তু তারা সরকারকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে সরকারি ট্রাইব্যুনাল যতক্ষণ না ব্যাঙ্ক-এর পাওনা নিয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিচ্ছে, ততক্ষণ তারা এই কেনাতে আগ্রহী নয়। ভারতের ন্যাশানাল কোম্পানি ল ট্রাইব্যুনাল ঋণ-দেওয়া ব্যাঙ্ক ও সংস্থাগুলিকে আরও পাঁচ মাস সময় দেয়, যার মধ্যে তারা যেন তাদের প্রাপ্য টাকা তারা “উদ্ধার” করে নেয়! বিভিন্ন ব্যাঙ্ক-এর কাছে আম্বানি সংস্থার ঋণের পরিমাণ মাত্র ১১ হাজার কোটি টাকা। ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য ঋণদাতা সংস্থাকে রিলায়েন্স সংস্থার সম্পত্তি বিক্রি করে যদি তাদের টাকা উশুল করতে হয়, তবে তাদের আবার রিলায়েন্সেরই খপ্পরে পড়তে হবে। রিলায়েন্স-এর একটি “সেজ” সংস্থা গুজরাট সরকারের কাছে থেকে দীর্ঘ মেয়াদি লিজ নিয়ে এক বিরাট পরিমাণ জমি নিজেদের কব্জায় এনেছে। এই “সেজ” কোম্পানিটি আবার রিলায়েন্স শিপইয়ার্ডকে বিরাট দামে তার “সেজ”-এর জমি লিজ দিয়েছে। এখন শিপইয়ার্ডের অনেক সম্পত্তি বাঁধা দেওয়া আছে রিলায়েন্সের “সেজ” কম্পানির কাছে। অতএব, ব্যাঙ্ক বা অন্যান্য ঋণ দেওয়া সংস্থাকে আগে রিলায়েন্স-এর “সেজ” সংস্থাকে তার লিজের পাওনা মেটাতে হবে, এবং তারপর তাকে শিপইয়ার্ড-এর সম্পত্তি বেচে তার ঋণ এবং লিজ মেটানর টাকা সুদ সহ উশুল করতে হবে! এ যেন একেবারেরি খুড়োর কল, ঋণের টাকার নাগাল পাওয়ার জো নেই!
দোসর পুঁজির কারিকুরির শেষ নেই। পরের পর্বে আমরা তাদের অন্যান্য কয়েকটি ক্ষেত্রে খেলা আবার দেখবো।