নৈহাটি লোকাল আর না ঝোলালে তাপসদার ছেড়ে যাওয়া উইন্ডো সিটটার মায়া কাটিয়ে উঠে পড়তে হবে ততক্ষণে। বিধাননগর রোডের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে গাড়ি। ক্যান্টনমেন্টের দিক থেকে বেঁকে আসা লাইনটা ইতিমধ্যে ছোটা শুরু করেছে সাতটা বেজে বাহান্ন মিনিটে নৈহাটি ছেড়ে আসা লোকাল ট্রেনটার সমান্তরালে।
আচমকাই ককিয়ে উঠল ফোনটা।
সেটটা সেকেন্ড হ্যান্ড। ককিয়ে ওঠা থেকে ছবি আসার ফাঁকে বিরতি নেয় কয়েক মুহূর্তের। মায়ের মুখটা পর্দায় ভেসে উঠতেই তিরিক্ষি হয়ে উঠল মেজাজ। উফ, আর সময় পেল না! কেটে দিলেও নিস্তার নেই এখন। সমানে করতেই থাকবে কল। আর বারেবারেই থমকে যাবে কাক্কুর টাইমার। হুঁ হুঁ বাবা, এ ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা হোয়াটসঅ্যাপ নয়। দিনে বিশ মিনিট অনলাইন থাকতে দস্তুরমতো পয়সা দিচ্ছে তোমাকে। পরকীয়া সইবে কেন? সবুজ গোল্লাখানাকে উপরে টেনেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে অন্তরা, দমদম ঢুকছি। কী ব্যাপার বলো তো! বিধাননগর নেমে ফোন করি তো জানোই…
পৌঁনে ন’টা হয়ে গেল। এখনও করলি না, অনুযোগের সুর মায়ের গলায়, তাই ভাবলাম। তা চেঁচাচ্ছিস কেন? চিন্তা হয় না নাকি?
শেষের দিকে ওপারেও চড়ল সুরটা।
ব্যারাকপুরে দাঁড়িয়েছিল আট-দশ মিনিট, গলা ঈষৎ নামায় অন্তরা। দেরির কথাটা রাখা উচিত ছিল মাথায়। সত্যিই তো, বাড়িতে আর জানছে কী করে! বিরক্তিটা যদিও কেটেও কাটছিল না, এই জন্যেই বলেছিলাম, অ্যাপটা ইনস্টল করে দি। দেখে নিতে পারবে কোথায় আছি। দু’ মিনিট দেরি হলেই চোদ্দোবার ফোন করবে না...
অত অ্যাপ-ট্যাপ বুঝি না আমি। লেট হলে একবার ফোন করে দিতে কী হয়? তোর বাবাও চিন্তা করছে...
অন্তরাও জানে। বাড়িতে একদম বসে যাওয়ার পর থেকেই কেমন গুম মেরে গিয়েছে মানুষটা। মায়ের সঙ্গে যেমন তেমন, বাবার কথাটা কানে গেলেই তাই আর বেশি চেঁচাতেও পারে না। সেই না-পারাটার সুযোগ নিতেও অবশ্য কসুর করে না মা। বাবার ঘাড়ে বন্দুক রেখে চালিয়ে নেয় মাঝেমধ্যেই। এদিকে টপাটপ পড়তে লেগেছে উইকেট। দমদমের লাইনের ল্যাজা হুড়মুড়িয়ে পিছিয়ে আসছে জানলার দিকে। ভিড়টার দিকে একঝলক তাকিয়ে মোলায়েম করে আনে গলা, বুঝলাম। কিন্তু ভিড়ভাট্টার মধ্যে ব্যাগ থেকে সব সময় ফোন বের করা কত চাপের বলো তো!
ও মা। দাঁড়িয়ে রয়েছিস বুঝি? সিট পাসনি? কেন রে, তাপস যায়নি আজ? তা কিছু তো বললি না কাল রাতে…
ধুত্তেরি!
মুখে না বললেও মনে মনে উচ্চারণ করেই ফেলল শব্দটা। যত কমে সারতে চায় ততই জট পাকিয়ে ওঠে কথা। এদিকে প্ল্যাটফর্মের কাছাকাছি এসে পড়েছে গাড়ি। স্নায়ুর তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে চাকার ধাতব মন্দনের রেশ টের পেতে পেতেই উশখুশিয়ে উঠছিল অন্তরা। কে আর বুঝবে, এক-একটা সেকেন্ডের মূল্য এই মুহূর্তে কী ভীষণ!
