পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

কর্পোরেট আগ্রাসন – পরিবেশ ও কৃষির রূপান্তর, নতুন রোগের উদ্ভব (দ্বিতীয় অংশ)

  • 14 November, 2023
  • 1 Comment(s)
  • 852 view(s)
  • লিখেছেন : জয়ন্ত ভট্টাচার্য
পাম তেল বেশ কিছুদিন অতি লাভজনক আন্তর্জাতিক ব্যবসা। দানবীয় বহুজাতিক কোম্পানিরা দুভাবে এর উৎপাদন বৃদ্ধি করে – (১) সরাসরি বিভিন্ন দেশের ওপরে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক চাপ সৃষ্টি করে হাজার হাজার হেক্টর জমিতে এর ফলন ঘটায়, কিংবা (২) দরিদ্র বা মধ্য কৃষকদের নগদ মুনাফার লোভ দেখিয়ে জমিতে চাষের ধরণ রূপান্তরিত কর। যেভাবেই করুক, শেষ অব্দি বহুজাতিকের বিলিয়ন ডলার ব্যবসা হয়। অন্যদিকে কৃষির চরিত্র বদলে যায়।

সাদা মানুষের নতুন কৃষি – লোভের নতুন হাঁ-মুখ

১৮২০-৩০-এর দশক থেকেই বিশেষত ইংল্যান্ডে এবং আমেরিকায় অতি ব্যবহারের ফলে মাটির উর্বরাশক্তির জরাজীর্ণ অবস্থা জমিতে সার প্রয়োগের চাহিদা বিপুলভাবে বাড়িয়ে তুললো। ১৮২৩ সালে ইংল্যান্ডে হাড়ের আমদানির পরিমাণ ছিল ১৪,৪০০ পাউন্ডের। ১৮৩৭ সালে সেটা বেড়ে হল ২৪,৬০০ পাউন্ড (£)। একইসঙ্গে বিভিন্ন পাখির নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ মলের (guano) চাহিদা বৃদ্ধি পেতে শুরু করল। ১৮৪১ সালে লিভারপুল বন্দরে ১,৭০০ টন গুয়ানো আমদানি করা হয়েছিল, ১৮৪৭-এ ২২০,০০০ টন। (Hungry for Profit: The Agrobusiness Threat to Farmers, Food, and The Environment, ed. Fred Magdoff, John Bellamy Foster and Frederick H. Buttel, 2000, পৃঃ ৪৪)

শুধু গুয়ানোর সরবরাহ অবাধ রাখার জন্য আমেরিকা ১৮৫৬ সালে আমেরিকার কংগ্রেসে শিল্পপতিদের চাপে Guano Island Act পাশ করিয়ে ফেললো। ১৮৫৬ থেকে ১৯০৩ সালের মধ্যে ৯৪টি দ্বীপখণ্ড এবং পাহাড় দখল করে নিল। যদিও সরকারিভাবে ৬৬টির কথা স্বীকার করা হল। ২০২২ সালেও আমেরিকার দখলে থাকা এরকম দ্বীপের সংখ্যা ৯টি। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৫)

আমরা যদি সময়কাল খেয়াল করি তাহলে দেখব, যে সময়ে চিফ সিয়াটল চিঠি লিখছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে সেরকম সময় দিয়ে এ ঘটনাগুলো ঘটছে। পূর্বোদ্ধৃত দীর্ঘ চিঠিতে এরকম ইঙ্গিতই বারংবার করেছেন রেড ইন্ডিয়ানদের দলপতি। তাঁদের কয়েক শতাব্দি-সিঞ্চিত অভিজ্ঞতায় বুঝেছেন জমির সাথে জমির দখলদারদের এক চিরকালীন বিচ্ছেদ জন্ম নিচ্ছে। পূর্বোক্ত পুস্তকে মন্তব্য করা হচ্ছে – “The decline in natural soil fertility due to the disruption of the soil nutrient cycle accompanying capitalist agriculture, the growing knowledge of the need for specific soil nutrients, and limitations in the supply of both natural and synthetic fertilizers that would compensate for the loss of natural fertility, all contributed, therefore, to a widespread sense of a crisis in soil fertility.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৫)

