আজ দোয়েলের বড্ড মন কেমন করছে। সকাল থেকে বাইরে বৃষ্টি, হোম- স্কুলের আজ শেষ দিন। এই অন্তরীণ দশায় হোম - স্কুল, বন্ধুদের সঙ্গে জুম মিটিং করে তার সময় কাটত এতদিন। কাল থেকে সেও বন্ধ। বাইরে খেলার সময় সীমাবদ্ধ আর ঘরে বসে বন্ধুহীন সময়ের এই দুর্গতি।কী যে করে দোয়েল! এবার বড়দিন বড্ড ম্লান কাটবে
তাছাড়া প্রতি বছর শীতের ছুটিতে সে নিউ জার্সি থেকে উড়ে যেত কলকাতায়।সেখানে কত্ত মজা। দাদু-দিদার সঙ্গে খুনসুটি, মাসি বাড়ি, পিসি বাড়ি,আর ঠাম্মির বাড়িতে তো মস্ত খোলা একখানা ছাদ।সেই ছাদে কত রকম পাখি আসে,কত নানা রঙের ফুল ফুটে থাকে। দোয়েল আর ওর ভাই কখনো কখনো বিকেলে ওই ফুল গাছের গোড়ায় জল দেয়, হরিণ-পায়ে এ মাথা থেকে ও মাথা ছোটাছুটি করে। ক্লান্ত হ’লে, হাত-পা ধুয়ে দাদুর কোলে ঠাসাঠাসি করে গল্প শুনতে বসে যায়।ঠাকুমার ঝুলি আর জীবনস্মৃতি।দোয়েল বিদেশে বড় হলেও বাংলার অক্ষর জ্ঞান তার আছে।অনেকটা লিখতে পড়তে পারে।উচ্চারণ স্পষ্ট।
দোয়েলের কলকাতার ফ্ল্যাটের পাশের বাড়ি ওর খুব প্রিয় এক বান্ধবী থাকে।সে সারা বছর ওর জন্য অপেক্ষা করে। তার নাম মিহি। দোয়েল আর মিহি এক সঙ্গে পার্কে খেলে,সাইক্লিং করে। মা কাছাকাছি না-থাকলে,ভাই-কে ওরা কিছুতেই ওদের খেলায় শামিল করবে না। ভাই তখন কড়া নালিশের ভয় দেখায় দিদিকে।
প্রতি বছর স্যান্টা দাদু তার থলে ভরা উপহার নিয়ে আসে ওদের জন্য।
ছোট ছোট পোস্ট ইট, রং পেন্সিল, নিটিং কিট, অ্যাক্রেলিক, পেইন্ট ব্রাশ, আরও কত কী !
দোয়েল, মিহি এখন কিছুটা আন্দাজ করতে পারে যে, উপহারগুলো তাদের মায়েদের দেওয়া।এর পাশাপাশি মজা লাগে ভাবতে যে, এখনো স্যান্টা আসে রেইনডিয়ারে চেপে।সুদূর প্রান্ত থেকে।
এই সাধারণ আড়ালের মাঝে অসাধারণ একটা ছোটবেলা তৈরি হয়ে চলেছে দোয়েল, তার ভাই এবং ছোট্ট মিহির।ওদের অজান্তে।
সবচেয়ে আনন্দ হয় যখন কলকাতায় মা-বাবা কেউ-ই বাড়ি থাকে না।কারণ, মা - বাবার কাছ থেকে দূরে থাকলে লেখাপড়া থেকে ছুটি!
