শুনেছি, পড়েওছি কোথাও যে, বাংলার বিপ্লবীরা কালীপূজা করতেন; দুর্গাপূজা করতেন কি না জানা নেই তবে দেবী দুর্গাকে মনে রেখে 'বন্দে মাতরম' গান রচিত হয়েছিল ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে বারোয়ারি পূজা শুরু হয়, এমন পড়েছি এবং রাবণ জয়ের জন্য রামচন্দ্র যে সময়ে দুর্গাপূজা করেছিলেন-- এখনও আমরা সেই সময়ে দুর্গাপূজা করে চলেছি... অন্তরে কি আমরা যুদ্ধের জন্য সদা প্রস্তুত ? কার বিরুদ্ধে, কী জয় করতে চাই আমরা ?
অথচ দুর্গাপুজো মানে শিউলির গন্ধ মাখা উৎসব। নতুন জামাকাপড়ের গন্ধ-আলো-সুর-বাজিপটকা। নানান খানাপিনা। খেলনা-পুতুলের সময় থেকেই মন খারাপ টের পেতাম। যত বয়স বেড়েছে মনখারাপের এক-একটা কারণ সরে গিয়েছে ঠিকই তবে অন্য কারণ এসে হাজির হয়েছে। এই উৎসব সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতা প্রকাশের নিরিখে 'রাজনৈতিক' হয়ে উঠেছে। এই ভাবনা থেকে মনখারাপ। কারও কাছে মনখারাপের কথা বাড়াবাড়ি রকমের 'আঁতলামি' মনে হতে পারে। কারও কাছে নির্বোধ ভাবনার বিষয়, তিনি বলতে পারেন, দুর্গাপুজো শুরু থেকেই তো 'ক্ষমতা প্রকাশ'-এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে-- যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তি রূপেন সংস্থিতা-- রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রকাশ মানে সংঘর্ষ ও নির্মাণ-- প্রতিপক্ষ ও যা কিছু 'অশুভ' তাকে ধ্বংস করা। যেমন, অশুভ প্রতিপক্ষ ছিল অসুর... ওই 'অসুরনিধন'-- আমার নতুন মনখারাপের কারণ হয়ে উঠেছে।
সব রকমের বস্তু শক্তি থেকে কাজ করবার সামর্থ্য পায় এবং এই শক্তি বস্তুর মধ্যেই নিহিত থাকে, আইনস্টাইনের সূত্র E = mc2 -- তা হলে বস্তুর মধ্যে দেবীকে শক্তি রূপে সন্নিবেশিত করানোর অর্থ কি কাজ করার সামর্থ্যকে ধ্বংস-ক্ষমতায় রূপ দেওয়া ? মহিষাসুর বধের যে সব আধুনিক 'অডিও ভিস্যুয়াল' মহালয়া উপলক্ষ্যে টিভি চ্যানেলে দেখানো হয়, তার সঙ্গে খবরে দেখানো যুদ্ধের ক্লিপিংসের অদ্ভূত মিল আছে দেখতে পাই। বিভ্রম? মনখারাপের গভীরতা বাড়ে... এই বিভ্রম সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে যখন জানতে পারি, দেবী দুর্গার যে গল্প আমরা জানি তার অন্য গল্প আছে। সেই গল্পে মহিষাসুরের নাম 'হুদুড় দুর্গা' এবং তিনি আদিবাসী সমাজে পূজিত হন। অর্থাৎ বিভ্রম কেটে যাওয়ার পর মনখারাপের মধ্যে দাঙ্গাহাঙ্গামার আশঙ্কা ঢুকে পড়েছে।
#
দুর্গা-মহিষাসুরে গল্প আমাদের জানা। দেবতা-অসুর দ্বন্দ্বের চলমানাতায় সেই গল্প পল্লবিত হয়েছে। 'মিথ' ভেঙে যে ইতিহাসে সমাজ-ইতিহাসকারেরা আমাদের জানিয়েছেন, তা হল জল-জমি-জঙ্গল দখল করবার ইতিহাস। 'আর্যদের' আক্রমণ। জল-জমি-জঙ্গলের অধিকার কায়েম রাখার জন্য 'অনার্যদের' প্রতিরোধ। আর্যদের দিক থেকে 'মহিষাসুর বধ' গৌরবকথা। উৎসবের উপলক্ষ্য। অন্যদিকে অনার্যদের কাছে তা শোকগাথা, শোকপালনের সংস্কৃতি। একই স্থান-কালে আনন্দ-বিষাদ উদ্যাপন ! এই আধুনিক সময়ে সংঘর্ষের আশঙ্কা অমূলক নয়। আজও অরণ্যসভ্যতা আক্রান্ত হয়ে আছে। প্রতিরোধ দুর্বল হলেও অব্যহত রয়েছে। আশঙ্কা এইখানে। আমাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মধ্যে রয়েছে যুদ্ধের ইতিহাস। সেই ইতিহাস ফিরে আসুক, রাজনৈতিক স্বার্থে কেউ এ রকম চাইতে পারে আর জয়ের আকাঙ্ক্ষায় 'দেবীর আরাধনা', সেই 'অকাল বোধন'-এর মতো প্রতি বছর হবে, তাতে আর আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই ! নেই বলেই আশঙ্কা-- আশঙ্কা এ কারণে যে, পূজা-উৎসবের