আরণ্যক উপন্যাসের গোড়াতেই বিভূতিভূষণ জানিয়েছিলেন – “স্বচ্ছন্দ প্রকৃতির লীলাভূমি আমার হাতেই বিনষ্ট হইয়াছিল, বনের দেবতারা সেজন্য আমায় কখনও ক্ষমা করিবেন না জানি। নিজের অপরাধের কথা নিজের মুখে বলিলে অপরাধের ভার শুনিয়াছি লঘু হইয়া যায়। তাই এই কাহিনীর অবতারণা।” আমারও এ প্রবন্ধের অবতারণাও এই একটিমাত্র কারণে।
অনেকের মতে, আমরা এখন যে Anthropocene যুগে বাস করছি সেটা “unofficial unit of geologic time, used to describe the most recent period in Earth’s history when human activity started to have a significant impact on the planet’s climate and ecosystems”। এ যুগে মানুষ, থুরি কর্পোরেট পুজি, সর্বময় কর্তা। যেভাবে ইচ্ছে সে প্রকৃতিকে দুমড়ে মুচড়ে ব্যবহার করে। ছিবড়ে করে ফেলে দেয়। আমরাও আমাদের মননের গভীরে এই মানসিক অবস্থানকে সন্তানবৎ লালন পালন করি। প্রকৃতি আমাদের কাছে wilderness, আমাদের অস্তিত্বের অংশ নয়।
প্রকৃতি মানে একদিকে যেমন মানুষ রয়েছে, অন্যদিকে তেমনি রয়েছে মানুষের চেয়ে লক্ষ কোটি গুণ বেশি অরণ্যানী, বিস্তীর্ণ প্রান্তর, পশু-পাখি-কীট-পতঙ্গের সমারোহ, অগণন অণুজীবের বৈচিত্র, রয়েছে উন্মুক্ত আকাশের নীচের জলপ্রবাহ, পর্বত এবং এই নীল গ্রহ।
শিল্পবিপ্লবোত্তর সময়ে আমাদের দানবিক কার্যকলাপ তছনছ করে দিচ্ছে মহাবিশ্ব (macrocosm) এবং অণুবিশ্বের (microcosm) ভারসাম্য। জলবায়ুর পরিবর্তন থেকে অজানা ভাইরাসের আতংক সবকিছুই আমাদের গ্রাস করছে। অথচ প্রাক-শিল্পবিপ্লব যুগে, বিশেষ করে সর্বময় কর্পোরেট প্রভুত্বের আগে, পৃথিবীর সমস্ত প্রাচীন সভ্যতার অস্তিত্ব ধারণের মূলে যে দার্শনিক ভিত্তি ছিল তা ছিল এই অণুবিশ্ব এবং মহাবিশ্বের মধ্যেকার ভারসাম্য রক্ষার বস্তুগত ভিত্তিকে ধারণ করে। প্রাচীন এই চিত্রায়ন বিষয়টি বুঝতে সাহায্য করবে।
কিন্তু বর্তমান সময়ের বাইরে আরেককটি সময় ছিল। বিশ্বের মানুষ সে সময়ের মাঝে বাস করত। কেমন ছিল, প্রকৃতির সন্তান মানুষের অনুভবে, সে সময়কাল? একবার সে সময়কালকে স্মরণ করে নেওয়া যাক।
কর্পোরেট তাণ্ডবের ইঙ্গিত
আমেরিকার ১৮তম প্রেসিডেণ্ট ছিলেন ফ্র্যাঙ্কলিন পিয়ের্স (Franklin Pierce) – ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৭ সাল অব্দি। তাঁকে ১২ জানুয়ারি, ১৮৫৪ (ভিন্ন মতানুযায়ী ১৮৫৫) সালে রেড ইন্ডিয়ানদের Suwamish এবং Duwamish ট্রাইব-এর নেতা চিফ সিয়াটল (Chief Seattle) একটি চিঠি লেখেন বলে জানা যায়। ৪ জুন, ১৯৭৬ সালে The Irish Times পত্রিকায় এ চিঠি ছাপা হয়। যদিও গবেষকমহলে এ বিষয়ে কিছু মতদ্বৈধ আছে। কিন্তু চিঠিটির অন্তর্বস্তু আমাদের গোচরে আসা দরকার – বিশেষ করে বর্তমান সময়ে। এ চিঠির ভিন্ন ভার্সন (যদিও মূল স্পিরিটে একই রয়েছে) এবং চিফ সিয়াটলের কথা Albert Furtwangler-এর Answering Chief Seattle (Seattle: University of Washington Press, 1997, পৃঃ ১০-১৭) এবং Clarence B. Bagley-র History Progress of King County, Washington (Charles J. Hutchsosn, 1916)-এ ছাপা হয়েছে। বর্তমান চিঠিটি খানিকটা পরিবর্তিত রূপে অনুবাদ করছি। (উৎসঃ “Chief Seattle's Speech” – https://www.historylink.org/File/1427, accessed ৮ আগস্ট, ২০২২)
