পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

জাতক্রোধ ও উল্লাস : অন্য এক স্বপ্নসম্ভব কাব্যের ভূমিকা

  • 26 May, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 878 view(s)
  • লিখেছেন : অশোক চট্টোপাধ্যায়
শহিদ স্তম্ভের মাথায় একটি ফুলকপি রেখে অমিত শাহ তাচ্ছিল্যসূচক হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন, আর শহিদ স্তম্ভের গায়ে লেখা : ‘নকশালিজম রেস্ট ইন পিস’! ছাব্বিশের মার্চের মধ্যে এভাবেই তিনি নাকি দেশকে মাওবাদী তথা নকশালমুক্ত করবেন! ১৯৮৯ সালে ভাগলপুরে গণহত্যার পর সেখানে অসংখ্য মুসলিমকে ফুলকপির ক্ষেতে পুতে দেওয়া হয়েছিল। এখানেও সেই ভাগলপুরের অনুসূত্রে নকশালপন্থী তথা নকশালপন্থীদের কবরে পাঠাতে তিনি যে বদ্ধপরিকর তারই বার্তা এখানে এই ব্যঙ্গচিত্রের মধ্যে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

জাতক্রোধ বলে একটা অতিপরিচিত শব্দ আছে। এই শব্দ যুক্তি-বুদ্ধি-বিবেচনার ধার ধারে না। মানবিক আবেদন এই জাতক্রোধের অগ্ন্যুদ্গীরণে দগ্ধে ঝলসে যায়। বিচারবিযুক্ততার সঙ্গে ধর্মীয় মৌলবাদ, উন্মত্ত সন্ত্রাসবাদ, ফ্যাসিবাদ এবং এই জাতক্রোধ-এর আত্মগত মিল দুর্নিরীক্ষ্য নয়।

গতকাল ছিল ২৫মে নকশালবাড়ি দিবস। আজ থেকে আটান্ন বছর আগে এই ২৫ মে পশ্চিমবাংলার অজয় মুখার্জী-জ্যোতি বসুদের অকংগ্রেসি ‘যুক্তফ্রন্ট’ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিপিআই(এম) নেতার নির্দেশে পুলিশ গুলি চালিয়ে উত্তরবঙ্গের নকশালবাড়িতে আন্দোলনকারী নয়জন কৃষক এবং দুজন শিশুকে হত্যা করেছিল। আর গত ২১ মে  সেই মে মাসেই বিজেপি নেতৃত্বাধীন নরেন্দ্র মোদি সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর নির্দেশে সাতাশ জন মাওবাদীকে হত্যা করেছে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনী। এই ২৫ মে'র দিনে একদিকে যেমন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিভিন্ন এলাকায় ক্ষুদ্রায়তিক হলেও আটান্ন বছর আগেকার এই শহিদস্মরণ এবং শপথস্পন্দিত সময় তার অবিনাশী নিনাদধ্বনি তুলেছে, তেমনই এই শহিদ আর বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের ঐতিহাসিক মাসেই রাষ্ট্র হত্যা করেছে জল-জমি-জঙ্গল রক্ষায় আদিবাসী জনজাতির আন্দোলনে দীর্ঘকাল ধরে সহযোদ্ধার সক্রিয় ভূমিকায় থাকা মাওবাদীদের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীকে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন পার্টির সম্পাদক কমরেড বাসব রাজুকে নিকেশের সদম্ভ প্রচার।

