পরিবেশ ধ্বংস ও উপনিবেশবাদের প্রেক্ষিতে পৃথিবীর এবং ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে ১৪৭৪ সাল এক নতুন প্রাসঙ্গিকতা আমাদের সামনে হাজির করে। স্যার পিটার ফন হাগেনবাখ বার্গান্ডির ডিউকের “নির্দেশে” আলাসটিয়ান অঞ্চলের শাসনের ভার নেন, সময়কাল ১৪৬৯ থেকে ১৪৭৪। সেই অঞ্চলের মানুষদের “বেয়াড়াপনা” রোখার অভিপ্রায়ে তিনি পাইকেরি হারে গণহত্যা, ধর্ষণ চালান বলে ইতিহাসে নথিবদ্ধ হয়ে আছে। ১৪৭৪ সালে আলাসটয়ান অঞ্চলের নানা শহরের ন্যায়াধীশবৃন্দ এবং আজকের “জুরি ব্যবস্থার” আদি রূপ হিসেবে প্রায় ২৮জন “সুনাগরিক” এই মামলার সব নথিপত্র ঘেঁটে, এজাহার নিয়ে হাগেনবাখকে মানবজাতির বিরুদ্ধে অমানবিক আচরণের কারণে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। এটাই হয়তো পৃথিবীর লিখিত ইতিহাসে প্রথম যুদ্ধাপরাধের বিচার। এরপর থেকে এই আজ পর্যন্ত লাগাতার মানবজাতির বিরুদ্ধে অমানবিক আচরণ চলেই আসছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি বিজয়ী হয়ে অক্ষশক্তির দেশগুলির, বিশেষত জার্মানি ও জাপানের বিরুদ্ধে দুটি যুদ্ধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এবং নাৎসি ও জাপানি যুদ্ধবাজদের অনেককেই ফাঁসিকাঠে ঝোলায়। যে সব অভিযোগের ভিত্তিতে নুরেনবুর্গ ট্রাইব্যুনালের আয়োজন, সেই একই অভিযোগে জাপানের যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে গঠিত ট্রাইব্যুনালের ভারতীয় আইনজ্ঞ, রাধাবিনোদ পাল মন্তব্য করেন যে, যারা হিরোসিমা-নাগাসাকিতে অসামরিক জনগণের ওপর নিউক্লিয়ার বোমার শক্তি পরীক্ষা করতে গিয়ে ব্যাপক গণহত্যা ঘটিয়েছে, তারা কোন মুখে এই ট্রাইব্যুনাল বসাচ্ছে। এতো সেই মানবজাতির ইতিহাসে আবহমান কাল থেকে চলে আসা বিজয়ীদের দ্বারা বিজিতদের ওপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কূটনৈতিক চাল মাত্র। এই প্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আজকে আমাদের যোগ করতে হবে পরিবেশ ও প্রতিবেশ ধ্বংসের কারণটিও।
পর্তুগাল-এর রাজা পঞ্চম আফনসো তাঁর পুত্র রাজকুমার জন-কে সে দেশের আফ্রিকার উপনিবেশগুলির দেখাশোনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। রাজকুমারের ওপর মূল দায়িত্ব বর্তায় আফ্রিকার দেশ গুয়েনা-র সঙ্গে পর্তুগালের বাণিজ্যের (এখানে বাণিজ্য বলতে বোঝানো হচ্ছে সেযুগের রাজা দেশ ও প্রজা দেশের মধ্যে বাণিজ্যের নামে লুঠ, প্রাকৃতিক সম্পদের একচেটিয়া এবং একমুখি প্রবাহ) বিষয়টি দেখাশোনা করা। এই “বাণিজ্যিক” দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তাঁকে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে