মিনি বলে, ছবিগুলো দেখ মাসি, ভাই এগুলো কি এঁকেছে?
-তুই কোথায় পেলি এই খাতা?
-তোমরা হাসপাতালে চলে যাওয়ার পর ভাইয়ের বিছানাটা ঠিক করতে গিয়েই তো পেলাম।
আমি খাতা হাতে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। অমল! আমার ছোট্ট অমল এই ছবিগুলো এঁকেছে? আমাকে ওর ডাক্তারের কাছে যেতেই হবে এই খাতা নিয়ে। পারলে আজই। বুঝতে হবে অনেক কিছু। অমলের ওপরে মানসিক অত্যাচার অনেক হয়েছে, তার না বলা কথাগুলো, প্রতিবাদগুলো সে এই খাতায় এঁকে রেখেছে?
আমার ছেলে অমল যে ঘরে থাকে সে ঘরের পাশে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শিরীষ গাছেরা। ঠিক পাশে নয় অবশ্য, তবে ওর ঘর থেকে দেখা যায় শিরীষের মাথা নাড়া আর হাতছানি। না; জানলা দিয়ে ডাকঘরের অমলের মত কোনো ধোঁয়া ওঠা পাহাড় ও দেখতে পায়নি কোনোদিন। শিরীষ গাছেদের ঘন বুনোটের উঁচু নিচু যে দিগন্তরেখা, যা সবুজ লাইন টেনে দিয়েছে আকাশের গায়ে, তাকেই কখনো শখনো পাহাড় বলে মনে হয়। অমল কি ভাবে ওই শিরীষ পাহাড়কে ডিঙিয়ে কোনো একদিন সুধা নিশ্চয়ই চলে আসবে ওর জানালায়। জিজ্ঞেস করবে ওর নাম। জানতে চাইবে ও রোজ স্কুলে যায় না কেন? ওর বন্ধুদের নাম কী?
অনেকদিন অফিস থেকে ফিরে উঁকি দিয়ে দেখেছি, অমল হয় তার নিজের খাতায় মগ্ন নাহলে জানলায়। সরে যাই নিঃশব্দে। আমি জানি ডাকঘরের অমলের মতো ওরও ইচ্ছে হয় সারাদিন জানলার ধারে বসে থাকতে। কিন্তু সময় নেই; স্কুল আছে। দাবার ক্লাস আছে। লাইন দিয়ে ক্লাসেরা দাঁড়িয়ে থাকে ওর সামনে পেছনে। ওকে এতটা ব্যস্ত রাখার সিদ্ধান্ত অবশ্য আমিই নিয়েছি। আমি সব সময় চেষ্টা করি গলন্ত লাভার স্রোত যেন ওর কান পর্যন্ত পৌঁছাবার সুযোগ না পায়। জানি সবসময় পারি না। তবু চেষ্টা করি।
ছুটির একটা দিন ও অপেক্ষা করে কখন মা একবার এসে ওকে জড়িয়ে কপালে একটা চুমো খাবে।
ডাকঘরের গল্পটা আমিই ওকে বলেছিলাম।
গল্পটা শোনানোর কয়েকদিন পর একদিন আমাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকল। গেলাম ওর কাছে এক ছুটে। আমার ছেলে এভাবে ডাকে বড় কম। কথা তো বলে আরো কম। বললাম, কিছু বলবে অমল? মাথা ঝাঁকাল। আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। খানিকক্ষণ পর ঠিক যেন চুপিচুপি কিছু বলছে, এমনিভাবে বলল, মা রগু টাকুরদাদা?
আমার সঙ্গেই ওর যা দু’একটা কথা। পাশের ফ্ল্যাটের রঘুনন্দন আংকেলকে অমলের ঠাকুরদা বলে মনে হয়! ডাকঘরের অমলের ঠাকুর্দার মতন। এভাবে আমার অমল নিজেকে ডাকঘরের অমলের সঙ্গে রিলেট করতে পারছে? বুকের রক্তে ঢেউ উঠল, ছেলে আমার বড় হচ্ছে? বুঝতে শিখছে?
