অ্যাভেঞ্জারস ইনফিনিটি ওয়ার সিনেমাটা দেখেছেন? না দেখলে এই আপাত ছুটিছুটি পরিস্থিতির মধ্যে চটকরে দেখে ফেলুন। কেন? এই সিনেমায় একজন দারুন খলনায়কের চরিত্র আছে, তার নাম হল থ্যানোস। তিনি বিভিন্ন গ্রহে গিয়ে সেখানকার জনসংখ্যা অর্ধেক করে দিয়ে আসেন যাতে বাকি অর্ধেক সেই গ্রহের সমস্ত সম্পদ সম্পূর্ণভাবে ভোগ করতে পারে। যদি এই অদ্ভুত যুক্তি আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য না মনে হয়, তাহলে মনে রাখবেন, ডারউইন যার লেখায় ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন, সেই ম্যালথাস সাহেব কিন্তু ১৭৯৮ সালে 'অ্যান এসে অন দা প্রিন্সিপাল অফ পপুলেশন'' বলে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন যাতে উনি জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে খাদ্যাভাব তৈরি হওয়ার একটা সম্ভাবনার কথা আলোচনা করেছিলেন। কাজেই, আলোচনাটা কিন্তু দীর্ঘদিনের। এটাও কিন্তু সত্যি যে এই জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সে মানুষ বা অন্য যে কোনো প্রাণীরই হোক না কেন, তার নিয়ন্ত্রণ প্রকৃতি কিন্তু বিভিন্ন ধ্বংসলীলা বা প্রাকৃতিক বির্পযয়ের মাধ্যমে বারংবার করে থাকে এবং করবে।
তাহলে এই কোভিড-১৯ অতিমারী কি প্রকৃতির এরকমই এক অস্ত্র যার সঙ্গে আমাদের এক অসম লড়াই চলছে? উত্তরটা মনে হয়, না। কোভিড-১৯ বা এরজন্য দায়ী যে ভাইরাস,সার্স কোভিড ২ বা তার বিভিন্ন সংস্করণ, এদের কারুরই মারণক্ষমতা এখনো এই পর্যায়ের নয় যে সে এক চরম মহামারীর রূপ নিতে পারে। বর্তমানের উন্নততর স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও খুবই গুরুত্বপূর্ণভাবে বহুল জনসংখ্যার কারণে এই ভাইরাসের অত্যধিক মৃত্যু ঘটানোর ক্ষমতা খুব সম্ভবত নেই। প্রথম বিষয়টি বোঝার জন্য সাম্প্রতিকতম ১৯১৮-১৯২০ সালের আন্তর্জাতিক ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী যা স্প্যানিশ ফ্লু নামেও পরিচিত, তার কথা বলা দরকার। তখনকার সারা বিশ্বের ২৫ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ৫ কোটি এই রোগে মারা যান। সম্ভাব্য কারণগুলি কি ছিল? সময়টা খেয়াল রাখবেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবী। সে অর্থে সমস্ত তথাকথিত ধনী দেশগুলিও রিক্ত, নিঃস্ব। অপুষ্টি, অর্থাভাব চরমে। স্বাস্থ্যব্যবস্থা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। আফ্রিকা বা এশিয়ার উপনিবেশগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। অপুষ্ট, দুর্বল এই সমস্ত মানুষের কাছে যৎসামান্য স্বাস্থ্যব্যবস্থাও পৌঁছনো যায়নি। ফলত দীর্ঘরোগভোগকালীন সময়ে ব্যাক্টেরিয়াজনিত আনুষঙ্গিক সংক্রমণ ঘটতে শুরু করে এবং অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর ও অপুষ্টিজনিত কারণে রোগপ্রতিরোধক্ষমতাহীন বহু মানুষ এই সময় মারা যান। