আইন সিদ্ধ লুটে পাওয়া জমিতে নির্মীয়মান রাম মন্দির উদ্বোধনের ঠিক প্রাক্কালে হঠাৎ করে রাম কোম্পানি গীতার প্রতি এত আকৃষ্ট হয়ে পড়ল কেন? এখন তো অখণ্ড তুলসীদাসী রামচরিতমানস পাঠ, ছিয়ানব্বই ঘন্টা নাকি সুর সহযোগে লাগাতার হনুমানচালিশা পাঠ, ইত্যাকার কর্মসূচি নেবার কথা। আর বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গ থেকেই বা এই কর্মসূচির শুরু কেন? মহারাষ্ট্র বা উত্তর প্রদেশ থেকেই এর শুরু হওয়াটা আপাতভাবে যুক্তিগ্রাহ্য হতে পারত। তবে, আমরা জানি, সঙ্ঘ গোষ্ঠী কোনো কাজই খুব ভালো মতন ভাবনাচিন্তা না করে করে না। এর পেছনে ওদের নিশ্চয়ই কিছু দুরভিসন্ধি আছে। এক নম্বর, সেটা আমাদের খুঁজে দেখতে এবং বুঝে নিতে হবে। তার পরে, আমাদের এ সম্পর্কে কিছু কথা পাঠককে জানাতে হবে। বিচার বিবেচনার জন্য।
আমার ধারণা, উত্তর ভারত কেন্দ্রিক রামায়ণের রাম চরিত্রকে ধরে তাদের প্রচার সর্বভারতীয় পর্যায়ে প্রধান আকার ধারণ করলেও এবং রামের নামে ভোট চাইলেও এত দিনে ওরা বোধ হয় বুঝতে পেরেছে, সারা দেশে ধর্মীয় প্রতিমা হিসাবে রামচন্দ্রের আকর্ষণ গরু বলয়ের মতো জোরালো নয়। বরং তুলনায় কৃষ্ণের আবেদন কিঞ্চিৎ বেশি। দেশের ধর্মবৈচিত্র্যের সেই কথা মনে রেখে তারা এক দেশ এক রাম শ্লোগানের বদলে কৃষ্ণভক্ত বৈষ্ণবদেরও রাম মন্দির আন্দোলনে তথা ভোটের থলে ভর্তি করার উদ্দেশ্যে সামিল করতে চায়। সম্ভবত, সেই জন্যই ওরা গীতার প্রশ্নকে সামনে টেনে এনেছে। গীতাকে “জাতীয়গ্রন্থ” হিসাবে গ্রহণ করার দাবি তুলেছে।
দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গে একাধিক রামনবমীতে পেশী আস্ফালন করেও সাংগঠনিক বা ভোটতান্ত্রিক অঙ্কে ওরা খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি। কিন্তু ধার্মিক হিন্দু বাঙালির কাছে গীতা একটি সমাদৃত গ্রন্থ। বিশেষ করে, আত্মীয়স্বজন কেউ মারা গেলে শ্রাদ্ধ করার দিনে আঠারো অধ্যায় গীতাপাঠ একটা অবশ্যকর্তব্য। যদিও অধিকাংশ লোকই এর শ্লোকগুলির মানে বোঝে কিনা সন্দেহ। বুঝতে পারলে অন্তত দলিতদের গীতা নিয়ে আদিখ্যেতা দেখানোর কথা নয়। এতে জাতপাত ভেদ এবং শুচি অশুচির প্রশ্নটাকে যেভাবে ভগবানের সৃষ্টি বলে মর্যাদান্বিত করা হয়েছে, “চাতুর্বর্ণ্য ময়া সৃষ্টি … “ ইত্যাদি বলে, এবং প্রত্যেককে তার তার জাত ধর্ম পালন করাই একমাত্র শ্রেয় কর্তব্য বলে যে মহিমা প্রদান করা হয়েছে তা কোনো শূদ্রের পক্ষে সম্মানজনক হওয়ার কথা নয়। তাদের গীতা সম্পর্কে অগভীর জ্ঞান এবং ধর্মবিশ্বাসের অন্ধত্ব এই দিকে তাদের টেনে আনতে সক্ষম হয়ে উঠেছে। তবে অন্যান্য জায়গার মতো এই ক্ষেত্রেও সঙ্ঘ কোম্পানি গীতা প্রসঙ্গে বেশ কয়েকজন মনীষীর সাধারণ মূল্যায়নকে অগ্রাহ্য করেই এগোতে চায়। আমরা সেই দিকে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
