পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ভিকি জানেই না সে মার্জারিন খাচ্ছে !

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 201 view(s)
  • লিখেছেন : দেবাশিস সরকার
— না স্যার ! এটা আমার উইকলি নিউজ পেপার । — অত টেকনিক্যাল পয়েন্ট ধরেন কেন ? বেশ ! উইকলি বুলেটিনই বলুন না হয় ! — সে কি কথা ! রেজিস্ট্রেশন আছে বই কি ! না হলে করপোরেশনের অ্যাড ছাপছি কিসের জোরে ?

— না , ডেলি নয় ।  আর ছেচল্লিশ দিন বাদে করপোরেশন ইলেকশন , আমাদের শহরে এখন খবরের হেভি ডিমান্ড ! তাই আমার কাগজও ডেলি বেরোচ্ছে  । পাবলিক নিউজ খেতে চাইছে সকালে বিকেলে চায়ের সঙ্গে, আমিও কিছু কামিয়ে নিই এই মওকায় । হ্যা : হ্যা : হ্যা : !

 

— আজ্ঞে হ্যাঁ, পাঁচজন রিপোর্টার আমার কাগজের । কি? সব টেম্পোরারি ।  পার্মানেন্ট রিপোর্টার রাখব কোত্থেকে ? তাহলে তো    'শিল্পনগরী বার্তা ' না হয়ে  'আনন্দবাজার'  বা 'আজকাল' নাম হোত  কাগজের । হ্যা : ! পার্মানেন্ট রিপোর্টার ! একে মা রাঁধে না ,  তাই আবার পান্তা !

 

— না না , ইলেকশন উপলক্ষে না, আমার কাগজ প্রথম থেকেই বারো পাতার । আপনি কি ফলো করেন ? তাহলে  এক কাজ করেন, ইলেকশন অব্দি আছেন যখন এখানে কিনুন রোজ একখানা করে , মাত্র তিন টাকা তো মোটে, রোজ পাঁচখানা করে ওয়ার্ডের হাল হকিকত নিয়ে লেখা থাকবে ।

— বেশ বলচেন যাহোক ! কর্পোরেশন নির্বাচনে লোকাল কাগজের ভূমিকা নতুন করে আর কি থাকবে ! সেই তো আদিকালের পুরনো ট্রাডিশন !  নাগরিক সুবিধা ঠিকমতো পাচ্ছি কি পাচ্ছি না । এইতো ? এরই হিসাব মতো রুলিং পার্টি থাকবে নাকি বিদায় নেবে  তা ঠিক  করবে ভোটাররা । এই জনমতটুকু  তৈরি করতে সাহায্য করে  প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া । নয় কি ?

— এটা কি বলছেন ?  কলকাতা বেসড মিডিয়া আমাদের শহরের প্রতিটি ওয়ার্ড ধরে ধরে রিপোর্ট ছাপবে কেন ? তাদের পাঠকদের কাছে এই বাংলার কোন একটা শহরের মিউনিসিপাল ইলেকশন মেন ফুড আইটেম নয় । জাস্ট একটা তরকারি মাত্র !  হাঃ হাঃ হাঃ !

— ওঃ ! বারবার বলছি ফুড আইটেম – ফুড আইটেম , বুঝতে চাইছেন না ? সামান্য তিন টাকার কাগজ বিক্রি করে  খরচাপাতি বাদ দিয়ে ক'পয়সা থাকে আমাদের ? সে ভরসায় মাইনে দিয়ে রিপোর্টার রাখা যায় ?

— কামাবো না কেন ? সন্ধ্যে থেকে বাংলা নিউজ চ্যানেলগুলো লক্ষ্য রাখুন , সবকটাই আমাদের শহরের কোনো না কোনো ওয়ার্ড নিয়ে আধঘন্টা ধরে ভ্যাজর ভ্যাজর করছে । এমনি এমনি  ? আবার এ শহরে শুধু আমি নই , তিনটে  তো ছিলই আরো দুখানা নতুন কাগজ গজিয়েছে  এই ইলেকশন উপলক্ষে । তারাও বাজারে নেমে পড়েছে ! 

— বেশ ! বোঝাই তাহলে !  আমাদের শহরে এখন টাকা ওড়ানোর খেলা শুরু হয়েছে ! যে পারছে কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে ভরছে , মাস দেেড়েক  পরেই এই খেলা শেষ , সুতরাং , এই কটা দিনই টাকা কামানোর মরসুম । এরপর লোকসভা, কে পোঁছে আমাদের ? দু'বছর বাদে বিধানসভা, সেখানেও পাত্তা পাই  না ।

— কি ? আরে হেজিটেড করছেন কেন ! ঝেড়ে কাশুন না !  ও ! এই কথা ! টাকা কিভাবে আসে ? স্পনসররা দেয়  –

 — হ্যা :হ্যা : হ্যা : ! বোঝাচ্ছি– না দাদা ! ফুটবলার বা ক্রিকেটারের জার্সিতে বা টিভি সিরিয়ালের আগে পিছে যেসব কোম্পানির নাম লেখা থাকে তারা কি  আমার কাগজে বিজ্ঞাপন দেবে ? এই কর্পোরেশন ইলেকশনে যে সমস্ত ক্যান্ডিডেট লড়ছে তারাই আমার কাগজে বিজ্ঞাপণ দেয় ।

— এক দুজন কেন ? সব্বাই !

এখানে বিয়াল্লিশ খানা ওয়ার্ড জানেন তো ? চারটে পার্টির একশ আটষট্টি খানা ক্যান্ডিডেট । ফাউ হিসেবে আছে গোটা তিরিশেক নির্দল, হরে দরে দুশোখানা স্পনসর আমাদের। কি বিশাল বাজার, ভেবেছেন এর আগে ?

—  ও ! বুঝতে পারেন নি! এখানে কোন লোকাল কাগজ পর পর দেখেছেন কিছুদিন ধরে?