“Chief Seattle, as seen by Dr. H. A. Smith, 1887” ছাপা হয় History Progress of King County, Washington পুস্তকে। স্মিথ লিখেছেন – “In the early days of Seattle old Chief Seattle ruled the destiny of the tribe. In later years the descendents of his followers have become divided and separated until they are but wandering tribes, eking out a livelihood by fishing, hunting and berry picking.”
(চিফ সিয়াটলের ১৮৬৪ সালের ফটো। তুলেছিলেন E. M. Sammis, Courtesyঃ Seattle Public Library। নীচে চিফ সিয়াটলের কন্যার ফটো।)
প্রায় ১৭০ বছর পরেও চিফ সিয়টলের সে চিঠি আজও প্রাসঙ্গিক। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সে সময়ে আমেরিকার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে (এখন যে অঞ্চল ওয়াশিংটন) Suwamish এবং Duwamishদের কাছ থেকে ২০,০০,০০০ একর জমি জোর করে কিনে নিতে চেয়েছিলেন। তার জবাবে চিফ সিয়াটলের এই চিঠি।
কি লিখেছিলেন চিফ সিয়াটল তাঁর চিঠিতে?
“সে ছিল এক দিন আমাদের” (There Was A Time)
“এক সময়ে আমাদের লোকেরা এই সমগ্র অঞ্চলে পরিব্যাপ্ত হয়ে থাকত, যেমন বায়ু-তাড়িত সমুদ্রের ঢেউ ঝিনুকের খোল বাঁধানো মেঝেকে আবৃত করে রাখে। কিন্তু সে সময় দীর্ঘকাল আগে হারিয়ে গেছে, যেমন হারিয়ে গেছে আমাদের গোষ্ঠীর মহানুভবতার স্মৃতি। কিন্তু আমি আমাদের অসময়ে মৃত্যুর জন্য বিলাপ করব না। একে ত্বরান্বিত করার জন্য আমাদের ফ্যাকাশে-মুখ ভাইদের তিরষ্কারও করব না। হয়তো বা আমাদের নিজেদেরকেই এরজন্য খানিকটা দোষারোপ করতে হয়।
যখন আমাদের যুবকেরা ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে কোন বাস্তব বা কাল্পনিক ভুলের জন্য, এবং নিজেদের মুখমণ্ডল কালো রঙে বিকৃত করে দিয়েছে, তাদের হৃদয়ও তখন বিকৃত এবং কালো হয়ে গেছে। সেরকম মুহূর্তে তাদের নিষ্ঠুরতা বাঁধ মানেনা, নিষ্করুণ হয়ে ওঠে। ওদেরকে সংযত করা যায়না।
কিন্তু আমাদের আশা থাকুক যে লাল-মানুষ এবং তাদের ফ্যাকাসে-মুখ ভাইদের মধ্যে শত্রুতা যেন আর ফিরে না আসে। আমাদের সবকিছুই রয়েছে হারানোর জন্য, জয় করার জন্য কিছুই নেই।
এটা সত্য যে আমাদের বীর যুবকদের প্রতিশোধ নেওয়া, এমনকি নিজেদের জীবনের বিনিময়েও, লাভ হিসেবে মনে করা হয়, কিন্তু যে বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধারা যুদ্ধের সময়ে ঘরে বসে থাকে এবং যাদের সন্তানেরা যুদ্ধে হারিয়ে যায় তারা এই লাভক্ষতি অনেক ভালো বোঝে।
এমনটা কি কখনো হতে পারে? (But Can This Ever Be?)