(১)
প্রথমেই একটা জিনিস পরিষ্কার করে দেওয়া দরকার। দামোদর ধর্মানন্দ কোশাম্বী কিংবা জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মার্ক্সবাদী বুদ্ধিজীবীরা গীতার যে ঐতিহাসিক এবং আর্থসামাজিক বিশ্লেষণ করেছেন [Kosambi 1985; Kosambi 2002; এবং বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৪] তা খুব মূল্যবান বিচার হলেও আমরা এখানে সেই মূল্যায়নকে আপাতত ধরছি না। আমাদের দেশে অনেকেই বক্তব্যের ঠিক-ভুলের চাইতেও বিশ্লেষকের পরিচয় নিয়ে বেশি মাথা ঘামান এবং ধরে নেন, মার্ক্সবাদীরা দেশি ঐতিহ্যকে যথাযথ গুরুত্ব দেন না। তাই সঙ্ঘ প্রচারকদের বক্তব্যের নিরিখে আমাদের বর্তমানে বিবেচ্য হচ্ছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সোহহং স্বামী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এবং স্বামী বিবেকানন্দের প্রদত্ত গীতা সংক্রান্ত কিছু আলোক কণা। যাঁদের একজনও মার্ক্সবাদী নন এবং অন্তত দুজন—বঙ্কিম ও বিবেকানন্দ—সঙ্ঘ প্রচারে অত্যন্ত ওজন পেয়ে থাকেন। তাছাড়া আমাদের শিবিরে থাকা যুক্তিবাদী ও মার্ক্সবাদী সমালোচকদেরও এই সব কথা জানা এবং চর্চায় আনা দরকার।
১ (ক)
বঙ্কিমচন্দ্র গীতা প্রসঙ্গে লিখেছেন: “যুদ্ধক্ষেত্রে উভয় সেনার সম্মুখে রথ স্থাপিত করিয়া, কৃষ্ণার্জুনে যথার্থ এইরূপ কথোপকথন যে হইয়াছিল, তাহাতে বিশেষ সন্দেহ। দুই পক্ষের সেনা ব্যূহিত হইয়া পরস্পরকে প্রহার করিতে উদ্যত, সেই সময়ে যে এক পক্ষের সেনাপতি উভয় সৈন্যের মধ্যে রথ স্থাপন করিয়া অষ্টাদশ অধ্যায় যোগধর্ম শ্রবণ করিবেন, এ কথাটা বড় সম্ভবপর বলিয়াও বোধ হয় না। . . . গীতায় ভগবত প্রচারিত ধর্ম সঙ্কলিত হইয়াছে সন্দেহ নাই, কিন্তু গীতা গ্রন্থখানি ভগবত প্রণীত নহে, অন্য ব্যক্তি ইহার প্রণেতা।” এর পর বঙ্কিমের মতে, “যে ব্যক্তি এই গ্রন্থের প্রণেতা, তিনি যে কৃষ্ণার্জুনের কথোপকথনকালে সেখানে উপস্থিত থাকিয়া সকলই স্বকর্ণে শুনিয়াছিলেন এবং শুনিয়া সেইখানে বসিয়া সব লিখিয়াছিলেন বা স্মৃতিধরের মতো স্মরণ রাখিয়াছিলেন, এমন কথাও বিশ্বাসযোগ্য হইতে পারে না। সুতরাং যে সকল কথা গীতাকার ভগবানের মুখে ব্যক্ত করিয়াছেন, সে সকলই প্রকৃত পক্ষে ভগবানের মুখ হইতে নির্গত হইয়াছিল, এমন বিশ্বাস করা যায় না। অনেক কথা গ্রন্থকারের নিজের মত, তিনি ভগবানের মুখ হইতে বাহির করিতেছেন, ইহাও সম্ভব।” [চট্টোপাধ্যায় ২০১২, ৮২৬; আধুনিক বানান রীতি প্রযুক্ত] স্পষ্টতই বঙ্কিম গীতা প্রচারিত কর্মফল ইত্যাদিতে বিশ্বাস করলেও এর প্রণেতৃত্ব (authorship) এবং মহাভারতের মূল পাঠে এর অস্তিত্ব সম্পর্কে গভীর সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর “পারস্যে” নামক একটি ছোট ভ্রমণ রচনায় বলেছেন, গীতার আত্ম-কর্মফল যে