মাধ্যমে এ কথা প্রচার পায় যে, মানুষের বেঁচে থাকায় 'অশুভ' যা কিছু তা ওই অসুর-শক্তির প্রকাশ কিন্তু শুভ শক্তির কাছে তার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। এও এক মিথ। আধুনিক রাজনীতি তার প্রতিপক্ষকে অশুভ শক্তি রূপে নির্মাণ করে। ফলত শক্তি-ধারণার 'বাইন্যারি' রূপের বিভেদ ঘটিয়ে মানুষ সর্বজীবের অমঙ্গলের কারণ হয়েছে। অমঙ্গলের সবচেয়ে বড় কারণ যুদ্ধ-- যুদ্ধের একমাত্র কারণ 'পরস্ব অপহরণ' বা 'ভূখণ্ড দখল'-এ নিহিত । সংসদীয় রাজনীতিতে তা ক্ষমতা দখল। 'মহিষাসুর বধ' গল্প আসলে তো এক যুদ্ধের গল্প কিন্তু ওই কারণ সেই গল্পের মধ্যে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এমনকি, আদিবাসী উপকথাতেও তা পাওয়া মুশকিল তবে এই উপকথায় আমরা-কিন্তু তা অনুমান করে নিতে পারি।
#
গল্পটা বলার সময়, মহিষাসুর-দুর্গার গল্প আমরা মনে রাখব, যদিও এই গল্প বিভিন্ন পুরাণ কথায় সংঘর্ষের ভিন্ন ভিন্ন কার্যকারণ তৈরি করেছে কিন্তু অন্তিম পরিণতি সর্বক্ষেত্রে এক 'অসুর' নিধন। এবং স্বর্গরাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা আর অসুররাজ্য মূলত যা বনভূমি, তা দেবভূমির অংশ করে নেওয়া। এই মনে রাখা থেকে এই তত্ত্বও রচনা করা যেতে পারে যে, ভারতভূমির 'পৌরাণিক ইতিহাস' দেব-অসুর, অন্য কথায় আর্য-অনার্য সংঘাতের ইতিহাস। এবং কারও মনে এই প্রশ্ন জাগতে পারে যে, সেই ইতিহাস কি আজও চলমান নয়? ছত্তিশগঢ়ের জঙ্গলমহল, পশ্চিমবঙ্গ-বিহার-ওড়িষা-অন্ধ্রের জঙ্গলমহলের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় কর্পোরেট আগ্রাসনের উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন তুলতে পারেন, এগুলি কি 'আর্য' আগ্রাসন নয়?
এই প্রশ্ন মনে রেখেই গল্পটা বলা যাক।
কোনও এক জঙ্গলমহলে চাইচাম্পা গ্রাম বা গড়ের রাজা ছিলেন 'হুদুড় দুর্গা'। আর্যদের ভূমি দখলের অভিযান এই জঙ্গলমহলে এসে থমকে যায়। বার বার আক্রমণ করেও জয় করা যায় না গড়াধিপতিকে। বন্যমহিষের আচমকা আক্রমণে দেবসেনা নাজেহাল। মেঘমুক্ত আকাশ থেকে হঠাৎ শিলাবৃষ্টি, ক্ষয়ক্ষতি সামলানোও মুশকিল। সম্মুখযুদ্ধেও রাজাকে সমীহ না করে পারেন না দেবসেনাপতি। কিন্তু এ জঙ্গলমহল দেবরাজের চাই-ই চাই। সমস্ত রণকৌশল ব্যর্থ। তখন, এত শক্তিশালী রাজার দুর্বলতা তো কোথাও থাকবে তার খোঁজ পড়ল। তা আবিষ্কার হল। রাজা নারীজাতির প্রতি খুবই সহানুভূতিসম্পন্ন। নারী যাতে আঘাত না পায় সে বিষয়ে তিনি সদাই যত্নবান।
এবার নতুন উদ্যোমে শুরু হল অভিযান। রাজা দুর্গা দেখলেন শত্রুসেনার মধ্যে একাধিক নারীর উপস্থিতি। বিভ্রম নয় বুঝে তিনি যুদ্ধের কৌশল বদল করলেন। সেনা দল থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করে বন্দি করলেন। এই দুই বন্দির মধ্যে 'দিবি' নামের মেয়েটির রং-রূপে মুগ্ধ হলেন রাজা। প্রেমে পড়লেন। বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। বিয়ে হল।
একদিন দিবি এক আবেগঘন মুহূর্তে কণ্ঠে অভিমানের সুর তুলে বলল যে, অন্যের মুখ থেকে সে রাজার মায়িক গুণের কথা অনেক শুনেছে, সে স্বচক্ষে যুদ্ধকালীন মায়া দেখতে চায়।
নিমরাজি হয়ে রাজা একদিন রাণীকে নিয়ে গেল এক পাল মহিষের কাছে। মহিষের মাথায় রাজার হাত বোলানো দেখে রাণীও হাত বোলালো। এক সময় রাণীর খেয়াল হল তার পাশে রাজা নেই। তখন মহিষ দলের মধ্যে থেকে রাজা আওয়াজ দিচ্ছেন।
তার পর, আর একদিন-- মহিষরূপী রাজাকে রাণী আদর করার বায়না ধরল।
আর সেই দিনই রাণী পূর্ব পরিকল্পনামতো হুদুড়দুর্গাকে হত্যা করল !