— ও বাবা! ভালো করে খোঁজ খবর না করেই স্টোরি করতে নেমে পড়েছেন? বেশ! আপনি অন্তত দিন দশেক আমার কাগজটাই কিনুন ! রোজ সকালে চকবাজারের নন্দী বুক স্টলে পেয়ে যাবেন। লক্ষ্য থাকে বারো পাতার কাগজটিতে অন্তত তিন – চার খানা ওয়ার্ডের কিছু কিছু সমস্যা নিয়ে যেন লেখা ছাপা থাকে । সঙ্গে চারটে কোয়ার্টার পেজে  অন্তত চারখানা স্পনসরের বিজ্ঞাপন যেন ছাপা হয় !

— হাঃ হাঃ হাঃ ! সব পাখিপড়া করে বোঝাতে হবে স্যার? দেখবেন ছাপা আছে , "'শিল্পনগরী বার্তা" র সমৃদ্ধি কামনা করি ! আমরা নিশ্চিন্দিপুরের সর্বাঙ্গীন উন্নতির জন্য দায়বদ্ধ "। পরের লাইনে শ্রী বা কম অমুক, তমুক নম্বর  ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সিলর বা প্রার্থী । "আপনার শহরকে আরো উন্নত করার জন্য অমুক চিহ্নে ছাপ দিন !" এরপর ক্যান্ডিডেটের দলীয় প্রতীক চিহ্ন। দেখে থাকবেন আগে।

— হ্যাঁ ! তাও থাকে একটা দুটো । 'রাধারানী বস্ত্রালয়" বা 'মামনি জুয়েলার্স' ও বিজ্ঞাপন দেয় মাঝে মাঝে। তবে তাদের রেট ক 'টাকাই বা আর ! লোকাল কাগজের কোয়ার্টার পেজের রেট পাঁচশো  বা এক হাজার হলেই তো যথেষ্ট !

—  হ্যাঁ ! এটা তো অনুমান করাই যায়, অ্যাড পড়ে কোন কাস্টমার কোন দোকানে কিনতে এসেছিল বলে আমি অন্তত শুনিনি ! সিটিং কাউন্সিলর বলে দেয় তাই অ্যাড দেয় , এটাকে কি টাকা কামানো বলে নাকি ?

— পাগল ! ভোটের ময়দানে যারা কব্জির জোর পরীক্ষা করতে নেমেছে তারাই টাকা ওড়ায় ।

— তাও জানতে হবে ? অন্য সব কাগজ বা নিউজ চ্যানেলগুলো কে কত টাকা পায় বলতে পারি না আমার কথা বলতে পারি । আপনি ইনকাম ট্যাক্স বা সিবিআই এর লোক তো নন , হলেও আমার কিছু যায় আসে না , আমার তো দু নম্বরি ইনকাম না , আমার শালির আবদার আপনাকে হাঁড়ির খবর জানাতে হবে  –যতটা পারি বলি !

— যেমন রুগী তেমনি দাওয়াই ! সিটিং কাউন্সিলররা চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার দেয় , বাকি তিনটে পার্টির ক্যান্ডিডেটগুলো  দশ পনেরোর এর বেশি উঠতে চায় না , স্পেস ফাঁকা থাকলে নির্দল ক্যান্ডিডেটলোর অ্যাড ছাপি ।

— ওরা ? বেশি না,  দু থেকে পাঁচ হাজার। বারগেন করতে হয়, দর উঠে  –

— হাসালেন স্যার ! আমি  কি এই  খোঁজ নিতে পারি ? কোনো কোনো বিষয়ে নাক গলানো বারণ আমাদের। আমরা তো আর সিবিআই বা পুলিশ নই। টাকা কোত্থেকে আসছে কেউ বলে? আমার হাতে টাকা আসবে, তারপর ম্যাটার ডিটিপি হবে, ব্যস ! আমার এরিয়া এইটুকু।

— ও ! এটা যেমন আপনি আমি জানি, ওরাও কি জানে না ? আমার ইয়ের কাগজে ওদের বিজ্ঞাপণ ছাপা হলো কি হলো না, তা দেখে কেউ ভোট দিতে আসে না। দেয় এজন্যে যাতে ওদের বিরুদ্ধে আমার কাগজে কিছু লেখা ছাপা না হয়। কেননা এরপর চেয়ারে কে বসবে সেটা একমাত্র মিডিয়াই ঠিক করে দেয়, সেটা ওরা জানে ।

— মানছি আপনার কথা খানিকটা। মানুষ তার চারপাশের জগত থেকে দেখাশোনা আর পত্রপত্রিকার রিপোর্ট পড়ে  সিদ্ধান্ত নেয় এটা খানিকটা ঠিক  –

— ইয়েস স্যার ! খানিকটা, পুরোটা নয় !

— শুনেন ! তর্ক করবেন পরে – আপনি আর আপনারা ক'জন জানেন যে অমুক পার্টি যদি ভোটে যেতে তাতে ভালোই হবে। আমি আর আমরা বলব অমুক না, তমুক পার্টিই ভালো?  হলো ?

— বেশ ! এবার আপনাদের আর আমাদের মতের বাইরেও আরেকটি মত আছে যেটি সমস্ত যুক্তিবাদী মানুষের মগজেও  ফেনাতে থাকে একটানা তার খোঁজ রাখেন কি ? মিডিয়ার জোরের জায়গাটা এখানেই ! 

— আপনারা লেখক মানুষ, মানুষের  হৃদয়ের রহস্য নিয়ে মশগুল  থাকেন , আমাদের কারবার চাক্ষুষ ঘটনা নিয়ে । আপনারা বলেন , 'ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা ', এর বাইরে আর কিছু নেই, তাই তো ? আমরা বলি ,' জগতকে যে মিথ্যা বলা হচ্ছে তার স্বপক্ষে যে যুক্তিগুলি তুলে ধরা হচ্ছে সেগুলি এতোই দুর্বল যে জগৎ মিথ্যা নয় বলে মনে হচ্ছে। জগত তো সত্যিও হতে পারে ' ! মানুষের আবেগ এই খাতেই বয়ে চলে স্যার ! প্রিন্ট মিডিয়ার জোরের জায়গাটা এটাই। বাইডেন থেকে মোদী থেকে দিদি সব্বাই এটা জানে ! হাঃ হাঃ হাঃ !