মানুষ এবং ভূমির মধ্যে এরকম চিরকালীন বিচ্ছেদকে মার্ক্স অভিহিত করেছেন “metabolic rift” বলে – “irreparable rift in the interdependent process of social metabolism”। বেলামি ফস্টার মন্তব্য করছেন – “To insist that large-scale capitalist society created such a metabolic rift between human beings and the soil was to argue that the nature-imposed conditions of sustainability had been violated. “Capitalist production,” Marx observed, “turns towards the land only after its influence has exhausted it and after it has devastated its natural qualities.” (John Bellamy Foster, Marx’s Ecology: Materialism and Nature, 2000, পৃঃ ১৬৩)

“মেটাবলিক রিফট”-এর একটি ধারণা নীচের ডায়াগ্রাম থেকে পাওয়া যাবে।

 

 

           (Metabolic Rift)                         

১৮৮৩ সালে প্রকাশিত হল মার্ক্সের চিরকালের অভিন্নহৃদয় বন্ধু ও কমরেড ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলসের ডায়ালেকটিকস অফ নেচার । বইটি অসম্পূর্ণ চেহারায় ছিল। প্রকৃতির সাথে মানুষের ডায়ালেকটিকাল সম্পর্ক নিয়ে এ পুস্তকে তিনি মৌলিকভাবে আলোচনা করেন। এ পুস্তকে তিনি বলছেন – “যখন আল্পস পর্বতের ইতালীয়রা দক্ষিণের ঢালের পাইন বনকে সম্পূর্ণত ব্যবহার করে নিঃশেষ করে ফেলল, এবং পরে উত্তরের ঢালেও, তখন তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিলনা যে একাজ করার ফলে তারা তাদের অঞ্চলের ডেয়ারি শিল্পের গোড়া ধরে কেটে ফেলছে। আরও কম ধারণা ছিল যে এরফলে প্রায় সারা বছর ধরে প্রবাহিত পাহাড়ি ঝর্ণার জলধারা শুকিয়ে যাবে। শুধু তাই নয় এদের অনুমানেও ছিলনা এর ফলশ্রুতিতে বর্ষার সময় সমতল অঞ্চলে ভয়ংকর জলের প্লাবন নেমে আসবে।” (Dialectics of Nature, Progress Publishers, Moscow, ১৯৮৬, পৃঃ ১৮০)

এঙ্গেলস আরও বলেন – “এভাবে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ স্মরণ করিয়ে দেয় যে বিদেশী মানুষদের ওপরে আমরা যেভাবে বিজয়ীর কর্তৃত্ব কায়েম করি সেভাবে প্রকৃতির ওপরে শাসন চালাতে পারিনা – যেন কেউ একজন প্রকৃতির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে এবং প্রভুত্ব চালাচ্ছে। কিন্তু আমরা আমাদের মাংস, রক্ত এবং মস্তিষ্ক নিয়ে প্রকৃতির এক অংশ হিসেবে অস্তিত্ব ধারণ করি। এবং প্রকৃতির ওপরে আমাদের সমস্ত প্রভুত্বের ভিত্তিতে রয়েছে এই বাস্তবতা যে অন্য সব প্রাণীর তুলনায় আমাদের সুবিধেজনক অবস্থান হল আমরা প্রকৃতির নিয়মকানুনকে আমরা শিখে নিতে পারি আর সঠিভাবে সেগুলো প্রয়োগ করা সম্ভব।” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৮০)

 

কৃষির রূপান্তর – দুর্ভিক্ষ – নতুন রোগ

 

ওপরে আমেরিকার মুনাফার উদগ্র বাসনা থেকে গুয়ানো দ্বীপসমূহ দখল নিয়ে স্বল্প কথা বলেছিলাম। গুয়ানো সাম্রাজ্যবাদের বলি দ্বীপগুলোর চেহারা কি হতে পারে তার একটুকরো চিত্র দেখা যাক। এক ছোট দ্বীপ Nauru বা নাহরু। ১৮৮৮ থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অব্দি জার্মানদের দখলে ছিল। এরপরে কিছুদিন অস্ট্রেলিয়ার দখলেও থাকে।