অমল ওর বড় বড় চোখদুটো মেলে তাকায়- এই একটা জিনিসই ও ওর বাবার মত পেয়েছে। বড় বড় স্বপ্নালু চোখ। এই চোখ দেখেই আমি পাগল হয়েছিলাম। সে চোখের ভাষা বদলে গেছে অনেক বছর আগেই, তবু অমলের চোখ দেখলেই সেই চোখদুটো মনে পড়ে আমার।
আমি ভাবি অমল কি এও ভাবে, সুধা যদি আসে তাকে খুঁজে, খুঁজে? অমলের তো এখন ঠিক সেই বয়স, যখন মানুষ বন্ধু খোঁজে। আমি জিজ্ঞেস করি, অমল সুধা?
আবার চোখ তুলে আমাকে দেখে। কিছু বলে না।
আচ্ছা ও কি ভাবে? সুধা কিভাবে আসবে? যদি আসেও ওকে খুঁজে খুঁজে তাহলেও তো ফিরে যাবে। দশতলার জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে সুধা গল্প করবে কিভাবে?
অমল হাসে একবার। ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে আমি উঠি। অফিস যাওয়ার সময় হয়ে আসছে, রেডি হতে হবে।
অমল কি জানে সুধা যদি আসেও ওয়াচম্যান কিছুতেই সুধাকে দশতলায় ওঠার অনুমতি দেবে না। এক, সে সুধাকে চেনেই না আর অত সাধারণ ফ্রক পরা সুধা খালি পায়ে এলে এ বিল্ডিঙয়ের ওয়াচম্যান তাকে কিছুতেই ঢুকতে দেবে না গেটের এপারে। সুধা যদি চোস্ত ইংরেজিতে কথা বলে, তাহলে ওয়াচম্যান কী করবে…?
ভাবতে গিয়ে নিজেই হেসে ফেলি। আমিও কি অমলের সমবয়সী হয়ে গেলাম?
পিছন ঘুরে অমলের দিকে তাকিয়ে দেখি অমলের হাসি মুখ হঠাৎ করে কালো হয়ে গেছে। কেন? সেও কি এখন সুধার কথাই ভাবছিল? ভাবছিল যদি সুধা আসে ওর খোঁজ নিতে, কিভাবে সে পৌঁছাবে অমলের কাছে?
মিনি বলে ভাই হাসছিল কেন মাসি?
আমি বলি, ও একজন ঠাকুরদা খুঁজে পেয়েছে তাই বোধহয়।
মিনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়। ও বলে হোয়াট ইস ঠাকুরদা মাসি? গেম?
আমি হেসে মেয়েটার মাথার চুল নেড়ে দিই হাত বাড়িয়ে। ওকে সম্পর্কটা একটু বোঝাই। হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি অফিসের বাস আসার সময় হয়ে গেছে,
-বাকিটা তোকে পরে বোঝাব মিনি, বলে দৌড় দিই লিফটের দিকে।
মিনি আমার অমলকে সামলায় একেবারে বড় বোনের মত। হয়ত বা মায়ের মতই। মেয়েটার একটা অদ্ভুত সারল্য যেমন আছে তেমনি ওর সিনসিয়ারিটি; একদিন ছুটি নিতে হলেও আগে থেকে বলে যায়। মিনি না থাকলে আমার যে কী হত জানি না।
ও মীনাক্ষী, আমি বানিয়ে নিয়েছি মিনি।
অমল গম্ভীর হয়ে যায় মিনি ঘরে ঢুকতেই। মিনি জানে অমল তার উপর বেশ কর্তৃত্ব ফলায়। ওকে দেখে মিনিদি ভয় পায় এটাতে বোধহয় অমলের খুব মজা লাগে। মিনিদি কত বড় তাও সে ভয় পায় অমলকে। এসব ভাবলে মিনির মন খারাপের জায়গায় হাসিই পায়। সে ফিক করে হেসে ফেলে অন্যদিকে তাকিয়ে। অমল এটা দেখলে আরো রেগে যাবে এটা সে জানে। হাসিমুখের কালো হওয়া দেখে মিনি, কিন্তু কিছুই বলে না। সে এতদিনে বুঝে গেছে, অমলের ইচ্ছে না থাকলে সে একটা কথারও উত্তর দেবে না। মিনি রান্নাঘরে যায়। অমলের প্রিয় নীর দোসাই আর তেঙ্গা চাটনি বানাতে। এই খাবার দেখলেই অমলের কালো মুখে আলো জ্বলবেই।