— আহা ! ইলেকট্রনিক মিডিয়া দুর্বল, সেটা কখন বললাম স্যার ? সেটার বিষয়ে পড়ে আসচি –

— ও ! শুধু কথার কচকচি চলছে বলচেন? বেশ ! পুরনো প্রসঙ্গে ফেরা যাক – আপনি খবরের কাগজের হেঁশেল নিয়ে একটা লেখা তৈরি করার আগে সুলুক সন্ধান নিতে আমার কাছে এসেছেন তো?

— বলবো ! আপনার লেখা আমি পড়িনি কখনো, আমার গিন্নিকে আপনি চেনেন না সে কিন্তু পড়ে আপনার লেখা। খবরের কাগজের সঙ্গে আপনাদের পত্রিকাটিও বাড়িতে আসে  যে ! আমার গিন্নির আবদারই আসে, আমি ওসব উল্টেপাল্টে দেখি না। ওতেই তো আমার শালীর কবিতা ছাপা হল একবার, জানিনা সেটা আপনার সুপারিশেই কিনা, পড়েচেন সেটা ? 

— আমিও না। বাঙালি ইয়াং জেনারেশন পুড়কি জাগলেই ওসব কোবিতা–ফোবিতা, গল্প–টল্প লেখে কিছুদিন –

— বেশ ! থামা যাক ! আমার শালী পরশু বলছিল, আপনি আসবেন খোঁজখবর নেবার জন্যে , তবে তার আগে জেনে নিই আপনি কি ওই কাগজটার এমপ্লয়ি লেখক ? স্কুপ নিতে এসেছেন ?

— জিজ্ঞেস করলাম কেন , তার কারণ আছে স্যার ! কাগজের লোকেরা ভালই জানে যে ভোটের বাজারে টাকা কেন ওড়ে আর কারাই বা ওড়ায় আর কারাই বা কুড়োয় !  হ্যা : হ্যা : হ্যা : ! সামান্য কর্পোরেশন ইলেকশনে জিততে  পারবে  না জেনেও এক এক জন নির্দল প্রার্থী দশ – বিশ হাজার উড়িয়ে দিচ্ছে !

— আরে দাদা , শুধু বিজ্ঞাপন কেন, কোন কোন পার্টির ক্যান্ডিডেট হয়ে দাঁড়াতে গেলে পার্টি ফান্ডেই তিন চার লাখ টাকা ডোনেশন লাগে । জানতেন ?

— বিশ্বাস না হওয়ারই কথা । বেশ , আপনি ভেঞ্চার ক্যাপিটালিজম টার্মটা শুনেছেন ?

— আরে ! আমি কি পন্ডিত নাকি?  কোথায় যেন পড়ছিলাম – এক একটা নির্বাচন প্রার্থীর জন্য যে পুঁজি লাগানো হবে, আগামী পাঁচ বছরে তার দশ–বারো গুণ রিটার্ন আসবে।  এই উদ্দেশ্যে ভোটের বাজারে যে টাকা ওড়ে তার পোশাকি নাম এটা ।

— কে বলছে হচ্ছে না ? রিটার্ন কত হলো না হলো তা চোখে দেখছি না বটে , তবে পুজি যে লাগানো হয় তা তো সবাই জানে !

— যা বাবা ! এটাও জানেন না ? মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো  নানান পার্টি ফান্ডে টাকা দেয় না ? অবশ্য আমাদের দেশের সব এমপি গুলোই তো একশো–দুশো কোটি টাকার মালিক । তারা নিজেরাই –

— অ! আপনি শুধু এই কর্পোরেশন ইলেকশনের খুঁটিনাটি জানতে এসেচেন ? বেশ ! পার্টি পান্ডে দু– চার লাখ ডোনেশন ,প্রচারের পেছনেও দু লাখ , ভোটের দিনে বুথ জ্যাম , ছাপ্পা ভোট এসবের জন্য লাখ দুই , কমবেশি ছ থেকে আট লাখ টাকা পুঁজি  লাগে একটা করপোরেশনের ভোট লড়তে গেলে।

— আরে বাবা ! মাত্র পাঁচ বছরেই ষাট সত্তর লাখের গ্যারান্টি যেখানে সেখানে এই ইনভেস্টমেন্ট অনেকেই করবে। অন্য সব কাগজ কে কত পায় আমি বলতে পারি না তবে এই ভোটের মরশুমে বিজ্ঞাপন ছেপে চার পাঁচ লাখ টাকা কামায় আমার কাগজ। এই ইনকাম থেকেই তো আমার আগামী পাঁচ বছরের কাগজটা ছাপা হবে !

— এইতো মুশকিলে ফেললেন স্যার ! আপনি জিজ্ঞাসা করতে ছাড়ছেন না আবার বিশ্বাসও করতে চাইছেন না ! কথার মাঝে 'এটা কি ওটা কি' জিজ্ঞাসা করে লাইনের গাড়িকে বেলাইন করে দিচ্ছেন বারবার! বিশ্বাস করতে আপনার আটকাচ্ছে কোথায় ? শুনুন তাহলে একটা সত্যি ঘটনা । দিন পাঁচেক  আগে আমার একজন রিপোর্টার এসে বলল , "দাদা ! অমুক নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বলল, 'আমি কোন কাগজে বিজ্ঞাপণ টিজ্ঞাপণ দেব না। গত পাঁচ বছরে আমার কাজ দেখে পাবলিক এমনিই আমাকে ভোট দেবে ।' ভেবে দেখলাম বেশ বিপদ !  পাবলিক এমনি এমনিই যদি ভোট  দিয়ে দেয় তাহলে আমরা রয়েছি কি করতে ? আমরা খাওয়াবো তবে না পাবলিক খাবে ! গেলাম পরদিন সকালে ওর বাড়ি ।