ওরকম প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর একটি সবুজ দ্বীপের পরিণতি নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর মতো সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে দেখে নেওয়া যাক – “Inch for inch, Nauru is the most environmentally ravaged nation on earth. So much of the island has been devoured by strip-mining begun 90 years ago that Nauruans face the prospect that they may have to abandon their bleak, depleted home ... After generations of mining, the environmental devastation of Nauru is nearly total. Four-fifths of the island has been mined out, leaving behind a pitted, ghostly moonscape of gray limestone pinnacles, some as tall as 75 feet. The only habitable land is a narrow coastal fringe shaded by coconut palms. Because of the mining, even the weather has deteriorated. The waves of heat that rise from the mined-out plateau drive away rain clouds, leaving the sun-baked island plagued by constant drought ... Environmentalists say it is unlikely that the land will ever produce enough food to feed the population.” (Philip Shenon, “A Pacific Island Nation Is Stripped of Everything”, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ডিসেম্বর ১০, ১৯৯৫, পৃঃ ৩)

Nauru-র পরিণতি একাধিক সাম্রাজ্যবাদের সরাসরি লুণ্ঠনের ফলে। কিন্তু ইতিহাস বিখ্যাত “Irish Potato Famine” তো ঘটেছিল বেশি মুনাফার জন্য একই ধরণের ফসল (monoculture agriculture) বছরের পর বছর ধরে একই জমিতে ফলনোর পরিণতিতে – অভিজ্ঞ কৃষকদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্ন ধরণের চাষের ফলে (rotational cropping) যে জমির উর্বরা শক্তি বজায় রাখে এ ধারণা আন্তর্জাতিক মুনাফার কাছে কোন গুরুত্ব বহন করেনি।

এরই একটি পরিণতি হল কুখ্যাত “আইরিশ পোট্যাটো ফেমিন”। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল ন্যূনতম “potato wage”-এর কাহিনীও – “What became known as the “potato wage” enabled the extraction of the most labor for the least cost, driving the cost of labor close to its theoretical minimum. Then disaster struck. The microorganism Phytopthera infestans arrived, presumably from the Americas, and found the effective monocultures of potatoes an ideal background environment for rapid spread. Potatoes rotted in the fields and the storehouses.” (John H. Vandermeer, The Ecology of Agroecosystems, 2011, পৃঃ ৫)

ডাবলিন শহরে এই দুর্ভিক্ষে মৃত হতদরিদ্র শ্রমিকদের স্মরণে রাওয়ান গিলেসপির এক অসামান্য ভাস্কর্য রয়েছে।

 

(Great Famine-Dublin-Rowan Gillespie)

নীচের ডায়াগ্রাম থেকে বোঝা যাবে কিভাবে চিফ সিয়াটলদের মতো জমির অন্তরাত্মার সাথে জড়িয়ে থাকা কৃষকের ভালোবাসা-উপজাত উৎপাদন সর্বোচ্চ মুনাফাদায়ী “মনোকালচার” কৃষিতে রূপান্তরিত হচ্ছে – প্রায় সমগ্র বিশ্বব্যাপী।

 

 

 

কৃষি উৎপাদনে চরিত্রের এই পরিবর্তন নতুন রোগের “প্যান্ডোরা’স বক্স”-এর দরজা খুলে দিয়েছে – “Oil palm, rubber plantation and rice paddy monocultures have reduced species richness compared with primary and secondary forests, and these monocultures are structurally less complex than natural forests typically exhibiting a more uniform age structure, lower or no canopy, sparse undergrowth, less stable and more extreme microclimates, and greater levels of human disturbance and presence. Evidence suggests that such changes related to physical characteristics of the landscape or biodiversity loss itself could favour disease carrying hosts or vectors or increase the efficacy of disease transmission to remaining hosts (in this case people).” (Hiral A. Shah, Paul Huxley, Jocelyn Elmes & Kris A. Murray, “Agricultural land-uses consistently exacerbate infectious disease risks in Southeast Asia”,  Nature, 20 Sptember, 2019, pp. 1-13, পৃঃ ৭)