তোমাদের ভগবান তোমাদের ভালোবাসে আর আমাদের ঘৃণা করে। তাঁর শক্ত দুহাতে সাদা মানুষদের ভালোবেসে জড়িয়ে ধরে যেমন বাচ্চাদেরকে বাবারা ধরে এগিয়ে নেয়। কিন্তু তিনি তাঁর লাল সন্তানদের পরিত্যাগ করেছেন। তিনি তোমাদের প্রতিদিন শক্তিশালী করে গড়ে তুলছেন, আর শীঘ্রই সমগ্র অঞ্চল এরা ভরে ফেলবে – যখন আমাদের মানুষেরা দূরে অপসৃয়মান ঢেউয়ের মতো ক্ষয়ে যাবে, আর কখনো প্রবাহিত হবেনা। সাদা মানুষের ভগবান তাঁর লাল সন্তানদের ভালোবাসতে পারেন না, রক্ষা করতেও নয়। এদেরকে অনাথ বলে মনে হয়, যারা সাহায্যের জন্য দিগন্তের কোথাও তাকাতে পারে না।
কিভাবে আমরা পরস্পরের ভাই হতে পারি? কি করে তোমাদের পিতা আমাদের পিতা হবেন এবং আমাদের সমৃদ্ধি এনে দেবেন? কি করে আমাদের স্বপ্ন থেকে জাগিয়ে তুলবেন আমাদের মহান গুণাবলী সহ?
তোমাদের ঈশ্বরকে পক্ষপাতদুষ্ট মনে হয়। তিনি সাদা মানুষদের কাছে এসেছেন। কিন্তু আমরা তাঁকে কখনো দেখিনি, কখনো কণ্ঠস্বরও শুনিনি।
তিনি সাদা মানুষদের আইনকানুন দিয়েছেন। কিন্তু যে লক্ষ কোটি লাল সন্তানেরা এই সুবিস্তীর্ণ মহাদেশ ছেয়ে ছিল, যেমন তারারা গগনতল ভরিয়ে রাখে, তাদের জন্য তাঁর কোন শব্দ নেই।
না, আমরা দুটি স্বতন্ত্র জাতি এবং চিরকাল এমনটাই থাকব। আমাদের মাঝে “common” কিছু নেই। আমাদের পিতৃপুরুষদের ভস্ম পবিত্র এবং তাদের চিরঘুমের স্থানটিও পবিত্র ভূমি। কিন্তু তোমরা তোমাদের পিতৃপুরুষের সমাধিক্ষেত্র থেকে দূরে, আরও দূরে চলে যাও, কোন অনুশোচনা ছাড়া।
ওয়াশিংটন থেকে আমেরিকার Great Chief এরকম খবর পাঠিয়েছেন যে তিনি আমাদের জমি কিনে নিতে চান। গ্রেট চিফ আমাদের বন্ধুত্ব এবং শুভেচ্ছার বার্তা পাঠিয়েছেন। এগুলো তাঁর মহানুভবতা, কারণ আমরা জানি প্রতিদানে আমাদের বন্ধুত্বের প্রয়োজন খুব সামান্যই। কিন্তু আমরা আপনার প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখব, কারণ আমরা যদি বিবেচনা না করি তাহলে সাদা মানুষেরা বন্দুক হাতে এসে আমাদের জমি নিয়ে নিতে পারে।
চিফ সিয়াটল আপনাদের জানাচ্ছে যে আমাদের কথাকে আপনারা গণ্য করতে পারেন – ততটাই সৎভাবে যেভাবে সাদা বন্ধুরা ঋতুচক্রের আবর্তন দেখে। ঐ দ্যাখো আকাশ যে আমাদের পিতৃপুরুষের ওপরে সমবেদনার অশ্রুজল বর্ষণ করেছে অগুন্তি শতক জুড়ে, এবং যা আমাদের কাছে এখন শাশ্বত মনে হচ্ছে সে বদলে যেতে পারে। আজ এটা পরিষ্কার দেখাচ্ছে, আগামীকাল মেঘে ঢেকে যেতে পারে। আমার কথা তারাদের মতো – কখনো অস্তমিত হয়না।
