পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস ও দোসর-পুঁজি পর্ব-তিন

  • 10 April, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1811 view(s)
  • লিখেছেন : শুভাশিস মুখোপাধ্যায়
যে দোসর-পুঁজি আজ আমাদের দেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তাদের চেতনায় সারা দেশটি তাদের মুনাফার জন্য মৃগয়াক্ষেত্র মাত্র, সেখানে না আছে মানুষের স্থান, না আছে প্রাণীজগতের অন্য প্রজাতির স্থান।

যে সম্পত্তির মালিকানা পেতে গাঁটের কড়ি গুনতে হয় না, যে জমি ব্যবহার করে মুনাফার জন্য বিনা সুদে, বিনা বন্দকিতে ফেরত-না-দিলেও কিছু যায়-আসে-না এমন শর্তে ব্যাঙ্ক থেকে “ধার” পাওয়া যায়, সেই সম্পত্তি হলো দুর্বৃত্ত ফড়ে-দালালদের জন্য স্বর্গলাভ। তেমন সম্পত্তি হলো ভারতের জঙ্গল আর আদিবাসীদের জমি। আর তেমন “গৌরী সেন” আমাদের দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি

১৯৮০ সাল থেকে এই আজ পর্যন্ত ভারতে বড়ো বড়ো “শিল্প” গড়ার নামে এক বিরাট অরণ্য-নিধন চলেছে হরেক রঙ আর মতাদর্শ দ্বারা পরিচালিত সরকারের হাত ধরে, ভারতের অরণ্য-শামিয়ানা কমেছে প্রায় ২০ শতাংশের আশপাশে। এর বিনিময়ে পাওয়া গেছে পরিবেশ আর জীবিকা-বিধ্বংসী হাজার ২৪ “প্রকল্প”, যেগুলোর এক বিরাট অংশ অসম্পূর্ণ, মাঝপথে পরিত্যক্ত, ব্যাঙ্ক ঋণ খেলাপি। ধ্বংসের এই উৎসবে মাতোয়ারা সরকার থেকে দস্যু কর্পোরেট সবাই।

১৯৮৬ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে সারা দেশে ১৪ হাজার বর্গ কিমি-র মতো অরণ্যানী প্রায় হাজার চব্বিশেক “উন্নয়ন প্রকল্প”-এর জন্য বিসর্জিত হয়েছে। আজকে কৃষি আন্দোলনে উত্তাল যে হরিয়ানা প্রদেশ, তার ক্ষেত্রফল কম-বেশি ১৫ হাজার বর্গ কিলোমটার; উন্নয়নের আগ্রাসনে গত তিন দশকে আমরা হরিয়ানার মতো ক্ষেত্রফলের একটি প্রদেশকে কুরবানি দিয়ে বসে আছি!

অবশ্য সব রঙের এবং জাতের সরকারের বনমন্ত্রীবর্গ একবাক্যে রামধুন গেয়ে আমাদের শুনিয়েছেন যে অবস্থাটা মোটেই এত বিপদের নয়, এসবই পরিবেশবাদীদের “গভীর চক্রান্ত”! আসলে সরকার দ্বিগুণ উৎসাহে এই সময়ে ”বন-সৃজন” চালিয়ে ভারতে বনাঞ্চল-শামিয়ানার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটিয়েছে

কিন্তু সরকারি রির্পোটগুলোই সরকারের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দিয়ে জানিয়েছে যে, এক) বন-সৃজনের মাধ্যমে সৃষ্ট কৃত্রিম অরণ্য কোনও ভাবেই হারিয়ে যাওয়া অরণ্যের পরিপূরক নয়, দুই) গত ১৫-১৬ বছরে ভারতে ১৩ শতাংশ অরণ্য বৃদ্ধির যে তথ্য সরকার বারে বারে প্রচার করছে, তা অতিরঞ্জিত, সংখ্যাতত্ত্বের কারচুপি ছাড়া আর কিছুই নয়।

