স্বাধীনতার এতগুলো বছর পেরিয়েও দেশের সবরকম খাবার সবার মুখে পৌঁছে দেওয়া গেলনা।এ দায় কার?রাষ্ট্রের।সব মনে রাখা হবে।
ভাটিয়া বিল্ডিং এর সুইপার বস্তীর এক টালিঘর ফুঁড়ে টিভির হাই টিআরপির অনুষ্ঠান "হেঁশেল জংশন "এর কথাবার্তা ভেসে আসছিল।আজকের মেনু ভেটকি ভুনা আর চিতল চটপটি।ভ্রূ কুঁচকে রিমোট অফ করে স্নানে যায় রুবি বাসফোঁড়।এসব অনুষ্ঠান তাদের সংসারে খুব বেমানান।সত্যিতো।আর রুবির ছোটমেয়ে স্কুল থেকে এসেই এ অনুষ্ঠান দেখে রোজ।তাই আপাতত মা মেয়ের খন্ডযুদ্ধে এ মহল্লা রীতিমত সরগরম।রুবির স্বামী পৌরসভার চুক্তিভিত্তিক সাফাই কর্মী।খুব ভোরে একটা ঝাড়ু নিয়ে সে আমার আপনার বাড়ির আশপাশ সাফ করতে বেরিয়ে পড়ে।আর তাতেই সেবার নির্মলবাংলা অ্যাওয়ার্ড চলে এসেছিল আপনার ওয়ার্ডে।মনে পড়ে?
কাল রবিবার।বাবুলালের মেয়ে বাবার কাছে আবদার রেখেছে,বাজার থেকে ভেটকিমাছ আনতেই হবে।আর মাকে বলেছে ভেটকির ভুনা খাবে।নইলে অনশন।বাবুলালের একটাই সন্তান।বড় আদরের মেয়ে ফুলবা।কিন্তু তাই বলে ভেটকি।একটা দিনই সপ্তাহে ছুটি পায় বাবুলাল।কিন্তু মেয়ের এই বায়নায় বাজারের ব্যাগটাকে তখন ইলেকট্রিকের হাইটেনশনের তার মনে হয়।আজকের বাজারে এক কেজি ভেটকির যা দাম,তা বাবুলালের দুদিনের রোজগার।মানে দুদিন কাকভোরে উঠে রাস্তা সাফাই করলে বাবুলাল এককেজির একটা ভেটকিমাছ এনে ফুলবার মন ভরাতে পারবে।না।তা আর হয়নি।সেদিন মেয়ের চোখে ধুলো দিতে অনেক কষ্টে আড়াইশো টাকা কেজি দরের পাঙাশকেই ভেটকি বলে চালিয়েছিলেন ফুলবার বাবা।তাই ফুলবার মত মেয়েরা আজও ভেটকি আর পাঙাশের স্বাদ যে আলাদা ,তা জানল না।জানবেও না।কেননা তাদের পরিবারের চিরতরে এই ভেটকি মাছ কেনার মত ক্ষমতা সরকার সিস করে নিয়েছে।ভেঙে পড়া অর্থনীতির দোহাই দিয়ে দেশে ধনীদের অর্থ বাড়তে সাহায্য করে গেছে কেন্দ্রসরকার।শুধু তাই নয়,শেষ কবে যে ওদের ঘরে মটন এসেছিল,মনে নেই ছোট্টমেয়েটির।মটনও এখন ফুলবার বাবার দুদিনের রাস্তাঝাড়ের মজুরি।তেমনি মাগুর,ট্যাংরা,শোল, ইলিশের এতো দাম যে, এসব মাছগুলোর প্রবেশ চিরদিনের মত বন্ধ হয়েছে এই ভাটিয়া বস্তীর দুকামরার ঘরে।কারণ বেলাগাম বাজার দর।তাই বাবুলাল এখন কাছের স্টেশন বাজারের পূর্বপারের পুকুরধার দিয়ে বাজারে মাথা নীচু করে ঢোকে।যাতে বড় মাছবাজারটা এড়ানো যায়।এদিকটায় মাছি ভনভন করে।পচা গন্ধে গা গোলায়।কারণ পেটনরম করা সস্তা মাছের একটা ছোট বাজার বসে এখানে।তাই সেখান থেকেই রিঠা,ল্যাঠা,চ্যাং,লোটে,পাঙাশ,গোচি বা তেলাপিয়ার মত সস্তা মাছগুলো কিনে নেয় বাবুলাল।তাই আপাতত চিতল চটপটি বা ভেটকিভুনা থেকে বঞ্চিত থাকে ফুলবা।
ফুলবার কি দোষ?সে তো জানেই না যে,তার বাবা কোনদিনই এসব মাছ কিনতে পারবে না।কারণ তার বাবার সাধ্য নেই।আর এখানে তাই সাধ্যের কাছে সাধের ইনিংস ডিফিট।বাবুলাল হেরে গেল ।এরকম হাজার হাজার বাবুলাল রোজ হেরে যাচ্ছে ।মাছবাজারে,শপিং মলে,আইনক্সে, হোটেলে, কসমেটিকসের দোকানে,ফার্ণিচারের দোকানে,বিরিয়ানির দোকানে,সোনার দোকানে।সাথে