“মা,আমরা কী একটুও কলকাতা যাব না এবার?” সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দোয়েল করুণ কণ্ঠে জানতে চাইল।
“ একটুও যাব না। সব বছর তো সমান হয় না সোনা। কলকাতার জন্য মন কেমন করছে?” দোয়েলের মা ওর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করে।
“ হ্যাঁ, আর মিহিও তো অপেক্ষা করবে আমার জন্য। ওর জন্য এবার হ্যারি পটারের লাস্ট ভলিউমটা নিয়ে যাব প্ল্যান করেছিলাম। আর ও - ও তো… ,” বলতে বলতে দোয়েলের যেন আরও মন ভারী হয়ে আসে।মিষ্টি গাল বেয়ে নামছেচোখের জল।
দোয়েল মিহির বন্ধুত্ব একটু অন্য ধরনের। সারা বছর ওদের দেখা হয় না ঠিকই কিন্তু যে ক'টা ওরা কাছাকাছি থাকে, তখন ওদের মতো সাবলীল বন্ধুত্ব মেলা ভার। আসলে, খুব ছোট বেলা থেকেই মানুষ হয়ত বোঝে যে, অল্পে গাঢ়তা থাকে, বেশিতে নয়।
দোয়েল মিহি দু’জনেই এখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। ওদের ঠিক বড় বলা যায় না।ছোটোরা বড় বললে তাদের বেশ একটা বড়-বড় ভাব আসে। অবশ্য এই বয়েসে নিজেরা কিন্তু নিজেদের বড় ভাবতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে।
কেবল কোনো কিছুতে ভয় পেয়ে গেলে মুশকিল। যেমন ভুতের গল্প শুনতে গিয়ে ভয় পাওয়া, কোনো ভয়ের সিনেমা দেখতে গিয়ে অথবা অন্ধকারে একলা ঘরে আঁতকে ওঠা! সে ক্ষেত্রে সবাই ঠাট্টা করে বলবে, ‘ কী বোকা ! এখনো ছোটদের মতো ভয় পায়!’
“ বেশ তো। এই উইন্টার ব্রেকে আমার মাথায় একখানা নতুন গেমের আইডিয়া এসেছে, তোমার আর মিহির জন্য!” মা একদিন আদর করতে করতে বলল দোয়েলকে।
“কি আইডিয়া বলো? বলো না মা,” দোয়েল ছটফট করতে থাকে শোনার জন্য।
“আইডিয়াটা হল, ছবি আঁকার। তোমরা দুজনেই খুব আঁকতে ভালোবাসো। তোমরা দু’জনে দু’জনের জন্য একটা ছবি আঁকবে। খুব সুন্দর করে। ধরে নাও এটা খুব বড় একটা প্রজেক্ট। অনেকদিন সময় নিয়ে করতে হবে।ছবি পোর্ট্রেট হতে পারে, কিংবা কোনো সিনারি অথবা কোনো অ্যাবস্ট্রাক্ট কিছু। আর যেদিন যা আঁকছ তা কেউ কাউকে বলবে না এবং দেখাবেও না।
মিহিকে ই-মেলে রোজ তোমার আঁকা নিয়ে সামান্য হিন্ট দিয়ে কিছু লিখবে। দু’জনেই এমন ভাবে লিখবে যে, কেউ কারোর স্কেচ বা পেইন্টিং আন্দাজ করতে পারবে না।”
দোয়েল হাঁ করে শুনছে মায়ের কথা।স্কুল বন্ধ হয়ে, তার মা-কে যে কত রকম নতুন নতুন খেলা, সময় কাটাবার ব্যাবস্থা করতে হয়, তা একমাত্র দোয়েলের মা-ই বোঝে!
“আচ্ছা,তারপর? আঁকাটা শেষ হয়ে গেলে?” দোয়েল এখন থেকেই ভাবতে শুরু করেছে শেষের শেষে কী হবে? মিহির সঙ্গে ছবি আঁকার শেষে তাদের কথা বন্ধ হয়ে যাবে? মিহি ওকে আবার ভুলে যাবে পরের ক্রিসমাস পর্যন্ত? দোয়েল কী মিহির সঙ্গে আর বন্ধু থাকবে না? স্যান্টা ক্লজ এবার দোয়েল মিহির ঘরে আসবে?