এরপর বিধাননগর রোড ঢুকে পড়লেই ঝপ করে জ্যান্ত হয়ে উঠবে একটা অন্য টাইমার। প্ল্যাটফর্মে পা রাখার আগেই গুটোতে হবে এদিকের পাট। ক’টা টাকা উপরি আয়ের ভার্চুয়াল দুনিয়াটাও তখন কেজো পৃথিবীর পাশে নেহাতই ঠুনকো। তারপর গুঁতোগুঁতি করে সাবওয়ের দিকে এগিয়ে চলা। সুড়ঙ্গের মতো সিঁড়িতে একরাশ কালো কালো মাথা। ল্যান্ডিং-এর মুখটায় বারোমাসের জমে থাকা নোংরা জল। পায়ে পায়ে পিছল চাতাল। সেসব পেরিয়ে যতক্ষণে গিয়ে দাঁড়ানো খোলা আকাশের নীচে, ততক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছে বাঙ্গুরের বাসের জন্য তাড়াহুড়ো। চাদরে ছড়িয়ে থাকা কয়েনগুলোর সামনে নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় বসে থাকা হনুমানজির দিকে ফিরে তর্জনী কপালে ছোঁয়ানোর ফুরসতও থাকে না এক-একদিন। তারপর অফিসে পৌঁছেই গোটা দিনের মতো ডুবে যাওয়া স্টক, অর্ডার, রাশি রাশি ইনভয়েস আর ডেটাবেস আপডেটের পৃথিবীটায়। মাঝে আধাঘণ্টার লাঞ্চ ব্রেক। প্রাত্যহিকের সেই একঘেয়ে আর ক্লান্তিকর রুটিনটা শুরু হওয়ার আগেভাগেই মিটিয়ে ফেলা দরকার অবশিষ্ট সাত মিনিট চুয়ান্ন সেকেন্ডের মামলাটা।
রোজের নিয়মেই দমদমে অনেক ফাঁকা হয়ে গেল কামরা। তলপেট থেকে একরাশ বিস্রস্ত মানুষকে উগরে ফেলে আবার ভোঁ দিল ডাউন নৈহাটি। অ্যান্ড্রয়েড স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়ে অন্তরার ভুরুতে। গাড়ি আর না ঝোলালে বিশ মিনিটের কোটা পুরোনোর আগেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়বে বিধাননগর রোড।
খড়দায় নেমে যায় তাপসদা। হোয়াটসঅ্যাপে একবার চোখটা বুলিয়েই অতঃপর কাক্কুটা খুলে বসে অন্তরা। মাঝের রাস্তাটুকু ছুটে আসতে লোকাল ট্রেনের লেগেই যায় বিশ মিনিট। হিসেবটা শুনলে হয়তো স্বভাবসিদ্ধ ঢঙেই মাথা নাড়ত তাপসদা, শালা, একদম খাপে খাপ মন্টুর বাপ তো...
সেই খাপে খাপটাই হতে পারেনি আজ।
হোয়াটসঅ্যাপ খুলতেই একগাদা সুপ্রভাত বার্তার ফাঁকে অফিস গ্রুপে নতুন মেসেজ নোটিফিকেশনটায় আটকে গিয়েছিল চোখ। খোদ পোদ্দারস্যারের মেসেজ! তারপর আর উপায় ছিল না দেখে? হিলিং টাচ আর স্বাস্থ্যসুন্দরের দুটো লম্বা লম্বা অর্ডার ঢুকেছে কাল রাতে। ফাইল দুটো সোজা গ্রুপে চালান করে দিয়েছেন স্যার। একটা চার আর একটা সাত পাতার পিডিএফ। বারোটার মধ্যে অর্ডার প্যাকিং করে ট্রান্সপোর্টে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশও রয়েছে। চালু ব্র্যান্ডগুলোর স্টকের একটা মোটামুটি হিসেব থাকেই অন্তরার মাথায়। ঝট করে পিডিএফ দুটোয় একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়াই মনস্থ করেছিল। দেশটা যেন দিনদিনই ছেয়ে যেতে লেগেছে শর্করা আর মনোরোগীতে। নিজের ঘরেই তো দেখছে। সুগার আর অ্যাংজাইটির মেডিসিন এই বাজারে যেন পড়তেই পারছে না স্টকে। দু’-চার পাতার ঘাটতি কিছুই আশ্চর্যের নয়। তেমন হলে অফিসে ঢুকেই করে দিতে হবে রিপোর্ট। নইলে আবার একপ্রস্ত ঝাড় নাচছে কপালে।
হোয়াটসঅ্যাপের চক্করেই খেয়ে গেল দু’-তিন মিনিট। ঢুকে পড়ল সোদপুর। তাও শেষ অবধি টায়ে টায়ে হয়তো উতরে যেত কুড়ি মিনিট। দুম করে মায়ের কলটা ঢুকে গিয়েই ওলট-পালট করে দিল সব হিসেব। উলকার গতিতে ছুটছে এবার ডাউন নৈহাটি। পারলে ব্যারাকপুরের খামতি পুষিয়ে দেয় শিয়ালদায় ঢুকতে ঢুকতেই। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছিল অন্তরার। সেদিনের মতো না হয় আবার। ইশ্, তখন বেকার অতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল ব্যারাকপুরে। কাক্কুটা খুলে রাখলেই পাঁচশো কয়েন ঢুকে যায় এতক্ষণে ওয়ালেটে। কে আর জানবে তখন!