কোনো রকম গণহত্যাকে এক রকম ন্যায্য করে তোলে। কারণ যে মারছে, তাকে সেই মারের দায়িত্ব নিতে হচ্ছে না। এ এক ভয়ানক খুন মন্ত্র! “আকাশযানের থেকে মানুষ যখন শতঘ্নী বর্ষণ করতে বেরয় তখন সে নির্মম ভাবে ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে; যাদের মারে তাদের অপরাধের হিসাব বোধ উদ্যত বাহুকে দ্বিধাগ্রস্ত করে না, কেন না, হিসাবের অঙ্কটা অদৃশ্য হয়ে যায়। যে বাস্তবের ’পরে মানুষের স্বাভাবিক মমতা, সে যখন ঝাপসা হয়ে আসে তখন মমতারও আধার যায় লুপ্ত হয়ে। গীতায় প্রচারিত তত্ত্বোপদেশও এইরকম উড়োজাহাজ—অর্জুনের কৃপাকাতর মনকে সে এমন দূর লোকে নিয়ে গেল, সেখান থেকে দেখলে মারেই-বা কে, মরেই-বা কে, কেই-বা আপন, কেই-বা পর। বাস্তবকে আবৃত করবার এমন অনেক তত্ত্ব নির্মিত উড়োজাহাজ মানুষের অস্ত্রশালায় আছে, মানুষের সাম্রাজ্যনীতিতে, সমাজনীতিতে, ধর্মনীতিতে। সেখান থেকে যাদের উপর মার নামে তাদের সম্বন্ধে সান্ত্বনাবাক্য এই যে, ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে!” [ঠাকুর ১৯৯৫, ৬২৯]
সোহহং স্বামী (শ্যামাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়: ১৮৫৮-১৯১৮) তাঁর ভগবদ্গীতার সমালোচনা (১৯১৯) শীর্ষক নাতিক্ষুদ্র গ্রন্থে বৈদান্তিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই গীতা এবং গীতাকারের সম্পর্কে মারাত্মক কিছু অভিযোগ উত্থাপন করেছেন, যাকে এদেশের অধিকাংশ অধ্যাত্মকুল ও বিদ্বৎসমাজ এযাবত প্রায় অগ্রাহ্যই করে এসেছেন। তিনি বিভিন্ন প্রাচীন শাস্ত্র মন্থন করে দেখিয়েছেন: গীতা ও মহাভারত অনুযায়ী অর্জুন যুদ্ধ শেষে কৃষ্ণ উবাচ সমস্ত বাণী ভুলে গিয়েছিলেন। কৃষ্ণকে সে কথা বললে তিনি বলেন, তিনিও ভুলে গেছেন। [অনুগীতা পর্ব, মহাভারত] কৃষ্ণ অর্জুনকে যে বিশ্বরূপ দর্শালেন, বললেন, তা নাকি তিন লোকের কেউই কোনো সাধনাতেই দেখতে পায় না। অথচ মহাভারতের আখ্যান অনুসারে সঞ্জয় বিশ্বরূপ দর্শন সহ সমস্তই দেখে ধৃতরাষ্ট্রকে তার বিবরণ দিয়ে গেল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অন্তত একশ বছর পরে বৈশম্পায়ন “ফনোগ্রাফের ন্যায়” স্মরণ করে অর্জুনের প্রপৌত্র জন্মেজয়কে এই কাহিনি শুনিয়েছিলেন। ব্যাসদেব তা শুনে মহাভারত লিখে ফেললেন। গীতার বয়ানও তার বৈশম্পায়নের কথা শুনে মনে রাখতে কোনো অসুবিধা হল না। সোহহং স্বামী লিখেছেন, “[এই সব] বিচার্য বিষয়-নিচয় প্রণিধান করিয়াও যদি কেহ ভগবদ্গীতা “ভগবদ্বাক্য” বলিয়া বিশ্বাস করেন, তাহা কিঞ্চিন্মাত্রও বিস্ময়ের বিষয় নহে, কারণ অবিদ্যার মহিমা অপার এবং মানবের মনোবৃত্তি বিচিত্রা।” [সোহহং স্বামী ১৯৪৯, ১৩-১৪; আধুনিক বানান রীতি প্রযুক্ত] তিনি প্রশ্ন তুলেছেন: “কর্মবিমুখ অর্জুনের কর্মে প্রবৃত্তির জন্যই ভগবানের উপদেশ, এই জন্যই