ছোটবেলার ছোট ছোট এই প্রশ্নগুলিই খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়। এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে,বড়বেলায় তার রেশ থেকে যায়।
দোয়েলের মা বলে, “ দুর বোকা! অত সহজে বন্ধুত্ব চলে যায়? গেমের শেষটুকু তো বলাই হয়নি।”
যেদিন তোমাদের আঁকা শেষ হবে তোমরা ভিডিও কল করে একে -অপরকে সেই সুন্দর আঁকাটা দেখাবে। ছবি দেখানোর আগে যার ছবির বিষয় নিয়ে গেসওয়ার্ক মিলে যাবে, সে-ই জিতবে গেমটা।সে একটা প্রাইজও পাবে। প্রাইজটা হল, তোমরা প্রতি রবিবার নিজেরা ভিডিও কল করে কথা বলতে পারবে। কিছুক্ষণের জন্য।কী,রাজি? আমি তাহলে মিহির মা-কে কল করে জানিয়ে দেব।”
দোয়েল সব শুনে মনে মনে খুব খুশি! খুব মজা। ও জানে ও এই গেস গেমটা জিতবেই। “ হ্যাঁ রাজি।” পরমানন্দে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায় সে।
এরপর ফোনে দুই বন্ধু নতুন গেমের পরিপাটি একটা পরিকল্পনা করে নিয়েছে মনে মনে।দু'জনের বাড়িতে এখন ক্রিসমাস ট্রি সাজানো চলছে পুরোদমে।
দোয়েলের বাড়িতে আসল ক্রিস্টমাস গাছের সাহেবি অলংকার।বাগানে আলোকসজ্জা, নাট ক্রেকার।অন্যদিকে মিহি ক্রিসমাস ট্রি ভরছে হাতে বোনা চট, কাগজের পাখি, বেল, ডেকোরেটিভ বল দিয়ে।
দু'জনের প্রবল আস্থা ভরসা জীবনের প্রতি।দু'জনে ভাবে স্যান্টা আসবে।মহামারির কোনো এক অন্তিমকালে।
এবার ছবি আঁকার পালা। নিউ জার্সিতে ডিসেম্বর মাসে জাঁকিয়ে শীত পড়ে।কখনো কখনো বছরের প্রথম তুষারপাত হ'লে দোয়েল হোয়াইট ক্রিসমাস উপভোগ করে। মনে মনে এমন এক প্রকৃতির বর্ণনা ভাবছ সে।
স্নো ফ্লেক দোয়েলের ভারী প্রিয় বিষয়!
ওদিকে মিহির জীবন, রিমোট লার্নিং করে খানিকটা অভ্যস্ত হয়েছে। স্ক্রিন খুললেই ক্লাসরুম! তার প্রাথমিক ধাক্কা সামলাতে বেশ নাকানিচোবানি খেতে হয়েছে মিহি এবং তার মা-কে। এখন অবশ্য সবটাই অভ্যেস।প্রাত্যহিক কাজ।
বাড়তি সময় পেয়ে মিহি আনন্দমেলা পড়ে, ছবি আঁকে,গানের রেওয়াজ করে। সবই চলছে বেশ অভ্যেসমাফিক। এখন আবার ইন্টারনেটে ডিওয়াইআই এর কত ভিডিও দেখে ক্রাফট শিখছে মিহি!
খারাপ সময়ের সঙ্গে বেশ অভ্যস্ত হয়ে পড়ে ছোটরা। তাদের রুটিন অন্যরকম হয়ে গিয়েছে।মানিয়েও নিয়েছে তার সঙ্গে।
বন্ধুহীন জীবনে দূরের দোয়েলের জন্য আরও বেশি মন কেমন করে মিহির। বিশেষ করে দুপুরের দিকে। যখন ওর মা খাওয়াদাওয়া সেরে একটু ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে বিছানায় গড়াগড়ি খায়, ঠিক তখন।
আজকাল মাঝে মধ্যেই মিহি নিঃসঙ্গতায় চুপচাপ জানলার কোণটায় ঠায় বসে থাকে। গাছ দেখে, ফুল, পাতা, আকাশে উড়ে যাওয়া পাখিও দেখে। আগে এত কিছু দেখার সময় কোথায় ছিল মিহির!