আসলে যতক্ষণ পাশে থাকে তাপসদা, আর কোনও চিন্তা মাথাতেই আসে না। ওটুকুই তো রাস্তা। শ্যামনগর থেকে খড়দা। যত কথা তার মধ্যেই। ওটুকুও যদি নষ্ট করে...
মানুষটা কি কিছুই বোঝে না!
নাকি টের পায় সবই!
এত ভাববে কেন নইলে তার মতো একটা সাদামাটা মেয়ের জন্য?
মাসখানেক আগেও বলেছে, বাসভাড়ার ব্যাপারটা কিন্তু শালটে দিয়েছি। কঞ্জুষি ছাড়। নিজের দিকেও নজর দে একটু...
তা উপরি ইনকামের খেলাটা তাপসদাই চিনিয়েছিল। মাস তিনেক আগের সকালটাকে বেশ মনে পড়ে আজও। এই নৈহাটি লোকালেরই কামরা। সেকেন্ড বা ফোর্থ স্যাটারডের মধ্যে কিছু একটা ছিল দিনটা। ভিড় তাই খানিক পাতলা। কপাল ভাল থাকলে মাসের মধ্যে এই দুটো দিনই যা বসতে পারে পাশাপাশি দু’জনে। নইলে তো শ্যামনগর থেকে অন্তরাকে উঠতে দেখলেই ফোর্থ কম্পার্টমেন্টের এই উইন্ডো সিট ছেড়ে সটান দাঁড়িয়ে পড়ে মানুষটা। খড়দা অবধি দাঁড়িয়েই থাকে ঠায়। গোড়ায় আড়ষ্ট লাগত। ইদানীং বরং শিউরে ওঠে মানুষটা না থাকলে রোজ এতটা পথ জার্নি করত কী করে ভেবে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দম আটকেই হয়তো মরে যেত। চারিপাশে এত লম্বা লম্বা লোকজনের ভিড়ে ঢাকা পড়ে।
মনে আছে হাইটের কথাটাতেই সেদিন ইয়ার্কি জুড়েছিল তাপসদা, পাঁচ ফুট হবি মাথায়?
না তো। দেড় ফুট মোটে, কপট রাগের ভঙ্গি ফুটিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল চার এগারোর অন্তরা, নিজে তো তালগাছ। যাও। আর হ্যাটা করতে হবে না। ভগবান হাইট দেননি সে আমি কী করব?
খাবি না ঠিকঠাক, তার দোষ ভগবানের...
বলে ফেলেও হঠাৎই কেমন থম মেরে গেল তাপসদা। কিছু তো আঁচ করেই নিয়েছে এতদিনে। হায়ার সেকেন্ডারির পর আর পড়াশুনো হয়নি, জুড়ে যেতে হয়েছিল নীচু ক্লাসের টিউশনে বা লকডাউনের পর মুদির দোকানের কাজটাও ঘুচে গিয়েছে বাবার— এসবের কিছুই যতই মুখ ফুটে না বলুক অন্তরা। মাস গেলে সাড়ে আট হাজার টাকার জন্য শ্যামনগর থেকে রোজ নয় বগির ট্রেনের ভিড় ঠেলে সেই কোন বাঙ্গুরে যাতায়াত করছে যে বছর তেইশের মেয়েটা, তার হাঁড়ির হাল বুঝে নিতে কি অতটাও কষ্ট হয় তাপসদার মতো চালাকচতুর ছেলের? হাইটটা নয় রক্তের সূত্রে পাওয়া। কিন্তু শরীরস্বাস্থ্যেও কি আছে তেইশ বছরের বয়স্থা মেয়ের জেল্লা? ছুটির দিনে আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজের মনেই খেলে যায় প্রশ্নটা। স্কুলের পুরনো ইউনিফর্মটা চাপালে বোধহয় এখনও অনায়াসেই ক্লাস টেনের ছাত্রী বলে চালিয়ে দিতে পারবে নিজেকে। ডায়েটিং করে রোগা হওয়ার গপ্পোগুলো মনে পড়লে হাসি পায় তখন। আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক-একদিন মনে হয় এরপর আচমকাই ঝুপ করে একদিন অনেক বেশি বয়সের ছাপ নেমে পড়বে এই রুগ্ন প্রতিবিম্বখানায়। ক্লাস টেন থেকে সোজাসুজি দু’ কুড়ি। কালের নিয়মেই মাঝের এই এতগুলো বয়স পেরিয়ে চলতে চলতেও তাদের মানানসই চেহারাছবিগুলোকে আর কখনওই ধারণ তথা লালনপালনের সুযোগ ঘটবে না এই শরীরী কাঠামোটুকুর।
তাপসদাও কি ভাবছিল এই কথাগুলোই অন্যভাবে? নইলে উচ্চতা নিয়ে একটা নিষ্পাপ মশকরা করতে করতে কেন থেমে গিয়েছিল আচমকাই? পরপর দুটো স্টেশন পার হয়ে এসেছিল ইতিমধ্যে তাপসদার শহর থেকে সকাল সাতটা বেজে বাহান্ন মিনিটে ছেড়ে আসা ডাউন ট্রেনটা। মাসের দ্বিতীয় নাকি চতুর্থ শনিবার ছিল দিনটা আর মনে নেই। তবে শুধু সেই সূত্রেই নয়, বোধহয় আর কোনও কারণেও বেশ ফাঁকা ফাঁকাই ছিল কামরাখানা। শুধু যে পাশাপাশি বসেছিল দু’জনায়, তাই নয়। তিনজনের সিটে তখনও অবধি ঠিক তিনজনই। দু’জনার মাঝে জমে ওঠা নীরবতাটুকুও তাই যেন হয়ে উঠেছিল বাড়তি অসহনীয়ই।
ব্যারাকপুরের আগে ঢিমে হয়েছিল গাড়ি।
হঠাৎ জোর করে হেসে আবার শুরু করল তাপসদা, সব দোষ ভগবানের ঘাড়ে চাপিয়ে দিবি এ তো ঠিক না। সময় হলে ফিরেও তাকান কিন্তু ভগাদা...