অমলকে দেখলেই ওর বুকের মধ্যে রোজ নিজের ভাইটার কথা উথালিপাথালি করে। এতবছরেও ভুলতে পারে না, ভাইটা ওর কী ভালো ক্রিকেট খেলত। কিন্তু সেই যে পায়ে চোট লাগল, তারপর গ্যাংগ্রিণ…। না মিনি আর ভাবতে পারে না। ভাবতে চায় না। গরম তাওয়ার ছ্যাঁকায় চমকে ওঠে। দোসাই প্লেটে নিয়ে নেয়। আরেকটু হলেই পুড়ে যেত। অমল খেত না। সব নষ্ট হত।
সে ঘরে ঢুকতেই অমল খাতাটা বালিশের নীচে লুকিয়ে ফেলে। এই খেলাটা প্রায় রোজই চলে মিনির সঙ্গে তার। খাতাটা যেন একটা গুপ্তধন।
অমলকে এলডোরাডোর গল্প মিনিই শুনিয়েছে। ঠিক যেমন শুনিয়েছিল ওর ভাইটাকে। বাবার চাকরিটা যদি না যেত, এতদিনে মিনিও হয়ত বিনীতা মাসির মত কোনো অফিসে চাকরি করত। তার অবশ্য ইচ্ছে ছিল স্কুলে পড়ানোর। ইংরেজির বা ইতিহাসের দিদিমনি হবার। ওই ক্লাস দুটোই সব থেকে ভালো লাগত তার। ক্লাসে বসেই সে যেন কোথায় চলে যেত।
#
আমরা যখন চেন্নাইয়ের এই বাড়িটায় এসেছিলাম তখনও অমলের জন্ম হয়নি; শ্রুতির বয়স সাড়ে চার। ছোট্ট শ্রুতি দেশের সবকটা রাজ্য, তার রাজধানীর নাম গড় গড় করে বলত। অনর্গল ইংরেজিতে মেয়ের কথা বলা দেখে লোকজন বেশ অবাক হতো। সেই সময়ই রঘুনন্দন কুমারদের পরিবারের সঙ্গে আলাপ হল আমার। পাশের ফ্ল্যাটেই ওনাদের বাস। অফিস থেকে ফিরে প্রায়দিনই দেখতাম আয়া মাসি দরজায় দাঁড়ান, মেয়ে আমার সেই ফ্ল্যাটে ঢুকে গেছে। তামিল জানি না একেবারেই, তাই আয়াকেই বলতাম, গিয়ে নিয়ে আসতে।
এক ছুটির দিনে আবার আয়া এসে বলল শ্রুতি ওনাদের ফ্লাটে ঢুকে গেছে। বেরোচ্ছে না। সেদিন বলা যায় ক্ষমা চাইতেই গেলাম প্রগলভ কন্যাটির হয়ে। আলাপ হল ওনাদের সঙ্গে। বুঝলাম মেয়ে আমার অতিরিক্ত আহ্লাদ পায় বলেই দৌড়ে, দৌড়ে যায়।
ওনারা দুজনেই শ্রুতির পাকামির গুণমুগ্ধ ভক্ত। সে মেয়ের পাকামির কথা ওনাদের মুখে আমি শুনি আর হেসে গড়াই। বলি, বেশি মাথায় তুলবেন না, বড্ড দুষ্টু।
রঘুনন্দন ছিলেন ডিআরডিওতে। স্ত্রী সেলভা রঘুনন্দন ছিলেন চেন্নাইয়ের একটি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপিকা। দুজনেই অবসর নেবার পরে, শহরের ট্র্যাফিক সিগনালে ভিক্ষারত বাচ্চাদের জন্য কাজ করছেন। বেশ কয়েকটি শিশুকে চেন্নাই পুলিশের সহায়তায় উদ্ধার করেছেন শুনলাম। আলাপ ধীরে ধীরে বাড়ে। এরপর একদিন সেলভার কাছেই শুনলাম তাঁদের জীবনের এক মর্মান্তিক ঘটনা। ওনাদের একমাত্র