স্কুলে দৌড়, খেতে বসে দৌড়, টিউশানে দৌড়, সাঁতারে যাওয়ার সময় দৌড়, আঁকাতে গিয়ে দৌড় --- তখন মনে হত দৌড়কে কমন ফ্যাক্টর নিয়ে,বাকি সব কিছু ব্র্যাকেটের মধ্যে যোগ করে ওই দৌড়ের সঙ্গে গুণ করে দিলেই,গন্তব্যে পৌঁছে যাবে মিহি।
দোয়েল অবশ্য বলে এত দৌড়ের চেয়ে এই ভাল। ঘরে আছে।অফুরন্ত সময় ! কিন্তু তাতে রোজকার জীবনে উদাসীনতা পেঁচিয়ে ধরে মাঝে মধ্যে।
কী যে হল! ইদানীং দু’জনে মনে মনে ভাবে। ভালও নয় মন্দও নয়।
দু’জনের মনে হয় ছবি আঁকলে, নতুন ভিডিও গেম খেলে, যদি এর থেকে একটু স্বস্তি পাওয়া যায়।
সেদিন বাইরে আকাশে বেশ মেঘ করে আছে। দুপুরে ঘরের ভিতর আলো জ্বালিয়ে রাখতে হচ্ছে। আজ প্রথম দোয়েল স্কেচ নিয়ে বসল। কোনো ছবি না দেখে নিজের মন থেকে আঁকতে বেশি সাবলীল বোধ করে সে। অনেক আকাশপাতাল ভেবে শেষমেশ প্রথম স্ট্রোক টানল দোয়েল।
ওদিকে মিহি স্কেচ করার আগে ভাবতে বসল, সে অ্যাক্রিলিক ব্যাবহার করবে না প্যাস্টেল শেডস। আঁকতে বসে না-ভাবলে হয় কখনো? হয়েছে কখনো? আসলে,আঁকা তো একটুখানি।ভাবনা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।সময়সাপেক্ষ।
ভেবে ভেবে কূলকিনারা করতে পারছে না মিহি। এই না-পারতে পারতে সে-ও আজ টানল তার প্রথম পেন্সিল স্ট্রোক।
রাতে দোয়েল মিহিকে ই-মেলে লিখল, “আজ বিকেলে আমাদের এখানে হালকা স্নো ফল হয়েছে।আমার স্কেচ পেপারে এঁকেছি সেই প্রিস্টাইন সাদা তুষারের প্রথম ড্রপলেট।’’
মিহি লিখল, “আমার কাগজে মস্ত আকাশ,এখনো রং ছোঁয়নি তাকে।’’
এইভাবে দৈনন্দিন ছবি, ছবির কল্পনা ই-মেলে কথোপকথন -- ইত্যাদি মাধ্যমে দোয়েল মিহি আবার কাছাকাছি আসে। দু'জনের মাঝে বছর খানেক জুড়ে জমা যে আড়ষ্টতা, তা যেন নিমেষে গায়েব!
তারা আবার খুঁজে পায় তাদের বাক্সবন্দী বন্ধুতা। সব মিলিয়ে বড়দিনের সময় কাটতে থাকে দুর্দান্ত!
দেখা গেল দু’জনে প্রায় একই সময় স্কেচ শেষ করে ছবি রং করা শুরু করল। রং করতে গিয়ে দোয়েল দ্যাখে, তার অ্যাক্রিলিক বাক্সে সব রং প্রায় শেষ হওয়ার মুখে।অনলাইন রং অর্ডার করে ডেলিভার করতে প্রচুর সময় লেগে যাবে।
তাহলে কী দোয়েল এই আঁকা সম্পূর্ণ করতে পারবে না? নিজের মনে আকাশকুসুম ভাবতে শুরু করল সে।
কখনো দুঃখ হচ্ছে , কখনো চিন্তা করে করে মাথা খারাপ করে ফেলছে দোয়েল। সারাদিন ব্রেনস্টর্ম ক’রে অবশেষে সন্ধেবেলা একটা উপায় মাথায় এল তার।
ছবির জন্য সে পেইন্ট তৈরি করবে বাড়ির হেঁসেলের কিছু জিনিসপত্র দিয়ে। দোয়েল জানে খাবার নষ্ট করতে নেই। তাই সে বেশি কিছু নেবে না মায়ের কিচেন থেকে।
সবুজ রং তৈরি হল বাগানের অল্প ঘাস বেটে আর তার সঙ্গে জল মিশিয়ে। কফি পেস্ট আর সয় সস দিয়ে তৈরি হল ব্রাউন রং। ভাই মিষ্টি ভালবাসে, তাই মা-র প্যান্ট্রিতে অনেক রকম রঙের জেলো পাউডার রাখা থাকে। সেই পাউডার অল্প অল্প নিয়ে তৈরি হল লাল, হলুদ, নীল রং।
সেই রাতে মিহি জানতে চাইল দোয়েল কোন কোন রং ব্যবহার করল আজ। দোয়েল মিহিকে তার স্ক্র্যাচ থেকে রং তৈরি করার কথা শেয়ার করল না।গেমের শেষে সারপ্রাইজ দেবে বলে।
সেই রাতে দোয়েল লিখল, “ আমি জেলো বানিয়েছি…হি হি হি !’’