কিভাবে তোমরা আকাশকে, জমির উষ্ণতাকে কিনতে বা বেচতে পার? এ ধারণা আমাদের কাছে আজব ঠেকছে। আমরা সতেজ বাতাস কিংবা জলের লহরীকে নিজস্ব বলে ভাবিনা। যেগুলো আমাদের অধিকারে নেই সেগুলোকে তোমরা আমাদের কাছ থেকে কিনবে কি করে?
এই ধরিত্রী আমাদের সবার কাছে পবিত্র। প্রতিটি ঝকমকে পাইন গাছের চুড়ো, প্রতিটি বালুকাময় বেলাভূমি, ঘন জঙ্গলের প্রতি কণা কুয়াশা, প্রতিটি গান গাওয়া পতঙ্গ আমাদের স্মৃতিতে পবিত্র, আমাদের মানুষদের অভিজ্ঞতায় অপাপবিদ্ধ। বৃক্ষের মধ্য দিয়ে যে রস সঞ্চালিত হয় তা আমাদের লাল-চামড়ার লোকেদের স্মৃতি বহন করে।
সাদাদের মধ্যে মৃত মানুষেরা যখন তারাদের মাঝে হেঁটে যাবার জন্য রওনা দেয় তখন তারা তাদের জন্মভূমির কথা ভুলে যায়। আমাদের মৃতরা কখনো তাদের অপরূপ জন্মভূমিকে ভুলে যায়না, কারণ এই পৃথ্বী লাল মানুষদের মাতা। আমরা পৃথ্বীর একটি অংশ এবং পৃথ্বী আমাদের একটি অংশ।
মধুগন্ধময় ফুলেরা আমাদের বোন, শিংওয়ালা জন্তুরা, অশ্বের দল, রাজকীয় ঈগল – এরা সবাই আমাদের ভাই। শস্যপ্রান্তর, মানুষ এবং শাবকদের উষ্ণ দেহ এরা সবাই এক পরিবারে বাস করে।
এজন্য, যখন ওয়াশিংটনের গ্রেট চিফ আমাদের বার্তা পাঠান যে তিনি আমাদের জমি কিনে নিতে চান তিনি বড়ো কারবার করতে চাইছেন। তিনি আমাদের বার্তা পাঠিয়েছেন যে আমাদের বসবাসের জন্য একটি স্থান সংরক্ষিত করে রাখবেন যেখানে আমরা সবাই আরামে একে অন্যের সাথে বসবাস করতে পারব। তিনি আমাদের পিতা হবেন, আর আমরা হব তাঁর সন্তান।
এ কারণে আমাদের জমি কিনে নেবার বিষয়টি আবার বিবেচনা করব। কিন্তু এটা সহজ হবেনা, কারণ এই জমি আমাদের কাছে পবিত্র। নদীর মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া জলের ঝিলিমিলি কেবলমাত্র জল নয়, এটা আমাদের পূর্বপুরুষের শোনিত।
আমরা যদি এই জমি বিক্রি করে দিই তাহলে তোমরা অবশ্যই মনে রাখবে মৃত্তিকা পবিত্র, এবং সন্তানদের শেখাবে যে তারা নিজেরা এবং হ্রদের পরিষ্কার জলে তাদের প্রতিটি প্রতিবিম্ব আমাদের মানুষদের জীবন ও স্মৃতির কথা বলে। জলের মর্মরধ্বনি আমাদের পিতার এবং তাঁর পিতার কণ্ঠস্বর বয়ে নিয়ে আসে।
নদীরা আমাদের বোন, এবং তৃষ্ণা মেটায়। আমাদের ডিঙ্গি নৌকোগুলোকে বয়ে নিয়ে যায়, আমাদের সন্তানদের খাদ্য জোগায় এই নদীরা।