সন্তান মারা গেছে মুম্বাই হামলায় দুহাজার আটে। সে তখন বম্বে আই আই টিতে ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট। এক বন্ধুর জন্মদিন সেলিব্রেট করতে সবাই মিলে গেছিল ট্রাইডেন্ট হোটেল। সেলভা বললেন, তোমার মেয়েটাকে দেখলেই আমার মনে হয় আমার যদি একটা নাতনি থাকত, সেও হয়ত এরকমই হত। তুমি কিন্তু রাগ করো না আমরা ওকে ডেকে নিয়ে আসি বলে। কিছু বলব কী আমার দুচোখ তখন ঝাপসা।
এর পর পরই অমল এল আমার শরীরে। শ্রুতির তখন আট বছর। আমি প্রায় চল্লিশ। অভিজিতের একেবারেই ইচ্ছে ছিল না এই সন্তান জন্ম নিক; তবু শরীরের ভেতর তিলে তিলে বাড়তে থাকা প্রাণকে কিছুতেই নষ্ট করতে পারলাম না আমি।
সেলভা রঘুনন্দন ততদিনে আমার সেলভা আন্টি হয়ে গেছেন। অনেক কথাই বলি তাঁকে। সেই সময় সেলভা আন্টি মানসিক লাঠি হয়ে গেলেন আমার। বললেন, নষ্ট কেন করবে? কী অপরাধ সেই শিশুর? শ্রুতিরও একটা সঙ্গী হবে।
একদিন বললেন শ্রুতির ভাই হলে নাম রেখো অমল।
ততদিনে জেনে গেছি, সেলভা পড়াশুনা করেছিলেন শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথের অন্ধ ভক্ত। কবিগুরুর অজস্র কবিতা আর গানের লাইন ওঁর ঠোটস্থ। আমরা বাঙালি, আমি বীরভূমের মেয়ে জানার পর একেবারে বাচ্চা মেয়ের মতো উচ্ছল হয়ে উঠেছিলেন।
অভিজিৎ যদিও বিরক্ত হয়েছিল এত ঘনিষ্টতায়, বিশেষত ছেলের নাম অমল রাখায়। সে মনে মনে ছেলের জন্য বিশুদ্ধ সংস্কৃত সংস্কৃতির একখানা নাম ঠিক করে রেখেছিল। হাসপাতালে রিসেপসনে গিয়ে সে জানতে পেরেছিল অনেক আগেই আমি ডাক্তারকে জানিয়ে রেখেছি, ছেলে হলে নাম হবে অমল আর মেয়ে হলে অমলা। আমার তখন কেমন এক জেদ এসে গিয়েছিল, সেলভা আন্টির এটুকু ইচ্ছা আমাকে পূরণ করতেই হবে।
অমল এল আমাদের জীবনে।
অমল নামের সূত্র অভিজিৎ যখন জানল, প্রচন্ড বিরক্ত হল। তবে শত বিরক্ত হলেও পরিশীলিত ভদ্রলোক, প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া করে না; অভিজিৎও নিজেকে একশো ভাগ ভদ্রলোক বলেই মনে করে। এই ঘটনার পর থেকে সে রঘুনন্দন এবং তাঁর স্ত্রী সেলভাকে সযত্নে এড়িয়ে চলত। ওনারা দুজনও ওর মাত্রাতিরিক্ত স্নবারির কারণেই হয়ত ওকে এড়িয়ে চলতেন।
বৃদ্ধ সন্তানহীন দম্পতি, আমাকে আর আমার ছেলেমেয়েকে নিজেদের পরিবারের একজন করে নিলেন।
অমল একটু একটু করে বড় হয়। শ্রুতি ভাইকে খুব পছন্দ না করলেও স্কুল থেকে ফিরে চলে আসে ভাইয়ের কাছে। বুক আমার আহ্লাদে ভরে। আদর করি দুজনকে জড়িয়ে, আর ভাবি এরকম একটা সংসারই কি সব মেয়ে চায় না? এটুকুই তো জীবনের স্বপ্ন হল সত্যি। দুই দেবশিশু আমার পাশে। আমিই যাদের সব কিছু।