অভিযান চালিয়ে সেখানে পর্তুগালের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার বিষয়টিরও দায়িত্ব দেওয়া হয়। সময়কাল সেই ১৪৭৪। রাজকুমার জন-এর মনোগত অভিপ্রায় ছিল ঐ অঞ্চলে অন্যান্য সমস্ত ইউরোপীয় শক্তিগুলির জলপথে প্রবেশ আটকে দিয়ে ব্যবসার নামে অঞ্চলটির প্রাকৃতিক সম্পদের একচেটিয়া মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা। এই সব বিষয়ে পরিকল্পনা করতে করতেই এসে পড়ে ১৪৮১ সাল, রাজকুমার জন অভিষিক্ত হলেন পর্তুগালের মহামান্য রাজার সিংহাসনে। আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে তিনি আফ্রিকা মহাদেশের শেষ বিন্দুটি কোথায় অবস্থান করে তা নির্ণয় করার জন্য এক “আবিষ্কারের মহা অভিযান” সংগঠিত করে ফেলেন। শুধু “আবিষ্কার” করলেই তো আর মহা রাজ-কর্তব্য সম্পূর্ণ হয় না, অতএব তিনি এই “অভিযান”-এর নায়ককে দিলেন পর্তুগালের রাজার চিহ্নবাহী এক ক্ষুদ্র মিনার, পাশাপাশি তিনি প্রভু যিশুর পবিত্র ক্রুশ-ও দিলেন। অভিযানের নায়ককের কাছে রাজা জন-এর নির্দেশ ছিলো—যে যে অচেনা প্রান্তরে তিনি পা রাখবেন, সেখানে আগে পর্তুগালের রাজার মিনার পুঁতে সেই অঞ্চলটিকে পর্তুগালের এক্তিয়ারভুক্ত এলাকায় পরিণত করবেন এবং কেবলমাত্র তার পরই স্থানীয় অধিবাসীদের বোঝাবেন যে পর্তুগালের মহামান্য রাজা এখানে প্রভু যিশুর নামে প্রেম ও ক্ষমা বিলোতে এই বিরাট কর্মকাণ্ডের আয়োজন করেছেন!
এই অভিযানে ছিলেন এক দক্ষ নাবিক ও চৌখোশ জলদস্যু, দিয়াগো ক্যাও। তিনি প্রথমে আফ্রিকার কঙ্গো-তে হাজির হন, মিনার পোঁতেন এবং পরে জাহাজে করে অ্যাঙ্গোলা উপকূলে পৌঁছন। আরও এগিয়ে তিনি পৌঁছন আজকের সান্তা মারিয়া-তে। এই পুরো অঞ্চল ছেয়ে যায় পর্তুগাল রাজত্বের চিহ্নবাহী অগণন মিনারে। পাশাপাশি স্থানীয় মানুষদের হাতে হাতে পৌঁছে যায় ক্রুশ আর বাইবেল। পর্তুগালে তিনি ফিরলে তাঁকে বিরাট সম্মান দেওয়া হয়, তাঁকে অভিজাতদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় ( তাঁর জলদস্যুতার দুর্নাম ঘুচে যায়, কেবল কিছু বেয়াড়া ঐতিহাসিক, যার মধ্যে বেশির ভাগই আফ্রিকান, যাঁরা ঔপনেবেশিক শাসনে তাঁদের দুর্দশা আজও ভুলতে পারেন নি, কেবল তাঁরাই এই কলঙ্কময় ইতিহাসকে “সভ্যতা”-র আলোতে এনে ফেলেছেন)। এই পথে গিয়ে দিয়োগো ক্যাও বুঝি ভারত মহাসাহরে পৌঁছে যাবেন, এই ভরসায় পর্তুগানের রাজার দাক্ষিণ্যে ঐ অঞ্চলে একটি দ্বিতীয় অভিযান সংগঠিত করা হয়। এই দ্বিতীয় অভিযানে তিনি শেষ পর্যন্ত ক্রশ অন্তরীপ-এ পৌঁছন এবং এই অঞ্চলে পর্তুগালের রাজার “হক” প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তিনি যাঁর প্রতিভূ, সেই প্রভু যিশুর প্রেম ও ক্ষমার বাণীবাহী বাইবেল ও ক্রুশ অকাতরে বিতরণ করেন। এ যাত্রায় তাঁর আর বেশিদূর অগ্রসরের খবর নেই আমাদের কাছে, বস্তুত তিনি ভারত মহাসাগরে আর পৌঁছতে পারেন নি, তার আগেই নিখোঁজ হয়ে যান।