আগামী বছরের মার্চ মাসের মধ্যে দেশ থেকে মাওবাদ নিশ্চিহ্ন করার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তথা সরকারি ঘোষণা, যা রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞকে নৈতিকতা দান করে চলেছে—তা এই পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞের মধ্যে অভূতপূর্ব সাফল্যের উৎসবগীত ধ্বনিত হতে শুনছে, প্রীত হচ্ছে এবং সদম্ভে এই মানবতাহানিকর হত্যা-উল্লাসের সপক্ষে দাম্ভিক শব্দাবলির  বিস্ফোরণ ঘটিয়ে  চলেছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দিনচারেকের যুদ্ধে অভাবিতপূর্ব সাফল্যের অতিশয়িক কীর্তনের পাশাপাশি এই গণহত্যার পক্ষে সাফাইয়ের নজির সম্প্রতিকালে প্যালেস্তাইনে গাজায় আমেরিকার সমর্থনপুষ্ট জায়নবাদী নেতানইয়াহুর ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে চলেছে।

১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে তৎকালীন অজয় মুখার্জীর নেতৃত্বাধীন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সদ্যজাত সিপিআই(এম)-এর ‘অবিসম্বাদিত’ নেতা জ্যোতি বসুর নির্দেশে উত্তরবঙ্গের নকশালবাড়ির প্রাসাদুজোতে আন্দোলনকারী কৃষকদের ওপর পুলিশের গুলিচালনায় দুজন শিশু সহ এগারোজন শহিদ হন। এর ফলশ্রুতিতে আমাদের দেশ দেখেছিল উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগের সবচাইতে গৌরবময় আন্দোলনের এক আলোকোদ্ভাষ। একদিকে যেমন এই আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গের সীমানা অতিক্রম করে সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তারলাভ করতে থাকে, তেমনই সিপিআই(এম) নেতৃত্ব এই আন্দোলনের সংঘটকদের গণহারে দল থেকে বহিষ্কার করতে থাকে। এই নকশালপন্থী নেতৃবর্গ সিপিআই(এম)-কে তাত্ত্বিকভাবে চালেঞ্জ করায়, মতাদর্শিক দেউলিয়াপনার জায়গা থেকে সিপিআই(এম) নেতৃত্ব নকশালপন্থীদের বিরুদ্ধে তাদের জাতক্রোধের নিদর্শন রাখতে থাকে। কখনো  তাদের সিআইএ-র এজেন্ট, কখনো কংশাল (কংগ্রেস নকশাল, যেমন এখন তারা নকশালদের একই শব্দবন্ধের প্রক্রিয়ায় বলে থাকে তৃণশাল) ইত্যাদি। সত্তরের দশকের প্রত্যুষলগ্নে কলকাতায় কাশীপুর-বরানগরে নকশালপন্থী-গণহত্যায় এরা সেসময় কংগ্রেস সরকার এবং সরকার পোষিত দলীয় সমাজবিরোধী গুণ্ডাদের সঙ্গে হাত মেলাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। নকশালপন্থীদের কেন বেশি সংখ্যায় পুলিশ হত্যা করছে না, তাদের বন্দুকে কি নিরোধ লাগানো আছে?—এমন ক্রোধান্ধ উক্তি করেছিলেন সিপিআই(এম)-এর অন্যতম নেতা এবং তাত্ত্বিক প্রমোদ দাশগুপ্ত! অর্থাৎ নকশালনিধনযজ্ঞে তাঁরা খুশি হতেন, আনন্দ পেতেন।

১৯৭১-এর ৪ অগাস্ট ভোরে প্রখ্যাত কবি-অনুবাদক-সাংবাদিক এবং সিপিআই(এম-এল) নেতা সরোজ দত্তকে সমকালীন কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের নির্দেশে পুলিশ কলকাতা ময়দানে ধরে নিয়ে এসে হত্যা করে তাঁর ধড়-মুণ্ডু আলাদা করে দিয়েছিল যাতে তাঁকে সনাক্ত করা সম্ভব না হয়। এই অমানবিক ঘটনার প্রতিবাদ সেময়  সিপিআই(এম) নেতৃত্ব করেনি এই জাতক্রোধের দরুনই। সরোজ দত্তের নিধন তাঁদের খুশি করেছিল। তাই দেখা গিয়েছে, কংগ্রেস জমানার অবসানের পরে সিপিআই(এম)-নেতৃত্বাধীন ‘বাম’জমানায় এই শহিদ সরোজ দত্ত হত্যার বিচার সংক্রান্ত  ফাইলটাই বিস্ময়করভাবে সরকারি দপ্তর থেকে হারিয়ে যায়! বাহাত্তরের ২৮ জুলাই কলকাতার লালবাজারে পুলিশি হেফাজতে নকশাল আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম নেতা চারু মজুমদারকে হত্যা করলেও সিপিআই(এম) সরকারিভাবে এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেনি। নকশালপন্থী—তা সে মাওবাদী বা যে নামেই হোক না কেন— কোনও নেতা-কর্মী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হলে এরা খুশিই হয়।