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে কোভিডের ক্ষেত্রে চিকিৎসা কিন্তু অনেকটাই আয়ত্তের মধ্যে। কিন্তু দ্বিতীয় কারণটি কেন? খেয়াল করুন, ১০০ বছর আগের ২৫ কোটি জনসংখ্যা আজ প্রায় ৮০০ কোটি ছুঁইছুঁই। জনসংখ্যার ঘনত্ব সারা পৃথিবীতে, বা একই দেশের বা শহরের বিভিন্ন অংশে কখনো এক রকম থাকেনা। কথা হল ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং সার্স কোভিড ২ জাতীয় ছোঁয়াচে রোগসৃষ্টিকারী ভাইরাস কিন্তু অনেক তাড়াতাড়ি ঘন বসতিপুর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিন্তু কোভিডের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটল না কেন? কেন ভারতের বিভিন্ন শহরের বস্তি অঞ্চলগুলোতে আমাদের আশঙ্কা অনুযায়ী রোগ ছড়াল না বা মৃত্যু ঘটল না? এইখানেই আমরা অনেকেই একটা ভুল করি। আমাদের শরীরে কোনো বীজাণু আগে কখনো আক্রমণ করেছিল কিনা সেটা বুঝবার বিশ্বস্ততম উপায় হল আমাদের রক্তে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধক অ্যান্টিবডি আছে কিনা সেটা দেখা। দেখা গেছে, এই সমস্ত অঞ্চলের বেশীর ভাগ মানুষের রক্তেই কোভিড অ্যান্টিবডি রয়েছে। তার মানে কি দাঁড়ালো? এঁরা প্রত্যেকেই কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন অথচ তাঁদের মধ্যে রোগের উপসর্গ দেখা যায়নি। কেন? দুটো কারণে এই ঘটনা হতে পারে। প্রথমত, তাঁরা সুস্থসবল এবং রোগপ্রতিরোধক্ষমতাসম্পন্ন এবং সেই কারণে সার্স কোভিড ২ র আক্রমণ এঁরা প্রতিহত করতে পেরেছেন। বস্তি অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত স্বাস্থ্যবান মানুষের বাস, এই যুক্তি খুব ধারালো মনে না হওয়াই স্বাভাবিক। দ্বিতীয় সম্ভাবনা হল, কোনো অসুখ হওয়ার জন্য একজন সুস্থ মানুষকে একটি ন্যূনতম সংখ্যার বীজাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে হয়, যেটি প্রত্যেকটি বীজাণুর ক্ষেত্রে আলাদা, এবং এই সংখ্যার থেকে কম বীজাণু এলে একজন মানুষ তাকে প্রতিরোধ করতে পারেন। জনসংখ্যার ঘনত্ব তাহলে কি ভাবে আমাদের কাজে আসতে পারে? ধরা যাক, এই বস্তি অঞ্চলে একজন মানুষ আক্রান্ত হলেন এবং সার্স কোভিড ২ তার মাধ্যমে সমগ্র এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। তর্কের খাতিরে ধরুন, আক্রান্ত ব্যক্তি মিনিটে ১০০টি সার্স কোভিড ২ ভাইরাস বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছেন আর ন্যূনতম ১০,০০০টি ভাইরাস শরীরে ঢুকলে আমাদের কোভিড হতে পারে। এই আক্রান্ত ব্যক্তি ধরুণ এক ক্ষেত্রে রোজ দুজন আর অন্য ক্ষেত্রে কুড়িজন মানুষের সংস্পর্শে আসেন। বোঝাই যাচ্ছে জনসংখ্যা যেখানে বেশী, সেখানকার মানুষজন ন্যূনতম সংখ্যার তুলনায় কম বীজাণু দ্বারা আক্রান্ত হবেন কিন্তু কম জনসংখ্যার ঘনত্বে এই ন্যূনতম সংখ্যাটি অনেক তাড়াতাড়ি পোঁছনো যাবে এবং তাদের রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও অনেক বেশী থাকবে।