— আহা ! আম খেতে এসেছেন খান না যত খুশি, গাছ গোনার  কি দরকার মশাই ? কত নম্বর ওয়ার্ড কি নাম জেনে কি লাভ ? মালটা তো প্রথমে দেখাই করতে চাইছিল না ! পারলে গেট থেকেই বিদায় দেয়।

— গেট মানে  গেটই !  দুটো লরি পাশাপাশি ঢুকে যাবে এত চওড়া , একতলা বাড়ির সমান উঁচু লোহার গেট ।

— হাসালেন স্যার ! একতলা বাড়ির সামনে  এ গেট মানায় ? বাড়ির  সমান হাইটের  গেট ? এটা অট্টালিকা !

— নয় কেন ? তাও তো এ এখনো মার্সিডিজ কেনেনি, গ্যারেজে মাত্র গোটা পাঁচেক  –

— না  –না ! গেটকিপারের হাতে কার্ড পাঠালাম  – অনেক পরে এলো গেটে, নেহাত সামনে ইলেকশান, তাই বোধহয় এলো –

— না , ভেতরে যেতে বলল না । আমি আমার কাগজের নীতি বললাম। বললাম , যেহেতু পাবলিক নিউজ খেতে পছন্দ করে তাই নিউজ মেকার হতে চাইলে , পাবলিসিটি পেতে চাইলে খরচা করতে হবে । "ফ্যালো কড়ি মাখো তেল, তুমি কি আমার পর ?"

— অত সহজে হবে ? সেই একই বুলি আওড়াল যা আমার রিপোর্টারকে বলেছিল । উত্তরে , মালটাকে হতভম্ব করে দিয়ে গেটে দাঁড়ানো অবস্থাতেই ওর গোটা কয়েক  স্ন্যাপ নিলাম প্রথমে । এরপর ওর গেটের বাইরে বেরিয়ে রাস্তা থেকে ওর প্রাসাদের গোটা কয়েক ছবি তুললাম । ওতো বেশ ঘাবড়ে গিয়েই , " অ্যাই ! এসব কি হচ্ছে ? ফটো তুলছেন কেন ? " চিৎকার করছিল ।

— আরে না না ! কিসের ব্ল্যাকমেল বা ভয় দেখাবো ? রাজপ্রাসাদের মতন বাড়ি ? সামান্য পঞ্চায়েত মেম্বারও আজকাল দিল্লিতে বা কলকাতায় তিন হাজার স্কোয়ার  ফুটের ফ্ল্যাট বুক করছে ! তোলা ছবিগুলো ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে এনে ওকে দেখালাম সব । এবার বললাম মোক্ষম কথাটা !

— বলছি রে বাবা ! ওর চোখ মুখের ভাব দেখে বুঝলাম ছবিগুলি বেশ পছন্দ হয়েছে ওর । ওকে জিজ্ঞেস করলাম, " রাস্তা থেকে দাঁড়িয়ে বহুবার আপনি দেখেছেন আপনার বাড়ি, এরকম ভাবে গেটেও দাঁড়িয়ে থেকেছেন বহুবার । এসব তো নতুন কিছু নয়, অথচ এই ফটোতে একটু অন্যরকম লাগছে কিনা ? " মালটা ঘাড় নেড়ে সায় দিল। তখন বোঝালাম, চির পরিচিত বা বহুবার দেখা একটি দৃশ্যপটকে যখন দেখি তখন সেটিকে একটি পারিপার্শ্বিকের ভেতর দেখি । কিন্তু  যেই  –

— হাসালেন স্যার ! ওর কাছে এত ভালো বাংলা বললে ও ঘোড়ার ডিম বুঝবে । আপনি লেখক মানুষ তাই এভাবে বলছি । ওকে বললাম ,  বহু চেনা একটা মানুষকে বা জিনিসকে যখন ভিড়ের মধ্যে দেখি তখন সেটি একটি মামুলি দৃশ্য মাত্র । কিন্তু যেই সেটিকে একটি ফ্রেমের ভেতরে রেখে দেখব সেটি কিন্তু তখন আর মামুলি বা সাধারণ দৃশ্য না হয়ে একটি চমৎকার দৃশ্য হয়ে উঠবে । ট্রেনের জানালার ফ্রেমের ভেতর দিয়ে একটি পুকুর বা তার পাড়ে দুটি তালগাছ চমৎকার লাগে দেখতে ! কিন্তু যেই  ট্রেন থেকে নেমে  হেঁটে  তার কাছে গিয়ে  দেখবো  সেটি এমন কিছু আহামরি নয় , একটি মামুলি  দৃশ্য  মাত্র । আপনি ফ্রেমবন্দি হতে না চাইলে কোন দুঃখ নেই আমার , আপনার ওয়ার্ডেই তো আরও তিনজন ক্যান্ডিডেট লড়ছেন ! তাদেরই কেউ না কেউ ফ্রেমবন্দী হবেন । আমার কাগজে  সপ্তাহে চারদিন মানে তিন চারে বারোশো শব্দের রেট বাহান্ন হাজার টাকা । মালটা গুম হয়ে ভাবতে শুরু করল ! আমার কার্ডটা ওর সামনে ফেলে দিয়ে ওর দিকে পিছন ফিরে হাঁটা  শুরু করলাম ।

— হ্যাঁ হ্যাঁ ! নাহলে আর এত সাতকাহন করছি কেন ? পরদিন দুপুরেই ফোন ! আমি জানতাম ফোনটা আসবে , দরাদরি করতে চাইছিল , স্রেফ ' না ' করে দিলাম ।

— আরে দাদা ! কলকাতার নিউজ চ্যানেলগুলো তো একটা পনেরো মিনিটের স্লটের এর জন্য এক  লক্ষ টাকা নিচ্ছে !