এবোলার ছড়িয়ে পড়া নিয়েও একই কথা প্রযোজ্য। ২০১৩ সালে এবোলা মহামারি হবার পরে “Did Ebola Emerge in West Africa by a Policy-Driven Phase Change in Agroecology? Ebola's Social Context” শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় (Environment and Planning A 2014, volume 46, pages 2533 – 2542)। এখানে দেখানো হয়েছে ব্রিটিশ পরিচালিত নেভাদার কোম্পানি “ফার্ম ল্যান্ড অফ গিনি লিমিটেড” ৯,০০০ হেক্টর জমি গিনিতে ৯৯ বছরের জন্য লিজ নেয় – ভুট্টা এবং সয়াবিন চাষের জন্য। এরপরে সে জমিতে palm oil উৎপাদন শুরু হয়। এরপরে প্রবেশ করে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং অন্যান্য বহুজাতিক কোম্পানি।

পাম তেল বেশ কিছুদিন অতি লাভজনক আন্তর্জাতিক ব্যবসা। দানবীয় বহুজাতিক কোম্পানিরা দুভাবে এর উৎপাদন বৃদ্ধি করে – (১) সরাসরি বিভিন্ন দেশের ওপরে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক চাপ সৃষ্টি করে হাজার হাজার হেক্টর জমিতে এর ফলন ঘটায়, কিংবা (২) দরিদ্র বা মধ্য কৃষকদের নগদ মুনাফার লোভ দেখিয়ে জমিতে চাষের ধরণ রূপান্তরিত কর। যেভাবেই করুক, শেষ অব্দি বহুজাতিকের বিলিয়ন ডলার ব্যবসা হয়। অন্যদিকে কৃষির চরিত্র বদলে যায়। কৃষকের সামাজিক মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটে। ১৮৭০ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে কিভাবে পাম তেলের বৃদ্ধি ঘটেছে সেটা নীচের গ্রাফ থেকে বোঝা যাবে।

 

ফলাফল? “Bushmeat need not be a default explanation for any given outbreak, however. Field (2009) noted that deforestation, including from oil palm planting, changes foraging behavior of the flying fox, fixating now on horticulture crops, and expands interfaces among bats, humans, and livestock. Fruit bats in Bangledesh transmitted Nipah virus to human hosts by urinating on the date fruit of the planted palm trees humans cultivated.” (পৃঃ ২৫৩৫)

ট্রুথআউট সংবাদ সংস্থার একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায় – “The majority of global deforestation today is driven by multinational corporations, including Cargill, JBS and Mafrig, as well as their creditors BlackRock, JP Morgan Chase and HSBC. These corporations clear acres of land for the mass production of a single cash crop. The Amazon, for example, is primarily being destroyed for products that people in Western countries buy but do not necessarily needpalm oil, sugar cane or various biofuels like ethanol.” (“Deforestation and Monoculture Farming Spread COVID-19 and Other Diseases”, মে ১২, ২০২০)

নামী নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন জার্নালে “গ্লোবালাইজেশন, ক্লাইমেট চেঞ্জ, অ্যান্ড হিউম্যান হেলথ”-এর মতো প্রবন্ধ (এপ্রিল ৪, ২০১৩, পৃঃ ১৩৩৫-১৩৪২)। প্রকাশিত হচ্ছে “Wildfires, Global Climate Change, and Human Health” শীর্ষক দীর্ঘ প্রবন্ধ (নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন, নভেম্বর ২৬, ২০২০, পৃঃ ২১৭৩-২১৮১)

সাম্প্রতিক সময়ে একই জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে “Climate Change and Vectorborne Diseases” শিরোনামে গবেষণাপত্র (নভেম্বর ২৪, ২০২২, ৩৮৭ঃ ১৯৬৯-১৯৭৮)। এই গবেষণায় জানানো হয়েছে – “The Intergovernmental Panel on Climate Change reported with high confidence that the prevalence of vectorborne diseases has increased in recent decades and that the prevalences of malaria, dengue, Lyme disease, and West Nile virus infection in particular are expected to further increase during the next 80 years if measures are not taken to adapt and strengthen control strategies.”