রাজার এই “আরদ্ধ কাজ” সম্পন্ন করার জন্য একটি নতুন অভিযানের প্রয়োজন উপস্থিত হয়। এই কাজের জন্য বাছা হয় আরও এক “দক্ষ নাবিক” ও “অভিযানপ্রিয় ব্যক্তি” বা “অ্যাডভেঞ্চারার” ( তত দিনে “আবিষ্কারের এই “আশ্চর্য অভিযান”-এর সঙ্গে জলদস্যুদের উপস্থিতি “অস্বস্তিকর” অবস্থায় পৌঁছেছে) বার্টোলমিউ দিয়াস-কে ( পুরো নামটি দৈর্ঘে বেশ খানিকটা হওয়ায়, বার্টোলমিউ দিয়াস দে নোভাইস, তিনি নামের প্রথম দুই অংশ নিয়েই পৃথিবী খ্যাত হয়েছেন)। দিয়াস-এর জন্ম ১৪৫০ সালে, অন্যান্য প্রায় সব “অ্যাডভেঞ্চারার”-দের তাঁর “মৃত্যুভাগ্য” প্রায় একই রকমের, সকলের অজ্ঞাতে অজানা এক অঞ্চলে সমুদ্রেই তাঁর মৃত্যু ঘটে, মে মাসের ২৯ তারিখে, ১৫০০ সালে)। তাঁর দেহ সমুদ্রেই বিসর্জিত হয়। দিয়াস ইউরোপের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে এশিয়া মহাদেশে আসার জলপথ খুঁজে বের করেন; এই পথ আসলে অতলান্তিক মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগর ঘুরে। তিনি পঞ্চদশ শতকের ইউরোপের এই “আবিষ্কারে অভিযান”-এ সব চেয়ে দক্ষ নাবিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন।
উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে ভারতের দিকের যাত্রার পথ ততদিনে ইউরোপীয়দের ধরা ছোঁয়ার মধ্যে আসতে চলেছে। এই কাজের জন্য মূল কৃতিত্ব অবশ্যই বার্টোলোমিউ দিয়াস-এরই প্রাপ্য সন্দেহ নেই। অতিমধ্যে পর্তুগালের রাজা হয়ে বসেছেন প্রথম ম্যানুয়েল, যাঁর রাজত্ব কাল অপেক্ষাকৃত সংক্ষিপ্ত, ১৪৯৫ সাল থেকে ১৫২১ সাল পর্যন্ত। তিনি আবার নতুন করে মশলার “এলডোরাডো”-এর দেশ ভারতে জলপথে পৌঁছনোর উদ্যোগ নিলেন। আবার ডাক পড়লো নতুন এক জলদস্যুর, অবশ্য ততদিনে রাজার স্নেহস্পর্শে তিনি এক জবরদস্ত হোমরাচোমরা ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন। সেই ব্যক্তির নাম ভাস্কো ডা গামা ( ১৪৬৯-১৫২৪)।
১৪৫৭ সালে রাজা প্রথম ম্যানুয়েল ভাস্কো ডা গামা-কে দায়িত্ব দিলেন মশলার দেশে পৌঁছনোর। ইউরোপীয়দের জানা ছিল ভূমধ্য সাগরে জলদস্যুদের উৎপাতের কথা। ফলে অন্যান্য অঞ্চলে জলদস্যুতার বিষয় নিয়ে তুখোড় জলদস্যু ভাস্কো ডা গামা-র মনে কোনও সন্দেহই ছিলো না। ভাস্কো ডা গামা তাঁর পূর্বসূরী, বার্টোলোমিউ ডায়াস নির্ধারিত পথেই আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে ভারতে পাড়ি জমানোর উদ্যোগ নেন। ডায়াস তাঁর সমুদ্র অভিযানের সময় অতলান্তিক মহাসাগরের সবল সমুদ্রবায়ু ব্যবহার করে পাল তুলে সাগরপাড়ি দিয়ে উত্তমাশা অন্তরীপ প্রদক্ষিণের কথা জানতেন।