— শুনুন দাদা ! আপনি মানুষের মগজের পুষ্টি বা বদহজম সাপ্লাই দেন আমার কাজ মানুষের  খবরের  খিদে  মেটানো । আমার রান্নাঘরের হাঁড়ি কড়াই সব উল্টোপাল্টে দেখালাম আপনাকে , তাই তো ? আপনার রান্নাঘর নিয়ে আমি কিন্তু কোন কৌতুহল দেখাই নি ! মরালিটির কথা বলচেন ? হায়  দাদা ! আপনাদের শরৎ , বঙ্কিম চাটুজ্যেরা কি এসব মাল মশলা দিয়ে তাদের নভেলের ভিত বানিয়েছেন ? আপনিও কি ওই একই মাল দিয়ে –

— সরি ! ঠিক আছে ! ব্রেক কষলাম – হেঁ হেঁ হেঁ ! আপনি চাইছেন কাগজের রিপোর্টাররা প্রফেশনাল এথিক্স মেনে চলবে । মন্দ না ! অন্য সবাই মানছে তো ?

— ইয়েস স্যার ! পাবলিকের সঙ্গে আমার  প্রডিউসার – কনজিউমার , সেলার –কাস্টমার সম্পর্ক । ওরা খায় আমি বানাই । ভেবে দেখবেন , আপনিও তাই !

— নয় কেন ? পাবলিকের চাহিদা আপনার ম্যাগাজিনের এডিটর বোঝেন । তার রোলটা ঠিক  রেস্টুরেন্টের ক্যাশে বসে থাকা মালিকের মতো ! পাবলিক যেমন যেমন অর্ডার দেয় আপনারা তেমন তেমন বানিয়ে গরমা গরম সার্ভ করেন ! নয় কি ! হ্যা : হ্যা : হ্যা : !

–  ওকি ! মুখ গোমড়া হয়ে গেল ? তুলনাটা পছন্দ হলো না ? আরে  দাদা ! সেই যে রবীন্দ্রনাথ না কে যেন  বড় এক  লেখক বলেছিলেন না , ' পৃথিবীটা একটা স্টেজ আর আমরা সবাই একেক জন  অ্যাকটর ? ' মনে পড়ছে ? উনি আজ  বেঁচে থাকলে বলতেন, পৃথিবীটা একটা বড় রান্নাঘর আর আমরা যারা লেখালেখি করে দুটো পয়সা  বা নামডাক কামানোর ধান্দা করি তারা সবাই এক একটা  রাঁধুনি !  মিডিয়া যা পরিবেশন করবে এখনকার পাঠক সোনামুখ করে তাইগব করে গিলে নেবে ! হ্যা! তবে হ্যাঁ, একটু মসলা-টশলা মেশাতে হবে !  হ্যা : হ্যা :  হ্যা: ! নয় কি ?

।  দুই ।।

 

– হ্যাঁ  গ বৌদি ! পুলুশেরও আবার 'ওপিসার ' হয় নাকি ? সিটা আবার কিরকম পুলুশ গ ? দারোগার চেয়েও উ কি বড় কুনু পুলুশ বঠে না কি ?

– জিগালম  কি আর  সাধে ? কাল সনঝ্যেয়  'বকুল কথা' 'সিরাল'টায় যা দেখালেক তাথে ইটা আনজাদে  বুইলম  কি পুলুশের  ওপিসার মানে হচ্ছে কি সে দারোগা ফারোগার  থেকেও বড়  কুনু পুলুশ । তাই জিগাচ্ছি এখন ।

– অ ! তুমি দেখ  নাই ? ক্যানে ? 'কারেন' ছিল  নাই ? নাকি  ঘরে লোক আইছিল ?

– ই বাবা ! তা উয়াদের  কুনু আক্কেল নাই ? তুয়ারা  না হয় নাই দেখলি, সিটা  হতেই  পারে , সবাইকার  'টেস' যে একোই হব্যাক তার ত মাথার  দিব্যি কিছু নাই ! তাই বলে সিরাল দেখার  টাইমে লোকের ঘরে যাস কি করে ?

– হঁ ! সে ঠিকেই আছে। আজ দুফরে দেখে লিবে  না হয়। 'বকুল'কে ত তুমার পছন্দ, লয়? দুফরে  ভাতের বেলায়ও দেখায় একবার । আমার ত তখন ঘরে বসে দেখবার  উপায়  নাই । ওই সময়ে সেন বৌদির ঘরে কাচা, বাসন ধুয়া  আছে । আমার ঘর  ফিরতে ফিরতে সেই বইকাল  তিনটে ।

– যা বলেছ বৌদি ! 'কারেন' না থাকলে  আবার  দুরকমের  কষ্ট ! গরমের কষ্ট  যেমন তেমন , সিরাল না দেখতে পেলে আমার  আর দিদির ঘুমই  আসব্যাক  নাই ! সেই লেগেই  ত  দুজনের  'রজগার' থেকে জেনারেটর লাইনটা লিলম । দুটো  ডুম লাইট  আর টিভি  চলব্যাক  – মাসে পনচাশ  টাকা  ।

– 'রজগার'  বুইলে নাই ? ইনকামও  বলে  অনেকে । আমি চারঘরে , দিদি  পাঁচটা ঘরে । দুজনে পুঁচিশ করে  দিই । তা ধর, ইলেকটিক  লাইনটা আবার টিভির  থেকেও  বেশি  কাজে  লাগে । মশার দাপটটা টুকচু কমে ।

– হ্যাঁ  গো ! শুদু  শনিবার ক্যানে , একটা চেনেলে সবসমতেই  হিন্দি বই আরেকটায়  বাংলা ! কত  দেখবে  দ্যাখ ! গেল রবিবার পসেনজিতের  'মায়ার খেলা' দেখলম। রিতুপন্নাও ছিলেক। সাধে কি আর মাসে মাসে গতর খাটালির পোয়সা দিতে দিদিও রাজি হলেক গ !

