পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ক্রিপটোকারেন্সি

  • 09 April, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1401 view(s)
  • লিখেছেন : অমিত দাশগুপ্ত
পুঁজিবাদ এগোনোর পথে মাঝেমাঝেই ঝাঁকি দিয়েছে, প্রযুক্তির ধাক্কায়। সেই জেমস ওয়াটের স্টিম এঞ্জিন আবিস্কার থেকে,আজকের কম্পুটার, স্মার্টফোন এসবই এক একটি ডিসরাপটিভ বা ওলোটপালোটের প্রযুক্তি। এগুলি এসে মানুষের প্রচলিত ধারণাকে ভেঙেচুরে দিয়েছে। মানুষ তা গ্রহণ করতে নারাজ হলেও শেষমেষ মানতে বাধ্য হয়েছে। বিটকয়েন বা ক্রিপটোকারেন্সি তেমনই এক ভয়াবহ চমৎকার ডিসরাপটিভ প্রযুক্তি। যা মুদ্রা ও অর্থব্যবস্থার উপরে রাষ্ট্র তথা বিপুল শক্তিশালী ব্যাঙ্ক গোষ্ঠিপতিদের নিয়ন্ত্রণ খর্ব, এমনকি লুপ্ত করতে পারে। অনেকেই মনে করেন, মুদ্রা বা টাকার পিছনে রাষ্ট্রের বরাভয় না থাকলে তা চলতে পারে না। তাঁদের মনে করিয়ে দিতে হয়, ঈশ্বর যেমন মানুষের সৃষ্টি তেমনি মুদ্রা বা টাকাও মানুষের সৃষ্টি, লেনদেনের বা বিনিময়ের জন্য। রাষ্ট্র সেই মানুষের সৃষ্ট মুদ্রাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে ও করছে, যেমন করেছে ও করছে মানুষের সৃষ্ট ‘ঈশ্বর’কে। সেই নিয়ন্ত্রণ খর্বিত হওয়ার ভ্রূণও যদি ক্রিপটোকারেন্সিতে থাকে (যা মনে হয় আছে) তাহলে ক্রিপটোকারেন্সিকে আবাহন করা দরকার।

ক্রিপটোকারেন্সিশব্দটিকে ভেঙে দেখলে এতে দুটি ভাগ রয়েছে। ক্রিপটো অর্থাৎ গুপ্ত, কারেন্সি অর্থাৎ মুদ্রা। ফলে ক্রিপটোকারেন্সি হল গুপ্তমুদ্রা, যাকে দেখা যায়না।

কারেন্সি বা মুদ্রার কাজ

সে অর্থে মুদ্রার মূল কাজ হল বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া। এছাড়াও টাকা বা মুদ্রা মূল্য পরিমাপের একক, মূল্যের সঞ্চয়, এবং পরবর্তীতে দেয় দায়ের পরিমাপ হিসেবে কাজ করে। একটু বিশদে যাওয়া যাক। টাকা আমরা কেনাবেচা বা লেনদেনের জন্য ব্যবহার করি, তখন সেটা বিনিময়ের মাধ্যম। টাকার নিরিখে পণ্যের দাম নির্ধারিত হয়, টাকা তখন মূল্য পরিমাপের একক। টাকাকে আমরা সম্পদ হিসেবে জমিয়ে রাখি, টাকা তখন মূল্যের সঞ্চয়। আজকের দেনা কালকে পরিশোধ করা হয়, সেটিও টাকার অঙ্কেই করা হয়, তখন টাকা পরবর্তীতে দেয় দায়ের পরিমাপ। অন্যদিকে টাকা হতে গেলে তাকে সমমানের হতে হবে, সহজে স্থানান্তরযোগ্য হতে হবে, অপচনশীল হতে হবে, টেকসই বা স্থায়ী হতে হবে, এবং সহজবোধ্য হতে হবে। মুদ্রা বা নোট এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যকে মেনে চলে।