#
যে প্রশ্ন মনে রেখে গল্পটা বলা হল, গল্পের মধ্যেই তার উত্তর আছে, হ্যাঁ-- কর্পোরেট-আগ্রাসন = আর্য-আগ্রাসন! এই আগ্রাসনের ঘটনা কালক্রমে কীভাবে 'মিথ'-এ রূপ দেবেন করপরেট-বুদ্ধিজীবী, তা গবেষণার বিষয় হতে পারে কিন্তু সেই মিথে আদিবাসীদের একাংশ যে কর্পোরেটের হয়ে লড়াইটা করবে, তা বলাই বাহুল্য-- আমাদের মনে পড়বে 'সাওলা জুড়ুম', মনে পড়তে পারে খুব সম্প্রতি, শারদ উৎসবের প্রাক্কালের একটি ঘটনা-- 'দলিত' শ্রেণীর একজন অধ্যাপক, সুধাকর সরদার, তিনি ব্রাহ্মণ্যবাদ (< আর্য > হিন্দু)-এর নিরিখে 'দলিত'-এর অবস্থা ও অবস্থান বিষয়ে, সামাজিক সাম্যের পক্ষে কথা বলা মানুষ, এই সব কথা বলার (হিন্দু ধর্মে আঘাত করার) জন্যই তাঁকে প্রত্যাঘাত ( শারীরিকভাবে) করা হয়েছে-- যাঁরা আঘাত করেছেন তাঁরা সকলেই আধুনিক "তপসিলি সমাজের লোক কিন্তু তারা ব্রাহ্মণ্যবাদের সমর্থক।" (দিলীপ গায়েন মহাশয়ের পোস্ট থেকে)-- পোস্ট থেকে এও জানা গেছে যে, আক্রান্ত ও আক্রমণকারীরা একই গ্রামের বাসিন্দা-- ভয়টা আরও গাঢ় হচ্ছে, মনে পড়ছে গুজরাট দাঙ্গায় 'বিলকিস বানু'কে যারা ধর্ষণ করেছিল, তাঁর পরিবারের লোকজনকে হত্যা করেছিল, তারা সকলেই ছিল তাঁরই গ্রামের মানুষ, প্রতিবেশীজন! ভাবতে কষ্ট হয়!
ভাবতে কষ্ট হয়, হিন্দু ধর্মের দেব-দেবীর প্রশস্তির মধ্যে এত জয়কীর্তন, সেই সব জয়ের উত্তরাধিকার আমরা পুরুষানুক্রমে বহন করে এসেছি, তবু সেই হিন্দুভূমি বার বার আক্রান্ত হয়েছে! আমরা কি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারিনি? অথচ দেবীর প্রশস্তিজ্ঞাপনের পর আমরা যুগ যুগ ধরে প্রার্থনা জানিয়েছি রূপ-জয়-যশ পাওয়ার জন্য, দ্বেষ নাশের আর্তিও জানিয়েছি তবু বিদ্বেষ বিষ কেন জমেছে আমাদের হৃদয়ে, উগরে দিচ্ছি আমাদের সহনাগরিকের উপর...
উপকথাটা শুনে একজন বলেছিলেন, তাহলে দেশের বর্তমান 'দেবতাদের' রাজনৈতিক অশান্তির কারণ হল মুসলমান আর 'দলিত'-- এঁদের 'অসুর' বিবেচনা করেই কি যুদ্ধ চলছে দেশের সব 'জঙ্গলমহল'-এ, সমস্ত 'আজানভূমি'তে?
#
শারদ-উৎসব ইদানীং এই গল্প মনে করিয়ে দেয়। মনখারাপের হাত থেকে আমার রেহাই নেই। আমার কেবলি মনে পড়ে আদর-উন্মুখ প্রেমিক-মহিষের গ্রীবা-- ওঃ ! কী করুণ ও ভয়ঙ্কর এই হত্যা!
প্রেম মানে তবে যুদ্ধ জয়ের ম্যাজিক !
প্রেম মানে বিদ্বেষের মায়াবী রূপ...
কিন্তু আমরা তো গভীরভাবে লালন করি : 'প্রেম মানে আরো আলো মানুষের তরে এক মানুষী গভীর হৃদয় !'
#
এবার সহনাগরিক/প্রতিবেশী হিসাবে আমার মনে পড়ল একজন দার্শনিক, র্যাবাই হিলেল-এর একটি কথা, "তোমার প্রতিবেশিকে নিজের মতো ভালোবাস।"
আঃ! এ যদি আমাদের উৎসবের মন্ত্র হত !