সরকারের সিএজি রির্পোট-ও সরকারের বিরুদ্ধে গেছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, যে সব শর্ত সাপেক্ষে এই সব প্রকল্পগুলিকে জঙ্গলের জমি ব্যবহার করার ছাড়পত্র মঞ্জুর করা হয়েছিল, এই প্রকল্পগুলি ব্যতিক্রমহীন ভাবে সেই সব শর্তাবলী লঙ্ঘন করেছে; এই বিষয়ে বেসরকারি সংস্থা আর সরকারি সংস্থার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। ভারতে প্রকৃতপক্ষে কতটা অরণ্য-নিধন ঘটেছে, সরকারি তথ্য থেকে তার হদিশ মিলবে না, সরকারের তথ্য শোচনীয়ভাবে বাস্তব অবস্থাকে কমিয়ে দেখছে

ভারতের মান্য গবেষণাসংস্থার গবেষকরা, ভারতের অডিটর জেনারেলের এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সহমত হয়েছেন। তাঁদের গবেষণার ফল দেখিয়েছে যে, ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমঘাট অঞ্চল, মধ্য ভারত এবং ভারতের উত্তরাঞ্চলের গভীর অরণ্য যথাক্রমে ৫.৭৭ শতাংশ, ৪.৩৮ শতাংশ এবং ২.৮৪ শতাংশ গত এক দশকে স্রেফ গায়েব হয়ে গেছে!

আর “আচ্ছে দিন”-এর অত্যাচারে অবস্থাটা সমস্যা থেকে তীব্র সংকটের দিকে যাত্রা করেছে। এখন কর্পোরেটদের জন্য ভারত সরকার বছরে ২৫ হাজার হেক্টারের মতো জমি স্রেফ “উপহার” হিসেবে ভেট দিচ্ছে। এই পরিমাণ জমি ঠিক কতটা স্থান, তার একটা ধারণা দেওয়ার জন্য বলা যায় যে এই পরিমাণ জমি পাঞ্জাবের চণ্ডীগড় শহরের জমির প্রায় দুগুণ।

যেসব প্রকল্পে এই পরিমাণ অরণ্যের জমি বেহাত হয়ে গেছে, তার মধ্যে রয়েছে “প্রতিরক্ষা প্রকল্প”, ছোটো-বড়ো-মাঝারি মাপের বাঁধ ও জলাধার, খনি, শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র, শিল্প, জাতীর সড়ক। এই তথ্য ২০১৮ সালে এই দফার পরিবেশ মন্ত্রী সংসদে জানিয়েছেন। মন্ত্রী মশাইয়ের এই বিবৃতি থেকে আরও জানা যাচ্ছে যে পাঞ্জাব রাজ্যটি ইতোমধ্যেই সেই রাজ্যের আওতায় থাকা পুরো অরণ্য অঞ্চলের প্রায় অর্ধেক পরিমাণ জমি উন্নয়নের যূপকাষ্ঠে বলিদান করে বসে আছে। মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু বা আমাদের পশ্চিমবাংলা গত এক দশক ধরে বছরে গড়ে প্রায় ২ শতাংশ করে অরণ্যের জমিকে “উন্নয়ন”-এর জন্য ছেড়ে দিচ্ছে। গত চার দশকে হরিয়ানার প্রায় সম পরিমাণ যে জমি ( প্রায় ১৪ হাজার বর্গ কিমি) উন্নয়নের গর্ভে বিলীন হয়েছে, তার মধ্যে খনির জন্য গেছে ৪৯৪৭ বর্গ কিমি, তার পরেই বলতে হয় প্রতিরক্ষা প্রকল্পের কথা, যেখানে গেছে ১৫৪৯ বর্গ কিমি জমি। জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রাস করেছে আরও ১৩৫১ বর্গ কিমি জমি।