কারেন্সির গ্রহণযোগ্যতা

টাকার গ্রহণযোগ্যতা আসে ওই টাকা বা মুদ্রা যারা চালু করে তাদের উপরে বিশ্বাস থেকে। সাধারণত, দেশের কেন্দ্রীয় ব্যঙ্ক বা সরকার মুদ্রা বা টাকার অছি(ট্রাস্টি)। আরেকটি বিষয় হল যখনই চালু টাকার পরিমানের সঙ্গে নতুন করে টাকা বা মুদ্রা ওই অছি চালু করে তখন টাকার দাম সেই মুহূর্তে কমে যায়, কারণ পণ্যের পরিমাণ একই থাকছে ও আগের থেকে বেশি টাকা সমপরিমাণ পণ্য কিনতে চাইছে। কিন্তু ওই অছির কাছে থাকা সামগ্রিক টাকা বা মুদ্রার মূল্য বেড়ে যায়। কারণ তিনিই নতুন টাকার মালিক।

একটা উদাহরণ দিয়ে দেখানো যাক। ধরা যাক কোনো দেশে বছরে কেবল ১০০০০ কিগ্রা চাল উৎপাদিত হয়। ওই দেশে ১০০০০ টাকা চালু আছে। এবং টাকা বছরে ১০ বার হাত ফেরত হয়, অর্থাৎ একটি টাকা হাত ঘুরে বছরে ১০ টাকার কেনাবেচা করে। ফলে ১০০০০ টাকা সারা বছরে ১০০০০০ টাকার কেনাবেচা করবে। সেই ১০০০০০ টাকায় কেনাবেচা হবে ১০০০০ কিগ্রা চাল। ফলে ১ কিগ্রা চালের দাম হবে ১০ টাকা। যদি সরকার বাজারে আরো ১০০০ টাকা ছাড়ে, তাহলে মোট টাকার পরিমাণ হবে ১১০০০ টাকা। ফলে ওই ১১০০০ টাকা ১১০০০০ টাকার কেনাবেচা করবে। যেহেতু চালের উৎপাদন একই আছে তাই ১ কিগ্রা চালের দাম হবে ১১ টাকা। ধরা যাক সরকারের হাতে আগে ১২০০ টাকা ছিল। অর্থাৎ, ১২০ কিগ্রা চালের মূল্য ছিল। টাকা ছাড়ার ফলে সরকারের হাতে ২২০০ টাকা এল। মানে ২০০ কিগ্রা চালের মূল্য এল।

মোট টাকা বা ক্রয়ক্ষমতা সৃষ্টিতে ব্যাঙ্কের ভূমিকা

সাধারণ ভাবে চালু টাকা বিষয়ে এই কথাগুলি জানানোর সাথে সাথে এটুকুও জানিয়ে রাখা দরকার যে, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক বা সরকার অছি হিসেবে যেটুকু টাকা বাজারে ছাড়েন বাজারে মোট টাকা বা ক্রয় ক্ষমতার পরিমাণ তার থেকে বেশি হয়। কেননা, যখন টাকা টাকার মালিক ব্যাঙ্কে রাখে তখন সেই আমানতকারীর ক্রয়ক্ষমতা তার গচ্ছিত আমানতের সমান। কিন্তু ব্যঙ্ক ওই আমানতের অল্প অংশ নগদে জমা রেখে বাকি অংশ ঋণ দেয় যা ওই ঋণগ্রহীতার ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায় ও সে পণ্য কেনে, সেই সূত্রে টাকা আবার ব্যঙ্কে ফেরে। ব্যঙ্ক তার স্বল্প অংশ রেখে আবার ঋণ দেয়। এই প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে। ফলে অর্থনীতির ক্রয়ক্ষমতা বাজারে চালু নোট বা মুদ্রার কয়েকগুণ হয়। যদি কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক মনে করে যে বাজারে টাকার (ক্রয়ক্ষমতা) পরিমাণ কমাতে হবে তাহলে তা ওই ‘স্বল্প অংশ’কে বাড়িয়ে দিতে পারে। বা বাজার থেকে নোট বা মুদ্রা তুলে নেওয়ার জন্য বাজারে ঋণপত্র বা বন্ড ছেড়ে দিতে পারে। বিপরীতে বাজারে টাকার যোগান বাড়াতে হলে উল্টোটা করা যেতে পারে। প্রচলিত নোট বা মুদ্রার ক্ষেত্রে এই ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের আছে।