আমার দিকে আর তাকালেন কই?
তাকাবেন তাকাবেন, বলতে বলতেই যে পকেট থেকে ফোনটাকে বের করে ফেলেছে তাপসদা, লক্ষ করেছিল অন্তরাও। প্যাটার্ন লক খুলতে খুলতে স্ক্রিনের দিকে চোখ রেখেই আবার হালকা সুর তাপসদার গলায়, দাঁড়া, তোর ওই গাধার খাটুনি খানিক কমানো যায় কিনা দেখি...
কীভাবে, আচমকাই দানা পাকিয়ে ওঠা অস্বস্তিটাকে হালকা করার তাগিদ থেকেই যেন চপলতার সুর তখন অন্তরার কণ্ঠেও, কোনও টাটা-বিড়লার অফিসে ঢুকিয়ে দেবে বুঝি?
অত ক্যাপা থাকলে কি আর নিজে সিকিউরিটি এজেন্সিতে পড়ে থাকতাম রে, ঠোঁটের কোনায় হাসি তাপসদার। টুং করে একটা শব্দ কানে এল। মুচকি হেসেছিল তাপসদা, একটা ইনভিটেশন লিংক সেন্ড করেছি দেখ। হোয়াটসঅ্যাপে। ইনস্টল কর অ্যাপটা। পড়ে দেখ কী বলছে। রোজ দশ মিনিট করে খুলে রাখবি...
হুড়মুড়িয়ে একগাদা লোক উঠে এল ব্যারাকপুর থেকে।
দেখি দেখি দাদা, চেপে বসুন...
কোকিলের ছবিটার নীচে লেখা কথাগুলো পড়ছে তখন অন্তরা। স্ক্রিন থেকে চোখ না তুলেই বলল, কয়েন জমা হয়ে লাভটা কী হবে শুনি? টাকা দেবে?
এই দেখো, নইলে আর পাঠালাম কেন বেকার? রোজ যা কয়েন জমবে ওয়ালেটে, ইউপিআই দিয়ে ক্যাশ ট্রান্সফার করে নিতে পারবি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। দেখ, এই যে ইনস্টল করলি, অলরেডি আজকের টাইম কাউন্ট শুরু হয়ে গেছে। সোদপুরের মধ্যেই দশ মিনিটের কোটা কমপ্লিট হয়ে যাবে...
তিনজনের সিটে চেপেচুপে চারজন বসাই দস্তুর এই লাইনের লোকালে। ভিড় হতে না হতেই শুরু হয়ে গিয়েছে ঠেসাঠেসি। ফোর্থম্যানের দিক থেকে আসতে শুরু করেছে চাপ। তাতে আবার মোটাসোটা একটা লোক বসেছে ফোর্থম্যান হয়ে। সেই মুহূর্তে চাপটাকে কিন্তু মনেপ্রাণে উপভোগই করছিল অন্তরা। তাপসদার সবল সটান শরীরটার সঙ্গে লেপটে যেতে যেতেই একবার দেহমনে শিহরিত হয়ে ওঠার মতো পরিস্থিতি তৈরি হল। সন্তর্পণে বাহু সরিয়ে নিল তাপসদা।
প্রথম দিন একশো কয়েন জমা হবে কাক্কু ওয়ালেটে। অর্থাৎ এক টাকা। এক পয়সায় একটা কয়েন তার মানে কাক্কুতে। দ্বিতীয় দিনে পাওয়া যাবে দুশো কয়েন। তৃতীয় দিন তিনশো। এভাবে সাতদিনের মাথায় সাতশো। সপ্তায় সেই হিসেবে জমছে আঠাশশো কয়েন। আঠাশ টাকা। পুরো টাকাটাই এনক্যাশ করে নেওয়া যাবে অ্যাকাউন্টে। এ আবার কী ম্যাজিক রে ভাই! কে দিচ্ছে এত টাকা? কেন দিচ্ছে? উত্তর পেল পড়তে পড়তেই। বেশ ফলাও করেই লিখেছে, কাক্কুর পলিসি হল কনজ্যুমারদের খরচ হওয়া সময়টার দাম দেওয়া। সময়ের মূল্যে বিশ্বাস করে কাক্কু। সেই সৎ বিশ্বাস থেকেই আরও আরও বেশি মানুষকে নিজের ছাতার তলায় নিয়ে আসার বিষয়ে আশাবাদী। আচ্ছা, এ-ও তবে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক বাড়ানোর এক নতুন কায়দা!