এতে ব্যবহৃত ডায়াগ্রামটি গুরুত্বপূর্ণ।

 

(Pathways between Fossil Fuels and Rising Greenhouse Gases and Vectorborne Diseases - NEJM)

২০১৪ সালে কয়েকজন গবেষক EcoHealth জার্নালে (২৩.০৫.২০১৪) এক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন “Anthropogenic Land Use Change and Infectious Diseases: A Review of the Evidence” শিরোনামে। এ গবেষণাপত্রে দেখানো হয়েছে – “জমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন এসেছে সে পরিবর্তনের ক্ষমতা রয়েছে রোগের dynamics-কে প্রত্যক্ষত বা অপ্রত্যক্ষত বদলে দেবার। জমির প্রসারণের ফলে বেশি করে অণুজীবেরা মানুষের বসবাসের অঞ্চলে প্রবেশ করবে। জমি ব্যবহারের পরিবর্তনের ফলে জনসমষ্টির বিন্যাসের পরিবর্তন ঘটছে, চরিত্রের পরিবর্তন হচ্ছে, ইমিউনিটির প্রতিক্রিয়া এবং পারস্পরিক সংযোগের অর্থাৎ রোগের বাহক ভেক্টর এবং মানুষের এবং রোগের ধারকদের ধরণ বদলে যাচ্ছে।”

 

 

খুব সহজ প্রশ্ন উঠবে – জমির ব্যবহারে পরিবর্তন (ল্যান্ড ইউজ চেঞ্জ) কারা করলো? কি উদ্দেশ্যে? যে উদ্দেশ্যে (খনিজ এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের সম্পদের জন্য) ব্রাজিলের রেন ফরেস্টের ২৫% পুড়িয়ে দেওয়া হয় সে উদ্দেশ্যে? শিল্প বিপ্লব পরবর্তীতে, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, এবং ক্রমাগত নিওলিবারাল অর্থনীতির প্রায়-একমাত্র হয়ে ওঠার পরে, প্রকৃতির উপরে প্রভুত্ব এবং পুঁজির প্রয়োজনে যথেচ্ছ ব্যবহারের বিষময় ফল আমরা ভোগ করছি।

নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন-এ প্রকাশিত (এপ্রিল ২, ২০২০) প্রবন্ধে (“Escaping Pandora’s Box – Another Novel Coronavirus”) বলা হচ্ছে – “আমাদের অবশ্যই এটা বুঝতে হবে যে ৭.৮ বিলিয়ন (৭৮০ কোটি) মানুষের থিকথিকে ভিড়ে ভরা পৃথিবীতে বিভিন্ন ঘটনার একসাথে ঘটা – যেমন, মানুষের চরিত্রের পরিবর্তন, পরিবেশের পরিবর্তন এবং আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্যের অপ্রতুল মেকানিজম – বিভিন্ন অস্পষ্টভাবে লুকিয়ে থাকা প্রাণী জগতের ভাইরাসকে মানুষের দুর্দৈব করে তুলেছে।” মানুষের চরিত্রের পরিবর্তনের মাঝে মুনাফার উদগ্র আকাঙ্খা এবং আধিপত্যের দুর্মর বাসনাও অন্তর্ভুক্ত হবে। ২০১৯ সালে (১১ জুন, ২০১৯) নেচার-এ প্রকাশিত রিভিউ আর্টিকলের শিরোনাম ছিল “Emerging human infectious diseases and the links to global food production”। এখানে ২০২০ সালের মধ্যে পৃথিবীর অনুমিত ১১০০ কোটি মানুষের জন্য জুনোটিক রোগ কি কাণ্ড ঘটাতে পারে সে ব্যাপারে সতর্ক বার্তা রয়েছে।

বিবিসি নিউজ-এ প্রকাশিত (১০.০৯.২০২০) অন্য একটি খবরের শিরোনাম “Wildlife in ‘catastrophic decline due to human destruction, scientists warn”। রিপোর্টে বলা হচ্ছে – “আমরা আমাদের পৃথিবীকে ধ্বংস করে ফেলছি – যে জায়গাটিকে আমাদের বাড়ি বলি আমরা – আমাদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা এবং পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ঝুঁকি নিয়ে। এখন ধরিত্রী আমাদের কাছে মরিয়া SOS পাঠাচ্ছে এবং আমাদের সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।” আরেকটু বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে – “নতুন ধরনের কম্পিউটার মডেল থেকে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে আমরা এখনো আমাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়াকে থামাতে পারি, এমনকি বাসস্থান হারিয়ে যাওয়াকে বিপরীতমুখীও করতে পারি যদি আমরা অত্যন্ত জরুরী ভিত্তিতে সংরক্ষণের জন্য পদক্ষেপ নিই এবং যেভাবে আমরা খাদ্য তৈরি করি ও উদরসাৎ করি সেটাকে পরিবর্তন করা যায়।” এর আগে (৬.০৫.২০১৯)