ঈশ্বরের মত টাকাও মানুষের সৃষ্টি

ক্রিপটোকারেন্সির আলোচনা করার সময়ে প্রচলিত টাকা বা মুদ্রা সম্পর্কে এসব কথা বলে নেওয়া দরকার। কারণ অনেকেরই ধারণা আছে যে, প্রচলিত টাকা ছাড়া মানবজীবন অচল, যদিও ‘টাকা’ সৃষ্টি করেছে মানুষ, যেমন ঈশ্বরও মানুষ দ্বারা সৃষ্ট। তাই টাকার বিভিন্ন ধরণ ছিল ও আছে। ক্রিপটোকারেন্সি পূর্ণমাত্রায় টাকা হয়ে উঠতে পারে কিনা সেটা একটি লাখ টাকার প্রশ্ন। যদি ক্রিপটোকারেন্সি তা হয়ে উঠতে পারে তাহলে ক্রিপটোকারেন্সির ভবিষ্যত রয়েছে, অন্যথায় নয়, অন্তত মুদ্রা হিসেবে নয়।

দেশের কারেন্সি দেশেই গ্রাহ্য অন্য দেশে নয়

আগেই বলেছি, টাকা বা মুদ্রার মূল কাজ হল বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কাজ করা। এবং তা মসৃণ বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে তখনই কাজ করে যখন তা যতদূর সম্ভব সর্বজনগ্রাহ্য হয়। দেশের মধ্যে ওই সর্বজনগ্রাহ্যতা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক বা সরকার কর্তৃক চালু করা টাকার থাকে কারণ রাষ্ট্র থাকে দেশের চৌহদ্দির মধ্যে আইনি বৈধতা প্রদান করে। কিন্তু দেশের বাইরে সেই বাধ্যবাধকতা থাকে না। সেক্ষেত্রে দেশের মুদ্রাটির শক্তির উপর তার গ্রহণযোগ্যতা নির্ভরশীল হয়। যেমন হয়তো বা ডলারের গ্রহণযোগ্যতা ভারতের মাটিতে থাকবে, অন্যত্রও থাকে। কিন্তু ভারতীয় টাকার সেই গ্রহণযোগ্যতা সর্বত্র থাকে না, কিন্তু নেপাল, ভূটানে তা গ্রাহ্য হয়। তবে নেপাল ভূটানের টাকা ভারতের মাটিতে সর্বত্র গ্রাহ্য হয় না। দেশের অভ্যন্তরে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত নিশ্চয়তা সেই দেশের মুদ্রাকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে সর্বজনগ্রাহ্য করলেও বিদেশের মাটিতে তা করে না। তাহলে ডলার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত অন্যত্রও সহজগ্রাহ্য হয় কেন, অন্ততপক্ষে সেই দেশের টাকায় রূপান্তর করা সহজ হয় কেন? কারণ প্রায় সমগ্র বিশ্ব সেটিকে মেনে নিয়েছে তাই। কিন্তু ভূটানের টাকার গ্রহণযোগ্যতা তেমন নয় কেন? কারণ ডলারের যে মান্যতা বিশ্ববাসী দেয় সেটা ভূটানের টাকা, ‘এনগালট্রাম’এর নেই।

