১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি আনন্দ নারায়ণ মুল্লা তাঁর এক ঐতিহাসিক রায়ে বলেছিলেন :
এমন কোনও বিশৃঙ্খল এবং নৈরাজ্যবাদী গ্রুপ আমাদের দেশের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না যাদের তরফে সংঘটিত খুন-হত্যাজনিত অপরাধের রেকর্ডের পাশে আর কোনও সংঘটিত শক্তিকে তুলনায় আনা যায়।—আর এরাই হলো ভারতীয় পুলিশ বাহিনী।
কিন্তু আমাদের দেশের পুলিশ বাহিনী সম্পর্কে এই নির্মম উক্তি সত্ত্বেও এই বিচারপতির বক্তব্যকে কি আমাদের দেশের সরকারগুলি কখনও মান্যতা দিয়েছেন? এই রায়ের এক দশকের মাথায় তো সারা দেশকে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর এই ‘হাড়-হিম-করা’ হত্যাকাণ্ড তো সংঘটিত করেছিল আমাদের দেশের সরকার পোষিত বিশ্বস্ত রাষ্ট্রীয় বাহিনী, যার নাম পুলিশ। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার পংক্তি অনুযায়ী অতি-ক্ষমতাধর পুলিশ তো অবলীলায় দিনকে রাত বানিয়ে দিতে সক্ষম! আর তাদের এই ক্ষমতার উৎস তো স্বয়ং সরকার, আইন এবং অবশ্যই সংবিধানের মান্য বিধান! বিরোধী কণ্ঠস্বরকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে তো সমস্ত ধর্ম-বর্ণের সরকার এই পুলিশকেই ব্যবহার করে থাকে। এই পুলিশই তো এই রাষ্ট্রের পাহারাদার।কোনও কবিকে দেখে পুলিশ তার মাথার টুপি খোলে না!
২
ইন্দিরা গান্ধী আন্দোলনকে ‘বিলাসিতা’ আখ্যা দিয়েছিলেন। স্বভাবতই তিনি এই ‘বিলাসিতা’কেবিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। অন্যত্র তিনি নিজেকে আবার স্বঘোষিত ‘বিপ্লবী’ আখ্যা দিতেও দ্বিধাগ্রস্ততা দেখান নি। আর এরই পরিসূত্রে নিজের বিপ্লবীয়ানা জাহির করতে এবং তার অনুশীলনী পর্যায়ে আন্দোলন নামক ‘বিলাসিতা’র উৎসাদনে বিগত শতকের ষাট-সত্তরের দশকগুলিতে তিনি কী নির্মমতার পরিচয় রেখেছিলেন তা আজ ইতিহাসের অক্ষয় সামগ্রী হিসেবে রক্ষিত রয়েছে। তাঁর প্রথম পর্যায়ের এগারো এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের চার বছর অর্থাৎ মোট পনেরো বছর (১৯৬৬-১৯৭৭ এবং ১৯৮০-১৯৮৪) তথা দেড় দশকের শাসনকালের কালো দিনগুলি এমন অনেক ‘অনুসরণীয়’ উপকরণ রেখে গিয়েছে যা উত্তরকালের শাসকবৃন্দ অবলীলায়এবং নির্দ্বিধায়সেই পথের অনুসারী হয়ে প্রায়োগিক অনুশীলনে অনেক সময় তাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। বিষয়টি বোধহয় আউট-হেরড শব্দের আক্ষরিক অর্থের কাছাকাছি।
একটা সময় তো কংগ্রেস নেতা দেবকান্ত বড়ুয়া শ্লোগান তুলেছিলেন : ইন্দিরাই ভারত, ভারতই ইন্দিরা! মনে রাখা দরকার একসময় ফ্যাসিস্ত ইতালিতে এমনই এক শ্লোগান উঠেছিল : মুসোলিনিই ইতালি, ইতালিই মুসোলিনি! দেবকান্ত বড়ুয়া ফ্যাসিস্ত ইতালির এই শ্লোগানটিকেই সরাসরি অনুসরণ করে ফ্যাসিস্ত মুসোলিনির উত্তরসূরি হিসেবে ইন্দিরা গান্ধিকে সম্মান জানাতে চেয়েছিলেন কি না জানা যায় না।তবে পঁচাত্তরের জুন মাসের শেষের দিকে দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করে ফ্যাসিস্ত মুসোলিনির পথানুসরণে ইন্দিরা গান্ধি তাঁর বিরোধী রাজনীতিক, সাংবাদিক, লেখক-বুদ্ধিজীবীদের রাতারাতি গ্রেপ্তার করে সারাদেশের জেলখানাগুলির শূন্যস্থান পূর্ণ করে দিয়েছিলেন।