অরণ্য অঞ্চলের প্রেক্ষিতে ভারতের অবিভক্ত মধ্য প্রদেশের অরণ্য-শামিয়ানার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, প্রায় ১০ শতাংশ, তারপরেই স্থান নিয়েছে অরুণাচল প্রদেশ, যেখানে ভারতের অরণ্য-শামিয়ানার ১০ শতাংশ জমি রয়েছে। তারপরেই স্থান ছত্তিশগড়। খেয়াল করলেই দেখা যাবে যে, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তিশগড় কর্পোরেটদের মৃগয়াক্ষেত্র, আবার ভারতের রক্ত-লাঞ্ছিত প্রদেশগুলির মধ্যে এই দুটি রাজ্য শীর্ষে রয়েছে।

সাধারণ নাগরিকদের ধোঁকা দেওয়ার জন্য ভারত সরকার অরণ্য-নিধন-কে মোলায়েম প্রলেপ দেওয়ার অভিপ্রায়ে একটি প্রক্রিয়ার কথা বলে, যার পরিভাষা হচ্ছে “কমপেনসেটারি অ্যাফরেস্টেশন”, বা সাদা বাংলায় বাধ্যতামূলক বন-সৃজন। এই নীতিতে বলা হয় যে যতটা বনাঞ্চল নষ্ট হলো, তার সম পরিমাণ বনাঞ্চল সৃষ্টির জন্য গাছ লাগাতে হবে। আমাদের দেশের দুর্নীতির যা পরম্পরা, যেখানে ১০০টা গাছ লাগিয়ে স্থানীয় সাংসদ-বিধায়কদের উৎকোচ দেওয়ার বিনিময়ে ১০০০টা গাছ লাগানো হলো বলে শংসাপত্র মিলে যায়, সেখানে যদি ধরেও নেওয়া হয় যে সত্যিই নষ্ট হওয়া গাছের সম পরিমাণ গাছ লাগানো হলো এবং সেই গাছ বেঁচে বর্তে রইলো, তাহলেও গাছের পরিবর্তে গাছ হলেও অরণ্যের পরিবর্তে অরণ্য নির্মিত হলো না। গাছ ফেরত আসা মানেই পুরোনো বাস্তুতন্ত্র ফেরত আসা নয়, যা গেলো, তা গেলোই, তার কোনও ক্ষতিপূরণ হলো না।

১৯৮০ থেকে যে পরিমাণ অরণ্যের জমি উন্নয়নের নামে গ্রাস করা হয়েছে, তার মাত্র ২.৫ ভাগ জমি এই বাধ্যতামূলক বন-সৃজন প্রকল্পের আওতায় এসেছে। এটা হওয়াই স্বাভাবিক, কেননা কোনও প্রকল্পেই এই বন-সৃজনের জন্য মূল প্রকল্পের খরচের ৬ শতাংশের বেশি ধরা থাকে না। মোদি জমানায় জন-বিরোধী, পরিবেশ-বিরোধী যেকোনো কাজ করার জন্য আর কোনও লুকো-ছাপার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তাই প্রথমবার দিল্লির তখতে আসীন হয়েই মোদি সরকার সংসদে স্পষ্ট বলে দেয় যে “উন্নয়ন প্রকল্প”-র ফলে অরণ্যের যে ক্ষতি হয়, বাধ্যতামূলক বনসৃজনের মাধ্যমে নষ্ট হয়ে যাওয়া অরণ্য ফিরিয়ে দেওয়া হয় না, কেই ক্ষতির প্রভাব যথাসম্ভব কমানোর চেষ্টা করা হয়, ক্ষতিপূরণ করা আদৌ সম্ভব নয়।