তাহলে, রোগপ্রতিরোধ করার জন্য জরুরি হল সাধারণভাবে কোন বীজাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরী করা যাতে আপনি নিজে যেমন রোগের হাত থেকে বাঁচবেন, সেরকম আবার বীজাণু অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে দেবেন না। দুটোভাবে আপনি শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরী করতে পারেন। প্রথম পন্থা এক্ষুণি বললাম, যে বীজাণুর সরাসরি সংক্রমণের মাধ্যমে। দ্বিতীয় উপায় হল, টীকাকরণ। টীকাকরণের সুবিধা কি? এর ফলে যে সমস্ত মানুষ এখনো বীজাণুটি দ্বারা আক্রান্ত হননি, তাঁরাও কিন্তু এর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরী করে ফেলবেন। এই দুই পন্থাতেই কিন্তু তথাকথিত গোষ্ঠীগত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা Herd Immunity যেটা এখন সংবাদমাধ্যমের দৌলতে বহুলচর্চিত, সেটি অর্জন করা সম্ভব। গোষ্ঠীগত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরী হলে লাভ কি? জনসংখ্যার যে অংশ যে কোন কারণেই হোক, অ্যান্টিবডি তৈরী করে উঠতে পারেননি, বাকিরা তাঁদের শরীরে থাকা অ্যান্টিবডি দিয়ে বীজাণুটির সংক্রমণ প্রতিহত করবেন, যাতে বীজাণুটি অ্যান্টিবডিহীন ব্যক্তির কাছে পৌঁছতে না পারে। এর ফলে সময়ের সঙ্গেসঙ্গে রোগটির প্রাদুর্ভাব কমবে কারণ বীজাণুটি বেশীরভাগ মানুষের রোগপ্রতিরোধক্ষমতার কাছে পরাস্ত হবে। তাহলে এই যে আমরা নিত্যনতুন সার্স কোভিড ২ এর বিভিন্ন নতুন নতুন সংস্করণের কথা শুনছি, এই অ্যান্টিবডি কি তার বিরুদ্ধে কাজ করবে? সেটার উত্তর কিন্তু নির্ভর করছে, সেই নতুন ভাইরাসটি পুরনো ভাইরাসগুলোর থেকে কতটা আলাদা, তার উপর। যদি নতুন ভাইরাসটির বাইরের গঠন পুরনোদের থেকে অনেক আলাদা হয়, সেক্ষেত্রে কিন্তু আপনার শরীরে সংক্রমণ বা টীকাকরণ যেভাবেই অ্যান্টিবডি তৈরী হয়ে থাকনা কেন, দুক্ষেত্রেই আপনি অসহায়। আর তা যদি না হয়, মানে পুরনোদের সঙ্গে নতুনদের বাইরের গঠনের মিল থাকে, তাহলে আপনি এর সঙ্গে সহজেই যুঝতে পারবেন, নিশ্চিন্ত থাকুন। আরেকটা কথাও ইদানিং খুব শোনা যাচ্ছে, রক্তে নাকি সার্স কোভিড ২ এর বিরুদ্ধে তৈরী অ্যান্টিবডি বেশীদিন থাকছে না। আসলে কিন্তু থাকার কথাও নয়। আচ্ছা বলুনতো, একজন চল্লিশ বছরবয়সী মানুষ ও একজন পনেরো বছরের কিশোর, কার রক্তে অ্যান্টিবডির পরিমাণ বেশী থাকবে? একজন চল্লিশ বছরের জীবনে যত বীজাণুর সম্মুখীন হয়েছেন, তার সকলের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি যদি তাকে সারা জীবনভোর বানিয়ে যেতে হত, তাহলে তো মহা দুর্গতি। বিবর্তন আসলে আমাদের সমৃদ্ধ করেছে যে, যে কোন পুরনো বীজাণুর আক্রমণ আমাদের শরীর মনে রাখতে পারে এবং যখন সেই বীজাণুটি থাকেনা, তখন তার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরী করা বন্ধ করে দেয়। যদি সে দ্বিতীয়বার আক্রমণ করে, তখন কিন্তু প্রথমবারের তুলনায় অনেক তাড়াতাড়ি তার বিরুদ্ধে প্রচুর অ্যান্টিবডি তৈরী হয়। কাজেই বারবার টিকা নিয়ে অ্যান্টিবডি তৈরী করার কোন প্রয়োজন নেই, ভাইরাসের জন্য সে ফাঁদ শরীর আগেই তৈরী করে রেখেছে।