ভাস্কো ডা গামা ১৪৯৭ সালের জুলাই ৮ পর্তুগালের লিসবন শহর থেকে যাত্রা শুরু করলেন। এই দিনটি ভারতের উপমহাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশক্ষেত্রে এক অপ্রাত্যাহারযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। জলদস্যু হওয়ার কারণে তিনি জানতেন যে তিনি যেমন কোনও এক সময় একদল জাহাজকে সমুদ্রে দেখলেই আক্রমণ করতেন, তেমনি মাঝ সমুদ্রে তাঁদের জাহাজ দেখলেও অন্যন্যরা তাঁদের আক্রমণ করতে পারে। এছাড়াও তিনি জানতেন যে অচেনা অঞ্চলের মানুষরা তাঁদের ধন সম্পদ লুঠ করার কাজটি বিনা প্রতিরোধে মেনে নেবে না, ফলে তাদের “শায়েস্ত” করার জন্যও সৈন্যবল লাগবে। অস্ত্রে সুসজ্জিত চারটি জাহাজ এবং তিন বছরের খাদ্য ও অন্যান্য রসদ নিয়ে তিনি যাত্রা শুরু করলেন। অন্যান্য অশিক্ষিত ইউরোপীয়দের মতো ডা গামা-রও ধারণা ছিলো যে ইউরোপের বাইরে অসভ্য মানব প্রজারির লোকজন বসবাস করে; অতএব তাদের সভ্যতার স্তর হবে অতি নিম্ন মানের। তারা অগ্রসর ইউরোপীয় সভ্যতার কাছে সহজেই পরাজিত হয়ে বশ্যতা স্বীকার করে নেবে! কিন্তু যাত্রা প্রথম দিকেই বিপর্যয় ঘটে। ডায়াস-এর সমুদ্রবায়ুকে বশে আনার যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিলো, দুর্ভাগ্যক্রমে ডা গামা-র সেই মূল্যবান অভিজ্ঞতা ছিলো না, ফলে অতলান্তিকের বায়ুর প্রবল প্রভাবে জাহাজসহ তাঁদের দলটি অতলান্তকের অতল সাগরে সমানে ঘুরপাক খেতে থাকেন। দীর্ঘ ৯৫ দিন সমুদ্রযাত্রার শেষে তিনি আজকের সেন্ট হেলেনা উপসাগরের কূল থেকে প্রায় ১২৫ মাইল উত্তরে হাজির হন। মাত্র ৪৭ বর্গমাইলের এই স্থলভাগটির অবস্থান অতলান্তিকের বুকে এক প্রকৃতই দুর্গম অঞ্চলে। দক্ষিণ অতলান্তিকের বুকে এই স্থলভাগ থেকে আফ্রিকা মহাদেশের দূরত্ব ১২০০ মাইলের কাছাকাছি আর দক্ষিণ আমেরিকা থেকে দূরত্ব প্রায় ১৮০০ মাইল। এই স্থলভাগের সবচেয়ে কাছে স্থলভাগের নাম অ্যাসেনশান দ্বীপ, প্রায় ৮০০ মাইল উত্তরপশ্চিমে যার অবস্থান। অঞ্চলটি আজও বেশ দুর্গম, ব্রিটেনের আজও তা উপনিবেশ, ঠিক কোভিড-কালের আগে সেখানে একটি বিমানবন্দর স্থাপিত হয়েছে, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন থেকে পাঁচ দিনের সমুদ্রযাত্রার শেষে সেই দ্বীপে পৌঁছনো যায়।