সাতাত্তর থেকে পরবর্তী দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন দশকের এই তথাকথিত ‘বাম’ জমানায় অসংখ্য গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে দলীয় এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে। মালোপাড়া গণহত্যা, করন্দা গণহত্যা, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-নেতাই, লালগড় সহ অসংখ্য গণহত্যার সংঘটক এই সরকার এবং পার্টিটি। অজস্র শহিদের রক্তে রঞ্জিত এদের হাত। স্বভাবতই নকশালপন্থী কিম্বা মাওবাদী নিকেশের সংবাদ এদের, এদের নিচুতলার মতাদর্শহীন কর্মীদের উল্লসিতই করে। মতাদর্শহীনতা একটা কথিত ‘কমিউনিস্ট’ পার্টিকে কোথায় নিয়ে যায়, তা সিপিআই(এম)-এর কর্মানুশীলনের স্পষ্ট। এরা যেমন স্বস্বার্থেই সালেম-টাটার অকৃত্রিম বন্ধু হয়ে ওঠেন, তেমনি কেরালায় বিজেপি-পোষিত আদানির সঙ্গসুখের অভিলাষী হন। এঁরা একদিকে যেমন পরদেশের সঙ্গে নিজের দেশের যুদ্ধের সময় মাত্রাতিরিক্ত দেশপ্রেমিক হয়ে সরকারের যুদ্ধাভিযানের উগ্র সমর্থক হয়ে ওঠেন, তেমনই আবার এই সরকারি যুদ্ধপ্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে উত্থিত প্রতিবাদী এবং প্রতিস্বর নিয়ে  ট্রোল করতেও পিছপা হননা। সরকারি উদ্যোগে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা তথাকথিত এনকাউন্টারে সাম্প্রতিক মাওবাদী নেতা-কর্মীদের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সরকারি ও অসরকারি ‘বাম’পন্থী দল প্রতিবাদী বিবৃতি জারি করায় বেকায়দায় পড়ে সিপিআই(এম) নেতৃত্বও খুব সতর্কভাবেই এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। তবে তাদের প্রতিবাদ তাদের দলীয় কর্মিদের অনেকেরই অনুমোদন পায়নি। তারা এই মাওবাদীদের সরকারি হত্যার সংবাদে উৎসবে সামিল হয়েছে। জাতক্রোধের যুক্তিদ্রোহী শিক্ষা যে এদের কোথায় নিয়ে গিয়েছে এবং আরও কতো নিচে নিয়ে যাবে তা বলা কঠিন।

একটা সংবাদ জানা গিয়েছে যা বিস্ময়কে বিপন্ন করে। কিছু সংবাদমাধ্যম রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞে এই নিহত মাওবাদীদের মধ্যে পার্টির সম্পাদক বাসব রাজু প্রকৃতপক্ষে ছিলেন কিনা এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছিলেন। অবশেষে একটি মানবাধিকার সংগঠনের (সিআরপিপি, অমরাবতী, অন্ধ্রপ্রদেশ) নেতা বল্লা রবীন্দ্রনাথের এক অভিযোগসূত্রে প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যাচ্ছে : সিপিআই (মাওবাদী) দলের সাধারণ সম্পাদক নাম্বালা কেশা রাও অর্থাৎ বাসব রাজু রাষ্ট্রীয়বাহিনীর এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের নিহত এই নেতা-কর্মীদের মধ্যে ছিলেন না। তিনি মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় উড়িষ্যার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পুলিশ সেখানে থেকে অসুস্থ বাসব রাজুকে গ্রেপ্তার করে এনে গুলি করে হত্যা করে তাঁকে এই নিহত মাওবাদীদের মধ্যে ফেলে রেখে প্রচার করে যে এই নিহতদের মধ্যে তিনিও ছিলেন! শ্রী বল্লা রবীন্দ্রনাথ এই সংঘটিত তথাকথিত সংঘর্ষে হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। 