যে দোসর-পুঁজি আজ আমাদের দেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তাদের চেতনায় সারা দেশটি তাদের মুনাফার জন্য মৃগয়াক্ষেত্র মাত্র, সেখানে না আছে মানুষের স্থান, না আছে প্রাণীজগতের অন্য প্রজাতির স্থান। যে অরণ্য মানুষ এবং অন্যান্য প্রজাতির প্রতিবেশীর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার জটিল এবং অতীব প্রয়োজনীয় কাজটি করে আসছিল সেই আদিকাল থেকেই, দোসর-পুঁজির মুনাফার চাপে সেই ভারসাম্য প্রায় ভেঙ্গে পড়ার মুখে। অরণ্যের অধিকার নিয়ে মানুষে মানুষে আবহমানকালব্যাপী দ্বন্দ্ব এখন প্রসারিত হয়েছে মানুষ ও অন্য প্রজাতির মধ্যে অনভিপ্রেত মধ্যে। আর উত্তরাখন্ড এই দ্বন্দ্ব দ্বারা সরাসরি বিরূপভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়েছে। দোসর-পুঁজির কাছে জমি তার কোম্পানির শেয়ারের মত আর একটি সম্পত্তিমাত্র, তাই অরণ্যের গভীরে জল বা খনির সন্ধান পেলে তার সেখানে মুনাফার টানে যেতে কোনও আপত্তিই নেই। অরণ্যের গভীরে এই সব প্রকল্পের নির্মাণকাজ অরণ্যেকে করে দেয় বিভক্ত, প্রাণীদের স্বাভাবিক চলাচলের পথকে করে আক্রান্ত, ফলে বহু প্রাণীর বাসস্থান ও খাদ্য-সংগ্রহের স্থান যায় ধ্বংস হয়ে।

দোসর পুঁজির স্বার্থে কাজ করতে গিয়ে মোদি সরকার উত্তরাখন্ডের অরণ্যে ছড়িয়ে থাকা গ্রামগুলির মানুষদের চিতাবাঘের খাদ্যে পরিণত করেছে। ২০০১ থেকে ২০১০-এর তথ্য এখন হাতে আছে, সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে যে, উত্তরাখন্ডে সেই সময়কালে ৫৫০জন গ্রামবাসী চিতাবাঘের আক্রমণের শিকার, মারা গেছেন প্রায় ২০০ জন। পরবর্তী দশ বছরে অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে, চিতাবাঘের আক্রমণ বেড়েছে প্রায় দুগুণ, সরকার এখনও মৃতদের তালিকা প্রকাশ করে নি। এই তথ্যর সঙ্গে যদি আমরা মেলাই যে এই সময়কালে উত্তরাখন্ড রাজ্যে অরণ্য ধ্বংস করে “উন্নয়ন প্রকল্প” নির্মাণ হয়েছে ভারতে সর্বাধিক, চার হাজার তিনশো তিরিশটি! দোসর পুঁজির জন্য সরকার কেমনভাবে আইনের তোয়াক্কা না করে তাদের মুনাফার জন্য অন্যায্য সুবিধা দিয়েছে, তা সিএজির একটি রির্পোট থেকেই স্পষ্ট। রির্পোর্টে বলা হয়েছে যে, এ রকম অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে কোম্পানিকে বেয়াইনিভাবে লিজ নবীকরণ করা হয়েছে, খনি থেকে বেআইনি উত্তোলনকে উপেক্ষা করা হয়েছে, লিজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও সরকারি সুরক্ষায় খনন কাজ চালিয়ে যাওয়া হয়েছে, যে প্রকল্পকে ছাড়পত্র দেওয়া হয় নি, সেই প্রকল্পের কাজ চলছে, অরণ্যের জমির চরিত্র পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে। এই প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে বেসরকারি মালিকদের অশুভ আঁতাত মানুষের জীবন ও পরিবেশ, দুটিকেই ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

আমরা আবার ফিরে যাই ছত্তিশগড় অঞ্চলে। ছত্তিশগড়ের প্রাচীন অরণ্য অঞ্চল হাসদেও আরান্ড। এই অরণ্যের পেটের ভেতর লুকিয়ে আছে এক বিশাল কয়লার ভাণ্ডার। পুরো অরণ্যটি সাফ না করে সেই কয়লা উদ্ধার করা কার্যত অসম্ভব।