স্বপ্ন ভাঙতে শুরু করল অমল এক বছর পেরনোর পর। বুঝতে পারা গেল ওর পা দুটো দাঁড়াবার উপযুক্ত নয়। ডাক্তার, অপারেশন, থেরাপি সব হল যেমন যা হবার, তবে তখন থেকেই অভিজিতের বিরক্তি জমা হতে লাগল ছেলের জন্য।
দলা করা ঘেন্না মাঝে মাঝেই সে ছুঁড়ে দিত ছেলের দিকে, যেমন নাম তেমনই হয়েছে।
দুধের শিশু আর কিছু না বুঝলেও বাবার ঘেন্না বুঝত। বাবা বাড়ি ফিরলেই হাসি, অকারণ কথা বলার চেষ্টা, হাত পা নাড়া সব বন্ধ করে কাঠের পুতুল হয়ে যেত সে। আমি বাড়ি থাকলে সেসব সময় অমলকে দিয়ে আসতাম ওনাদের বাড়ি।
রঘুনন্দন নিজের জ্ঞান উজাড় করে অমলকে গল্প বলতেন। ছোট্ট অমল সে গল্পের কিছু না বুঝলেও চোখ গোল গোল করে শুনত মহাকাশের কথা। রঘুনন্দন বলতেন ওর চোখ দেখলেই বোঝা যায়, কতটা মন দিয়ে ও গল্পগুলো শুনছে।
আমি আর কী বলব! হাসি! সব কৃতজ্ঞতার তো ভাষা হয় না।
শ্রুতিও শুনত গল্পগুলো, তবে অত মন দিয়ে নয়। অপেক্ষা করত কতক্ষণে তার বাবা বাড়ি ফিরবে, তার পছন্দের চকলেট বা কেক নিয়ে। অভিজিৎ বাড়ি ফিরেছে টের পেলে, ঘুড়ির মতো ছুটে মেয়ে ফ্ল্যাটে ফিরে আসত। তার ভাই তার উল্টো।
শ্রুতি আমাদের প্রথম সন্তান। তার বাবার কিংবা আমার আদরের ছিল বরাবরই, তবে অমলের শারীরিক অক্ষমতাগুলো টের পাওয়ার পর থেকেই অভিজিৎ যেন আরো বেশি করে প্রশ্রয় দিতে শুরু করল মেয়েকে। এভাবেই একই বাড়িতে অতি আদর আর ঘেন্না একসঙ্গে বেড়ে চলল। আমি বুঝতে পারছি, যে এক ঘোর অন্যায় হয়ে চলেছে প্রতিদিন; অভিজিৎকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি অনেকবার কিন্তু তার ব্যবহার দুর্বিনীত থেকে ধীরে ধীরে অসভ্যতার দিকে যেতে শুরু করল। ফলে পড়াশুনায় ভাল হলেই যে সাতখুন মাফ এটা শ্রুতি অতি অল্প বয়সেই বুঝতে পেরে গেল। ভাইকে ভালোবাসা অনেক দূরের কথা, ভাইকে সে মানুষ বলেই মনে করে না। অমল দিদিকে দেখলেও ভয় পায়। কিরকম নীল হয়ে যেত ওর হাত পা শ্রুতি সামনে এলে। আমি অনেক চেষ্টা করেও সে ভয় ভাঙাতে পারিনি।
অভিজিৎ অফিস ট্যুরে গেলে দুজনের সম্পর্কটা একটু ভাল হয়ে উঠত কখনো শখনো। সে ফিরে এলেই আবার এক বাড়িতে দুটো দল।
মেয়েটা হস্টেলে চলে যাবার পর, আমার ফাঁকা লাগে না বরং খানিকটা স্বস্তি হয়।
আমি ফোন করলে শ্রুতি তীর্যক ভাবে কথা বলে যখন, নিজেকে কিরকম অপরাধী মনে হয় তখন। আমি যে সত্যিই তাকে কম ভালবাসি না এটা কিভাবে বোঝাব মেয়েটাকে? জানি না। হয়ত সে কোনোদিন বুঝবে তার মায়ের কষ্ট। সে হয়ত সে যখন মা হবে তখন।
-মাসি ঘরে গিয়ে একটু শুয়ে নাও। আমি এবার বাড়ি যাই।
বারান্দায় বসেছিলাম। কখন যেন ক্লান্তিতে চোখ জুড়ে এসেছিল। মিনির বাড়িয়ে দেওয়া হাত থেকে চায়ের কাপটা নিই।
