সৎ বাণিজ্য অথবা স্রেফ লুণ্ঠন, সেই কাজের জন্য ইউরোপীয় ভাগ্যান্বেষীদের প্রয়োজন ছিলো জলপথে বাণিজ্য অথবা বাণিজ্যের ছল করে প্রাচের দেশগুলিতে পা রাখা। ইউরোপের ইতিহাসবিদদের অধিকাংশ জলদস্যুদের জলপথে পাড়ি জমানোকে সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসের অঙ্গ করে নিয়ে পর্বায়িত করেছেন “আবিষ্কারের অভিযানের যুগ” হিসেবে। কিন্ত ব্যাপারটি যে তা নয়, এখানে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছে, লুঠপাট, গণহত্যা আর তার পাশাপাশি বিরাট আকারে পরিবেশ সংহার। যা প্রথমে শুরু হয়েছিলো “মশলা বাণিজ্য” হিসেবে, সেই ঘটনা পরে পর্যবসিত হয় দেশ দখলে।
এই লেখকের এই বিষয়ের আগের লেখার দুটি পর্ব
পরিবেশ-প্রতিবেশঃ আমাদের দেশ পর্ব-এক
পরিবেশের সাত কাহন পর্ব-দুই ভারতে পর্তুগিজ আগমনের ইতিবৃত্ত
ত্রয়োদশ শতকে মঙ্গলদের আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর পুরো ইসলামি দুনিয়া উথালপাথাল হয়ে যায়। এই আগ্রাসনের ফলে ইসলামি দুনিয়ার সুসভ্য সাম্রাজ্য, আব্বাসিদ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। ফলে ইসলামি দুনিয়ার কেন্দ্রস্থলে এক বিশাল ফাটলের জন্ম হয়। এই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে আসে তুর্কি-রা; ইসলামি দুনিয়ার হাল ধরে এই তুর্কি সামাজ্যের বিভিন্ন রাজবংশ। তখন ভারত মহাসাগরের আশপাশ ঘিরে ছিলো তিন তিনটি অত্যন্ত সুগঠিত ইসলাম ধর্মাবলম্বী রাজত্ব।
এদের মধ্যে একটি রাজত্ব অটোমান রাজত্ব হিসেবে ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে। অটোমান সাম্রাজ্যের পত্তন হয় এক তুর্কমেনিয় যাযাবর প্রথম ওসমান-এর হাত ধরে। ১২৯৯ সালে সেখালের উত্তর-পশ্চিম আনাতোলিয়া, যা আজকের তুরস্ক, সেই অঞ্চলে। যুদ্ধে পারদর্শী এই যাযাবর প্রজাতির মানুষরা তাদের নিয়ন্ত্রণের পরিধি বাড়ানোর জন্য আশপাশের এলাকায় তাদের প্রভাব বিস্তার করে। ক্রমে ক্রমে এই অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় বলকান অঞ্চল, উত্তর আফ্রিকা এবং সেখালের লেভান্ত অঞ্চল, যা আজকের সিরিয়া, লেবানন, জর্ডন এবং ইস্রায়েল। অটোমান সাম্রাজ্যের বেশ সুগঠিত ও সুস্থির অর্থনীতি ছিলো, যার মুখ্য ভিত্তি হিসেবে ধরা হয় কৃষিকর-কে। সেকালের উত্তর-পশ্চিম আনাতোলিয়ার বন্দর শহর বার্সা, যা ছিলো সেই সময়ে অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী, সেখান থেকেও প্রচুর আবগারি কর, চুঙ্গি কর আমদানি হোতো। এই বন্দর শহরটির সঙ্গে সহজেই পশ্চিম এশিয়া যাওয়া যেত। ভূমধ্যসাগর কাছে থাকায় এই অঞ্চলটি নৌবাণিজ্যের জন্য আদর্শ স্থান হিসেবে পরিগণিত হয়। অটোমান সাম্রাজ্যের ঐশ্বর্য কেবল কর আদায়ের ওপরই নির্ভরশীল ছিলো না, বাণিজ্যের জন্য তাদের