দোসর-পুঁজির চাপ বড়ো দায়। ২০২০ অগস্ট মাসে মোদি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা আমাদের দেশে আরও ৪০টি খনি অঞ্চল বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দেবে। হাসদেও-আরান্ড অঞ্চলেই এই ৪০টি কয়লা ব্লক খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে শেষ পর্যন্ত। কোভিড-১৯ পরবর্তী অবস্থাকে নিজেদের কাজে লাগিয়ে মোদি সরকার যেমন অন্যান্য অনেক জন-বিরোধী কাজে আইনি বা বেআইনি শিলমোহর দিয়েছে, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। এক্ষেত্রে মোদি সরকার এখানেই থেমে থাকে নি। তারা একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে অতঃপর তারা কয়লায় রাষ্ট্রীয় মালিকানা পরিত্যাগ করে ভারতে একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক কয়লা ক্ষেত্রের উদ্বোধন করবে!

সরকারের এই সিদ্ধান্তকে দুহাত তুলে সাধুবাদ জানায় ভারতের বেসরকারি দোসর-পুঁজির মালিকবৃন্দ। ঠিকই অনুমান করেছেন, এই বিষয়ে ভারত সরকারের প্রথম ও প্রধান পছন্দ তিনি, যাঁর ব্যক্তিগত বিমানে চেপে আজকের সবচেয়ে পরিযায়ী প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছিলেন, সেই গৌতম আদানি, যিনি ইতোমধ্যেই বিশ্বের ধনীদের তালিকায় ধনীতম হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। যে ৪০টি কয়লা-ব্লক বেসরকারি হাতে তুলে দেয়ার কথা হয়েছে, তার মধ্যে সাতটিই খনির কাজে নিষিদ্ধ অঞ্চলে পড়েছে। এই ৪০টি ব্লকের ৮০ শতাংশ অঞ্চল খনির কাজে নিষিদ্ধ অঞ্চল বলে ভারত সরকার বহু আগেই ঘোষণা করেছিল। পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড এবং, হ্যাঁ, ছত্তিশগড় রাজ্য সরকার, নরেন্দ্র মোদির কেন্দ্রীয় সরকারকে লিখিতভাবে জানিয়েছে যে এই কয়লা ব্লকের বিষয়ে তাদের গুরুতর আপত্তি আছে, তাছাড়া এইভাবে কয়লা ব্লক বণ্টন করার ক্ষেত্রে যে আইনি জটিলতা আছে, সেগুলি কেন্দ্রীয় সরকার এড়িয়ে যাচ্ছে। মহারাষ্ট্র সরকার দেখিয়েছে যে একটি কয়লা ব্লক পড়েছে মহারাষ্ট্রের সংরক্ষিত ব্যাঘ্র-প্রকল্প, তাড়োবা-তে, ফলে সরকার সেই কয়লা ব্লকটিকে বণ্টনের বাইরে রাখতে বাধ্য হয়েছে।

ছত্তিশগড়ের আদিবাসীরা এই কয়লা-ব্লক বণ্টনের বিরুদ্ধে। আর হবেন না-ই বা কেন। ২০১১ সালে এই অঞ্চলে আদানির খোলামুখ খনি নিয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। অরণ্যের একেবারে ধার ঘেঁষে বেসরকারি দুটি খোলামুখ খনির কাজ শুরু হয়। এর ফলে প্রতিবেশের পক্ষে খুব গুরুত্বপূর্ণ অরণ্য একেবারে ধংস হয়ে যায়, জলের উৎসের বারোটা বাজে, ধোঁয়া, ধুলো তাপ এবং শব্দ দূষণে পুরো অঞ্চলটির অপূরণীয় ও অপ্রত্যাহারযোগ্য ক্ষতি হয়। হাতিদের বাসস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তারা অনেক আগ্রাসী হয়ে ওঠে এবং মানুষের সঙ্গে তাদের অনভিপ্রেত সংঘাত বাধে। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে হাজার হাজার বৃক্ষ-নিধন, যারা অনেকেই প্রায় শতাব্দী-প্রাচীন।