গীতাপ্রোক্ত যোগজ্ঞানও কর্মসঙ্কুল। বিস্বাদ বিষয়ও যেমন সুস্বাদু পদার্থদ্বারা আবৃত হইলে সুখ-সেব্য হয়, ‘নিষ্কাম’ বিশেষণ দ্বারা আবৃত কর্মও অর্জুন এবং তদবস্থ জীবের তদ্রূপ প্রীতিকর হইয়াছে এবং হইতেছে। . . . এই জন্যই ভগবদ্গীতা তত্ত্বাবরক ব্যামিশ্র বাক্যপূর্ণা, এবং বর্তমান সময়েও ইহা দ্বারা কর্মাসক্ত অজ্ঞের বুদ্ধিভেদ হয় না। অজ্ঞের বুদ্ধি অর্থাৎ অজ্ঞতা বা ভ্রান্তি ভেদিতা না হইলে জ্ঞানের স্ফুরণ সম্ভবপর কি??” [ঐ, ২৯৩] সিদ্ধান্ত পর্বে স্বামীজির অভিযোগ: “শ্রীকৃষ্ণের ব্রহ্মত্ব বা অবতরত্ব প্রতিপাদন পূর্বক সর্বত্র সর্ব সম্প্রদায়ে নরপূজা প্রচলন করাই গীতাগ্রন্থের উদ্দেশ্য; গ্রন্থকর্তার অসাধারণ বর্ণনা কৌশলে এবং অপূর্ব বাক্চাতুর্যে অভিভূত অজ্ঞ সমাজে গ্রন্থের উদ্দেশ্য সম্যক্ সংসাধিত হইয়াছে। কিন্তু কৃষ্ণদেহরূপ কার্যপদার্থে কৃৎস্নবৎবোধ যে তামসজ্ঞান মূলক তাহা গ্রন্থকর্তার বাক্যেই প্রমাণিত হইয়াছে; . . .” [ঐ, ২৯৪]
প্রায় সমসাময়িক কালে স্বামী বিবেকানন্দেরও গীতার প্রণেতৃত্ব এবং মৌলিকতা নিয়ে সন্দেহ ছিল। আমেরিকায় বসে এক আলোচনায় বসে গীতা মহাভারতের অংশ কিনা—এই প্রশ্ন নিজেই উত্থাপন করে বলেছেন: “শঙ্করাচার্য ভাষ্য রচনা করিবার পূর্বে গীতা গ্রন্থটি সর্বসাধারণে তত দূর পরিচিত ছিল না।” গীতার যে আর কোনো প্রাচীনতর ভাষ্য পাওয়া যায়নি, এ তথ্য সবিস্তারে পরিবেশন করে তিনি বলেন: “অনেকে এই রূপ অনুমান করেন যে, গীতা শঙ্করাচার্য প্রণীত। তাঁহাদের মতে তিনি ওইখানি প্রণয়ন করিয়া মহাভারতের মধ্যে ঢুকাইয়া দেন।” [বিবেকানন্দ ১৯৮৯, ১৯১-৯২] এই অনুমান সম্পর্কে এর পরে তাঁর নিজের মূল্যায়ন ব্যক্ত না করে তিনি প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দেন, তিনিও এর সঙ্গে একমত। অন্তত সন্দেহমুক্ত নন। তিনি কেন যে ভারতের যুবকদের গীতা না পড়ে ফুটবল খেলতে উৎসাহিত করেছিলেন, এর থেকে খানিকটা আন্দাজ করা যায়।
অর্থাৎ, বিজেপি চক্র এমন একটি বুদ্ধিনাশক গ্রন্থকে “জাতীয়” মর্যাদা দিতে চাইছে যার শুদ্ধতা সম্পর্কে বাংলার ধর্মবিশ্বাসী বিচারশীল মনীষীরাও অনেকে নিঃসংশয় নন। যার মধ্যে, রবীন্দ্রনাথের মতে, গণহত্যার উৎপ্রেরণা রয়েছে, আর তাই হয়ত হিন্দুত্ববাদীদের কাছে এর এত আদর।
(২)
এর পরে আর দুটো কথা পাঠককে মনে রাখতে বলব।
সোহহং স্বামী একটা পূর্ণাঙ্গ বই লিখেছেন। তাঁর যে বক্তব্য আমরা এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে রেখেছি, সেটাই তাঁর আগাগোড়া মত এবং তাঁর বক্তব্যের মূল সুর। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ এবং বিবেকানন্দ অন্যত্র গীতা সম্পর্কে অন্য রকম বক্তব্যও রেখেছেন। ফলে এটা ঠিক যে তাঁদের বক্তব্যকে প্রতিটি ক্ষেত্রে বিচার করে গ্রহণ না করলে যার যেরকম মত পেলে সুবিধা, তিনি সেই রকম মত সংগ্রহ করে নেবেন। আমরা তাঁদের সেই বক্তব্যগুলোই তুলে এনেছি যেগুলি যুক্তি তথ্য ও ইতিহাসের সঙ্গে খাপ খায়। কিন্তু এখানে উদ্ধৃত কথাগুলি ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যায়, এঁদের সকলেরই মহাভারতের সঙ্গে গীতার সম্পৃক্ততা নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ বা প্রশ্ন ছিল। আর ভাষার দিক থেকে বিচার করলে বিবেকানন্দের উত্থাপিত সন্দেহই জোরদার হওয়ার সম্ভাবনা বিশাল। এক দিকে মহাভারতে লব্ধ সাধারণ ভাষা গঠনের সঙ্গে গীতার ভাষাবয়ন একেবারেই মেলে না, অপর দিকে শঙ্করাচার্যের একাধিল রচনার ভাষা বিন্যাসের সঙ্গে এর ভাষা প্রায় হুববু মিলে যায়! আর একটা ঘটনা হল, ব্রাহ্মণ্যবাদীরা অত্যন্ত ধূর্ততার সঙ্গে মহাভারতের সঙ্গে গীতাকে প্রক্ষেপ করে মিলিয়ে রেখেছিল অনেক কাল ধরে। পশ্চিমি শিক্ষার আধুনিকতার ছোঁয়া এদেশের শিক্ষিত মনকে যুক্তি বুদ্ধি প্রয়োগ করে সমস্ত জিনিস দেখা, বিশ্লেষণ করা এবং স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপযোগী করে তোলার পরে পুরনো বিশ্বাস ঐতিহ্য ও গ্রন্থ পরম্পরাকেও প্রশ্ন করার দিকে ঠেলে দেয়।
অষ্টাদশ শতাব্দের শেষ দিকে ইংরেজ গবেষকরা মহাভারতের ইংরেজি অনুবাদ করার সময়ও এটা অনুভব করেন। ওয়ারেন হেস্টিংস-এর উদ্যোগে এই অংশটুকুকে আলাদা করে নির্বাচিত করে ইংরেজিতে কৃষ্ণার্জুন সংলাপ নাম দিয়ে ১৭৭৫ সালে লন্ডন থেকে একটা স্বতন্ত্র পুস্তক হিসাবে ছাপিয়ে আনা হয়। সেই বইটিকেই পরে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা শ্রীমদ্ভগবতগীতা নাম দিয়ে নতুন করে ধর্মীয় প্রচারে নেমে পড়ে। এতে পরোক্ষভাবে হলেও একটা বড় উপকার হয়। গীতাংশ যে মহাভারতের “অবিচ্ছেদ্য” অঙ্গ নয়, প্রক্ষিপ্ত এবং ব্রাহ্মণ্যবাদীরা যে জেনে বা না বুঝে এই তথ্যকে অগ্রাহ্য বা আড়াল করে এসেছেন, তা প্রকারান্তরে সকলেই মেনে নিতে বাধ্য হন।
গীতার সামাজিক ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত বিচার করতে বসে কোসাম্বির মনে হয়েছিল, এটা একাদশ শতকের রচনা। আর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, গীতা সম্ভবত গুপ্তযুগে রচিত হয়ে মহাভারতে ঢুকে যায়। আমার সামর্থ্যে এই বিতর্কের চূড়ান্ত রায় দেওয়া কুলোবে না। কিন্তু আমার সীমিত পড়াশুনার সাপেক্ষে আমি স্বামী বিবেকানন্দের সন্দেহকেই বেশি গুরুত্ব দিতে চাই। সেক্ষেত্রে এটা অষ্টম নবম শতাব্দের রচনা হওয়াই বেশি যুক্তিযুক্ত।
গীতার মধ্যে সাংখ্য এবং বৌদ্ধ মতকে নানা রকম ইঙ্গিতে বিরোধিতা ও সমালোচনা করা হয়েছে। শঙ্করাচার্যও তাঁর দর্শনের মধ্য দিয়ে একই কাজ করেছেন। বিবেকানন্দ তাঁর অন্য এক রচনায় বলেছেন, “উপনিষদ আলোচনা করলে দেখা যায়, তার মধ্যে অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথা চলতে চলতে এক মহাসত্যের অবতারণা। যেমন—জঙ্গলের মধ্যে অপূর্ব সুন্দর গোলাপ—তার শিকড় কাঁটা পাতা সমেত।” [বিবেকানন্দ ১৯৮৯, ১৯৪] আর গীতা হচ্ছে সেই ফুলগুলির সমাহার। সেই দিক থেকেও