যদি আমরা আমাদের জমি বিক্রি করে দিই তাহলে তোমাদের অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে এবং তোমাদের সন্ততিদের শেখাতে হবে এই নদীরা আমাদের এবং তোমাদের আত্মার আত্মীয়। এজন্য এরপর থেকে যেভাবে তোমরা তোমাদের ভাইবোনদের শুভকামী হয়ে দেখাশোনা কর, সেভাবে নদীগুলোকেও দেখাশোনা করবে।
আমরা জানি যে সাদা মানুষেরা আমাদের ভাবনার পথ বুঝতে পারেনা। জমির একেক খণ্ড ওদের কাছে একই রকম। কারণ ওরা হচ্ছে আগন্তুক, যারা রাতের বেলা আসে এবং নিজেদের যা প্রয়োজন সেসব জমির কাছ থেকে নিয়ে চলে যায়।
এই পৃথিবী তার ভাই নয়, বরঞ্চ শত্রু। যখন সে জমি দখল করে জয়ী হয় তখন কেবল এগোতে থাকে। তার বাবার কবরস্থান আর সন্তানের জন্মগত অধিকার পেছনে ফেলে যায়। কোন তোয়াক্কা না করে তার পিতার সমাধিক্ষেত্রকে ভুলে যায় আর সন্তানদের কাছ থেকে জমিকে ছিনিয়ে নেয়। সে তার মা, এই পৃথিবী, নিজের ভাই আর গগনমণ্ডলকে এমনভাবে দেখে যেন এগুলো কেনাবেচার সামগ্রী, এগুলোকে লুণ্ঠন করা যায়, বেচে দেওয়া যায়, যেন এরা ভেড়ার পালের মতো বা কাঁচের জপমালার মতো। তার অপ্রশমনীয় খিদে পৃথিবীকে গিলে খাবে এবং পেছনে পড়ে থাকবে এক মরুভূমি।
আমি তোমাদের বুঝতে পারিনা। তোমাদের পথের থেকে আমাদের পথ আলাদা।
তোমাদের শহরের দৃশ্য লাল মানুষদের চোখকে যন্ত্রণাবিদ্ধ করে। হয়তো এ কারণে যে লাল মানুষেরা বর্বর এবং এসব বোঝেনা। সাদা মানুষদের শহরে কোন শান্ত নীরবতার জায়গা নেই।
কোন জায়গা নেই যেখানে বসন্তে পাতার আওয়াজ কিংবা পতঙ্গের পাখা ঝাপটানোর শব্দ শোনা যায়। যেহেতু আমি একজন বর্বর এবং ভালো বুঝিনা – শহরের হট্টগোল আমাদের কানকে পীড়া দেয়। জীবনের আর কি অর্থ থাকতে পারে যখন রাতচরা পাখীর কর্কশ ডাক কিংবা পুকুরধারে ব্যাংয়েদের তর্ক-বিতর্ক না শোনা যায়? আমি একজন লাল মানুষ, আমি এগুলো বুঝতে পারিনা।
ইন্ডিয়ানরা মধ্যবেলার বৃষ্টিধোয়া বাতাসের নরম আওয়াজ কিংবা খাটো পাইন গাছের সৌগন্ধ পছন্দ করে।
লাল মানুষদের কাছে বাতাস বড়ো মূল্যবান। কারণ পৃথিবীর সমস্ত জীবন কণা – পশু, বৃক্ষ, এবং মানুষ – একে ভাগ করে নেয়। সাদা মানুষেরাও যে শ্বাস নেয় তা তো অনুভবই করতে পারেনা। দীর্ঘদিন ধরে মারা যাচ্ছে এমন একজন মানুষের মতো দুর্গন্ধেও সে অসাড় হয়ে থাকে।