সারা পৃথিবীর মেজাজ যেখানে কয়লা-ভিত্তিক শক্তি ব্যবহারের পরিবর্তে নবীকরণযোগ্য শক্তির উৎসে ফিরে যাওয়া, সেখানে মোদি সরকার পরিবেশ এবং নাগরিকদের জীবন-জীবিকাকে পণবন্দি করে, ফাটকাবাজিতে জুড়ে গিয়ে জীবাশ্ম জ্বালানিকেই তাদের অগ্রাধিকার বলে ঘোষণা করেছে। মোদির ঘোষণা যে তার সরকার পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ কয়লা রপ্তানিকারক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবে। খেয়াল রাখতে হবে যে ভারতীয় কয়লা, যেগুলি রপ্তানির জন্য চিহ্নিত হয়েছে, সেগুলিতে ছাইয়ের ভাগ প্রায় ৪৫ শতাংশ। ফলে এই কয়লা পরিবেশ দূষণের এক বড়ো কারণ হিসেবে সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত। সারা পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশই তাদের কোভিড-পরবর্তী শক্তিনীতিকে নবীকরণযোগ্য শক্তি-কেন্দ্রীক করে তুলছে, ফলে কোভিড-পরবর্তী সময়ে দেশ থেকে কয়লা রপ্তানি করে ভারতের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার যে রূপকথা মোদি সরকার শোনাচ্ছে, তা বাস্তবে মুখ থুবড়ে পড়তে চলেছে অচিরেই। ভারতের সব বড়ো উৎপাদক শিল্পের মালিকরা তাদের কয়লার চাহিদার জন্য অভ্যন্তরীণ কয়লা উৎপাদনের ওপর একেবারেই নির্ভর করা না, তারা তাদের প্রয়োজনীয় কয়লার পুরোটাই বিদেশ থেকে আমদানি করে তাদের নিজস্ব চাহিদা মেটায়। ফল দাঁড়িয়েছে যে ভারত এখন কয়লা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশ্বে দ্বিতীয়, দেশটি বছরে ২৪৭ মিলিয়ন টন কয়লা আমদানি করে, এর জন্য বিদেশি মুদ্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দাম দিয়ে থাকে।

কয়লা রপ্তানির যে গল্প শুনিয়ে মোদি সরকার তার দোসর-পুঁজিকে সুবিধা দিতে চাইছে, সেই ফানুসকে ফাটিয়ে দিয়েছে ‘সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার’ নামক একটি গবেষণা সংস্থা। তারা সরকারি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে যে কয়লা ক্ষেত্রে ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকার অধীনে সংস্থাগুলির এখনই যে উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে ভারত ২০ শতাংশ বেশি কয়লা উৎপাদন করতে পারবে এবং সেই বাড়তি উৎপাদন আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ২০৩০ পর্যন্ত মিটিয়েও অনেকটা কয়লা চাইলে রপ্তানিও করতে পারবে! বেসরকারিকরণের পেছনে ব্যবস্থাপনা বা আর্থিক, কোনও প্রণিধানযোগ্য যুক্তি নেই

সারা বিশ্বের মানুষের কাছ থেকে ধিক্কার শুনে এবং দোসর-পুঁজিকে নতুন ক্ষেত্রে স্থান করে দেওয়ার জন্য মোদি সরকার ঘোষণা করে যে ভারতের শক্তি উৎপাদনে এখন থেকে নবীকরণযোগ্য শক্তির ভাগ বাড়াবে। ২০২০-র অগস্ট মাসে মধ্য প্রদেশের রেওয়া-তে মোদি সরকার এশিয়ার সর্ববৃহৎ সৌরশক্তি উত্পাদন কেন্দ্রের উদ্বোধন করে। এই কেন্দ্রের একটি বড়ো শেয়ার মধ্য প্রদেশের সরকারি শক্তি বণ্টন কর্পোরেশনের মাধ্যমে আদানির সংস্থা কব্জা করেছে। এই প্রকল্প রূপায়নের যাবতীয় ঝক্কি পোহাবে মধ্যপ্রদেশ সরকার, আর লাভে ভাগ বসাবে আদানি। গভীর দোস্তি, সন্দেহ নেই!

0 Comments

Post Comment