আমরা সহজেই বুঝতে পারি, এই মহাসত্যগুলি হচ্ছে বেদান্তমতের ফুল ও ফল। যার মধ্য দিয়ে এক দিকে পূর্বতন বস্তুবাদী দর্শন ও বেদ বিরোধী মতগুলিকে খণ্ডন করা হয়েছিল এবং ব্রাহ্মণ্য জাতিভেদ প্রথাকে নানা ভাবে সমর্থন জানানো হয়েছিল। শঙ্করও যে জাতপাতের “দালালি” করেছিলেন এই বিষয়েও বিবেকানন্দের স্পষ্ট স্বীকারোক্তি রয়েছে। সুতরাং কার্যটি তাঁর হাতের নিপুণ শিল্প হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্টই।
হত্যা ও ধ্বংসের মধ্য দিয়ে বৌদ্ধ বিতাড়ন পর্ব সফল ভাবে সম্পন্ন করার পরই ব্রাহ্মণ্য শক্তি তার বর্ণাশ্রম মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মহাভারতের শান্তি পর্বে যেমন শরশয্যায় শায়িত ভীষ্মের মুখে উচ্চারিত বাণীতে মনুস্মৃতির হুবহু পুনরাবৃত্তি দেখতে পাওয়া যায়, সেভাবেই হয়ত শঙ্করাচার্যের মতামতগুলিও মহাভারতে আশ্রয় পেয়ে যায়।
সোহহং স্বামীর কথাই যথার্থ মনে হয়, গীতার সমস্তটাই একটা বহুকাল ব্যাপী জালিয়াতির উপর প্রতিষ্ঠিত। আর এরকম জিনিস যে ওদের চরিত্র সাপেক্ষে বিজেপি বা আরএসএস-এর কাছে খুব সমাদর পাবে সেটা স্বাভাবিক।
তথ্যসূত্র
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (২০১২), “শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা”; বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড; শুভম্, কলকাতা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯৯৫), “পারস্যে”; রবীন্দ্র রচনাবলী, একাদশ খণ্ড; বিশ্বভারতী, কলকাতা।
জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৯৪), সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ভগবদ-গীতা; এলাইড পাব্লিশার্স, কলকাতা।
স্বামী বিবেকানন্দ (১৯৮৯), “গীতাতত্ত্ব”; অনুবাদ দ্রষ্টব্য—স্বামীজীর বাণী ও রচনা; ৫ম খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা।
স্বামী বিবেকানন্দ (১৯৮৯গ), “স্বামী-শিষ্য-সংবাদ”; স্বামীজীর বাণী ও রচনা, ৯ম খণ্ড; উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা।
D. D. Kosambi (1985), “The Historical Development of Bhagavat-Gita”; in Kosambi (1985), On History and Society: Problems of Interpretation; Mumbai Univerisity.
D. D. Kosambi (2002), “The Avatara Syncretism and Possible Source of the Bhagavat-Gita” and “The Historical Krishna”; in Kosambi (2002), Combined Methods in Indology and Other Writings; Oxford Univerisity Press, New Delhi.