আর পশ্চিমবঙ্গে তাঁরই বশম্বদ সির্দ্ধার্থশঙ্কর রায় অত্যাচার, গুপ্তহত্যা, পুলিশি হেফাজতে হত্যার বেনজির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন সেইসময়। রাতের অন্ধকারে প্রতিবাদী লেখক-ছাত্রছাত্রী-বুদ্ধিজীবী-সম্পাদক-কবি-নাট্যকার সহ সাধারণ নাগরিকদেরও বাড়ির কড়া নেড়ে পুলিশ তুলে নিয়ে যেত। তারপর তাঁদের অনেককেই আর জীবিত কিম্বা মৃত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই প্রক্রিয়ায় কবি-সাংবাদিক-নকশাল নেতা সরোজ দত্তকে ধরে নিয়ে গিয়ে খুন করে তাঁকে ‘নিখোজঁ’-এর তালিকাবদ্ধ করা হয়েছিল। সেই থেকে পরবর্তী দুটি জমানায় পাঁচ দশকেরও বেশি সময়কাল সরোজ দত্ত আজও সরকারিভাবে ‘নিখোঁজ’-এর তালিকায় রয়ে গিয়েছেন! ইন্দিরা জমানায় পশ্চিমবঙ্গে তাঁর এই বিশ্বস্ত সেবক সিদ্ধার্থশঙ্করকে সমকালে কোনও সরকারি ‘বাম’পন্থী রাজনৈতিক দল ‘আধা-ফ্যাসিস্ত’ বলেছিলেন বলে জানা নেই, যদিও ইন্দিরা গান্ধীকে এই অভিধায় আখ্যায়িত করেছিলেন তাঁরা। এঁদের কাছে অবশ্য উত্তরকালে এই কংগ্রেস ‘আধা-ফ্যাসিস্ত’ অভিধা থেকে মুক্ত হয়েছে এবং বিজেপি-বিরোধী নির্বাচনী সংগ্রামে তাদের ঘনিষ্ট মিত্র হিসেবে সম্মানিত হয়েছে। ইন্দিরার উত্তরসূরি বর্তমান বিজেপি সরকারকে বিপ্লবী বামপন্থীরা ফ্যাসিস্ত বলে চিহ্নিত করলেও এঁরা এখনও সরকারিভাবে বিজেপিকে ফ্যাসিস্ত বলেনি!
ইন্দিরা-সিদ্ধার্থ জমানার যুগলবন্দিত্বে পশ্চিমবঙ্গে পুলিশের বর্বর ভূমিকার যে নিদর্শন উত্তর-সাতচল্লিশে আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম, সাতাত্তর-উত্তর পশ্চিমবাংলায় ‘বাম’ শাসনে পুলিশের সেই ভূমিকার তেমন কোনও পরিবর্তন দুর্নিরীক্ষ্য থেকে গিয়েছিল। ভিখারি পাশোয়ান তো আজও নিখোঁজ! এঘটনা তো ‘বাম’ জমানায় ঘটেছিল। মণীষা মুখোপাধ্যায় তো ‘বাম’ জমানায়ই ‘নিখোঁজ’ হয়েছিলেন! এঁদের কোনও সংবাদ কেউ আজও পায়নি। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের অধ্যাপককে যে পদ্ধতিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তা কোন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হিসেবে গণ্য হতে পারে? সত্তরের দশকে গণহত্যা, খুন সহ অমানবিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত পুলিশ কর্মীদের শাস্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ‘বাম’ সরকার তো রাখেইনি, বরং অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারদের প্রমোশন দিয়ে পুরষ্কৃত করেছিল। নুরুল থেকে সুদীপ্ত সহ শহিদ ছাত্রেরা সুবিচার পায়নি, তাদের হত্যার কিনারা হয়নি আজও। হবেও না কোনদিন। এইসব শহিদ ছাত্রেরা, সত্যি কথা বলতে, সরকার এবং ‘বাম’পন্থী সহ বিরোধীদের বাজার-গরম-করা রাজনীতির অসহায় শিকার হয়ে ওঠেন। অভিযুক্ত পুলিশদের গ্রেপ্তারের দাবি, ন্যায়বিচারের দাবি সমসময়ে বাজার গরম করলেও একসময় শীতল হতে হতে ডিপ ফ্রিজে চিরবিশ্রাম নিতে বাধ্য হয়। আজ পশ্চিমবাংলায় এক দক্ষিণপন্থী শাসকের ‘পরিবর্তনের’ জমানায়ও পূর্বসূরীদের অনুসৃত সরকারী নীতিরই অনুশীলন চলেছে পুরোমাত্রায়। কামদুনি-হত্যার বিচার হয়েছে কি? সেই দাবি আজ বাকশক্তিহীন জড়ভরতের দশা প্রাপ্ত হয়েছে। এমনকি রিজওয়ানুর-হত্যার বিচার—‘বাম’ আমলে এই হত্যাকাণ্ড ঘটলেও এই পরিবর্তনের জমানায় তার ন্যায়বিচার প্রাপ্তির আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা স্কন্দকাটা ভূতের মতো অন্ধকারে ঘুরে বেড়ায়। তখন যিনি এই হত্যার ন্যায়বিচারের দাবিতে অতিমাত্রায় সরব ছিলেন আজ তিনি মুখ্যমন্ত্রীর তখতে বসে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ বেমালুম বিস্মৃত হয়েছেন, যেমন উত্তর-সাতাত্তরে বাংলার ‘বাম’ সরকার তাঁদের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পালনকে উত্তরকালে আদতে মান্যতা দিতে আগ্রহ দেখান নি। তাঁদের মুখ্যমন্ত্রী তো বলেই দিয়েছিলেন: এমন তো কতই হয়ে থাকে! তিনি তো বিরোধীদের ‘নিরামিষ’ আন্দোলনকে ‘আমিষ’ করে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন পুলিশকে। আর পুলিশ অক্ষরে অক্ষরে সেই নির্দেশ পালন করেছিল। ফলে ৩১ অগাস্টের আরও এক শহিদ দিবসেই কলকাতায় শহিদ হয়েছিলেন মাধাই হালদার। সেসব কথা আজ আর ক’জন মনে রেখেছেন?