লিখেই সে খিলখিল করে হেসে শুয়ে পড়ল। ওদিকে মিহি অস্থির! চোখে ঘুম নেই। ওর তখন দুপুর।সে কৌতূহলে আরও জানতে চাইল।
দোয়েল ভাবছে মিহিকে আজ বেশ কিউরিওউস করা গেল। সে আরও মুখ টিপে হেসে অবশেষে ঘুমোতে গেল ভাইকে জড়িয়ে।
দোয়েল আর মিহির এই গেম নিয়ে তাদের বাড়ির সকলে ইতিমধ্যে বেশ উত্তেজিত। রোজ একটু একটু করে তৈরি হচ্ছে দু'জনের সব চাইতে মনের মতো দু'খানা ছবি।
মিহির স্কুলের বন্ধুরা ফোন করলে, সে তার প্রবাসী বন্ধুর সঙ্গে এই ছবির গেম খেলার কথা মাঝে মধ্যে শেয়ার করে। এদের মধ্যে কেউ দোয়েল এবং মিহির বন্ধুত্ব বোঝে, কেউ আবার বোঝে না।
যারা বোঝে না তারা ভাবে যার সঙ্গে বছরে মাত্র কয়েকটা দিন দেখা হয় তার সঙ্গে এত গেম খেলে মিহি কী এমন আনন্দ পায় কে জানে!
আমরা বড়রা কী বুঝি জীবনের কখন কোন বন্ধুত্বটা এতটাই মস্তিস্কে ক্লিক করে যায়, যে, দূরত্বের কষ্ট একঘেয়েমি সে ক্ষেত্রে মেনে এবং মানিয়ে নেওয়া যায়।
ধীরে ধীরে তাদের গেমের শেষ দিন চলে এল। দোয়েল মিহির আঁকা মোটামুটি শেষ।পরদিন ক্রিসমাস! রাত পোহালে কাল সকালে অর্থাৎ মিহির সন্ধেবেলা এবং দোয়েলের সকালবেলা তারা তাদের ছবি ভিডিও কলে একে-অপরকে দেখাবে, শেয়ার করবে ই-মেলে। তার আগে গেস গেম যে জিতবে, পুরষ্কার তারই প্রাপ্তি।
এ বছর স্যান্টার উপহারের পাশাপাশি থাকবে এই বাড়তি উপহার।মনের স্টকিংস ভরা রাশি রাশি আনন্দ!
“পুরষ্কার হল ভিডিও কল। মিহি নিশ্চয়ই ঠিকঠাক গেস করবে। কেউ একজন সঠিক গেস করলেই তো কেল্লা ফতে! তাহলে এখন থেকে দোয়েল এবং মিহি প্রতি রবিবার ভিডিও কল করতে পারবে।” মনে মনে ভাবে দোয়েল।সে রাতে এত উত্তেজনায় কিছুতেই ঘুম আসে না দু'জনের।দুই প্রান্তে।
মিহি অন্যদিকে চোখের সামনে ল্যাপটপ খুলে বসে। এক এক করে সমস্ত হিন্ট জোগাড় ক’রে, একটা পোস্ট - ইট - এ লিখে রাখে দোয়েলের ছবির বিষয়।
“ কাউকে তো জিততেই হবে! নইলে সারা বছর সে দোয়েলকে দেখবে কীভাবে!”