এক কাপ চা নিয়ে এখানে বসা অথবা বিছানা কোনটা যে বেশি টানছে, বুঝে উঠতে পারি না। অফিস থেকে ফিরে এভাবেই বারান্দায় বসি রোজ। সেসময় মিনি অমলের হুইল চেয়ারটা ঠেলে এখানে নিয়ে আসত। বারান্দার ছোট ছোট গাছ, ইলেক্ট্রিকের তারে বসা পাখি, গাছের ডালের কাঠবিড়ালিদের সঙ্গে সময়টা হুস করে কেটে যেত। সন্ধ্যা ঘন হয়ে সমুদ্রের গায়ে গাঢ় আঁধার ঘনিয়ে আসলে ঘরে ঢুকতাম। অমলকে ডিনার করিয়ে, মিনি বাড়ি ফিরে যেত। আবার পরদিন সকাল। আবার একই রুটিন।
আজ অমল হাসপাতালে। একশো চার ডিগ্রি জ্বর। অভিজিৎ হাসপাতালেই রয়ে গেছে। আমাকে জোর করে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। বহুদিন পর আজ অন্য অভিজিৎ। সেই পুরনোদিনের হারিয়ে যাওয়া মানুষটা। বলল, বাড়ি যাও। আমি আছি তো। কিচ্ছু হবে না অমলের। অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। ড্রাইভারকে ডেকে আমাকে নিয়ে বাড়ি ফেরার নির্দেশ দিয়ে সে আবার ঢুকে গেল হাসপাতালের ভিতর।
অমল বড় হচ্ছিল ঠিকই কিন্তু কোথায় যেন একটা ফাঁক রয়ে যাচ্ছিল। শ্রুতি যেভাবে বড় হয়েছে সেভাবে কিছুতেই অমলকে বড় করা যাচ্ছিল না। অসুবিধাগুলো কী হচ্ছে সেটা ধরতেই পারছিলাম না। খালি ভাবতাম একটু বেশি বয়সের সন্তান বলেই কী এমন হল? মা, বাবা, শ্বশুর শাশুড়ি সবাই চলে গেছেন অমল আসার আগেই। জিজ্ঞেস করার কেউ ছিল না, এক সেলভা আন্টি। তিনি শুধু বলতেন ধৈর্য্য ধর।
ছেলে কথা বলে খুব কম। শুধু মা আর রঘুনন্দন টাকুরদার সঙ্গে একটু আধটু কথা ব্যাস। এ ছাড়া কোথাও সে আত্মসপর্পণ করে না। স্কুল থেকেও খুব ভালো রিপোর্ট কিছু আসছিল না। যে দুএকটা সাবজেক্ট অমলের পছন্দের, সেগুলোতে প্রায় পুরো নম্বর আর বাকি বিষয় সাদা খাতা জমা দেয় সে ছেলে। ধরণ ধারণ দিন দিন যত বেশি অবোধ্য হয়ে উঠছিল তার, শ্রুতি আর তার বাবার হাসির পাত্র হয়ে উঠছিল ততই ছেলেটা। মাকে সে ততই আঁকড়ে ধরছিল আরো বেশি করে।
অভিজিতের বড় চাকরি, তার স্ট্যাটাস, তার দম্ভ, শ্রুতির দুর্বিনীত ব্যবহার, নিজের অফিসের নানা ঝামেলা এসবের থেকে অনেক বেশি ভরসা দিত আমাকে গল্প শোনা দুটো কিশলয় চোখ।
অজস্র ইন্ডোর গেম নিয়ে এসেছিলাম কিন্তু বুঝতে পেরেছিলাম তার কোনোটাতেই সে ছেলের বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই। আমাকে খুশি করতেই হয়ত দুএকবার হাত দিত। সেসবের থেকে বারান্দার গাছ আর খানিক দূরের শিরীষের জঙ্গল ওর কাছে অনেক বেশি আপন। গাছেরা ওকে হাত বাড়িয়ে ডাকে যেন।
এমন দেখে কখনো শখনো মনে হত অভিজিৎ যা চেয়েছিল, সে সিদ্ধান্তই কি ঠিক ছিল তাহলে? সামনে তাকিয়ে দেখতাম অমল মুচকি হাসছে। নিজেকে ধিক্কার দিয়ে উঠতাম। ছি!