ক্রিপটোকারেন্সি হয়ে উঠতে পারে বিশ্বমুদ্রা

তাই বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে বিশ্বজোড়া মান্যতা থাকলে কোনো একটি বা অনেকগুলি ক্রিপটোকারেন্সি বিশ্বমুদ্রা হয়ে উঠতে পারবে। সরকার অনুমোদিত টাকা দেশের মধ্যেও সর্বজনগ্রাহ্য হয় যদি সেই টাকাটির কোনো নকল না থাকে। অর্থাৎ কোনো একটি নির্দিষ্ট নোট কেবল একটিই থাকে (কোনো নকল না থাকে)। ফলে যদি টাকার জাল হওয়ার প্রবণতা তৈরী হয় তাহলে টাকার সর্বজনগ্রাহ্যতা কমবে। অনুরূপে ক্রিপটোকারেন্সিকে বিনিময়ের মাধ্যম হয় উঠতে গেলে সেই মুদ্রার (ক্রিপটোকারেন্সি) উপরে এই বিশ্বাস থাকতে হবে যে তার কোনো নকল নেই। এবং ক্রিপটোকারেন্সিকে সকলে মান্যতা দেবে। সরকার নিশ্চয়তা দিক না দিক সাধারণ মানুষ বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ক্রিপটোকারেন্সিকে মান্যতা দিলেই তা টাকার বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। যেহেতু ক্রিপটোকারেন্সির সর্বাধিক পরিচিত নামটি হল বিটকয়েন তাই এরপর থেকে ক্রিপটোকারেন্সির বদলে ‘বিটকয়েন’ কথাটি ব্যবহার করব।

ব্লকচেইন প্রযুক্তি

ক্রিপটোকারেন্সি চালু করার চেষ্টা চলছে গত শতাব্দীর শেষ দশক থেকেই। কিন্তু নকল করা যাবে না এমন ক্রিপটোকারেন্সি বন্দোবস্ত তৈরি করা সম্ভব হচ্ছিল না। ২০০৮ সালের বিশ্বজোড়া মন্দার সময়ে ‘সাতোসি নাকামোতো’ নামক একজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি বিটকয়েন বন্দোবস্ত শুরু করেন। যেকোনো মুদ্রাকেই এমনটা হতে হবে যা যেকোনো ব্যক্তি তৈরি করতে না পারে বা সেই মুদ্রা সীমিত পরিমাণে থাকবে। প্রচলিত মুদ্রার ক্ষেত্রে সেই সীমা রাষ্ট্র নির্ধারিত, এবং অবশ্যই রাষ্ট্রের প্রয়োজনে পরিবর্তনশীল। বিটকয়েন এমন একটি বন্দোবস্ত যা নিজস্ব ভাবেই নিজের পরিমাণের সীমা নির্ধারিত করেছে। এক্ষেত্রে যে প্রযুক্তির মাধ্যমে তা করা হয়েছে তার নাম ব্লকচেন প্রযুক্তি। এই লেখায় অবশ্যই সেই প্রযুক্তির গভীরে যাওয়া সম্ভব নয়, এবং লেখক তাতে পারদর্শীও নয়। তবে নোট কীভাবে বাজারে ছাড়া হয় সেব্যাপারে না জেনেও আমরা সকলে যেমন টাকা ব্যবহার করি তেমনি ক্রিপটোকারেন্সি কীভাবে কাজ করে না জেনেও তা ব্যবহার করা সম্ভব।