নিজস্ব উৎকৃষ্ট মানের অন্যান্য পণ্যও ছিলো। ইউরোপীয় ধনী মানুষদের শখের হাতে বোনা নানান সামগ্রী, রেশমের বস্ত্র তারা বিপুল পরিমাণে রপ্তানি করতো, যা গড়পড়তা ইউরোপীয় দেশের উৎপাদকরা ভাবতেও পারতো না। এ ছাড়া তারা সারা পৃথিবীতে বিপুল পরিমাণে খাদ্যদ্রব্য রপ্তানি করতো। এই খাদ্য রপ্তানিই ছিলো তাদের আর্থিক প্রাচুর্যের মূল ভিত্তি। ভেনিসের বণিকরা ইউরোপের খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য অটোমান সাম্রাজ্য থেকে বিপুল পরিমাণে খাদ্য কিনতো। নৌবাণিজ্যে নিয়ন্ত্রণ আনতে অটোমান সাম্রাজ্য দ্রুত তাদের নৌবাহিনী ও রণতরী সংগঠিত করে নেয়। এই নৌ-বল দিয়ে তারা সমুদ্রপথে তাদের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুরক্ষা নিশ্চিত করে। প্রধানত এই কারণেই এই অঞ্চল অনেকদিন পর্যন্ত ছিনতাই এবং জলদস্যুদের লুঠপাট থেকে অনেকাংশে মুক্ত ছিলো। অটোমান সাম্রাজ্যের নৌ-সেনা তাদের উপকূলভাগ এবং বাণিজ্যপথে নিয়ম করে টহলদারী চালাতো। ওবাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের এক বৃহৎ অংশ ছিনিয়ে নিয়েছিল অটোমান সাম্রাজ্য। তারা ভারত মহাসাগরের পশ্চিম দিকে বিস্তৃত ছিল। এদের দখল এবং নিয়ন্ত্রণে ছিলো লোহিত সাগরবাহী যাবতীয় নৌবাণিজ্য। এই জলপথ ধরেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্য ইউরোপের ভেনিস মারফৎ সম্পন্ন হোতো।
ভারত মহাসাগরের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে তখন রাজত্ব করছে সাফাভিদ বংশ। এই সাফাভিদ বংশের আদি ছিলো আরদাবিল অঞ্চলের সুফি পরম্পরার শেখ সাফি আল দিন-এর থেকে ( ১২৫৩- ১৩৩৪)। এই ইরান-কেন্দ্রীক সাফাভিদ রাজত্ব পারস্য উপসাহরীয় অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণ করতো। ভৌগোলিক দিক থেকে এই সাফাভিদ সাম্রাজ্যের অবস্থান খানিকটা অনন্য ছিলো বলা যায়। আরব আর ভারতবর্ষের মধ্যে তাদের এক বিস্তীর্ণ উপকূলভূমি ছিলো। সাফাভিদ সাম্রাজ্য ইউরোপে অনেকদিন থেকেই রেশমের থান এবং রেশমের বস্ত্র রপ্তানি করতো, যা ইউরোপের ধনী মানুষরা সোনার বিনিময়ে সংগ্রহ করতো। এ ছাড়া পারস্যের বিখ্যাত কার্পেট তো ছিলোই। ভারত মহাসাগর দিয়ে তাদের বহির্বাণিজ্য প্রসারিত হওয়ায় পৃথিবীর এক বিস্তৃত অঞ্চলে পারস্যের কার্পেটের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে এবং সাফাভিদ রাজত্বের অর্থকোষ ভরে উঠতে থাকে। প্রধানত ভৌগোলিক কারণে সাফাভিদ রাজত্ব নৌ-বাণিজ্যের থেকেও কাফেলা-কেন্দ্রীক স্থলপথে বাণিজ্যে বেশি মনোযোগ দেয়। তারা বাণিজ্যপথ সুরক্ষিত রাখতে সেনা ছাউনি প্রতিষ্ঠা করে। ভ্রাম্যমাণ সৈন্যদল বাণিজ্য কাফেলাগুলিকে সুরক্ষা দেয় এবং ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে রাজত্বের পক্ষ থেকে পরিষ্কার সরাইখানার ব্যবস্থা হয়, পথের ছোটোখাটো নদীগুলির ওপর সাঁকোর বন্দোবস্ত হয়।