এত ভেবে, মিহির ঘড়ির কাঁটা যেন কিছুতেই আজ সন্ধেতে গিয়ে পৌঁছতে পারছে না।
পরদিন সকলের উত্তেজনার নিরসন ঘটিয়ে এবার দু’জনে ফোন স্ক্রিনের সামনে এসে হাজির। আজ দোয়েল মিহিরের দেওয়া একটা সুতির টপ পরেছে। তাতে খুব সুন্দর কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের ছবি আঁকা। দোয়েল কলেজ স্ট্রিট চেনে।মায়ের সঙ্গে গিয়েছে গেল বার।
টেলিফোন লাইন অন ক'রে, দু’জনে দু’জনকে প্রথমে ‘হাই’ বলল মিষ্টি হেসে। দু’জনের যে মন আজ উত্তেজনায় টইটুম্বুর তা খানিকটা ওদের বোঝা যায়।
মায়েরা স্ক্রিনে উঁকি দিয়ে প্রাথমিক কিছু কথা সেরে ফোনটা ওদের হাতে দিয়ে দিল।
এইবার মিহি প্রথমে দোয়েলকে গেস করতে বলল। ঠিক করা হয়েছে এক একজনকে চার থেকে পাঁচ বার চান্স দেওয়া হবে, শেষে না-পারলে তখন আউট।
বেশ খানিকক্ষণ বাদে দেখা গেল কেউ ঠিকঠাক গেস করতে পারেনি।
এমনকি দোয়েল আর মিহিরের পরিবারে কেউ-ই আন্দাজ করতে পারেনি ওদের ছবির বিষয়বস্তু।iএতদিন পরিবারের সকলের কাছে তারা নিজেদের ছবি সিক্রেট রেখেছে।
এবার ছবি দেখানোর পালা। প্রথমে মিহি তার ছবি দেখাবে ঠিক করল দোয়েল।
মিহির ছবি দেখে দোয়েলের চোখে আচমকা জল!
“একি! এ তো আমি! এক্সাক্টলি আমি!”
মিহি বলল, “ এবার তুই দেখা তোর ছবি… এমন কী এঁকেছিস, যা আমি আন্দাজ করতে পারলাম না ?”
দোয়েল মুহূর্তে নিজেকে সামলে মিহির চোখের সামনে মেলে ধরল স্কেচ বুক।
দোয়েলের খাতায় মিহির মিষ্টি হাসি জ্বলজ্বল করছে।একি ! এও তো মিহির চেনা ছবি! তার নিজের ছবি!
“ জানিস মিহি এই রং গুলো আমার তৈরি। স্ক্র্যাচ থেকে।আমার অ্যাক্রিলিক শেষ হয়ে গিয়েছিল। তখন আমি নিজে বানিয়েছি এইসব রং। ঘাস, বিভিন্ন রকমের খাবারের সঙ্গে জল মিশিয়ে।তোকে বলিনি। সারপ্রাইজ দেব বলে।”
মিহি আনন্দে, আবেগে, আরও না জানি কত রকমের অনুভূতিতে জড়িয়ে ধরল ওর মা-কে। দোয়েলও কখন যেন ভুলে গিয়েছে ওদের প্রাইজের কথা।
তবে এই চেনা ছবি অচেনা প্রাইজ ওদের কাছে থেকে যাবে। যতদিন ওরা চাইবে এই অমূল্য ছবির মূল্য দিতে।
দুই পরিবারের সকলেই ভাবতে থাকে দু’জনের প্রাইজের কথা। সত্যিই কী ওদের ভিডিও কল পাওনা নয়?
জীবনের এই কঠিন সময় যা ওঠাপড়া আসে, সেগুলো ঠিক এইভাবে ভালোবেসে একে অপরের হাত ধরলে পার হওয়া অনেকটা সহজ হয়ে যায়।
দোয়েল মিহির মা- বাবা অনেক আদর করতে করতে ভাবে, যেন এভাবেই বড় হয়ে ওঠে ওরা।মনে মনে ছোট রয়ে গিয়ে ..