এই লম্বা আলোচনাটা করলাম কিন্তু একটু ভবিষ্যতের কথা ভেবে। অতিমারীর দিন কি শেষ হয়েছে? কবে আবার সবকিছু স্বাভাবিক হবে? স্কুলকলেজ কি আবার একইরকম ভাবে চালু হবে? এইসব প্রশ্নগুলো সাধারণ মানুষের কাছে এখন অতিমারীর প্রকটতার থেকেও অনেক প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। জীবন ও জীবিকা যে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন অনেক আর উত্তরগুলোও অনেকটাই ভবিষ্যতের কাছে লুকিয়ে। কিন্তু এই সংশয়, দ্বিধা এগুলো কি একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক? নাকি আসলে আমাদের মনের ভিতরের লুকিয়ে থাকা অদৃষ্টবাদী সত্ত্বাটা সামনে এসে পড়ছে। অথবা কেউ বা কারা এই সংশয়ের বাতাবরণের মধ্যেই তাদের কাজ হাসিল করছে আর আমরা হ্যামলিনের বাঁশি শুনে সেই মুষিককুলের মতোই আচরণ করছি? আমাদের মত দেশে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে শিক্ষাই কিন্তু একমাত্র ভবিষ্যতের সঙ্গে বাঁচবার উপায়। একটা মজার জিনিস হল পৃথিবীর প্রায় সব দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনি ভারতীয় অধ্যাপক বা ছাত্র পাবেন আর প্রতি শহরে অন্তত একজন ভারতীয় ব্যবসায়ী পাবেন। এর একটা প্রধান কারণ কিন্তু আমাদের চিরাচরিতভাবে শিক্ষার প্রতি একটা আগ্রহ ও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে সন্তানদের প্রতি শিক্ষার মাধ্যমে বিনিয়োগ। এটা ভেবে দেখবেন, স্কুলকলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রেখে আমরা আমাদের আসল পুঁজি নষ্ট করে ফেলছি না তো? সারা পৃথিবীর সবথেকে বেশী শিক্ষিত কর্মক্ষম যুবকের ঠিকানা কিন্তু আমাদের এই দেশ এবং সারা পৃথিবীর শিক্ষাপ্রযুক্তির নানাবিভাগে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরাই কিন্তু সর্বাগ্রে। সারা পৃথিবীতে যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার চেষ্টা শুরু হয়েছে অন্তত এক বছর আগে, আমরা কিন্তু ভবিষ্যতের লড়াইতে পিছিয়ে যেতে শুরু করেছি। শিশুদের মানসিক বয়স এই ঘরবন্ধ পরিস্থিতিতে পিছিয়ে যাচ্ছে, তাদের শেখার এবং মনে ধারণ করার ক্ষমতা কমছে। ২০২০ সালের একটি বাচ্চার শিক্ষার স্তর ২০২২ সালে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, তার পক্ষে কিন্তু পরে আর এই ব্যবধান মুছে দেওয়া সম্ভব হবে না। শিশুদের ক্ষেত্রে এই ভাইরাস যে খুব একটা বিপজ্জনক নয়, সেই ধারণা এখন আমাদের কাছে অনেকটাই পরিষ্কার, কাজেই অযথা দুশ্চিন্তারও আর কোন অবকাশ নেই। মনে রাখবেন, আপনার সন্তান যখন হাঁটতে শিখেছিল, আপনিই তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেই হাতটা যে তার আজ আবার বড় প্রয়োজন, আপনি কি এগিয়ে আসবেন না? নিজের বাচ্চাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে উদ্বুদ্ধ করুন, তাকে আবার বাঁচতে দিন। নয়তো থ্যানোস কিন্তু সত্যি হবেন, পৃথিবীর সব সম্পদ উপযুক্ত অর্ধেকের জন্য থাকবে, আপনার সন্তান কিন্তু তার মধ্যে নাও থাকতে পারে।
লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজীর অধ্যাপক।