– হঁ ! তুমি  ভুলে  গেইছ সব। দিদিও টাকা দিইছিল  বইকি ! তুমি যেমন আড়াই হাজার ধার দিলে দিদিও তেমনি  দত্তদের ঘর  থেকে তিন হাজার লিইছিল। লিজেদের যা জমানো ছিল , তার সঙে  তুমাদের  টাকা , তাথেই  ত  টিভি  আর  কেবিল টিভি  হোল ! তুমি  ভুলে গেইছ  নাকি !

– ই বাবা ! ধীরে ধীরে শোধ দুবো বই  কি !  অধম্ম  হব্যাক  নাই ? বিপদে  টাকা দিলে , এক মাঘে কি  শীত চলে গেল  নাকি ?  আবার বিপদে পড়লে কে উদধার  করব্যাক ?  পুজোর  বোনাস  দেড় হাজার  তুমার  কাছে  লুব নাই  ই বছর , তা বাদে  সামনের  তিন মাস  আমার  ব্যাতন  থেকে  পাঁচশ  টাকা করে কেটে লিবে। হোল ?

 – না  গ ! মা মনসার  কিরে !   লাও , দিব্যি  খেলম ।

— ছিঃ  ছিঃ ছিঃ ! উ কথা ক্যানে ? আজ দুমাস হলেক তুমি মুখ ফুটে একবারের  লেগেও আমাকে টাকার তাগাদা  দাও  নাই । ইটাও  কি কম কথা ! সাধে কি আর  তুমার  ঘরের  কাজ আমি গতর ঢেলে করি !

— লয় ক্যানে ? ওইন্য ঘরের বাসন কি এত টিপে টিপে মাজি, নাকি মেঝেয় ল্যাতা এত চিপে  চিপে ধরে বুলাই ?  তুমার  ঘরের  মেঝে যেমন  পিছলপারা  ওইন্য ঘরে  তুমি  পাবে  কুথায়  ?

— সে দাসবৌদির  কথা ছাড়  ক্যানে ? উয়ার  খুবেই পিটপিটানি । আমি  বলে উয়ার ঘরে  টিকে আছি  এখনও ! সেদিন বলল্যাক  কি – হাই দ্যাখ  গ !  তুমি কথায় কথায়  ভুলায়  দিইছিলে  আমার  পশনোটা  – পুলুশের  ত  কনসটেবল  আর দারোগাই  হয়  শুনেচি  –পুলুশের  ওপিসার কি  আরও বড় আর উঁচু পুলুশ ?

 — শুন ! তুমি দ্যাখ নাই যখন , খুলে বলি  আগে , আজ  বকুলের মরা বাপের নামে একটা পাইজ লিলেক বকুল । বকুলের  সঙে একজন কনসটেবলের  মেয়াও লিলেক  পাইজ । উয়ার পেকেটটা  ছোট  অবশ্য –

— ভালো কাজের লেগে যে পুলুশরা মিত্যুবরণ  করেচে তাদেরই  পাইজ  দিলেক  আজ ।

— কে আবার ? ওই  মন্তি– ফন্তী কেও একজন  দিলেক।  ত, ইটা  আসল পশনো লয়, দেখালেক  কি কনসটেবলের মেয়াটা যখন পাইজ লিলেক, ত্যাখন সেই মন্তি বসে বসেই পাইজ দিলেক আর  সবাই  বসে বসেই  হাততালি দিলেক । বঠে ? ইবার কি হোল  শুন ! বকুলের  বাপের নাম করে  বকুলকে ডাকলেক । বকুলের বাপ ত  ওপিসার ছিল , সেই লেগে  বকুলকে যখন  পাইজ  দিলেক ত্যাখন  সেই মন্তি উঠে  ডাঁড়িয়ে পাইজ  দিলেক  আর সবাই কিন্তু উঠে ডাঁড়িয়েই  হাততালি দিলেক !

– অ বাবা ! ইয়াতে কিছু বুইলে  নাই ? সবোই কি বলে  দিতে  হব্যাক ? ইয়াতেই বুঝা গেল কি  'ওপিসার ' এমন বড়  যে মিত্যুর  পরেও  বুঝা যাবেক কি , কে ছোট আর কে   বড় !  লয় ? কার লেগে  বসে বসে হাততালি  আর কার লেগে ডাঁড়িয়ে  ডাঁড়িয়ে  হাততালি ! বুইলে ?

– সত্যিই  বলছি গ !  মিছা বলে কি লাভ  ? আজ দুফরেই  ত  তুমি  দেখে  লিচ্ছ ।

– তাইলে দ্যাখ ! তুমিও  আমার মতেই মত  দিলে ! ই –ও দেশের জন্যে  মিত্যুবরণ  করেছে  আর উ–ও ! লয় ? তাইলে  উয়ার পাইজ লিতে যখন আলেক  ত্যাখন সবাই  উঠে  ডাঁড়িয়ে  হাততালি  দিলেক ক্যানে ! ইয়াতেই বুঝা গেল কি  ওপিসার এমন বড়  যে  মিত্যুর  পরেও  বুঝা যাবেক , কে বড় আর  কে লয় ! এমন ত লয় , যে কনসটেবলের  মেয়াটার আমাদের মতন  চ্যায়রা , সেই লেগে কেউ উঠে দাঁড়ালেক নাই   আর বকুল সুন্দরী  সেই লেগে সব উঠে দাঁড়ালেক । তুমি কি বল ? তুমার  তিন তলার   মন্ডল  বৌদি  বললেকে  কি , ইটাই ত  ঠিক , বড়  মাইনষের  লেগে শোক দুঃখ একটু  বেশিই হয় । ইটা আমি মানতে লাইরলম ।

 — বল তুমি ! তুমার সঙে আমার  মতের মিল  হব্যাকই  ! মন্ডল  বৌদির কথাটা ওইন্য সব বেলায়  সত্যি হতে পারে , যেমন কিনা ধর ,  হাতি জ্যাখন পাদব্যাক  ত্যাখন  ওইন্য জন্তু বা গাছ প্রজন্ত কেঁপে উঠব্যাক ! বঠে ?  তাই বলে  কি  শিয়াল  পাদলেও  তাই হব্যাক ?