মিনির কাছে শুনেছি যখন মা, বাবা দুজনেই অফিসে, তখন অমল বের করে খাতাটা।
মিনি ছটফটে, বছর বাইশেকের মেয়ে। অমল যখন আঁকে ও দূরে বসে থাকে। কাছে আসার পার্মিশন নেই। দাঁড়ালেই অমল বলবে স্ট্যাচু আর মিনিকে তখন মাথা নীচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে বেশ খানিকক্ষন। এটা নাকি অমলের তৈরি করা শাস্তি।
লুকিয়ে শুনেছি দুএকদিন, মিনি বলছে, আচ্ছা অমল আমাকে তোমার আঁকা ছবিগুলো দেখতে দাও না কেন তুমি?
অমল কিছু বলে না। মিনির কাছেই শুনেছি, মিনি দেখতে চাইলেই খাতাটা লুকিয়ে ফেলে বালিশের নীচে।
মিনি যদি বলে, আমি দেখলে কী হয়েছে? অমল মাথা ঝাঁকায়। খুব জোরে। ঝাঁকাতেই থাকে।
তখন মিনি হয়ত বলে, থাক অমল। থাক। আমি দেখব না। তুমি চুপ করে বস। ওভাবে মাথা ঝাঁকিয়ো না।
দু তিনবার বলার পর অমল চুপ করে বসে। সেদিন আর খাতাও বের করে না ছবিও আঁকে না। মিনিরই খারাপ লাগে। আহারে!
এসব শুনেছি মিনির কাছেই। তাই আমিও আর ঘাঁটাইনি ছেলেটাকে। থাক। কিছু জিনিস হয়ত সে গোপন রাখতে চায় আমাদের সবার থেকে। থাক গোপন।
এভাবেই চলছিল। গতকাল বাড়ি ফিরে দেখলাম অমল শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ। মাথায় হাত দিয়ে দেখলাম গা যেন পুড়ে যাচ্ছে ছেলের। অল্প জ্বর হয়েছিল পরশু। প্যারাসিটামল দিয়েছিলাম। ঠিকই তো ছিল। কী হল হঠাৎ করে? অভিজিৎকে ফোন করব কি করব না ভেবেও ফোন করলাম। আশ্চর্যজনকভাবে অভিজিৎ সেদিন বাড়ির কাছেই চলে এসেছিল তখন। পরপর দুটো মিটিং ক্যানসেল হয়েছে তার। এসে ছেলের অবস্থা দেখেই বলল, হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে।
অমলের ঘরে এসে ওর বালিশের নীচে রাখা আঁকার খাতাটা আবার হাতে নিই। অদ্ভুত সমস্ত ছবি দিয়ে পাতার পর পাতা ভর্তি। প্যাস্টেল নয়। জলরঙ নয়। শুধু পেনসিলে আঁকা।
প্রথম পাতা জুড়ে একটা অন্ধকার কুঁয়ো যার শেষ দেখা যাচ্ছে না। কুঁয়োটার ভিতরের দেওয়ালে লাইন দিয়ে গোল করে কিছু শব্দ লেখা। পড়ার চেষ্টা করি। খুব ছোট অক্ষরগুলো। মিনিকে বলি আমার চশমাটা নিয়ে আসতে। শব্দগুলো পড়ে চমকে উঠি।
-একে অপদার্থ তায় বোকা। কথাই বলতে পারে না ঠিকমত। এরকম আরো বেশ কিছু সেই অন্ধকার দেওয়াল জুড়ে গোল হয়ে ঘুরছে যেন। বেরোতে পারছে না।
এরপর পাতায় পাতায় গ্রহ থেকে গ্রহে যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে অমল। মহাশূণ্যের মহাপথে যেন রাস্তা খুঁজছে ছেলেটা। বিভিন্ন গ্রহ থেকে ভেসে আসছে ভয়ংকর সমস্ত আওয়াজ যেসব আওয়াজ অমল শুনতে চায় না তাই ওর পেন্সিলের টানে আওয়াজগুলোকে ভাসিয়ে দিচ্ছে মহাশূণ্যে। আওয়াজগুলো বন্দী হয়ে গেছে। তারা বেরোতে পারছে না। ঠিক যেভাবে তার বাবার বলা কথাগুলোকে সে ব্ল্যাক হোলে বন্দী করেছে। সেসব ছবিতে অমল হাসছে।