আসলে ক্ষমতার অলিন্দের অনেকখানি বাইরে থেকে ক্ষমতার তখতে প্রবেশের ছাড়পত্র পেতে এমন অনেক আন্দোলনই করতে হয়, এমন অনেক কথাই বলতে হয়, এমন অনেক জঙ্গিপনাই দেখাতে হয়, এমন অনেক পারফরম্যান্স-ই করতে হয়—যার মধ্যে আন্তরিকতার লেশ মাত্র থাকেনা। সবটাই দেখনদারি। ক্ষমতার সোপান বেয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে এমন অনেক কথাই বলতে হয় যা জনবিবেককে তাৎক্ষণিকভাবে প্রভাবিত করে। তারপর লক্ষ্যে পৌঁছাবার পর নেতা এবং নেতৃত্ব লিদি নদীর জলে স্নান করে মুক্তপুরুষ হয়ে যান! তখন তাঁদের আর অতীতের কথা মনেই থাকে না। এটা যেমন সাতাত্তরের ‘বাম’ সরকারের ক্ষেত্রে সত্যি, তেমনই কিম্বা ততোধিক সত্যি বর্তমান পরিবর্তনের জমানার ‘ঘরের মেয়ের’ ক্ষেত্রেও। রাতের অন্ধকারে বাড়িতে ঢুকে প্রতিবাদ-বান্ধব ছাত্র আনিসকে খুন করার অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে উঠলেও সরকারি নিস্পৃহতা দুর্নিরীক্ষ্য থাকেনি। স্বভাবতই আনিসের হত্যা নিয়ে অনেক চর্চাই হচ্ছে এবং হবে, দাবি এবং গরম গরম কথার অনেক প্রদর্শনীই কার্যকরী থাকবে কিছুদিন। তারপর সবই থিতিয়ে যাবে। যার কান্না তার বুক জুড়ে তা আমৃত্যু জাগরূক থাকবে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনে এই ন্যায়বিচারের দাবির আন্দোলন বিরোধীপক্ষকে তেমন কোনও বাড়তি সুবিধা দেয়নি।আগামি পঞ্চায়েত নির্বাচনে এই ইস্যু কতখানি কার্যকরী থাকবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। আর চব্বিশের সংসদীয় নির্বাচন? তার এখন ঢের দেরি। স্বভাবতই শাসক এবং তার সহযোগী সংস্থাগুলি এই নির্মম হত্যাকাণ্ডটিকে বিভিন্ন পর্যায়িকতার মধ্যে দিয়ে যথাসময়ে যথাস্থানেই পাঠিয়ে দেবে, যেখান থেকে কোনও রাজনৈতিক দলও আর এই অনির্দেশ্য ঠিকানা সন্ধানে উৎসাহী হবে না। অত্যন্ত নির্মম হলেও এটাই সত্যি।
৩
কবি সমীর রায় ইন্দিরা জমানায় তাঁর স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিক্রিয়ায় একটি কবিতা লিখেছিলেন। কবিতাটি সত্তরের দশকে লেখা। কবিতাটি প্রথম শুনেছিলাম বন্ধু শেখর রায় তথা পার্থ (কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্নেহধন্য এবং প্রতিবেশী)-এর মুখে। পরে কবিতাটি গ্রন্থবদ্ধ হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতাটির কয়েকটি পংক্তি হচ্ছে এইরকম:
হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী আমার শাড়ি
ছিঁড়বো ফাড়বো যাখুশি করবো
মহড়া দিচ্ছি তারি
এই মহড়া সেদিনও চলেছিল, আজও চলছে। অতীত তার আপাত জনগ্রাহ্যতার দেখনদারিকে পুঁজি করে আজও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করে চলেছে। এর মোকাবিলায় লড়াই সংগ্রামের যে উজ্জ্বল ধারাবাহিকতা একসময় আমরা দেখেছিলাম আজ তা পথান্থরী হয়েছে। ক্ষমতার দম্ভ একটা সময় আন্দোলনের অদমিত লাভাস্রোতে ভেসে যায়। কিন্তু আন্দোলনের মধ্যেই যদি শীতল-শিথিলতা সনির্মোক সাপের মধ্যে নিঃশব্দে ঢুকে যায়, তাহলে চলতি ব্যবস্থা তো দীর্ঘস্থায়ী হবেই।