— অ! ইটা  খারাপ  কথা ?  ঘরে  ত  দাদা নাই ? তাই ইরকম  খুল্লমখুল্লা  বলচি  গ ! লাও , আর বলবনি ।

— ই বাবা ! হাত চালাচ্ছি  বই কি ! তুমি  ত  দেখেও  দেখছ নাই ! কথা বলতে বলতে  তুমার সব ফান্নিচার  ঝাড়া শেষ । ইবার  ল্যাতা বুলানো । হামাগুড়ি দিয়ে উবু  হয়ে  শুয়ে আমি  ছাড়া কে তুমার ফান্নিচারের  তলা থেকে  ময়লা টেনে  বার করব্যাক  শুনি ? বকবকানিই দেখলে ? লাও , চুপ  মারলম ।

— অ ! সেই লেগে তুমি তাগাদা  মারছ ? আগে  বলবে  ত ! লিয়ে  এস , চা খাবার টাইম  ত  পারাঁই  গেল  বলে ! চা খাঁয়েই না হয়  বাসন ধুবো । লিয়ে এস ! আমিও  হাতটা ধুয়ে লিই ! ঝেঁটা হাতে  ত  আর – !


 

– আঃ ! তুমার  হাতটি বড়  মিঠা    গ ! ইয়ার লেগেই ত  ওইন্য ঘরের  চা মুখে রুচে নাই ।

— আরও শুনবে ? ক্যানে ? দুফরে  কুথাও  যাবে নাকি ? শুন  তবে !  বকুলের  হাতে পাইজটা দেখে খুশি  হওয়া ত  দূর , বকুলের শাওড়ির  মুখ  ভার । শাওড়িটা কেমন বেদো মেয়াছেলা  তুমি চিন্তা কর !

— না , ইটা  নংরা কথা লয় । 'বেদো ' একটা  গাল । আমাদের লেবার কলোনীতে  সবাইই  এই গাল  দেয় !

– ইয়ার  মানে ? উঁ – ধর ক্যানে যার অনেকগুলো  বাপ ।

– বেদো বইকি ! মরা বাপটাকে লিয়ে  প্রজন্ত টানাটানি ! বলে কিনা বকুলের  বাপ  ওপিসারদের পায়ে তেল দিত সবসমতেই , তাই এই পাইজ । লে ! অথচ  দ্যাখ ! তোর ছেলেটার ফাঁড়া কাটানোর  লেগে  মাত্তক  এক বছরের চুক্তিতে বিয়া কইরেছে  মেয়াটা , ক্যানে কিনা গরিবের ঘরের মেয়া , মায়ের চিকিচ্ছার  টাকা  ছিল নি । তোরই  ঘরে সে  এক বছরের লেগে  আইছে ঘর করতে , ক্যানে কি না  ইয়াতে  তোরই  ছেলের  ফাঁড়া কাটব্যাক , তাকে কুথায়   মাথায় করে রাখবি , তা লয় ! কথায় কথায় খুঁত ধরছে ! উয়ার মুয়ে  যেদি ঝেঁটা মারতে পারতম ! বেদো লয় ?

– ও বাবা ! তুমি ইয়ার মদ্যেই সব ভুলে গেইছ  নাকি ? বকুলের  সোয়ামীর মিত্যুযোগ কাটানোর লেগে উয়াদের কুলগুরু  বিধান  দিইচিল  কি একটি সতী মেয়ার সঙে ছেলার  বিয়া দিতে হব্যাক  যে কুমারী বঠে । বিয়ার  পরে  এক বিছানায় এক বছর শুবেক উয়ারা  তবুও  শরীলের কুনু সম্পক্ক হওয়া চলবে নি ! ধর  ক্যানে , ঘি আর আগুন ছুঁয়াছুঁয়ী , উদিকে মরদ জুয়ানের রোখ চেপে গেলেও  মেয়াকে ঠান্ডা থাকতে হব্যাক । কঠিন কাজ লয় কি ! তুমি ত দেখেছ, রেতে দরজা বনদো করে মাগ ভাতারে শুয়ে , মরদটার ছুঁকছুঁকানি  আছেই , বকুল কিন্তুক গলে  যাচ্ছে নি ! তুমি ত  জুয়ান  মেয়ামানুষ, বুঝ  ত সবঅই ! গনগনে  আগুন পাশে থাকলে লিজেকে ঠিক  রাখা কত মশকিল ! লয় ?

— তুমি ধরেচ  ঠিকেই ! উয়ারা মাগভাতার  হলে কি হব্যাক , ই উয়াকে 'আপনি ', 'আজ্ঞে ' করেই  কথা বলে ! উঁহু ! আমাদের মতন , 'তুই মাগী !' কিংবা তুমাদের মতন,'তুমি সোনা!' করে  ডাকাডাকির  ব্যাপারই নাই !  অথচ দ্যাখ , মন্ডল  বৌদি  ইটাও  বুঝতে পারে নাই ! বলে,' ই উয়াকে সনমান করে  তাই আপনি আজ্ঞে —'

— ভালবাসা বাই কি আর ! ধর  ক্যানে , মুসলমান বা  খিশ্চন  ঘরের মেয়া ত লয় ,  হিন্দুর ঘরের মেয়া , জানে মাত্তক এক বছরের চুক্তির বিয়া , তাই সাঁতার না জানলেও কি , ভাতার ডুবে যাচ্ছে দেখে মাথা ঠিক রাখতে না পেরে  লিজেই গভীর জলে ঝপাং করে ঝাঁপাই দিলেক । তারপর ভাতারকে নদীর পাড় প্রজন্ত টেনে লিয়ে এসে আর দম ধরে রাখতে পারল্যাক  নাই , লিজেই  গভীর  জলে ডুবে গেলেক !