যদি আমরা আমাদের জমি বিক্রি করে দিই তাহলে তুমি অবশ্যই মনে রাখবে বাতাস আমাদের কাছে মূল্যবান, সমস্ত জীবনকে বাতাস ধারণ করে আছে। যদি আমাদের জমি কিনে নাও তাহলে সে জমি তোমরা আলাদা করে রাখবে এবং পবিত্র রাখবে।
সে পবিত্র ভূমিখণ্ডে এমনকি সাদা মানুষেরাও যাবে ফুল এবং তৃণভূমির সুগন্ধে মধুর বাতাসের স্বাদ আস্বাদনের জন্য।
যদি আমি তোমাদের প্রস্তাব গ্রহণ করি, তাহলে আমি একটি শর্ত দেব – সাদা মানুষেরা এ প্রান্তরের সমস্ত পশুকে নিজেদের ভাই হিসেবে দেখবে।
আমি একজন বর্বর এবং আমি অন্য কোন পথে ভাবতে পারিনা। আমি দেখেছি প্রেইরি তৃণভূমিতে হাজার হাজার মোষ মরে পচছে – এদেরকে সাদা মানুষেরা ফেলে গেছে। পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া ট্রেন থেকে মজা পাবার জন্য গুলি করে এদেরকে মারা হয়েছে।
আমি একজন বর্বর। আমি সত্যিই বুঝিনা ধোঁয়া-ওগরানো ঘোড়া (চলমান ট্রেন) কি করে মোষদের থেকে মূল্যবান হতে পারে! মোষদেরকে শুধু আমরা বেঁচে থাকার জন্য হত্যা করি। পশু ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব কিভাবে সম্ভব?
যদি সমস্ত পশু চলে যায় তাহলে মানুষও মরে যাবে মহাবিশ্বে অসীম নিঃসঙ্গতার মধ্যে। পশুদের ক্ষেত্রে যা ঘটে, মানুষের ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটে। সবাই পরস্পর-সংযুক্ত। পৃথিবীর বুকে যা নেমে আসবে ধরিত্রীমাতার সন্তানদের ওপরেও নেমে আসবে সে দুর্দৈব।
তোমাদের সন্তানদের তোমরা শেখাবে যে তাদের পায়ের নীচের মৃত্তিকাতে তাদের প্রপিতামহদের ভস্ম রয়েছে। তারা যাতে মাটিকে শ্রদ্ধা করতে পারে সেজন্য তাদের শেখাও পৃথিবী আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবন দিয়ে পূর্ণ। তোমরা আমাদের যা শিখিয়েছ, সন্তানদেরও সেটাই শেখাও – এই পৃথিবী হচ্ছে মা। যা কিছু পৃথিবীকে আঘাত দেয়, আহত করে সে সবকিছুই পৃথিবীর সন্তানদেরও আঘাত দেয়। যখন মানুষ মাটিতে থুতু ফেলে সে নিজের ওপরেই থুতু ফেলে।
আমরা জানি – পৃথিবী মানুষের অধিকারে নয়। মানুষ পৃথিবীর অধিকারে। মানুষ জীবনের জাল বোনেনি। যা কিছু এই জালের ক্ষেত্রে কাজ করে তা আসলে নিজের ক্ষেত্রেই করে। পৃথিবীর ক্ষেত্রে যা ঘটে পৃথিবীর সন্তানদের ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটে। আমরা এগুলো জানি। প্রতিটি জিনিস পরস্পর-সংযুক্ত যেমন রক্তের বন্ধনে পরিবার বাঁধা থাকে।