সেকালে যে সব ভাগ্যান্বেষী সোনা-রুপো হীরের খোঁজে সমুদ্রপথে পাড়ি জমাতেন, প্রকৃতি তাঁদের এই অনাচারের জন্য তার নিজস্ব উপায়ে প্রত্যাঘাত করতো। টাটকা সবজি থেকে প্রাপ্ত ভিটামিন-এর অভাবে এই সব জাহাজের নাবিক ও অন্যান্য কাজের মানুষরা তখনকার দিনের দুরারোগ্য স্কার্ভি রোগের কবলে পড়তেন। প্রকৃতি ডা গামা-র নাবিকদেরও এই বিষয়ে ছাড় দেওয়নি। তাঁদের জাহাজ যখন সেন্ট হেলেনা দ্বীপের স্থলভাগে নোঙর ফেললো, তখন সেই জাহাজের অধিকাংশ নাবিবের স্কার্ভি হয়েছে, তাদের হাত-পা শোচনীয় ভাবে ফুলে গেছে, ফুলে ওঠা মাড়ি থেকে দাঁতের পাটিগুলি প্রায় খুলে এসেছে। ভারতবর্ষের সম্পদ লুঠ করতে আসা ইউরোপীয় দস্যুদের অধিকাংশই প্রকৃতির এই “স্বাভাবিক প্রতিরোধ”-এর শিকার হয়েছিলেন। জাহাজ নিয়ে ভাস্কো ডা গামা যত অগ্রসর হতে শুরু করলেন, ততই তাঁর চোখে পড়তে থাকলো, অনন্যসাধারণ সমস্ত অত্যন্ত ধনী শহর-কেন্দ্রীক রাজ্যগুলি, এগুলির অবস্থান ছিলো পূর্ব আফ্রিকা ও ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তদেশে। এই শহরগুলিকে ঘিরে তখন চলতো রমরমা উচ্চস্তরের বাণিজ্য, যা লিসবনবাসী ভাস্কো ডা গামা কস্মিনকালেও চোখে দেখেন নি। এই ব্যবসার ক্ষেত্র প্রসারিত ছিল আফ্রিকা থেকে ভারত, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া মারফৎ চীনের সঙ্গে।
এই পুরো অঞ্চলের বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ ছিলো মুসলিম দুনিয়ার। ইউরোপের খৃশ্চান সমাজের চেয়ে এই মুসলিম সমাজ ছিলো প্রায় সব দিক থেকে ভিন্ন; যে স্তরীভূত ব্যবস্থায় এই মুসলিম সমাজের সামাজিক বিধি ও রীতিনীতি নির্বাহ হোতো, সেটি বোঝার মতো জটিলতা, সে সময়ের ইউরোপের সমাজের মধ্যে থেকে উঠে আসা ইউরোপীয় প্রজাতির এই বংশধরদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। ফলে সমুদ্রবাহিত হয়ে তারা যখন এমন এক সুগঠিত সমাজের সামনাসামনি হাজির হলো, তাদের পক্ষে এই সমাজের বৈভব ব্যতীত মানবজাতির কৃষ্টির অন্যান্য কিছুই আর তাদের স্পর্শ করলো না।
মুসলিম সভ্যতার যে দিকটিকে ভাস্কো ডা গামা এবং তাঁর পরবর্তী অভিযানকারীরা সম্পূর্ণতই ভুল বুঝেছিলেন , তা হল এটাই যে তাঁরা দেখলেন যে আরব বণিকরা সম্পুর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় বাণিজ্যতরীগুলি নিয়ে নির্ভয়ে সমুদ্রযাত্রা করে থাকেন। আসলে এই অঞ্চলে ইউরোপের অনেকদিন আগেই উন্নত রাজনৈতিক ও ন্যায়নীতি ভিত্তিক সমঝোতা গড়ে উঠেছিল, যেখানে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দস্যুতার স্থান অনেককাল আগেই অবলুপ্ত হয়েছিলো। কিন্তু জলদস্যুতার কৃষ্টিতে লালিত ইউরোপীয়দের অভিজ্ঞতায় ছিল ভূমধ্যসাগরের জলদস্যুতার জন্য খ্যাত অঞ্চলগুলি; তাই এই অঞ্চল থেকে জলদস্যুতায় লালিত মানুষদের কাছে তা প্রতিভাত হয় এই অঞ্চলের মানুষের দুর্বলতার চিহ্ন হিসেবে, কৃষ্টির দ্যোতক হিসেবে নয়। ফলে আগামী বেশ কিছু বছর ভারত মহাসাগর এইসব জলদ্যুবৃত্তির এক