অনেকেই এখন বৈদ্যুতিন অনলাইন ওযালেটের সঙ্গে পরিচিত, যেমন ফোনপে, পেটিএম, আমাজনপে এইসব। ওইসব ওয়ালেটে টাকা রেখে দিয়ে তা থেকে কেনার জন্য টাকা দেওয়া যায় বা লেনদেনের জন্য ওই ওয়ালেট ব্যবহার করা যায়। আমার যদি কোন ওয়ালেটে টাকা থাকে তার থেকে আরেকজনের অনুরূপ ওয়ালেটে টাকা পাঠানো যাবে বা তার থেকে টাকা গ্রহণ করা যাবে। বিটকয়েনের জন্যও অনুরূপ ওয়ালেটের প্রয়োজন। তবে বিটকয়েন কোথায় কত আছে তা সম্পূর্ণ স্বচ্ছ। অর্থনীতিতে যত বিটকয়েন রয়েছে তা সব অপার্থিব বা ভার্চুয়াল। কিন্তু কত রয়েছে, কোন ওয়ালেটে কত রয়েছে তা অংশগ্রহনকারী সকলের জানা। যখনই কোনো বিটকয়েনের লেনদেন হয় তখনই সেই লেনেদেনের ফলে কোনো ওয়ালেটে যা জমা পড়ে ও কোনো ওয়ালেট থেকে যা খরচ হয় ও তার ফলে বিভিন্ন ওয়ালেটে থাকা বিটকয়েনের পরিমাণের যে পরিবর্তন ঘটে তা সমস্ত হিসেব নিকেশের পরে সকলে জানতে পারে। অর্থাৎ প্রতিনিয়ত যে বিটকয়েনের লেনদেন হচ্ছে তা বিটকয়েন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত সমস্ত ওয়ালেট বা লেজারে প্রতিফলিত হবে। ওই সমস্ত লেনদেন এক একটি ব্লকের শৃঙ্খল তৈরি করবে যাকে মূলত: ব্লক চেইন প্রযুক্তি বা ব্লক চেইন লেজার বলা হয়।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরা যাক কোনো একটি গ্রামে যে সমস্ত টাকার লেনদেন হয় তার হিসেব যে যারটা রাখে। ফলে নিজেদের মধ্যে হিসেবের গন্ডগোল হয়। তখন সবাই ঠিক করল যে, কোনো লেনদেন হলেই গ্রামের কোনো একটা জায়গায় সমাবেশিত হয়ে ঘোষণা করা হবে ও সবাই সেই সমস্ত লেনদেনের ফলে তাদের খাতায় যে পরিবর্তন হবে সেটা লিপিবদ্ধ করে সর্বসমক্ষে ঘোষণা করবে। ফলে যদি একজনের সঙ্গে অন্যজনের কোনো গরমিল থাকে তাহলে তা শুধরে নেওয়া যাবে ও তেমন কোনো বিরোধ হলে অধিকাংশের সম্মতির ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া হবে। অর্থাৎ লেনদেনের সঙ্গে পুরো গ্রামের মানুষ বা ব্লক জুড়ে থাকবে।

বিটকয়েন সৃষ্টি

বিটকয়েনের ক্ষেত্রেও অনুরূপ বন্দোবস্ত। বিটকয়েন লেনদেন হলে ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত সমস্ত কম্পুটার ওই লেনদেনের বৈধতা ও যাথার্থ্য নিরূপন করবে সংশ্লিষ্ট এক সফটওয়ারের মাধ্যমে। যখন ওই লেনদেনটির বৈধতা স্বীকৃত হবে তখন যে কম্পুটার বা কম্পুটারসমূহ ওই লেনদেন সম্পূর্ণ করার কাজটি প্রথমে সমাপ্ত করবে তারা একটি বিট কয়েন পাবে। অর্থাৎ তার ফলে একটি নতুন বিটকয়েন সৃষ্ট হবে। এমনভাবেই বন্দোবস্তটি আছে যে ওই সমাপ্তির জন্য মোটামুটি নির্দিষ্ট সময় লাগে। ফলে ওই নির্দিষ্ট সময় অন্তর একটি বিটকয়েন তৈরি হয়। মনে রাখা দরকার বিটকয়েন তৈরী হলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যেক বিটকয়েনের দাম একটু হলেও কমে যায়। কারণ পণ্যের পরিমাণ এক থাকলে টাকার পরিমাণ বাড়লে টাকার দাম কমে।

