আশ্চর্য সব ভয়ের খবর আসছে কাশ্মীর থেকে, আসাম থেকে। কাশ্মীরে ঘুমন্ত শিশুদের বিছানা থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে সেনা। কোনও রেকর্ড ছাড়াই পুলিশ বা সেনা হেফাজতে যাদের সন্তান আছে, তাঁরা নিজেদের নাম বলতে পারছেন না ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিমের কাছে। তাঁরা বলছেন নাম জানাজানি হলে যদি ছেলে ঘরে না ফেরে? ১১ বছরের এক সদ্য ঘরে ফেরা কিশোর জানিয়েছে তার থেকেও ছোটদের সে দেখেছে সেনা হেফাজতে। তাদেরও ঘুম থেকে রাতের বেলা তুলে নিয়ে গেছে সেনা বা পুলিস। ১১ বছর আরো জানিয়েছে যে সে মার খেয়েছে। বাড়ির মহিলারা জানাচ্ছেন নাইটরেইড চলাকালীন যৌন হেনস্থার শিকার হচ্ছেন তাঁরা। অর্থাৎ আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র যৌন লাঞ্ছনা ও নিগ্রহ করছে । হ্যাঁ। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র নিগ্রহ করছে তার নিজের দেশের মানুষকে আর আমরা সব দেখেশুনে সয়ে নিচ্ছি। জ্বলে উঠছি না,গর্জে উঠছি না। সহ্য করে নিচ্ছি।
দেশের পূর্ব প্রান্তের আসাম থেকেও আসছে ভয়াবহ সব দুঃসংবাদ। এনআরসির প্রয়োগ-পদ্ধতিতে সরকারি অফিসারদের ভুলে দেশের নাগরিকত্ব খুইয়ে ফেলছেন গরীব অসহায় মানুষগুলো। তারপর জেল।মামলা লড়তে উচ্চমূল্যে উকিল ভাড়া করতে হচ্ছে । টাকা যোগাতে চড়া সুদে ঋণ। অবশেষে, জমি বাড়ি সব বেঁচে অসংখ্য মানুষ ঋণদাতার ক্রীতদাসে পরিণত হচ্ছে। মনুষ্যত্বের এই ভয়াবহ অবমাননা আমরা শুনছি, জ্বলে উঠছি না, গর্জে উঠেছি না। সহ্য করে নিচ্ছি। কবে থেকে আমরা শিখলাম এমন সহ্য করে নিতে? একটা কথা স্মরণে রাখা ভাল--- দেশের দুই প্রান্তেই ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার যারা হচ্ছেন, তারা ধর্মে মুসলমান। অথচ শুরুটা তো এমন ছিল না।
আশির দশকে আমাদের শিক্ষা জীবন শুরু। বর্ণহিন্দু পরিবারে জন্ম হলেও ধর্ম বা পুজো নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য কোনওদিন দেখিনি বাড়িতে। ভুল বললাম, দিদার ঠাকুরের আসন ছিল, প্রণাম করেছি, নকুলদানা বাতাসা প্রসাদ খেয়েছি , কিন্তু কখনও কেউ শেখায়নি বিশ্বাস করতে, ভক্তি করতে। মা কখনও বলেননি নমো করো। পুতুল খেলার আনন্দের সঙ্গে গোপালপুজোর কোনও তফাৎ ধরা পড়েনি ছোটবেলায় । এমনকি পুজোর শেষে যখন মেঝেতে মাথা ঠেকিয়ে দিদা প্রণাম করছেন,আমাদের দুই বোনের ততক্ষণে প্রসাদ খাওয়া সারা হয়ে যেত। দিদা মুচকি হেসে বলতেন,আমার জ্যান্ত গোপালেরা প্রসাদ খেয়ে নিল। এইসব দেখতে দেখতে বড় হতে হতে নিজের মতো করে ধর্ম বুঝেছি। রবীন্দ্রনাথের ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা প্রভু তোমার পাণে বা যদি এ আমার হৃদয়দুয়ার বন্ধ রহে গো কভু /দ্বার ভেঙে তুমি এসো মোর প্রাণে ,ফিরিয়া যেওনা প্রভু শুনতে শুনতে অশ্রুসজল চোখে সুদূরের কোন দেবতাকে বুকের মধ্যে খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু কবে যে ধর্ম এমন মারমার কাটকাট রূপ ধারণ করলো বুঝতে পারিনি। বিজয়া দশমীর দিন মিষ্টি খেতে , অপরকে খাওয়াতে যে ধর্মপালন , কীর্তন শুনতে শুনতে রাধার বিরহে চোখে জল এসে যাওয়ায় যে ধর্মপালন তাতে তো কোনও মারাকাটা দাঙ্গা তরোয়াল ছিল না ? স্কুলে পরীক্ষার জন্য "বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য" পড়তে পড়তে নিজের মনে নিজের মতো করেই বহুত্বের যে উদযাপন বুঝেছিলাম, তার যেকোনও বিকল্প হতে পারে, সে তো আজও ভাবতে পারি না, ভাবতে চাইও না । ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষের সংবিধান মেনে চলতে হবে, অন্তত না মেনে চললে আদালতে তার বিরুদ্ধে নালিশ করা যাবে, এই তো ধ্রুবসত্য বলে জানতাম। কবে থেকে সব ওলট-পালট হয়ে গেল? কবে থেকে ঠিক হয়ে গেল একদল লোক সংবিধানের তোয়াক্কা না করে তাদের রুচি পছন্দ চিৎকার অন্যের উপর জোর করে চাপিয়ে দিতে পারে আর তার বিরুদ্ধে দেশের কোনও আদালতে কোনও নিন্দামন্দও চোখে পড়ে না ? বরং খুনিকে, ধর্ষককে মালা পরিয়ে, মিছিল করে চাকরি দিয়ে বরণ করে মূল স্রোতের রাজনীতি? তবে কি আমরাই গুরুত্ব না বুঝে অবহেলা বা উপেক্ষা করে অজান্তে প্রশ্রয় দিয়ে ফেললাম এই ভয়ানক অন্যায়কেই ? আমরা কি সহনশীলতার চর্চা করতে করতে অসহিষ্ণুতাকেই সয়ে ফেললাম? অসাংবিধানিক কথাকে বাকস্বাধীনতা ভেবে বসলাম? ভেবে নিলাম এ-ও বহুত্বের মধ্যে একরকম ? চিনতে পারলাম না এই "একরকম" যে বহুস্বরকে গলা টিপে মারার কথা বলছে ? নাকি আমরা আমাদের সংবিধান নিয়ে অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী ছিলাম ? আমরা ভাবতেই পারিনি যে সংবিধানের নামে শপথ নিয়ে কোনও দল বা রাজনেতা দাঙ্গায় মদত দিতে পারে ? আমরা ভাবতেই পারিনি মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যম নতিস্বীকার করতে পারে অভূতপূর্ব কোনও চাপের কাছে? আমরা ভাবতেই পারিনি বরিষ্ঠ বিচারপতিরা আদালত থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এসে বলতে পারেন যে গণতন্ত্র বিপদে পড়েছে? আমরা ভাবতেই পারিনি এত বড় দেশের এই বিপুল সংখ্যক মানুষের চোখের সামনে অর্থহীন ক'টি শব্দে পরিণত হতে পারে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্যের অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা ? আর চোখের সামনে একের পর এক এই সব অভাবনীয়কে দেখতে দেখতে আমরা সব সয়ে নিলাম ! আমরা সয়ে নিলাম একের পর এক গণহত্যা। আমরা সয়ে নিলাম দাঙ্গায় অভিযুক্ত নির্বাচনে জিতে সংসদে যেতে পারে। আমরা সয়ে নিলাম মহাত্মা গান্ধীর ঘাতককেও দেশপ্রেমিক বলা যায়। শহীদ পুলিশ অফিসারকে বলা যায় দেশদ্রোহী। আমরা সয়ে নিলাম নির্বাচন কমিশনের বেনজির মেরুদণ্ডহীন আচরণ। এমনকী আমরা সয়ে নিয়েছি দেশের সংখ্যালঘু মানুষের সঙ্গে ভারত সরকারের ব্যবহার বিষয়ে আন্তর্জাতিক গালমন্দ ।সব কিছু সয়ে নিতে নিতে সম্মিলিত ভাবে গর্জে উঠতে আমরা জানি না কবে ভুলে গেছি! আমরা সংবিধান থেকে শিখেছিলাম সহনাগরিকের রুচি, পছন্দ, খাদ্যাভ্যাসে নাক না গলাতে। কিন্তু সেই নাক না গলানোর অভ্যাস চর্চা করতে করতে আমরা আমাদেরই অর্থে আমাদের ধন-প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ-পরবর্তী প্রজন্মের বিষয়ে যাঁরা আইন বানাবেন, তাঁরা আমাদের স্বার্থে কাজ করছেন , নাকি আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করছেন, সেই একান্ত নিজস্ব প্রয়োজনীয় বিষয়ে নাক গলাতেও ভুলে গেছি। তাই পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের আইনি স্বার্থরক্ষার মূল কান্ডারী অ্যটর্নি জেনারেল সুপ্রিম কোর্টে দাঁড়িয়ে অনায়াসে বলতে পারেন ভোটদাতাদের জানার কোনও অধিকার নেই কোন রাজনৈতিক দল কার থেকে চাঁদা পাচ্ছে।
লাল কেল্লায় দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী অনায়াসে বলতে পারেন এক দেশ এক সংবিধান হয়ে গেছে। এইবার এক দেশ এক নির্বাচন। তাতে যে সংবিধানের মারাত্মক অবমাননা হয়, তা প্রধানমন্ত্রীর সম্ভবত মনে নেই কারণ আজকাল সংসদে আইন পাশ হয় সাংসদদের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনা আর বিতর্কের মাধ্যমে নয়, গরিষ্ঠতা আর ভীতিপ্রদর্শনের জোরে। সেভাবেই সংবিধান এখন যে কোনও দিকেই পরিবর্তিত হতে পারবে আর আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের নাগরিকরা নিজেদের ভয়াবহতম সর্বনাশ সহ্য করে নেব না শুধু, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ সম্ভবত নিজেদের সর্বনাশে উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করবেন।