পুব দিকে ছিলো গড়ে ওঠার মুখে মোঘল সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্য তখন আজকের পাকিস্তান এবং ভারতের উত্তর অঞ্চলগুলিতে খানিকটা সুস্থির রাজত্ব স্থাপন করতে পেরেছে যদিও তারা বিভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন হিন্দু রাজত্বগুলির সঙ্গে ঘন ঘন সংঘর্ষে এবং যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে। পানিপথের যুদ্ধের পর বাবরের হাত ধরে দীর্ঘকালব্যাপী এই উপমহাদেশে যে মোগল সাম্রাজ্য রাজত্ব করবে, তার ভিত তখন গাঁথা হচ্ছে। সাম্রাজ্যের সেই আদি দিন গুলিতেই মোঘল সাম্রাজ্যের বিত্ত ও বৈভব ইউরোপীয়দের চেয়ে অনেকটাই এগিয়েছিল। আজকের অর্থনীতিবিদরা হিসেব কষে দেখেছেন যে মোগল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে রমরমার দিনে এই সাম্রাজ্য সারা পৃথিবীর জিডিপি-র কুড়ি শতাংশেরও বেশি একাই তৈরি করতো। মোঘল সাম্রাজ্যের নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা এতোটাই সুগঠিত ছিলো যে তারা সারা পৃথিবীর বাজার থেকে কিছুই আমদানি করতো না এবং তাদের উৎপাদিত পণ্যের বৈচিত্র ও গুণমাণের জন্য তা সারা পৃথিবীর বণিককূল হামলে পড়ে সংগ্রহ করতো। তাদের আমদানির একমাত্র “পণ্য” ছিলো আরব দেশগুলির উৎকৃষ্ট ঘোড়া। আজকের অর্থনীতির ভাষায় যাকে “পজিটিভ ট্রেড ব্যালান্স” বলা হয়, মোঘলদের অর্থনীতিতে তার পরিমাণ ছিলো বিপুল। ভারতের অতি-উর্বর অঞ্চলের ফসলের দখল ছিলো মোঘলদের, তাদের কৃষিকর আদায় ব্যবস্থা ছিল উৎকৃষ্ট, ফলে করের টাকায় মোঘল অর্থ কোষ উপচে পড়তো। মোঘল আমলে যে ভারতীয় বস্ত্র উৎপাদিত হোতো, সেগুলি অটোমান ও সাফাভিদ রাজত্বের বস্ত্রের সঙ্গে মানের দিক থেকে টক্কর দিয়ে ইউরোপের বাজারের বৃহৎ অংশ দখল করে নিয়েছিলো। এছাড়া মশলা, হাতির দাঁত, নীল এবং সর্বোপরি ছিলো বাংলার মসলিন। ভারতীয় বস্ত্র এবং খাদ্য ব্যবসায় প্রায় একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সারা ইউরোপ সরাসরি সোনা এবং রুপো-র বিনিময়ে এই সব উৎকৃষ্ট দ্রব্য কিনতে থাকে। মোঘল অর্থকোষ বাণিজ্য থেকে পাওয়া এই সোনা এবং রুপোর সংগহে স্ফীত হতে থাকে। পরবর্তীকালে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীরা এই দেশ দখলের প্রায় প্রথম দিকেই এই সোনা-রুপোর বিপুল সংগ্রহ নিজেদের দেশে চালান করে এবং এই ধাতুগুলি দিয়ে তাদের মুদ্রা তৈরি করে। এর ফল হলো আজকের অর্থনীতিতে ব্রিটেনের অবদান প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হওয়া সত্ত্বেও তার মুদ্রামূল্য কৃত্রিম ভাবে উচ্চ, তার কারণ ভারত থেকে লুঠের মাল হিসেবে এই ধাতু সম্পদ তারা ফোকটে লাভ করেছে!