বিবিসি নিউজ-এ প্রকাশিত অন্য একটি খবরের শিরোনাম ছিল “Nature crisis: Humans threaten 1m species with extinction’”। এ রিপোর্টে স্পষ্ট ভাষায় জানানো হয়েছিল – “১৯৮০ থেকে ২০০০-এর মধ্যে দক্ষিণ আমেরিকায় ১০ কোটি হেক্টর ট্রপিক্যাল ফরেস্ট হারিয়ে গেছে পশুখাদ্যের জন্য পশুচারণের জমি তৈরি করতে এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় পাম অয়েল উৎপাদনের উপযোগী গাছ লাগানোর দরুন। বনের চেয়েও বেশি আক্রান্ত জলা জমি – ১৭০০ সালে যে পরিমাণ ছিল ২০০০ সালে তার ১৩%-এ এসে ঠেকেছে।” সর্বগ্রাসী নিওলিবারাল অর্থনীতি ও কর্পোরেট পুঁজি সমস্ত অণুজীবের বাসস্থান কেড়ে নিয়েছে। তাদের নতুন বাসভূমির ঠিকানা এখন ক্রমাগত মানুষের শরীর হয়ে উঠছে।

Mark Hamilton Lytle তাঁর The Gentle Subversive (2007) পুস্তকে র‍্যাচেল কারসনের দুনিয়া কাঁপানো বই সাইলেন্ট স্প্রিং নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলছেন – “কারসন সামাজিক অ্যাক্টিভিস্টদের নজর পরিবেশের দিকে যাতে নিবদ্ধ হয় সে কাজে সাহায্য করেছিলেন। র‍্যাচেলের পেস্টিসাইডের ওপর আক্রমণের মধ্যে এই অ্যাক্টিভিস্টরা আরও বেশি করে খুঁজে পেয়েছিল কর্পোরেট ক্যাপিটালিজমের বিভিন্ন শয়তানি। লাভের জন্য উদগ্র বাসনা, তাদের অভিমত অনুযায়ী, কোন জনহিতকর কাজ নয়, বরঞ্চ কেমিক্যাল কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করেছিল আরও বেশি বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করতে, যা পৃথিবীর অধিকতর ক্ষতিসাধন করবে। তাদের বিজ্ঞাপনের কুহক জালে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কি মূল্য চোকাতে হচ্ছে সেটা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। সমধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এই বিদ্রোহীরা কারসনের বিশ্বাসকে প্রসারিত করেছে – “জনগণের” অধিকার আছে সেসমস্ত সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার যেগুলো জীবনের জন্য ক্ষতিকর।” (পৃঃ ২০৭)

র‍্যাচেল কারসন তাঁর সাইলেন্ট স্প্রিং (২০০২) গ্রন্থে গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেছিলেন কেঁচোর কথা – ডারউইনের The Formation of Vegetable Mould, through the Action of Worms, with Observations on Their Habits-কে উদ্ধৃত করে। তিনি বলেছিলেন, কেঁচোরা জমির স্তর ইঞ্চি ইঞ্চি করে বাড়িয়ে তোলে এবং জমির উর্বরা শক্তিকে রক্ষা করে। কোথায় গেল কেঁচোরা? অনেকটা “Where have all the flowers gone”-এর মতো।