আরও অনেক অনেক দোকানে,ফুডপ্লাজায় এই পরাভবের উপাখ্যান ছড়িয়ে আছে।সৌজন্যে দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য।আমরা জানতে পারিনা।যেমন ঐ দূরের বাড়িটা।যেমন ঐ বাড়ির পলদেন মার্ডি।দোগাছি ফরেস্টের বুক চিরে পিএম জি এস ওয়াইয়ের কালো পিচ রাস্তার পাশে এক মাটির দেওয়াল।এখনো করমের আলপনা অমলিন।দাওয়ায় কালো পাতিলে ফুটছে ধান।নীচে গনগনে তুষের আগুন।পলদেনের বাবা নেই ।মা পাশের ইটভাঁটার দৈনিক দুশো দশটাকার শ্রমিক।জলে ডোবা মৃতদেহের মত ফ্যাকাশে আঙুলে এক গ্লাস জল এনে দিলেন।স্বামী মৃত্যুর পর পাঁচ বছর পঞ্চাশ বছরের সমান।কিন্তু এদ্দিনে বাড়িতে বিধবাভাতার এনকোয়্যারি করতে এসেছেন আধিকারিক।পলদেনের কাল ইউনিট টেস্ট।কথাবার্তা চলছে।ধান ফুটছে।এবার রেজাল্ট একটু ভাল হলে মায়ের কাছে পলদেন কিচ্ছু চাইবে না।ঠিক করেছিল ক্লাসের ফাস্টবয় প্রত্যূষের টিফিনবক্সে দেখা সেই বিরল খাবারগুলো চাইবে।পিৎজা,বার্গার, বেবিনান,কুলচা। তুবড়ি মার্ডির জীবনেএকটা পিৎজা মানে এক দিনের হাজিরা।দেশ বুঝলো কই?তাই পলদেন সেবার ভাল ফল করলেও তার মা সাকুল্যে একটা কেক কিনে শান্ত করেছিল বাপমরা ছেলেটাকে।
কিন্তু আজও অশান্ত ঝড় এলে মনে পড়ে তিতলির কথা।বাবা বনগাঁ লাইনে ধূপকাঠি ফেরি করেন।প্রতি প্যাকেটের কমিশন একটাকা।সে নিয়ে দিনে কোনক্রমে দুশো ,কোনদিন আরও কম।তিতলির অনেকদিনের ইচ্ছে একটু নিজের বাড়ির ছাদে উঠে আকাশ দেখবে।দেখবে,পাড়ার গলিটার একটু ছোট হয়ে আসা ।দেখবে রাতের কালপুরুষ।হয়নি।তাই একবার ক্লাসে শবরী ম্যাম জিজ্ঞেস করেছিলেন,কার কার বাড়িতে ছাদ নেই?সেদিন বাকরুদ্ধ তিতলিই প্রথম হাতটা কাঁপতে কাঁপতে তুলে ধরেছিল।তাই আজও ঝড় এলে তিতলির মা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরেন।শিলাবৃষ্টির আতঙ্কে পরিবারের মুখগুলো হয়ে ওঠে একেকটা অমাবস্যার চাঁদ।বৈশাখের ভরসন্ধ্যায় ওদের টিভি থেকে ভেসে আসে মজবুত রড আর সেরা সিমেন্টের বিজ্ঞাপন।তিতলি জানে ওদের এসব দেখানো অহেতুক।তবু রড সিমেন্টের মতই ওর স্বপ্ন এখনো অটুট।কারণ একটা ছাদ।কটা সিঁড়ি চেয়েছিল মেয়েটা।হয়নি।তবু তিতলি মাধ্যমিকে আনকমন ভাবসম্প্রসারণটাই লিখেছিল সেবার। ওপারে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস। কিন্তু সব বিশ্বাস হারিয়ে যায়,যখন প্রতিবেদনে দেখায়, আমাদের দেশে বিগত দুদশকে যেভাবে দেশের সবচেয়ে ধনী মানুষের১০%,আরও ১৫% ধনী হয়েছেন,সেভাবেই দেশের দরিদ্র মানুষের ১০%,আরও ১৫%দরিদ্র হয়েছেন।শুধু তাই নয় ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের(WEF) বার্ষিক সভায় মানবাধিকার সংগঠন অক্সফ্যাম যে পরিসংখ্যান দিয়েছে,তা আরো কুৎসিত।তাই বিশ্ব অর্থনীতির সমীক্ষায় ভারতের এই ডাউন সিনড্রমকে তারা অশ্লীল আখ্যা দিয়েছেন।কারণ
এবার তাদের ধনবন্টন সমীক্ষায় দেখা গেছে ভারতের মোটসম্পদের ৭০% রয়েছে দেশের ৫৭ জন ব্যক্তির কাছে।এমনকি দেশের সম্পদের ৫৮% কুক্ষিগত রয়েছে ভারতের ১%মানুষের কাছে।এটাই এখন ডিজিটাল ইন্ডিয়ার লাস্ট আপডেট।অক্সফ্যাম বলেছে,এই হতদরিদ্র পরিসংখ্যান ভারতবর্ষে এই প্রথম।সেক্ষেত্রে তারা দেশের বিভিন্ন ধনী ব্যক্তিদেরও এই ধনবৈষম্য দূর করতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
তাই পলদেন,ফুলবা,তিতলিরা আরও গরীবীর খাতায় নাম লিখবে,আর আমরা টিভির অনুষ্ঠানে ,বিজ্ঞাপনে কোটি কোটি অর্থ ঢেলেই যাব।এটাই বাস্তব ।তাই গুজরাটের হীরে ব্যবসায়ী তার কর্মচারীদের দেওয়ালীতে ফ্ল্যাটের চাবি উপহার দিলে এখন আর বিস্ময় জাগে না।কিংবা আকাশভরা তারার নীচে দেশের সবচেয়ে ধনী মানুষের আত্মীয়ের বিয়েতে পুরো বলিউডের হাতে রূপোর ঝুমঝুমি বাজতে দেখলে বিশ্বভরা প্রাণের জন্য আর কষ্ট হয় না।কেননা চোখ এগুলো এখন সয়ে নিয়েছে।তাই যা সয় তাই রয়।ভারতবর্ষ আর বদলাবে না।