এই মূহুর্তে বাংলায় বেশ কিছু ভালো ছবি হচ্ছে। নতুন নতুন পরিচালকেরা অন্য ধরনের ছবি বানানোর চেষ্টা করছেন। তার মধ্যে পরিচালক প্রসুন চ্যাটার্জীর ‘দোস্তজী’ অন্যতম একটি ছবি, যে ছবি নিয়ে কথা না বললে অন্যায় হবে। আমাদের বড় হয়ে ওঠার সময়, আমাদের ভালো থাকা, মন্দ থাকার এই সময়টাকে ধরে রাখার যে চেষ্টা পরিচালক করেছেন, তাকে দুহাত তুলে আমাদের মতো দর্শকেরা যদি সাধুবাদ না জানাতে পারি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। জার্মান নাট্যব্যক্তিত্ব, বার্টল্ড ব্রেখট বলেছিলেন, এই কঠিন সময়ে কি আমরা গান গাইতে পারি? হ্যাঁ, অবশ্যই পারি, এই কঠিন সময়ের গানই তো এখন গাওয়ার সময়। পরিচালক, এই ‘দোস্তজী’ ছবির মধ্যে দিয়ে এই কঠিন সময়কেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এই মূহুর্তে সারা বিশ্বে নানান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত এই ছবিটি কলকাতা সহ দেশের নানান প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হচ্ছে, এবার আমাদের দায়িত্ব এই ছবিটিকে দেখে, এই ছবিটি নিয়ে কথা বলার, কারণ এই ছবিটি আমাদের ছবি, আমরা যেভাবে, যে চোখে আমাদের প্রতিবেশী অন্য ধর্মের মানুষদের দেখি, তার ছবি।
পলাশ আর সফিকুল, দুটি আট বছরের বন্ধুর বড় হয়ে ওঠার দৈনন্দিন কিছু ছবি নিয়ে গল্প। দুটি পরিবার, একটি হিন্দু অপরটি মুসলমান, আক্ষরিক অর্থেই পাশাপাশি বাস। একটি উঠোন, মাঝে দরমার বেড়া দেওয়া পাঁচিল। একদিকের উঠোনে যখন পলাশের মা, ঝাড়ু দেন, পাশের উঠোনে তখন সফিকুলের দিদিও একই কাজ করে। মাস্টারমশাই পড়াতে আসেন, পলাশের বাড়িতে, সফিকুলও সেই একই চৌকিতে পড়তে বসে একসঙ্গে। পলাশের বাবা, অঞ্চলের পুরোহিত, যজমানির পয়সায় তাঁর দিন চলে আর ওদিকে সফিকুলের পরিবারের মহিলারা তাঁত বোনেন আর গামছা তৈরী করেন। পলাশ আর সফিকুল, দুই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু, ঘটনাচক্রে তারা দুই ভিন্ন ধর্মের বাড়িতে জন্মেছে। এরই মাঝে খবর আসে, বাবরি মসজিদ ভাঙার পরবর্তীতে সারা দেশে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। তারই প্রভাবে ধীরে ধীরে গ্রাম বাংলাও বদলে যেতে থাকে। পরিচালক, সুনিপুণ দক্ষতায় ছবির কুশীলবদের দিয়ে বেশ কিছু কথা বলিয়ে নিয়েছেন, যা বলা অত্যন্ত জরুরী এই সময়ে। যখন একদিকে উত্তরপ্রদেশে বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রতিবাদে, বাংলারই একটি গ্রামে ছোট বাবরি মসজিদ তৈরী করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বেশ কিছু মুসলমান মানুষজন অন্যদিকে তখন গ্রামের শিব মন্দিরের পাশে রাম-সীতার বিগ্রহ রেখে রোজ ফুল বেলপাতা দিয়ে পুজোর প্রস্তুতিও চলছে, হিন্দুদের তরফে। পলাশের মা, কিন্তু প্রশ্ন করছেন, রামায়ণ- মহাভারত তো মহাকাব্য, রাম আবার দেবতা হলো কিভাবে? পলাশের বাবা, যিনি নিজে পুরোহিত, তিনিও স্বীকার করছেন, হ্যাঁ, বাঙালীদের কাছে রাম কোনোদিনই বাংলায় সেই অর্থে পূজিত দেবতা নন, মূলত রামকে নিয়ে উন্মাদনা, উত্তর ভারতেই দেখা যায়। পলাশের মা, ভীত, তাঁর ভয় হয় মুসলমান প্রধান অঞ্চলে বসবাস করতে, সে বাচ্চাকে খাওয়াতে খাওয়াতে তাঁর স্বামীকে বলে, এই অঞ্চল থেকে চলে যাওয়ার কথা। পলাশ, খেতে খেতে শোনে, কিন্তু বুঝতে পারে না কেন, সে এটুকু বোঝে সফিকুল তার বন্ধু, এবং বন্ধুর সঙ্গে কথা বন্ধ থাকলে তার কষ্ট হয়।