এভাবেই কোথাও তার বাবা, কোথাও দিদি, কোথাও স্কুলের টিচাররা।
কোনো, কোনো ছবিতে হালকা রঙের ব্যবহার করেছে সে। একটা ছবিতে এক সবুজ পৃথিবীতে এক বৃদ্ধ টেলিস্কোপে আকাশ চেনাচ্ছেন এক শিশুকে হাত ধরে। সে শিশুর পিঠে ছোট্ট ডানা। চোখ টেলিস্কোপে।
ডাক্তারের হাতে খাতাটা দেবার আগেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, অমলকে আনেননি? কিছু না বলেই খাতাটা বাড়িয়ে দিই।
খাতার পাতা উলটাতে উলটাতে ডাক্তার বললেন, আমি জানি অমল খুব ট্যালেন্টেড। আগেও আপনাদের বলেছি। ওকে নিয়ে আসুন জমিয়ে গল্প করব এবার এই ছবিগুলো নিয়ে। মহাবিশ্বের এত কঠিন ব্যাপার ও জানল কোত্থেকে? যদি জেনেও থাকে তাকে এমনভাবে নিজের ছবিতে ফুটিয়ে তোলা। এ ছেলে অনেকদূর যাবে দেখে নেবেন।
নিয়ে আসুন ওকে। ওর সঙ্গে গল্প করে আমাকে জানতেই হবে এই ছবিগুলোর ভেতরের কথা।
মাথা নিচু করে বসে থাকি। মনে পড়ে রঘুনন্দন টাকুরদার গল্প মনোযোগ দিয়ে শুনছে অমল।
ডাক্তার আবার বলেন, কী হয়েছে?
ডাক্তারকে বলি, মারাত্মক জ্বরে মস্তিস্কে রক্ত ক্ষরণ শুরু হয়ে গিয়েছিল আমার ছেলেটার। সে এখন হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে।
চীৎকার করে উঠি, একদিন, একদিনও কেউ ভালোবাসা দেয়নি ছেলেটাকে। হাউ হাউ কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে জীবন্ত হয়ে ওঠে খাতায় অমলের আঁকা শেষ ছবিটা। মহাকাশের নীরবতার ঠিক আগে যেন ভয়ংকর শব্দে মহাবিশ্বের গ্রহরা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে ভীষণ শব্দে। সে শব্দে কান পাতা যায় না। কেঁপে ওঠে মহাবিশ্ব।
-ডকটর ছেলেটা আমার বাঁচবে তো?
-হ্যাঁ বাঁচবে। ওকে বাঁচতেই হবে। বাঁচাতেই হবে আমাদের। আমাকে ওর বেড নম্বর আর ডাক্তারের ফোন নম্বরটা দিন। আজই যাব আমি।
ডাক্তার খাতাটা আরেকবার উলটে দেখেন। দেখেন একেবারে শেষে লেখা আছে অমলের স্বপ্নগুলো। ডাক্তারের চোখ থেকে দু ফোঁটা জল নেমে আসে ঐ শব্দ দুটোর ওপরে।
#
মিনি ঢোকে, আমি বলি আজ কেন এলি মিনি? অমল তো…।
-হ্যাঁ মাসি, ভাইয়ের খবর এলে সঙ্গে সঙ্গে পাব তাই। বাড়িতে বসে থেকে কী করব?
-আচ্ছা। বোস।
-মাসি হাসপাতাল থেকে ফিরে ভাই যখন ছবি আঁকবে আবার, আমার একটা ছবি এঁকে দিতে বলবে? আমি বলব ভাইকে আমার ছবিতে আমার হাতে থাকবে হলুদ ফুল।
কথার মাঝখানেই ফোনটা বেজে ওঠে ঝনঝন করে। দেখি অভিজিতের নম্বর।
ফোনটা অন করার আগেই বলি, দেখিস মিনি ওর ছবি আঁকা চলতেই থাকবে, আর বলে দেব তোর ছবি যেন আঁকে। ঠিক যেভাবে তুই বললি হাতে হলুদ ফুল নিয়ে।