যেহেতু বিটকয়েন সৃষ্টির ক্ষেত্রে মোটামুটি একটি সীমা নির্ধারিত আছে তাই যথেচ্ছভাবে কেউ তা সৃষ্টি করতে পারেনা। দ্বিতীয়ত, যেহেতু বহু ব্যক্তি তাদের কম্পুটার ব্যবহার করে বিটকয়েনের লেনদেন সংক্রান্ত পদ্ধিতটির সমাপ্তিবিন্দুতে সকলের আগে পৌঁছতে চাইছেন তাই কোনো একজনের কাছে সমস্ত বিটকয়েন চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রহিত। এছাড়াও সর্বাসাকুল্যে ২কোটি ১০ লক্ষ বিটকয়েন চালু হওয়ার পরে নতুন করে বিটকয়েন তৈরি হবে না। অবশ্য বিটকয়েনের ভগ্নাংশ দিয়ে লেনদেন করা যাবে। তবে লেনদেনের যাথার্থ্য নির্ধারণকারীরা পুরস্কৃত হবে কী করে? এক্ষেত্রে যার ভাগে লেনদেন সম্পূর্ণ করার কৃতিত্ব এসে উপস্থিত হবে সে বা তারা লেনদেনের একটি অতিক্ষুদ্র অংশ লেনদেন ফি বাবদ বিটকয়েনের মাধ্যমেই পাবে। যেমনটা ভাবা হয়েছে তাতে বিটকয়েন সৃষ্টি ১৩০ বছর ধরে চলবে।

বিটকয়েন মানব কেন?

যেহেতু আমরা সরকারের উপর বিশ্বাস ন্যস্ত করে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রচলিত মুদ্রাকে ব্যবহার করে থাকি, তাই একটি প্রশ্ন অবশ্যই আমাদের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে যে, বিটকয়েনের বিশুদ্ধতা ও গ্রহণযোগ্যতা কে নিশ্চিত করবে? এক্ষেত্রে অবশ্যই কোনো অছি নেই। কিন্তু ব্লকচেইন প্রযুক্তি থেকে উদ্ভুত সার্বিক স্বচ্ছতা আছে। মনে রাখা দরকার দুই বা ততোধিক ব্যক্তি নিজেদের মধ্যে লেনদেন যেকোনো বিনিময়ের মাধ্যম ব্যবহার করেই করতে পারে। অবশ্যই সেগুলিকে নির্দিষ্ট মানের হতে হবে ও তাদের পরিমাণ সীমিত হতে হবে। এবং সর্বোপরি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে দ্ব্যর্থহীন ভাবে গ্রহণ করতে রাজি থাকবে। বিটকয়েন যদি সকলে গ্রহণ করতে রাজি তাকে তাহলে বিটকয়েন লেনদেন ও বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে প্রচলিত হতে কোনো বাধা থাকবে না, রাষ্ট্র বা সরকার তাকে স্বীকৃতি দিক বা না দিক। যেমন কোনো রাষ্ট্রের নিশ্চয়তা ছাড়াই কড়ি একসময়ে বিনিময় ও লেনদেনের মাধ্যম ছিল।

বিটকয়েনের স্বচ্ছতা ও গোপনীয়তা

বিটকয়েন সার্বিক বিনিময়ের মাধ্যম হতে গেলে বিনিময় ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত সকলের বিটকয়েন লেজার বা খতিয়ান থাকতে হবে। ওই খতিযানের জন্য একটি ব্যবহারকারীর নাম (নিজের না হয়ে কোন ছদ্ম নামও হতে পারে) ও একটি সঙ্কেতচিহ্ন (পাশওয়ার্ড) লাগবে। কিছু কিনতে গেলে বিক্রেতার খতিয়ানে বিটকয়েন পাঠাতে হবে। আগেই বলেছি ব্লকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে সেই বিটকয়েনের অধিকারী ক্রেতা কিনা তা যাচাই হবে। ও লেনদেন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবার পরে পুরো বিটকয়েন ব্যবস্থার মধ্যে থাকা সমস্ত খতিয়ান নবায়িত হবে। সকলে তা জানতে পারবে। কিন্তু কে সেই খতিয়ানের মালিক সেই ব্যক্তিগত তথ্য জানা যাবে না। সেই দিক থেকে বিটকয়েন সম্পূর্ণ গোপন।

রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ক্রিপটোকারেন্সি

বিটকয়েন বা ক্রিপটোকারেন্সি যদি সর্বব্যাপী হয়ে পড়ে তাহলে মুদ্রাব্যবস্থার উপর থেকে রাষ্ট্রের তথা ব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ উঠে যাবে। তদর্থে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থাই অর্থহীন হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাঢ়া বিটকয়েন একটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা। কোনো ধরণের বিদেশি মুদ্রা বিনিময় বন্দোবস্ত লাগবে না। বিশ্ববাজারকে প্রায় মুক্ত করে তুলবে। টাকার উপর থেকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ লুপ্ত হলে ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে রাষ্ট্রের পক্ষে। বর্তমানে যেমন অতি শক্তিশালী ধনী দেশ সেদেশের অপছন্দের কাজ করা কোনো দেশের উপরে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে তা করা অসম্ভব হয়ে উঠেবে বিটকয়েনের দুনিয়ায়।

ক্রিপটোকারেন্সির অনুমোদন

এবারের বাজেটে ক্রিপটোকারেন্সিকে মোটামুটি ভাবে অনুমোদন দিয়ে দেওয়া হয়েছে, চাঁদ সওদাগরের বাম হাতে মনসাকে পুঁজো দেওয়ার মত করে। ক্রিপটোকারেন্সিকে সম্পদ হিসেবে দেখে তার ক্রয়-বিক্রয় থেকে প্রাপ্ত মুনাফার উপর ৩০% কর বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও ক্রিপ্টোকারেন্সিকে লেনদেনের আইনি মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, বা ক্রিপটোকারেন্সিকে প্রথাগত অনুমোদন দিয়ে সে বিষয়ে কোনো নিয়ন্ত্রণমূলক আইন তৈরি করা হয়নি। তবে আমেরিকা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা বিটকয়েনকে অনুমোদন দিয়ে তাকে নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইন তৈরি করেছে। অপরদিকে চিন, আলজিরিয়া, বাংলাদেশ, নেপাল, মরক্কো, ইরাক, কাতার, টিউনিশিয়া, ইরাক ও ইজিপ্টে ক্রিপটোকারেন্সি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ক্রিপ্টোকারেন্সি আদতে নিষিদ্ধ মালদ্বীপ, ভিয়েতনাম, কুয়েত, লিবিয়া, বাহারিন, বুরুন্ডি, ক্যামেরুন, ম্যাকাও, জিম্বাবোয়ের মত অনেকগুলি দেশে।এল সালভাডোর হল এমন একটি দেশ যেখানে বিটকয়েন লেনদেনের আইনি মাধ্যম, অর্থাৎ সকলেই বিটকয়েন গ্রহণ করতে বাধ্য।

ক্রিপটোকারেন্সি এক ওলোটপালোট (ডিসরাপটিভ) প্রযুক্তি

পৃথিবীর প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সবসময়ই প্রচলিত ব্যবস্থাকে ব্যতিব্যস্ত করে ওলোটপালোট করে দিয়েছে। যেমন কম্পুটার ইন্টারনেট। বিটকয়েনও তেমনি এক “ডিসরাপটিভ” বা ওলোটপালোটকারী প্রযুক্তি যা এসে উপস্থিত হয়েছে ও ভবিষ্যতে তা সকলকে মেনে নিতে বাধ্য করবে বলেই মনে হচ্ছে। যারা কেবল বিটকয়েনকে ফাটকা মুনাফার জন্য এক ধরণের সম্পদ ভাবছে তাদের ভাবনায় যে সঙ্কীর্ণতা আছে তা অচিরেই ধাক্কা খাবে বলে মনে হয়।

0 Comments

Post Comment