সাতদিন পর আবার একশো কয়েন থেকে শুরু।
প্রতি সপ্তায় তার মানে আঠাশ টাকা! চার সপ্তায় একশো বারো। মাসে আর-একটু বেশি।
টিটাগড় থেকে ইতিমধ্যে ভোঁ দিল গাড়ি।
তাপসদা উঠবে এবার।
অন্তরা জিজ্ঞাসা করেছিল, তুমি নিজে কখনও তুলেছ টাকা?
এই দ্যাখ, ফোনটাকে চোখের সামনে ধরে নাচায় তাপসদা, দুশো টাকার কাছাকাছি তুলেছি আজ অবধি। ই-পাশবুকটা দেখতে চাস?
এ মা! না না, সে কথা বলছি না...
ভয়ের কিছু নেই। রোজ দশ মিনিট করে খুলে রাখবি শুধু। আর কিচ্ছু করতে হবে না। সপ্তায় আঠাশ টাকা। মাসে...
টানা দশ মিনিট খুলে রাখতে হবে? ধরো যদি দু’ মিনিট পর বন্ধ করে দি?
কোনও প্রবলেম নেই। আবার যখন খুলবি দু’ মিনিট এক সেকেন্ড থেকেই শুরু হবে কাউন্ট। রাত বারোটার মধ্যে শুধু কমপ্লিট করে ফেলতে হবে দশ মিনিট।
বুঝলাম। বারোটার পর থেকে আবার পরের দিনের কাউন্ট শুরু...
একদম। যাক, মাসের শেষ আট-দশ দিনের বাসভাড়াটা কিন্তু এখান থেকেই উঠে যাবে তোর...
মুখ ফসকে সেদিন বলে ফেলা কথাটা তার মানে খেয়াল করে রেখেছে মানুষটা! তাপসদার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছিল না অন্তরা। সত্যি বলতে কি, ঠিক এই হিসেবটাই চলছিল সেই মুহূর্তে তার মাথায়।
সাড়ে আট হাজারে আজকের দিনে তিনটে মানুষের মাস চালানো। খাওয়াপরা, লাইটের বিল, ফোনের খরচা থেকে ন্যূনতম সামাজিকতার সবটুকুই আছে। সবার আগে আছে বাবার ওষুধের খরচা। তাও তো নিয়মিত ব্লাড টেস্ট করতে বলেছে ডাক্তার। মাসের পর মাস যদিও কিছুই করাতে চায় না মানুষটা। ওষুধ চলার অজুহাতেই গোঁয়ারতুমি করে কাটিয়ে যায় দিন। মাঝেমধ্যে ভয় ধরে অন্তরার। দু’ বেলা এত এত মেডিসিন নিয়ে নাড়াচাড়া বলেই কি আরও বেশি করে লাগে ভয়টা! তলে তলে চিনির মাত্রা বেড়েই চলছে না তো মানুষটার রক্তে? মিষ্টতার আড়ালেও যে লুকিয়ে থাকতে পারে এক জাতের হুমকি, কী অবলীলায় এই বয়সেই তাকে উপলব্ধি করিয়ে ছেড়েছে জীবন। আবার মাসের গোড়ায় ব্লাড টেস্ট বাবদ ধরে রাখা টাকাটা মাসের শেষে খরচ না হতে একটু-আধটু আশ্বস্তও যে লাগে না তাও নয়। এরই মধ্যে কুড়ি-বাইশ তারিখের পর থেকেই অফিসফেরতা হাঁটা শুরু করে অন্তরা। সেই ভিআইপি বাঙ্গুর থেকে উল্টোডাঙা অবধি প্রায় পৌঁনে এক ঘণ্টার হাঁটাপথ যেন ফুরোতেই চায় না দিনের শেষে। বাসে রাস্তাটা মিনিট পনেরোর বেশি নয়। কিন্তু হলে কী হয়! মাসের শেষে একশোটা টাকাও যে কম নয় নেহাত। দশ দিন হেঁটে ফিরলেই বাঁচিয়ে নেওয়া যায় যে টাকাটা।
তাপসদা নেমে গিয়েছিল খড়দায়।
সোদপুরে ঢুকতে ঢুকতে সত্যিই দুশো কয়েন জমা হয়েছিল ওয়ালেটে। দশ মিনিট অনলাইন থাকার জন্য সেদিনের বরাদ্দ একশো কয়েন। আরও একশো কাক্কুতে জয়েন করার দরুণ ওয়েলকাম গিফট। একটু ভয়ে ভয়ে ইউপিআই আইডি-টা দিতেই সেকেন্ডখানেকের মধ্যেই দু’ টাকা জমা পড়ল ব্যাংকের খাতায়। সার্ভিস মেসেজটা বারেবারে দেখেও হজম হতে চাইছিল না অন্তরার।
মাসে একশো বারো টাকা আয় করা এত সোজা!