– ই বাবা ! এখনই  মরব্যাক  ক্যানে ? উয়ার ভাতারের ত এখনও দু দুটো  মিত্যুযোগ  আছে না কি ? কে বাঁচাব্যাক  উ মরে  গেলে ? তুমি কি মন দিয়ে দেখছ নাই  নাকি  বল দিনি ? ইয়ার জন্যেই ত বকুলকে বিয়া করে ঘরে এনেছে উয়ারা । আমার কি মনে লিছে জানো ? শেষবারের  ফাঁড়াটাতে ভাতারকে বাঁচিয়ে লিজে আর বেঁচে  ফিরব্যাক নাই বকুল ! আমার বড়দির মেয়া  ইলেবেনে পড়ে ইশকুলে । উ কাল বলছিল । বচ্চনের  একটা বহু আগের সিনামায়  নাকি  ইরকম  আছে । তাথেই ত বচ্চনের  ইরকম নামডাক  হোল ! নিজে মরে বন্দুকে বাঁচাইছিল বচ্চন । খুব দুঃখের সিনামা !

– ডাগর  ত  বটেই ! ইলেবেনে  পড়ে। তবু বিয়া হয় নাই  এখনও, ক্যানে কিনা , আঠারো  পুরতে এখনও দু মাস  বাকি । ইদিকে  কন্যাশ্রীর পুঁচিশ হাজার  এখনও বেংকে  আসে নাই ।

 – পাতরো ত রেডিই আছে । কিন্যাশ্রীর  টাকাটায়  বিয়ার  খরচটা খানিকটা উঠে আসতো !

— দুমাস পেরাক । নাইলে  আবার পাড়ার কাউনসিলার , পুলুশ  আর ইস্টার আনন্দ  ছাঁদনাতলায়  এসে জুটব্যাক । দেখেছ ত টিভিতে ।

— যা বলেছ ! সময় কুথায় ? তুমার  যেমন ইসব দেখার  সময় নাই   আমার  ত আরও কম সময় ! কিষ্ট কুথায়  গরু বিচতে যেয়ে ধরা পড়ল্যাক,  কি পার্থকে ঘুষ দিলেই ইস্কুল মাস্টারের চাগরি  মিলছে  কিংবা  ধর ক্যানে , মোদী বা মমতা  কে কার পঁদে  কাঠি  করছে  উসব লিয়ে ভাববার  সময়  কই  আমাদের ? উসব লিয়ে ভাবলে আমাদের চলে ? ভোটের সময় ঘোষদা যে বতামটা  টিপতে বলব্যাক  সেটাই টিপে  দুবো বাবা ! নাইলে আবার 'লক্ষীর ভান্ডার 'কি  ওইন্য কিছু যদি  বনদো হয়ে যায় ক্যানে ! 

– তা লয় ? তুমার ত তবু  সন্ধ্যেবেলায়  ফুরসৎ মিলে  আর আমার  দ্যাখ ! সনঝেবেলায় চান করে  রাতের খাবার  জোগাড় করি  ধড়ফড় করতে করতে । ত্যাতক্ষনে 'বৌদি নম্বর  উয়ান ' আরম্ভ হয়ে গেছে ! উটা  শেষ হতে  না হতে  ওইন্য  চেনেলে কুনু  বই যেদি  দেখবে তার উপায়  নাই , ন'টায়  'বকুল কথা '। রাত দশটার পরে আর টানতে লারি , ঘুমাতে  হয় , কাল ত  আবার ভোরে উঠা ! লয় কি ? তুমারও ত  একোই  কান্ড , লয় ? টিভিটা  আছে বলেই  একটু দম ছাড়তে পারছি  বাবা ! বকুল কালকে কি দারুণ  শাড়িটা পরে রুটি বেলছিল  দেখেছ ? উটা কি  বালুচরী   বৌদি ? কি ঝলমলে  গো!

– আমি চিনব কি  করে ? দিদির মেয়া বললেকে উটা হয়  বালুচরী , লয় ত  কাঞ্জিভরম  হব্যাক । তবে উয়ার সঙে পা ঢাকা জুতোটা  মানায়  নাই ।  জুতো  অমন  সাদা ক্যানে ? বল !

 — কি জানি বাপু ! উয়াদের  ঘরের মেঝে ত ঝকঝকে , পিছলপারা ! ধুলো কুথা পাবে ? তবু  বেটাছেলে , মেয়াছেলে  সবাই ঘরের ভিতরে অমন জুতো পরে থাকে  ক্যানে  গ ! তুমাদের মতন ঘরে ইরকম হাওয়াই চটি পরে থাকলেই পারে । সস্তায় হব্যাক ।

— অ ! এর মদ্যেই তুমার  শেষ ?  দাঁড়াও বাবা ! এই চা  আর ।সনঝের  ওই  টিভি  সিরাল  এইটুকুই  ত  আয়েশ  জীবনে । চা আমি ঘরেও দুবার খাই  ! ইগুলো  জলদি জলদি  শেষ করতে পারব নাই ! এই ত  সামান্য সুখ , বল ! আমরা তো উটা আর টিভিটা লিয়েই বেঁচে আছি । লয় ?

— অ !  শরীলের পোক্কে ক্ষতির ?  ধুরো !   উসব  ভাবার সময় কুথায় ! আর ভেবেই বা কি করব ! ভোট দিয়ে বেরাঁলেই  ত ঘোষদা বা উয়ার চ্যালা চামুণ্ডারা  বুঝে যাবেক কুন বতামটা টিপেছি ! লয় ? তারপর ? ঝোপড়িতে টিকতে পারব  কি ? লাও লাও ! আর চায়ের আমেজটা নষ্ট কোরোনি  !

 

0 Comments

Post Comment