 

তেলেঙ্গানা সিভিল লিবার্টিজ কমিটিও সরকারের অপারেশান কাগার বন্ধ রেখে কেন্দ্র সরকারের তরফ থেকে যুদ্ধ বিরতির দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু খুনের নেশায় উন্মত্ত সরকার এধরনের কোনও দাবিকেই যে মান্যতা দেবে না তা বলাই বাহুল্য। বরং বিজেপি এবং হিন্দুত্ববাদী ধর্মীয় ফ্যাসিস্তরা দেশের মুসলিম সম্প্রদায় এবং কমিউনিস্টদের যে সমশত্রু হিসেবে গণ্য করে এবং তাদের বিনিপাতের ব্রতবদ্ধতায় সদাব্যস্ত থাকে, তার একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। সিপিআই-এমএল (লিবারেশান)-এর তরফ থেকে মাওবাদী নেতা শহিদ বাসব রাজু সহ অন্যান্য দলীয় নেতা-কর্মীদের এভাবে ঠাণ্ডা মাথায় ‘বিচার-বহির্ভূত’ পদ্ধতিতে হত্যার মতো অমানবিক রাষ্ট্রীয় দুষ্কর্মকে বিরোধিতা করায় বিজেপি ক্ষুব্ধ হয়েছে। তাদের এবং ‘দেশ ও জাতির শত্রু’ এই মাওবাদীদের নিকেশের বিরোধিতায় তারা কর্নাটক বিজেপির অফিশিয়াল পেজ-এ ‘লোল সালাম কমরেড’ শিরোনামায় একটি ব্যঙ্গচিত্র পোস্ট করেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে বিজেপি নেতা ও দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এই নিহত মাওবাদীদের কবরে ‘ফুলকপি’ নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন শোকের নিদর্শন রাখতে। শহিদ স্তম্ভের মাথায় সেই ফুলকপি রেখে তিনি তাচ্ছিল্যসূচক হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন, আর সেই শহিদ স্তম্ভের গায়ে লেখা : ‘নকশালিজম রেস্ট ইন পিস’! ছাব্বিশের মার্চের মধ্যে এভাবেই তিনি নাকি দেশকে মাওবাদী তথা নকশালমুক্ত করবেন! 

 

১৯৮৯ সালে ভাগলপুরে গণহত্যার পর সেখানে অসংখ্য মুসলিমকে ফুলকপির ক্ষেতে পুতে দেওয়া হয়েছিল। এখানেও সেই ভাগলপুরের অনুসূত্রে নকশালপন্থী তথা নকশালপন্থীদের কবরে পাঠাতে তিনি যে বদ্ধপরিকর তারই বার্তা এখানে এই ব্যঙ্গচিত্রের মধ্যে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেশের মুসলিম এবং নকশালপন্থীদের তিনি এভাবেই বিজেপি পরিকল্পিত দেশ ও জাতির বিনিপাতযোগ্য সমশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন।—সিপিআই(এম)-এর যেসব সমর্থক মাওবাদী নিকেশের সংবাদে উল্লাসে মেতে উঠেছেন,  তাঁদের চোখে সম্ভবত এই ব্যঙ্গচিত্রটি এখনও পড়েনি। পড়লে তাঁরা কী প্রতিক্রিয়া দেন, তার অপেক্ষায় থাকতে হবে।