সকাল থেকে পরপর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকেই যেন তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।
আড়চোখে কামরার এপাশ-ওপাশ দেখে নিয়ে খুব সন্তর্পণে একবার চিমটি কেটেছিল নিজের গায়ে।
বাড়ির ফোনেও ইনস্টল করে নেবে নাকি অ্যাপটা? রাতে ফিরে নিজেই খুলে বসবে না হয় দশ মিনিটের জন্য। কাউকে বলে কাজ নেই। হিতে বিপরীত হয়ে যাবে শেষে। আকাশপাতাল ভেবে ভেবে উলটে শরীর খারাপ করে বসে থাকবে মানুষ দুটো। কোথা থেকে এত টাকা আসছে মাসে মাসে। কে দিচ্ছে। কেন দিচ্ছে। বাপ রে বাপ। বয়স হলে এত ভীতু কেন যে হয়ে যায় মানুষগুলো! কিন্তু নিজেরাই যদি কখনও খুলে দেখে...
থাক। ফোনটার অবস্থাও ভাল নয়। সেকেন্ড হ্যান্ড তো বটেই। হাল আরও তথৈবচ। চলতে চলতেই বিদ্রোহ করে বসে মাঝেমধ্যেই। নতুন অ্যাপ ভরতে গিয়ে না শেষে একদমই শহিদ হয়। থাক। বেশি লোভে কাজ নেই। একটা চলনসই গোছের সেকেন্ড হ্যান্ড সেটও এখন অনেকগুলো টাকার ধাক্কা।
সেই মাসের পুরোটাই অফিসফেরতা বাসেই উল্টোডাঙা ফিরল অন্তরা।
ঊনতিরিশ তারিখ ফেরার পথে খিদে খিদে লাগায় শান্তিপুর লোকালের হকারের কাছ থেকে কিনে খেল দশ টাকার মিষ্টি বাদামও। বাবার জন্য মনটা যে খচখচ করছিল না একদম, তা নয়। আহা, মিষ্টি খেতে কী ভালই না বাসত মানুষটা। সেসবের পাট ইদানীং উঠেই গিয়েছে বাড়ি থেকে।
তিন মাসের মধ্যে একদিনই শুধু ফসকেছে কয়েন।
মায়ের ফোনটা ঢুকতেই তখন মেজাজটা তিরিক্ষিও হয়ে উঠছিল সেদিনের কথাটা মনে করেই।
ব্রিজের তলায় এলিয়ে পড়ে থাকা চক্ররেলের লাইনগুলোকে আড়াআড়ি পেরিয়ে যাচ্ছে এই মুহূর্তে ডাউন নৈহাটি। একটা-আধটা করে আবার পড়তে শুরু করেছে উইকেট। দরজার মুখটায় বাড়ছে ভিড়। সেই শুরুর দিনগুলোর মতো দশ মিনিটের মামলা হলে তো চিন্তাই ছিল না। আজকাল কুড়ি মিনিট করে খুলে রাখতে হচ্ছে কাক্কু। এই তিন মাসে বিস্তর অদলবদল ঘটেছে নিয়মে। মোটামুটি দেড় মাস একভাবে চলার পরই ঝপ করে কমিয়ে দিল কয়েনের পরিমাণ। একশো, দেড়শো, দুশো করে সপ্তম দিনের মাথায় গিয়ে দিতে লাগল মোটে চারশো কয়েন। সপ্তায় সতেরোশো পঞ্চাশ। আঠাশ দিনে উপরি আয়ের পরিমাণ একশো বারো থেকে রাতারাতি নেমে এল সত্তর টাকায়। কিছুদিন পর স্ক্রিনটাইম দশ থেকে বাড়িয়ে করে দিল পনেরো মিনিট। ইদানীং সপ্তায় আবার আঠাশশো কয়েন দিতে শুরু করেছে ঠিকই। তবে ক্যাশ টাকা তোলা যাবে না আর আগের মতো...
গতি কমছে গাড়ির।
ঢুকছে বিধাননগর রোড।
চার মিনিট তেইশ সেকেন্ড বাকি রয়ে গেল। মনে খুঁতখুঁতুনি নিয়েই নেট অফ করে অন্তরা। ফোন হাতে নিয়ে নামাটা ঠিক নয়। অতি ছ্যাঁচড়া জায়গা রেলের প্ল্যাটফর্ম। সাবওয়ের সিঁড়িতে পা রাখতে রাখতে অন্যদিন মাথায় ভিড় করে আসে সিসোদিয়া ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং এজেন্সির সঙ্গে সম্পৃক্ত হাজারো চিন্তা। স্টক। অর্ডার। রাশি রাশি ইনভয়েস। আর কম্পিউটরে ডেটাবেস আপডেট। আজ কিন্তু মনে মনে খচখচিয়েই চলেছে চার মিনিট তেইশ সেকেন্ডের কথাটা...