নিউ ইয়র্ক টাইমস সংবাদপত্রের একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ “How Humanity Unleashed a Flood of New Diseases” (Ferris Jabr, জুন ২৫, ২০২০) অনুযায়ী, মানুষের শরীরের ৬০ থেকে ৭৫% রোগ আসে প্রাণী জগত থেকে। লেখক বলেছেন – “যে সমস্ত অণুজীবেরা আমাদের দেহে রোগ সৃষ্টি করে (Zoonotic pathogens) তারা আমাদের খুঁজে খুঁজে বের করেনা কিংবা কাকতালীয় ভাবে আমাদের ওপরে হোঁচট খেয়ে পড়েনা। যখন প্রাণীদের থেকে মানুষে রোগের প্রবেশ ঘটে কিংবা উল্টোটা হয়, এর কারণ সাধারণত আমরা আমাদের ‘shared ecosystem’-কে নতুন করে গড়ে নিয়েছি এমন এক ভাবে যে পারস্পরিক স্থানান্তর (transition) অনেক বেশি সম্ভাব্য করে তোলে। অরণ্য নিধন, খনি খনন করা, নিবিড় চাষ এবং শহরের লাগামহীন ভাবে বিস্তার ঘটা এদের স্বাভাবিক বাসস্থান ধ্বংস করে দেয়। বনের জীবদের বাধ্য করে মানুষের সমাজে ঢুকে পড়তে।”

 

 

 

কৃষি এবং পশু ফার্মিং-এর নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত নিদর্শন ধরা আছে ইয়ুভাল হারারির স্যাপিয়েনস পুস্তকে – “দুগ্ধখামারগুলোতে একটু অন্যরকম উপায়ে পশুদের ইচ্ছেমত ব্যবহার করা হয়। সাধারণত গাভী, ছাগী কিংবা ভেড়ী শুধুমাত্র বাছুর বা বাচ্চা জন্মের পরেই দুধ উৎপাদন করে, তাও ততক্ষণ পর্যন্তই যতক্ষণ তাদের সন্তানদের সেটা দরকার হয়। এখন, খামারে দুধের জোগান অব্যাহত রাখার জন্য যেটা করা হয় সেটা হল সেইসব বাছুর, ছাগলের বাচ্চা কিংবা ভেড়ার বাচ্চাদের জন্মের পরেই হত্যা করা হয়। আর তারপর যতদিন সম্ভব ততদিন ধরে মায়েদের দুধ দোয়ানো হয়। তারপর আবার তাদের অন্তঃসত্ত্বা বানানো হয়। এটা এখনও খুবই প্রচলিত একটা পন্থা। এখনকার অনেক দুগ্ধখামারে একটা দুধ দেয়া গাভীকে হত্যা করার আগে মোটামুটি বছর পাঁচেক বাঁচে। এই পাঁচ বছর সময়ের প্রায় পুরোটা জুড়েই সে অন্তঃসত্ত্বা থাকে। তাকে প্রতি ৬০ কি ১২০ দিন পর পর নিষিক্ত করা হয় যাতে সর্বোচ্চ দুধ উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়। তার সন্তানকে জন্মের পরপরই তার কাছ থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। গাভীগুলোকে লালন পালন করা হয় পরের প্রজন্মের দুধ উৎপাদনকারী হিসেবে আর ষাঁড়গুলোকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মাংসের খামারে।” (অনুঃ মোস্তাক আহমেদ, শুভ্র সরকার, সুফিয়ান লতিফ এবং রাগিব হাসান, বাংলাদেশ, পৃঃ ৯০)

এরপরে আর নতুন করে কি বলার থাকতে পারে? সমস্যাকে আদ্যোপান্ত হৃদয়ঙ্গম করা, গভীরে ভাবা এবং সামাজিক সংলাপ শুরু করা ছাড়া আর বিশেষ কোন পথ খোলা আছে বলে মনে হয়না। পরবর্তী প্রজন্মের যদি হৃদয় এবং বৌদ্ধিক জগত সম্পূর্ণভাবে রূপান্তরিত হয়ে কেবলমাত্র প্রকৃতিগ্রাসী কোন প্রাণীর মতো না হয় তাহলে তারা আমাদের দিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকাবে – আমরা অন্তত ৩০০ বছর ধরে চলা এই অপরাধগুলোর প্রজন্মগত সাক্ষী ও নীরব মদতদাতা।