মোঘল সাম্রাজ্য যখন প্রায় সারা ভারতীয় উপমহাদেশে বিস্তৃত হয়ে পড়েছে, তখনও তারা কেরালার কালিকটের হিন্দু রাজত্বের এবং দাক্ষিণাত্যের বিজয়নগর রাজত্বের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়েই যাচ্ছে। ভারত মহাসাগরে মুসলমান রাজত্বের দুটি মুখ্য নৌ-বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। এর মধ্যে অটোমান সাম্রাজ্যের দখলে ছিল এডেন বন্দর, যার অবস্থান ঠিক লোহিত সাগরের মুখে। সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই স্থান হিসেবে এডেন ভারত মহাসাগর ও লোহিত সাগরের মধ্যে সংযোগকারী হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ঐতিহাসিক কালে মিশরীয় সভ্যতা, গ্রিক ও রোমান রাজত্বও এই পথই ব্যবহার করতো। ভারত মহাসাগর বাহিত হয়ে যে সব পণ্য আসতো, সেগুলি এডেন বন্দরে খালাশ হয়ে জাহাজ বাহিত হয়ে মিশরে প্রবেশ করতো।
অন্য নৌ-বাণিজ্য কেন্দ্রটি ছিলো সাফাভিদ রাজত্বের নিয়ন্ত্রণে। ভারত মহাসাগর বাহিত পণ্যের ব্যবসা চলতো হরমুজ মারফৎ ( এই হরমুজ-এর অবস্থান হলো পারস্য উপসাগর ও অমান উপসাগর অঞ্চলে)। এই পথ দিয়েই দীর্ঘদিন ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্য নির্বাহ করা হতো। এতদসত্ত্বেও ভারত মহাসাগর দিয়ে ব্যবসার ক্ষেত্রে ভারতের একটি কেন্দ্রীয় স্থান ছিলো। ভারতের হিন্দু রাজত্ব ছিলো কালিকটে, যা আজকের কোঝিকোড়, কুন্নুর, কোচিন, কুইলন ঘিরে এক শতাব্দী-প্রাচীন বাণিজ্য পথ ছিলো। এছাড়া মুসলিম অধ্যুষিত গোয়া, মালাবার উপকূল এবং মুসলিম দখলে থাকা ক্যাম্বে উপসাগরীয় অঞ্চল, যা আজকের গুজরাট প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত, সেগুলিও এই অঞ্চলের মুখ্য বাণিজ্য পথ ছিলো। পঞ্চদশকের শেষাশেষি গুজরাটের নৌ-বাণিজ্য ভারত মহাসাগরের মাধ্যমে যে সুগঠিত আরবীয় বণিকদের বাণিজ্য ছিলো, তাদের সঙ্গে রীতিমতো পাল্লা দেওয়া শুরু করে।
ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিলো কেরলের কালিকট। এখান থেকেই সারা পৃথিবীতে মরিচদানা রপ্তানি করা হোতো। গত কয়েক শতাব্দী ধরেই ভারত মহাসাগর দিয়ে যারা বাণিজ্য করতো, তাদের গন্তব্য ছিলো এই কালিকট বন্দর। কোথা থেকে না বণিকরা এখানে এসে জমায়েত হোতো! তারা আসতো এডেন, হরমুঝ বা পরবর্তীতে বিকৃত উচ্চারণে যা গিয়ে দাঁড়ায় ওরমুঝ-এ, মালাক্কা, চীন। এখান থেকে রপ্তানি হোতো ভারতের সূতিবস্ত্র, যার ইউরোপীয় নাম হয়ে দাঁড়ায় “ক্যালিকো”, যা আসলে কালিকট-এর ইউরোপীয় অপভ্রংশ।