রক্তলাঞ্ছিত অধ্যায়ের সাক্ষী হয়ে রইলো। ভাস্কো ডা গামা ও তাঁর সঙ্গী সাথীরা দক্ষিণ কেনিয়ার মোম্বাসা-য় উপস্থিত হয়ে স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে রীতিমতো সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে যুদ্ধে এঁটে উঠতে না পেরে দলবল নিয়ে তিনি আরও প্রায় ১০০ মাইল এগিয়ে গিয়ে কেনিয়ার অন্য একটি বন্দর শহর, মালিন্দি-তে হাজির হন। সংঘর্ষের টাটকা অভিজ্ঞতা থাকায় এখানে এসে তিনি ন্যায্য বাণিজ্য মারফৎ কিছু পণ্য সংগ্রহ করেন। দু;খের বিষয়, তিনি অধিকাংশ পণ্য চিনতেও পারেন নি বা আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের মূল্য কেমন হতে পারে, সে সম্পর্কেও বিশেষ কিছুই অনুমানও করে উঠতে পারেন নি। ওপর ওপর দেখে যেগুলিকে তাঁর নতুন ও চিত্তাকর্ষক বলে মনে হয়েছিল, তিনি কেবল তাদের এক সামান্য অংশই সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। এই মালিন্দিতেই তাঁর প্রতি ভাগ্যদেবী “প্রসন্ন” হন, তিনি একজন গুজরাতি নাবিকের দেখা পান, যিনি ভাস্কো ডা গামা-কে পথ দেখিয়ে ভারতে নিয়ে আসতে রাজি হন। যে গুজরাত প্রদেশ আজকে “হিন্দুত্ববাদ”-এ টৈটম্বুর, সেই গুজরাতই কিন্তু ভারতে সাম্রাজ্যবাদীদের পথ দেখেয়ে আবাহন করে এনেছিল!
ভাস্কো ডা গামা যখন মালিন্দি বন্দরে তাঁর জাহাজগুলি নোঙর করেছিলেন, তখন তাঁর নজরে পড়ে বন্দরে সদ্য নোঙর করা ভারতের কালিকট-এর চারটি বাণিজ্যতরী। তিনি সহজেই বুঝতে পারেন যে এই জাহাজের নাবিকরা মুসলিম নন, তাঁদের ধর্ম আলাদা। অসীম অজ্ঞতায় ডা গামা ভেবে বসেন যে এই জাহাজের নাবিকরা নিশ্চয়ই এক ধরণের খৃষ্টের পূজারি, অর্থাৎ তাঁর তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত যে সাগর পেরিয়ে এদের দেশে একবার হাজির হতে পারলেই সেখানে একদল খৃস্টের পূজারীদের পাওয়া যাবে, বাইবেল এবং ক্রুশের সাহায্যে তাদের বশীভূত করা খুব কঠিন হবে না।
আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ
1 Afanasy Nikitin’s Travel to India during 1466-1472 AD, when Muslim
Period of Bahmani Sultan ruled Deccan
এই সব ভাবতে ভাবতে ভাস্কো ডা গামা মালিন্দি বন্দর থেকে ভারতের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলেন ১৪৯৮ সালের ২৪ এপ্রিল। গুজরাতি নাবিকের সহায়তায় এ যাত্রার তাঁর জলপথে ভারতের আজকের কেরালার কালিকট বন্দরে আগমন মসৃণ ভাবেই ঘটে। ভাস্কো ডা গামা-র ধারণা ছিলো তিনি মুসলমান প্রভাব ছেড়ে বুঝি প্রাচ্যের এক খৃস্টান দুনিয়ায় হাজির হলেন। কিন্তু তিনি বাস্তবে দেখলেন যে তিনি হাজির হয়েছেন বহু ঈশ্বরের পূজারি, প্রাচ্যের এক অতি প্রাচীন সভ্যতার এক বিরাট ভূখণ্ডে।