দলের নেতা অসুস্থ বাসব রাজুকে হাসপাতাল থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে এসে তাঁকে সরোজ দত্তের মতোই হত্যা করা এবং তারপর তথাকথিত এনকাউন্টারে নিহতদের মধ্যে চালান করে দেওয়ার মতো অমানবিক ঘটনাকে এই দেশের স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সোল্লাসে তারিফ করেছেন। এই রক্তের হোলি খেলার মধ্যে সাফল্যের আলোকচ্ছটা দেখতে পেয়ে তাঁরা উল্লাস প্রকাশ করেছেন দ্বিধাহীনতার সঙ্গেই। এভাবেই এই নির্মম ঘটনাক্রমকে রাষ্ট্রের তরফে ন্যায্যতা দেওয়া হচ্ছে, বৈধতা দেওয়া হচ্ছে।

দেশের সংবাদপত্রগুলিতে এই ‘শত্রু’ (নকশাল তথা মাওবাদীরা দেশ ও জাতির শত্রু—সরকার তা যে যে ধর্ম ও বর্ণের হোক না কেন, এই প্রচারই করে থাকে। এক্ষেত্রে কংগ্রেস, বিজেপি কিম্বা অন্যান্য শাসকদলের মধ্যে বিন্ধুমাত্র মতদ্বৈধতা নেই) খতমের ফলাও প্রচার হচ্ছে, তদন্ত নিরপেক্ষভাবে সরকারি প্রচারকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে ‘ডেকান ক্রনিকল’ নামীয় একটি সংবাদপত্রে (২২ মে) প্রকাশিত এক সংবাদ থেকে জানা গিয়েছে গত বুধবার অর্থাৎ ২১ মে এই গণহত্যার দিন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সিভিল লিবার্টিজ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক লক্ষ্মণ অভিযোগ করেছেন যে মাওবাদীরা আলোচনা চেয়ে নিজেরা যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে সরকারের সঙ্গে আলোচনার আহ্বান জানানো সত্ত্বেও সরকার সেই দাবি উপেক্ষা করে এই গণহত্যা জারি রেখেই দেশের জনসাধারণের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ জারি রেখে এক নিকৃষ্টতম নজির স্থাপন করেছে।

দেশের সরকার, সরকার-পোষিত মিডিয়া, এই রাষ্ট্রের তরফে সংঘটিত গণহত্যায় শহিদ একটি কমিউনিস্ট পার্টির (মাওবাদী) নেতা-কর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর বিপ্রতীপে জাতক্রোধে উন্মত্ত উল্লাসকারীদের এই সমারোহের বিপরীতে বাসব রাজু সহ অন্যান্য পার্টি নেতা-কর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সিপিআই (মাওবাদী)র তরফে সংঘটিত যে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে ‘গণসমাবেশ’-এর ছবি সমাজ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তা আগামীকাল ২৫ মে-র নকশালবাড়ির শহিদ দিবস পালনের প্রাক্কালে এক অন্য বার্তা বহন করছে।

আজকের নকশালবাড়ি দিবসের সময়ে বাতাসে কি পুনরায় ধ্বনিত হচ্ছে : ‘মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি…’? অন্ধকার তো শেষ কথা বলে না। রাত্রির গভীরতম তমসাই তো নতুন ভোরের জন্মকে অবধারিত করে। প্রবীণ গণশিল্পী পরেশ ধর-এর সেই অমোঘ গান : ‘এমন রাত্রি নেই যার প্রভাত হয় না…’। কারা যেন মিছিল করে হাত ধরাধরি করে দৃপ্তপায়ে এগিয়ে আসছে। ধ্বনিত হচ্ছে কবি ইয়েটস-এর সেই অমোঘ পঙক্তি :

Danger no refuge holds, and war no peace,

For him who hears love sing and never cease.

 

0 Comments

Post Comment