ছোটবেলায় বড়দের বলতে শুনতাম, গরমকালে গরম পড়বে ও শীতকালে শীত, এটাই তো স্বাভাবিক। প্রকৃতির নিয়মই তো এমন। এ নিয়ে এত হইচই চেঁচামেচি কেন?যখন আমরা ‘উফ্ কী গরম’ বলে পাড়া মাথায় করতাম কিংবা শীতকালে স্নানের আগে মগ ভর্তি জল গায়ে না ঢেলে ‘মাঘের শীত বাঘের গায়’ বলতে বলতে নাচানাচি করতাম, বড়রা তখন অমন কথাই বলতেন।
আজ আমরা বড় হয়েছি। কিন্তু গরম ও শীত নিয়ে ছোটদের জন্য অমন মন্তব্য এখন কদাচিত করি। যেভাবে দেশের (বিদেশেরও) গরম ও শীতকালের চরিত্র বদলাচ্ছে, তাতে বরং চিন্তিত হয়ে ভাবি, কলিকালে পৃথিবী এভাবেই ধ্বংস হয়ে যাবে কি না! ছোটদের তাই বিপদ বোঝাই।
এখন স্কুলে ছেলেপিলেদের শেখানো হচ্ছে (বাড়িতেও) পরিবেশ কী করে রক্ষা করতে হবে। কী কী করলে পরিবেশ দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। গাছ পুঁততে বলা হচ্ছে। প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে উপদেশ দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, পরিবেশকে রক্ষা করা না গেলে আমরাও বাঁচব না। সবাই ভেসে যাব।
ভেসে যাওয়ার আতঙ্ক এবার দেশের উত্তর–পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় মারাত্মকভাবে গেড়ে বসেছে। বর্ষা নামার আগেই যেভাবে অসম, মেঘালয়, অরুণাচল প্লাবিত, দার্জিলিং, সিকিম থেকে শুরু করে উত্তরাখন্ড ও হিমাচলে এবার যেভাবে ধস নেমেছে, পাহাড়ি নদীগুলো জলোচ্ছ্বাসের দরুন উথাল–পাতাল, তা ভয়ংকর প্রলয়েরই ট্রেলার। প্রকৃতি এভাবেই ইঙ্গিত দেয়। জানায়, তাকে অবহেলা করলে, তাকে নিয়ে যথেচ্ছাচার করলে, তাকে নির্বিচারে হত্যা করলে সভ্যতাকেও ধ্বংস হতে হবে। এখনই না শোধরালে প্রতিশোধ গ্রহণ স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।
অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যা ও ভূমি ধস ফসল ও জীবনহানির পাশাপাশি নষ্ট করছে পরিকাঠামোরও। বদলে দিচ্ছে কৃষি জমির চরিত্র। উপকূলবর্তী এলাকার মিঠে জলের পুকুর নদী সহ জমির লবনাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে চিরায়ত চাষের চরিত্র। বিপর্যয় এখন বহুরূপী। কখন কোন রূপ নেয় তা নির্ভর করে মানুষ কতটা বেহিসেবি ও বেপরোয়া তার উপর।
এ বছর উত্তর ভারতের তাপমান এক নাগাড়ে যেভাবে ৪৮–৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে আটকে থেকেছে, তা কিন্তু হুট করে হয়নি। শিল্প বিপ্লবের আগে ১৮৫০ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত বিশ্বের তাপমাত্রা যা ছিল, এখন তা বেড়ে গেছে ১.৫৮ ডিগ্রি! সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা এক ধাক্কায় বেড়ে হয়েছে ২১.০৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস! অথচ মাত্র ৮ বছর আগে, ২০১৬ সালে, এই তাপমাত্রা ছিল ২০.৯৫ ডিগ্রি! ভারতের আবহবিদদের পর্যালোচনায় দেখা গেছে গত দুই দশকে, ২০০১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত দেশের গড় তাপমাত্রা ০.৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি হয়েছে মার্চ থেকে জুন মাসে। এ বছর এত বেশি তাপপ্রবাহ স্মরণাতীত কালে দেখা যায়নি। বিশেষ করে উত্তর ভারতে। লক্ষণীয়, তাপবৃদ্ধি কিন্তু সব মরসুমে সমান নয়। গরমে বেশি, শীতে কম। হাওয়া অফিসের রেকর্ড দেখাচ্ছে, গ্রীষ্মে তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৭ ডিগ্রি, কিন্তু শীতে বেড়েছে ০.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ভারতের বিশালত্ব ও বৈচিত্রপূর্ণ চরিত্র তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত। উত্তর ভারতের দিল্লি, পাঞ্জাব, হরিয়াণা, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থানের তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাপপ্রবাহ এবার নাগাড়ে চলেছে। এই তাপপ্রবাহ স্বাস্থ্যহানির কারণ হয়েছে যেমন, তেমনই কৃষিকাজে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে প্রবলভাবে। দাক্ষিণাত্যে তাপমান বাড়লেও উত্তরের তুলনায় তা কম। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলবর্তী এলাকাগুলোয় দেখা দিয়েছে নতুন চ্যালেঞ্জ। বাতাসে আর্দ্যতার পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে মারাত্মকভাবে। এই পরিবর্তনের ফলে কোনও এলাকা বানভাসি হয়েছে, কোথাও খরা। কোথাও তাপপ্রবাহ তো কোথাও সাইক্লোন। কোথাও অনাবৃষ্টি তো কোথাও অতিবৃষ্টি। গত দুই দশকে তাপপ্রবাহের দিন বেড়ে গেছে ৫০ শতাংশ। উত্তর ও মধ্য ভারতে তাপপ্রবাহের ছোবল সবচেয়ে বেশি। এবার তাপপ্রবাহের বলি হয়েছেন প্রায় আড়াই হাজার মানুষ।
এক দিকে মাত্রাছাড়া তাপপ্রবাহ, অন্য দিকে বর্ষার রূপ বদল, তার আসা–যাওয়ার সময় পরিবর্তন ও বারিপাতের অসমান পরিমান কৃষি নির্ভর ভারতের অর্থনীতি অনিশ্চিত করে তুলেছে। এই কারণে গত দুই দশকে দেশের বন্যার চালচিত্রটাও বদলে গেছে। জলবায়ুর এই চরিত্র পরিবর্তনের পুরোটাই প্রায় মনুষ্যসৃষ্ট। ২০১৩ সালে উত্তরাখন্ডের বন্যা ও ভূমিধসে সাড়ে ৫ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর দায় স্রেফ প্রকৃতির উপর ছেড়ে দিলে তা হবে ভাবের ঘরে চুরি। কিংবা ২০১৮ সালে কেরলের বন্যা। সেবার ৫০ লাখ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছিল। ১০ লাখেরও বেশি মানুষ ঘরছাড়া হয়েছিলেন। এর দায় মানুষকেই নিতে হবে। বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগর থেকে আজকাল বছরে কতগুলো নিম্নচাপ আছড়ে পড়ছে, এবং বিশ–তিরিশ বছর আগে কতগুলো সৃষ্টি হত, হিসেব কষলেই সেই পার্থক্য ধরা পড়বে। বর্ষার আগে ও বর্ষার পরে এমন গভীর নিম্নচাপ সেভাবে দৃশ্যমান ছিল না।
বিশ্বব্যাপী পরিবেশবিদেরাও প্রমাদ গুণতে শুরু করেছেন। তাঁরা লক্ষ্য করেছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে গাছের পরাগ উৎপাদনে পতন ঘটছে। পরাগরেণুর বৈচিত্র এখন আর সেই আগের মতো দেখা যাচ্ছে না। ফলে উদ্ভিদের বংশ বিস্তার ব্যাহত হচ্ছে। এই পতন রোধ করা না গেলে একদিন পৃথিবীতে দেখা দেবে প্রবল খাদ্য সংকট।
ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, ভার্জিনিয়া টেক ও ইউনিভার্সিটি অব নেভাডার তরফে সম্প্রতি তাপমান নিয়ে এক গবেষণাপত্র বের করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলে সিয়েরা নেভাডা পার্বত্য এলাকা ও নদী উপত্যকায় ২০০–রও বেশি প্রজাতির প্রজাপতি রয়েছে। ২০০১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ওই প্রজাপতিদের মাধ্যমে পরাগ সংযোগ নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়েছিলেন। ওই ২১ বছরের রেকর্ডের সঙ্গে বর্তমানের প্রজাপতিদের পরাগ সংযোগ মিলিয়ে দেখা হয়। তাতে বিস্তর ফারাক ধরা পড়েছে।
ফসল উৎপাদনে পরাগ সংযোগ ও পরাগবাহকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক–গবেষক বেহনাজ বলমাকি বলেছেন, জলবায়ুর পরিবর্তন উদ্ভিদ ও পরাগবাহকদের সম্পর্কেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় ফুল ফোটার সময় যেমন বদলে গেছে, তেমনই পরাগবাহক প্রজাপতি ও পাখিদের অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে পড়েছে। এর ফলে উদ্ভিদের বংশ বিস্তার কমে গেছে। তাতে ফসলের ফলন কমছে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে বিশ্ব জুড়ে একদিন দেখা দেবে খাদ্য সংকট।
এই ‘এখনই ব্যবস্থা নেওয়াটাই’ আজকের দাবি। সর্বস্তরের। অথচ সেখানেই চলছে বেজায় গড়িমসি। পাশকাটানোর নীতি। জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা করার দায়িত্ব এ ঠেলে দিচ্ছে ওর দিকে, ও ঠেলছে এর ঘাড়ে। এ যেন ঠিক সেই দুধপুকুর ভরানোর গল্প। সবাই ভাবছে, আমি না গেলেও চলবে। ওরা তো যাবে।
গল্পের দুধপুকুর খটখটে থেকে গিয়েছিল। বাস্তবের পৃথিবী এগিয়ে চলেছে সর্বনাশের দিকে।