এমনকি সাদা মানুষেরাও, ঈশ্বর যাদের সঙ্গে হাঁটেন এবং কথা বলেন, একটি সাধারণ নিয়তিকে এড়াতে পারবেনা। আমরাও হয়তো সবশেষে পরস্পরের ভাই হতে পারি। আমরা জানি যে হয়তো একদিন সাদা মানুষেরাও হয়তো বুঝবে যে পৃথিবী তাদের কাছে মূল্যবান। এবং পৃথিবীর ক্ষতি করা আসলে পৃথিবীর স্রষ্টার প্রতি ঘৃণাকে স্তুপীকৃত করে তোলা। কোন এক রাতে হয়তো দেখবে তোমরা যে শয্যাকে অপবিত্র করছ সে শয্যায় তোমরা বর্জ্য পদার্থে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আছ।
কিন্তু তোমাদের শেষ মুহূর্তগুলোতে তোমরা হয়তো এরকম ধারণায় উদ্ভাসিত হবে যে ঈশ্বর তোমাদেরকে এই প্রান্তরগুলোতে নিয়ে এসেছেন এবং কোন বিশেষ উদ্দেশ্য তোমাদের মাঝে দিয়েছেন – এই জমির দখলদারি আর লাল মানুষদের ওপরে প্রভুত্ব।
যখন সমস্ত মোষকে জবাই করে ফেলবে, সব বুনো ঘোড়াকে পোষ মানিয়ে ফেলবে, অরণ্যের গোপন গহীন অঞ্চল প্রচুর মানুষের গন্ধে ভারী হয়ে যাবে আর ফলবান পর্বত চুড়া নোংরা হয়ে থাকবে কথা বলা তারের জালে তখন কোথায় পাবে ঘন বনজঙ্গল? সেগুলো বিদায় নিয়েছে।
ঈগলগুলো কোথায়? এরাও বিদায় নিয়েছে। এবং এটা কেমন হবে যে দ্রুত ধাবমান পাখীগুলোকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে শিকার করে ফেলবে? জীবনের পরিসমাপ্তি হবে, শুরু হবে বেঁচে থাকা (The end of living and the beginning of survival)।
“আমরা হয়তো সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যাবার আগে সামান্য কটা দিন বাঁচব। যখন পৃথিবী থেকে শেষ লাল মানুষটিও অদৃশ্য হয়ে যাবে, এবং আমাদের স্মৃতি কেবলমাত্র প্রেইরির তৃণভূমির ওপর দিয়ে ভেসে যাওয়া মেঘের মতো রয়ে যাবে, তখনও তটভূমি আর অরণ্য আমাদের মানুষদের আত্মাকে ধরে রাখবে। কারণ তারা এই পৃথ্বীকে ভালোবাসে যেমন একজন নবজাতক ভালোবাসে মায়ের হৃদস্পন্দন।
এই পৃথিবীর যত্ন নিও, যেমনটা আমরা এতদিন নিয়েছি। জমির কাছ থেকে যেমন নিচ্ছ তেমন জমিকে ফিরিয়ে দিও – তোমাদের স্মৃতিতে এটা রেখো। এবং তোমাদের সমস্ত শক্তি ও পৌরুষ দিয়ে, সমস্ত হৃদয় দিয়ে একে রক্ষা কোরো – তোমাদের সন্ততিদের জন্য। ঈশ্বর যেমন আমাদের সবাইকে ভালোবাসেন তেমন করে ভালোবেসো একে। এই ধরাতল ঈশ্বরের কাছে মহা মূল্যবান। এমনকি সাদা মানুষেরাও তাদের সাধারণ নিয়তিকে এড়িয়ে যেতে পারবে না।”
এই লেখার প্রথম অংশটি পড়ুন নীচের সূত্রে।
কর্পোরেট আগ্রাসন – পরিবেশ ও কৃষির রূপান্তর, নতুন রোগের উদ্ভব (দ্বিতীয় অংশ)