চার মিনিট তেইশ সেকেন্ড না! অতক্ষণ কিন্তু কথা হয়নি মায়ের সঙ্গে। বড়জোর দেড়-দু’ মিনিট চলেছিল কলটা। তার মানে মায়ের ফোনটা তখন না ঢুকলেও এখনও শেষ হত না কুড়ি মিনিটের কোটা। ভাবতে গিয়ে মনে হল এতক্ষণে, অতটা ঝাঁঝিয়ে না উঠলেও হত তখন...
বাসের জন্য দাঁড়াতেই হল না আজ আর।
খুব সময়ে এসেছে। সেকেন্ডখানেক দেরি হলেই হচ্ছিল আর কি। হাঁস-মুরগির মতো ভিড় হয়েছে। পাদানিতে পা রাখতে না রাখতেই এক রামধাক্কায় উঠে পড়ল দু’ ধাপ। কী গরম ভেতরটা। ইঞ্জিনের ঘড়ঘড় ছাপিয়ে তখনও শোনা যাচ্ছে, উঠুন উঠুন দাদা, বাঙ্গুর যাবে, দক্ষিণদাঁড়ি, শ্রীভূমি, ক্লক টাওয়ার...
কলকাতার সব বাস কনডাক্টরের গলাই কি একই রকম হেঁড়ে মেজাজের!
এই অবস্থায় ব্যাগ থেকে ফোন বের করা স্রেফ অসম্ভব।
বাড়িতে চিন্তা করলেও কিছু করার নেই।
একেবারে স্টপেজে নেমেই করবে যা করার।
হাডকোর মোড় পেরিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লেগেছে বাসটা। চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে ক্রমাগত ঝাঁকুনি খেতে খেতেও চার মিনিট তেইশ সেকেন্ডের কথাটাই খালি ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথায়। এক ভুল কিছুতেই করা চলবে না আর। যতক্ষণ না মিটছে এদিকের মামলাটা, কিছুতেই অন্যদিকে মন দেবে না অন্তরা। প্যাকিং-এর ফাঁকে ফাঁকে যেভাবে হোক চুকিয়ে ফেলতে হবে এদিকটা।
কতদিন লাগবে এখনও পঁচাত্তর হাজার কয়েন জমতে...
সাড়ে সাতশো টাকা।
ওর কমে তো হবে না...
সপ্তাখানেক আগে বাতিল হয়েছে ওয়ালেট থেকে অ্যাকাউন্টে সরাসরি ক্যাশ টাকা সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ। বদলে জমা হওয়া কয়েনে এখন থেকে সারা যাবে অনলাইন কেনাকাটা। কাক্কুর মনোনীত কিছু ব্র্যান্ডের কাছ থেকে। যেদিন প্রথম দেখল নতুন স্কিমটা, দমে গিয়েছিল মনটা। অফিসফেরতা বাসে আসা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল শেষ আড়াই মাসে। টাকার পরিমাণ যখন ঝপ করে কমিয়ে দিল একশো বারো থেকে সত্তরে, তখনও অসুবিধা হচ্ছিল না খুব একটা। বরং বাসের জানলা থেকে পেছনপানে অপসৃয়মান গাড়িঘোড়া, দোকানপাট আর ঘরবাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাঝেমধ্যে অবাক লাগত নিজেরই। কী করে হেঁটে আসত সে রোজ এতখানি পথ! দিনের শেষে বাসেই তো ফুরোতে চায় না রাস্তা। তাই তো সেদিন দমে গিয়েছিল মনটা। যদিও বুঝতে পেরেছিল দেখে আর লাভ নেই, তবু হতাশ চোখ বোলাচ্ছিল প্রোডাক্টগুলোর উপর। তখনই এক জায়গায় আটকে গেল দৃষ্টি।
ব্লাড টেস্ট কিছুতেই আর করানো হয়ে উঠছে না বাবার। সায় নেই সেই মানুষটারও। এই জিনিসটা বরং সেদিক দিয়ে বেশ কাজের। আলাদা করে টাকা বের করার দরকারও হবে না। জমানো কয়েন থেকেই হয়ে যাবে...