সেই সময়ে কালিকটের রাজত্বে আসীন সামুথিরি রাজবংশ। আফ্রিকা থেকে সম্ভাব্য খৃস্টান রাজার জন্য ভাস্কো ডা গাম যেসব ভেট এনেছিলেন, কালিকটের কোনও মানুষই সেইসব ঝুটো মুক্তো, নিকৃষ্ট সূতীবস্ত্রের দিকে ফিরেও তাকাতো না। ভেট হিসেবে রাজার প্রশাসন সেই সব রদ্দি মাল তৎক্ষণাৎ বাতিল করে দেয়। কিন্তু ছলে কাজ না হলে যে বল প্রদর্শনে কাজ হয়, সে বিষয়ে ভাস্কো ডা গামা-র বিলক্ষণ অভিজ্ঞতা ছিল। বল প্রদর্শন মারফৎ তিনি কালিকট-এ সামান্য কিছু ব্যবসার অনুমতি আদায়ে সক্ষম হন। কিন্তু কালিকট-এর রাজা ভাস্কো ডা গামা-কে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেন যে অন্যন্য দেশের বণিকরা এদেশে ব্যবসার জন্য যে সমস্ত কর যেমন হারে দিয়ে থাকেন, ভাস্কো ডা গামা-কেও ঠিক সেই পরিমাণে ও সেই হারেই কর দিতে হবে।
এদেশে দস্যুতার পুনরাবৃত্তি করে বিশেষ সুবিধা হবে না বুঝতে পেরে ডা গামা আপাতত লিসবন-এ ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৪৯৮ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁর গোটা তিনেক জাহাজের বহর নিয়ে তিনি কালিকট বন্দরের নোঙর ওঠান। একটি জাহাজে তিনি তাঁর স্কার্ভি রোগাক্রান্ত মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে থাকা ভাই-কে নিয়ে ভার্দে অন্তরীপের উদ্দেশে রওয়ানা দেন। আর বাকিটি দুটি জাহাজ ২৫ এপ্রিল, ১৪৯৮ সালে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে পৌঁছে দুটি আলাদা জলপথে পর্তুগাল-এর উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। ভাস্কো ডা গামা একমাস তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে থাকে; ভাইয়ের মৃত্যু হলে তিনি ১৪৯৯ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে লিসবনে ফেরেন।
লিসবনে হিসেব করে দেখা যায় যে ভাস্কো ডা গামা-র এই অভিযানের জন্য মূল্য পড়েছে অতিরিক্ত। তাঁর সঙ্গে যত লোক এই সমুদ্র অভিযানে সঙ্গী হয়েছিলো, তাদের দুই-তৃতীয়াংশই মারা গেছে, জাহাজের বেশ কয়েকটি নিখোঁজ হয়েছে, অনেক অস্ত্র ফেলে দিতে হয়েছে। এত কিছুর পরেও ভাস্কো ডা গামা কালিকট বন্দর থেকে অল্প পরিমাণে হলেও অতি সরেস মশলা আনতে সক্ষম হয়েছেন, যার ইউরোপীয় বাজারে আর্থিক মূল্য উশুল করলে এই অভিযানের মোট খরচের চেয়ে অনেক বেশি টাকা রাজকোষে জমা পড়বে। অতএব ভাস্ক ডা গামা-কে অচেনা সমুদ্রের নাবিকদের মধ্যে সেরা নায়ক হিসেবে রাজ সম্বর্ধনার এলাহি আয়োজন করা হয় এবং তিনি লিসবন-এর আরও উচ্চকোটির মানুষদের আভিজাত্যের অংশ হয়ে ওঠেন।
এর পর পর্তুগালের পক্ষ থেকে ভারতকে দখলের এক বৃহৎ পরিকল্পনা করা হয়।
আগের পর্ব পড়ুন