ক্যাম্বে উপসাগরীয় অঞ্চলকে দুটি ছড়ানো হাত হিসেবে ভাবা যেতে পারে। তার দক্ষিণদিকের বাড়ানো হাত ধরে আমরা গিয়ে হাজির হতে পারি এডেন বন্দরে। অন্য বাড়ানো হাতটি আমাদের পৌঁছে দেবে আজকের মালয়েশিয়ার মালাক্কা-র দিকে। দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন হিন্দু রাজ্য থেকে শুরু করে গোয়া, ভাটকাল, মালাবারের প্রায় সব জায়গা থেকেই সমুদ্রপথে এডেন, হরমুঝ, শ্রীলঙ্কা, পেগু, শ্যামদেশ (আজকের থাইল্যান্ড), এবং মালাক্কা পর্যন্ত গিয়ে ভারতীয় বণিকরা ব্যবসা চালাতো। এই ব্যবসায় বাঙলা থেকেও জাহাজ যেতো। পঞ্চদশ শতকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলির দখল মুসলিম রাজত্বগুলির প্রায় একচেটিয়া দখলে চলে আসে। ভারত মহাসাগর ও চীন উপসাগর দিয়ে জাহাজ নিয়ে ভারতীয় ও চীনা নৌ-বাণিজ্যতরীগুলি মালাক্কায় গিয়ে ভিড়তো, তাদের সঙ্গে থাকতো জাহাজ ভর্তি মশলা; মরিচদানা, দারুচিনি, জায়ফল, জৈত্রী। বাণিজ্যতরীর অনেক নাবিক এই সব ব্যবসাকেন্দ্রে পাকাপাকিভাবে বসতবাটি বানিয়ে নিত, তারা আর তাদের নিজভূমে ফিরতো না। কিন্তু তারা তাদের দেশে, কারুর জন্য কালিকট, কারুর জন্য গোয়া, কারুর জন্য তা ক্যাম্বে অঞ্চল, জলপথে যাওয়ার রাস্তা ভোলে নি। অনেক সময় তারা অন্যান্য বিদেশি বাণিজ্যতরীকে পথ দেখিয়ে কালিকট বা মালাবার উপকূলে পৌঁছে দিত। বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে ভেনিসের বণিকবৃন্দ ভারতের মশলা, যেমন মরিচদানা, লবঙ্গ, জায়ফল, জৈত্রী, ধনে ইত্যাদি তাদের মধ্যপ্রাচ্যের ব্যবসা-সহযোগী মামলুক এবং অটোমানদের মারফৎ ইউরোপে পৌছে দিত।
ইউরোপীয়রা চাইছিলো এই অঞ্চলের মশলার ব্যবসার একচেটিয়া অধিকার কী ভাবে দখল করা যায়। ইউরোপীয় “আবিষ্কারের অভিযান” সেই লক্ষ্য সাধনের উপায় হিসেবে বিভিন্ন দেশের রাজা রাজড়াদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। একথা আমরা সবাই জানি যে, হরির লুঠের সময় যারা সামনের সারিতে দাঁড়াতে সক্ষম হয়, তাদের ভাগ্যে জোটে সবচেয়ে বেশি লুঠের মাল। তাই শুরু হলো এইসব “অভিযান”, কলম্বাস, ভাস্কো ডা গামা, হার্নান্দেজ আরও কত নাম। সভ্যতার ইতিহাসে যত রক্তগঙ্গা বয়ে গেছে, তার এক বড়ো অংশ এই ইউরোপীয় অ্যাডভেঞ্চারের প্রত্যক্ষ ফল, আধুনিক যুগে যার বহিঃপ্রকাশ ভিয়েতনামে মাই লাই হত্যাকাণ্ড, হিরোসিমা-নাগাসাকি, উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার জার্মানির হাতে হেরেরো-নামা নিধন, কঙ্গো, হলোকস্ট…। তালিকা বিরাট।
এমনই এক প্রেক্ষিতে ভারতে আগমন ঘটবে, ইউরোপীয় আবিষ্কারের আশ্চর্য নায়ক ভাস্কো ডা গামা-র। শুরু হবে পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংসের এক শোচনীয় গাথা।