গ্লুকোমিটার।
সাড়ে সাতশো পড়বে।
মাস ছয় যদিও লাগবে পঁচাত্তর হাজার কয়েন জমতে।
রোজের কয়েন তাই ইদানীং ভীষণ মূল্যবান।
আগের চাইতেও।
লেকটাউনের ক্লক টাওয়ার পেরিয়ে গিয়েছে।
সেই দিনটাকে মনে পড়ছিল অন্তরার। বিধাননগর রোডে নামার সময় ঠিক আজকের মতোই বাকি রয়ে গিয়েছিল সময়ের কোটা। সেদিন আরও কম। দু’ মিনিট কয়েক সেকেন্ড বোধহয়। ভেবেছিল পরে একসময় নেট চালিয়ে সেরে নেবে ওটুকু। সেদিন আবার পাওয়ার কথা ছিল সাতশো কয়েন। অফিসের কাজে ডুবে গিয়ে সারাদিনে আর মনেই পড়েনি। দিনের শেষে দেহমনে ভর করে একরাশ ক্লান্তি। বিধাননগর রোড থেকে ডাউনের গাড়ি ধরে শিয়ালদায় চলে গিয়ে বসে ফেরে অন্তরা। ঘুমিয়ে পড়ে প্রায়দিনই। সেদিনও ব্যত্যয় হয়নি। বাড়ি ফিরে টুকিটাকি কাজ থাকেই মায়ের হাতে হাতে। শুতে যাওয়ার আগে ফোন চার্জে বসিয়ে শেষবারের মতো হোয়াটসঅ্যাপটা দেখতে গিয়েই চোখ পড়েছিল লাগোয়া কোকিলের ছবিটায়। ঘড়ির কাঁটায় রাত সেই মুহূর্তে এগারোটা বেজে ঊনষাট মিনিট ছুঁইছুঁই।
তাড়াহুড়ো করেও শেষরক্ষা হল না।
চোখের সামনে দিয়ে উবে গেল সেদিনের কড়কড়ে সাতশো কয়েন।
মাত্রই কয়েক সেকেন্ডের জন্য।
পরক্ষণেই যদিও একশো কয়েনের জন্য আবার চালু হয়েছিল টাইমার।
ভিআইপি বাঙ্গুর আসবে, ভিআইপি বাঙ্গুর, ঝনঝনিয়ে উঠল সেই হেঁড়ে কণ্ঠ, এগিয়ে আসুন, এগিয়ে আসুন...
দীর্ঘ তিন মাসের অভ্যাস বদলানো যায় না রাতারাতি। দিনের শেষে ভেঙে আসে শরীর। সরে না পা। সামনের পথটাকে মনে হয় আর কখনও ফুরোবে না। অবশ্যই সেই মনে হওয়ায় থাকে না উত্তমকুমারের মুগ্ধতা। তাতে যদি বেরোনোর মুখে মুখে একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা ঘটে অফিসে, মনটাও হাত মেলায় পরিশ্রান্ত শরীরটার সঙ্গেই তখন।
ভিআইপি বাঙ্গুর স্টপেজ থেকে আজও উল্টোডাঙার বাস ধরল অন্তরা।
গরমের দিনে বেলা বাড়ে।
তবুও অন্ধকারকে তো একটা সময় ঘনিয়ে আসতেই হয় পৃথিবীর বুকে।
লেডিস সিটে বসে পেছন দিকে ছুটে চলা সদ্য আলোকিত গ্লোসাইন বোর্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবছিল অন্তরা। কাল থেকেই ফিরতে হবে তিন মাস আগের অভ্যাসে। যদিও আজ মাসের সবে বারো তারিখ, তবুও। নইলে চালাতে পারবে না গোটা মাস।
দুশো ছিয়াশি টাকা।
তার একদিনের রোজ।
ওয়ালেট থেকে সরাসরি অ্যাকাউন্টে ক্যাশ সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ যদি এখনও রয়েও যেত কাক্কুতে, তবুও টাকাটা পুষিয়ে নিতে লেগে যেত আড়াই মাসের কাছাকাছি। অন্যভাবেও দেখা যেতে পারে যদিও হিসেবটা। গত তিন মাসে যত টাকা উপরি আয় করেছিল অনলাইনে, পলকেই তার প্রায় পুরোটাই উবে গেল এই খানিক আগে কলমের এক খোঁচায়। উপরি রোজগারের ভার্চুয়াল দুনিয়াটাকে তাই দিনের শেষে কেজো পৃথিবীটার পাশে আজ মনে হচ্ছিল সত্যিই ঠুনকো।
একজন স্টাফকে দিয়ে পাঁচ পাতা ফ্লুভক্সিন ফিফটি দেড় ঘণ্টার মধ্যে কলকাতার দক্ষিণ সীমানায় পাঠাতে কি সত্যি সত্যিই দুশো ছিয়াশি টাকা খরচ হয় এজেন্সির? যদিও এই প্রশ্নটা ম্যানেজমেন্টকে করা যায় না আজকের দিনে। পত্রপাঠ দেখিয়ে দেবে দরজা। তাতে ভুলটা যেখানে নিজেরই। মুখ বুজে একদিনের বেতন কাটার নির্দেশ মেনে নেওয়াই অতএব বুদ্ধিমত্তার পরিচয়।
বৃহত্তর মহানগরের বুক চিরে নেমে আসা সন্ধ্যার কালো আলখাল্লাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অন্তরার কানে বাজছিল পোদ্দারস্যারের কথাগুলো, ট্রান্সপোর্টে দেওয়ার আগে চেকিং-এই ধরা পড়ার কথা। যদি অবশ্যই মন থাকে কাজে। রিপোর্ট পেয়েছি, বারেবারে ফোন ঘাঁটছিলে তুমি। দ্বিতীয়বার করে কনজ্যুমার এন্ডকে কম্যুনিকেট করার লোকসান তোমার একদিনের রোজ কেটেই উশুল করবে এজেন্সি...