দুটি নিষ্পাপ কিশোরের বন্ধুত্বের গল্প বলার ফাঁকে ফাঁকে অনেক দৃশ্য পরিচালক দেখিয়ে দিয়েছেন, যার মধ্যে কোথাও মোটা দাগের সম্প্রীতি নেই। ঈদের সিমাই সফিকুলের কাছ থেকে নিয়ে এসে বোনকে খাওয়ায় পলাশ, আর তা বুঝতে পেরে মায়ের রাগ, কিংবা সফিকুলের জন্য জল চাইতে আসা পলাশের বোন জবাকে যখন তার মা, সফিকুলের জন্য অন্য গ্লাসে জল দেন, তখন বাচ্চারা না বুঝলেও বড়রা এটা বুঝবেন, যে পাশাপাশি থাকলেও মুসলমানদের আমরা কখনোই আপন করতে পারিনি, হাজার সম্প্রীতির কথা বললেও, এই অভ্যেস আমাদের ছিলই, ‘ওঁদের’ জন্য থালা বাটি গ্লাস আলাদাই ছিল, আজও আছে। অথচ এই সমস্ত কিছুই দুই বন্ধুর নিজস্ব বন্ধুত্বের মাঝে কোনোদিনই আসেনি। যে সমস্ত মানুষ এইরকম পরিবেশে বড় হয়েছেন, তাঁরা এই ছবি দেখে নিশ্চিত একবার হলেও ভাববেন, সেই কথাটা, যা পরিচালক, রামায়ণের যাত্রাপালার কুশীলবদের দিয়ে বলিয়ে নিয়েছেন। ‘আমরা বন্ধুই ছিলাম, পেটের কারণে বা অন্য ধান্দার কারণে একে অপরের শত্রু সেজেছি’।
আসলে একটি ছবি নির্মাণ করা হয়, নানান ছোট ছোট ছবির সমাহারে। আবার অনেক সময়ে অনেক বড় ছবি, ছোটদের চোখ দিয়েও দেখানো সম্ভব। এই ‘দোস্তজী’ ছবিতে দুটোই করার চেষ্টা হয়েছে। সিনেমাটোগ্রাফার তুহিন বিশ্বাসের ক্যামেরায় অনেক ছোট ছবি, বড় হয়ে এসেছে। কখনো বৃষ্টির দিন, কখনো নদীতে মাছ ধরা, আলপথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া, এটাই তো আমাদের গ্রাম, এইখানেই তো আমাদের স্কুল, এইখানেই তো আমাদের বন্ধুরা থাকে, যে বন্ধু হারালে সত্যিই দুনিয়াটা ফাঁকা হয়ে যায়। যে বন্ধু, ‘জীবনেও কথা বলবো’ না বলার পরে যখন সত্যিই জীবন থেকে হারিয়ে যায়, তখন যে কি অসহায় লাগে, তা সফিকুল, তার অভিনয় দিয়ে দেখাতে পেরেছে সফলভাবে। একজন মা, তাঁর সন্তানকে হারিয়ে, মনে মনে যে তার বন্ধুকেই দোষারোপ করছে, তা অদ্ভুত ভালোভাবে দেখিয়েছেন পলাশের মায়ের ভুমিকায় অভিনয় করা জয়তী চক্রবর্তী। শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি বেরিয়ে, যখন উড়ে যায়, তারপর তাঁর কান্না যে তাঁর সন্তান হারানোর কান্না, তা বলে দিতে হয় না। পলাশ এবং সফিকুলের ভুমিকায় অভিনয় করা আশিক শেখ এবং আরিফ শেখের চোখে হয়তো শহুরে চাকচিক্য নেই, কিন্তু যে সরলতা আছে, তাকে যেভাবে পরিচালক দেখিয়েছেন তা তারিফযোগ্য।
https://www.youtube.com/watch?v=fHL4QXpRqgk
কোকিলের ডাকের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ডাকতে ডাকতে, ছবি শেষ হওয়ার মধ্যে দিয়েও যেন একটা ভালোলাগার রেশ থেকে যায়। হ্যাঁ, এই ছবি এই সময়ের একটি গান, একটি কঠিন সময়ের গান, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমাদের যাপনের কথা। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রেক্ষাপটে হয়তো একটা দাঙ্গা বিরোধী ছবিও করতে পারতেন, পরিচালক। করতে পারতেন একটি সাধারণ সম্প্রীতির গল্প নিয়ে ছবি, কিন্তু তিনি বেছে নিয়েছেন এমন একটি বিষয়, কৈশোরের বন্ধুত্ব, যার মধ্যে দিয়ে তিনি সব কথাই বলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এই ছবি অনেক আন্তর্জাতিক পুরষ্কার পেয়েছে, আগামীতেও হয়তো পাবে, কিন্তু আমার আপনার মতো দর্শকেরা যদি নিজেরা প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখেন এবং বন্ধুদের নিয়ে দেখেন, তবেই পরিচালক তাঁর শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার পাবেন। হ্যাঁ, এই ছবি, বার্টল্ড ব্রেখটের কথা অনুযায়ী, আজকের কঠিন সময়ের গান।
পুণঃ এই লেখাটি কোনও ছবি রিভিউ নয়, এই লেখাটি একটি ব্যক্তিগত আলাপ।