এখানেও মার্ক্সের ভাষা ধার করে বলতে হয় –  “In every stockjobbing swindle every one knows that some time or other the crash must come, but every one hopes that it may fall on the head of his neighbour, after he himself has caught the shower of gold and placed it in safety. Après moi le déluge! [After me, the flood] is the watchword of every capitalist and of every capitalist nation. Hence Capital is reckless of the health or length of life of the labourer, unless under compulsion from society.” (ক্যাপিটাল, ৩য় খণ্ড, চ্যাপ্টার ১০, https://www.marxists.org/archive/marx/works/1867-c1/ch10.htm#81)

ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের তরফে ২০০৯ সালে একটি সুবৃহৎ পুস্তক প্রকাশ করা হয় – Awakening Africa’s Sleeping Giant: Prospects for Commercial Agriculture in the Guinea Savannah Zone and Beyond। সে বইয়ের শেষের দিকে বলা হচ্ছে – “এটা বিস্ময়কর নয় যে, সফল বাণিজ্যিক কৃষির বিকাশের ক্ষেত্রে প্রধান পরিচালনা-সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কিভাবে বিভিন্ন মন্ত্রী দপ্তরের মধ্যে সার্ভিস এবং ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে সমন্বয় সাধন করা হবে। এটা সেটা হবে একাধিক স্তরে – বিভিন্ন দপ্তরের বিনিয়োগ এবং পাবলিক ও প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগের মধ্যে মেলবন্ধন করে। এখানে একেবারে ওপরের তলার রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রয়োজন যিনি নিশ্চয়তা দেবেন যে কোন একটি বিশেষ অঞ্চলের কৃষির বিকাশ প্রাধান্য পাবে, যেমনটা ব্রাজিল এবং থাইল্যান্ডের উদাহরণ আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে।” (পৃঃ ১৯২)

এরকম “প্রয়োজনীয়” রাজনৈতিক নেতৃত্বের চেহারা আমাদের দেশে “Forest (Conservation) Rules, 2022”-এর মধ্য দিয়ে দেখা গেছে। নতুন নিয়মে বলা হয়েছে – অরণ্য অঞ্চলের অধিবাসীদের আগাম অনুমতি ছাড়াই যারা প্রাইভেট পুঁজি বিনিয়োগ করবে তারা নির্বিচারে বৃক্ষচ্ছেদন করতে পারতে পারবে।

নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর মতো প্রভাবশালী সংবাদপত্রে ভারতে ফরেস্ট রক্ষার কাজে নিয়োজিত কর্মীদের ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর প্রকাশিত হয়েছিল “Risking Their Lives, for Little Pay, to Guard India’s Forests” (ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২২)।

সংবাদটি সঠিক। কিন্তু অরণ্যকে তো প্রকৃতপক্ষে বাঁচিয়ে রাখে Chief Seattle-এর মতো অরণ্যের সন্তানেরা। তাঁদের অরণ্যের অধিকার আজ লুঠ হয়ে যাচ্ছে কর্পোরেট পুঁজির কাছে। নতুন সংক্রামক ব্যাধি ছড়ানোর মধ্য দিয়ে আগামীদিনে এর বিষময় ফল ভোগ করবে সমগ্র ভারতবর্ষ।

PLoS One জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে (জুন ৩, ২০২২) “State-led agricultural subsidies drive monoculture cultivar cashew expansion in northern Western Ghats, India” শীর্ষক গবেষণাপত্র। এই গবেষণাপত্রের সিদ্ধান্ত – “Our study deepens the understanding of how government-led agricultural subsidies drive farmers’ uptake of cashew cultivars, farmers’ cashew management practices, and how these factors drive deforestation in this landscape at the state and farm level.”

এরপরে বিচারের ভার যুক্তি-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের হাতে। সমাজকর্মীদের হাতে – এমনকি চিকিৎসকদের হাতেও, যেমনটা সায়েন্টিফিক ও মেডিসিনের জার্নাল থেকে দেখলাম আমরা।

 

 

এই লেখকের এই বিষয়ের আগের লেখাটি।

 

কর্পোরেট আগ্রাসন – পরিবেশ ও কৃষির রূপান্তর, নতুন রোগের উদ্ভব (প্রথম অংশ)

 

1 Comments

Soumya Chakraborty

17 November, 2023

Excellent one sir

Post Comment