স্বদেশী গান নিয়ে বিবিধ সঙ্কলন ও গবেষণা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। এ লেখা সে বিষয়ে নয়। অন্যান্য অনেক অঞ্চলের মতো, বাংলাতেও গ্রামীণ মেয়েদের নিজস্ব গানের একটা ধারা প্রচলিত আছে দীর্ঘদিন ধরে। এই প্রচলনের লিখিত উল্লেখ পাওয়া যায় লক্ষ্মণ সেনের সমসাময়িক কবি গোবর্ধন আচার্যের 'আর্যাসপ্তশতী',ধোয়ীর 'পবন দূত',অন্যান্য সঙ্কলন গ্রন্থ,'সুভাষিত রত্নকোষ','সদুক্তিকর্ণামৃত'প্রভৃতিতে। তারও আগে থেকে এই ধারার অস্তিত্বের স্বপক্ষে নানা পোড়া মাটির ফলক ও সাহিত্যসূত্রের উল্লেখ করা হয়। মেয়েদের নিজস্ব গানের এই ধারা ক্রমশ হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলেও এখনও যেটুকু টিঁকে আছে প্রবীণাদের স্মৃতিতে তা-ও নানা সাক্ষ্য দেয়। বঙ্গমাতার ভাণ্ডারের বিবিধ রতনের মধ্যে এ গান এক উজ্জ্বল রত্ন।
মেয়েরা গান করেন কোনও সামাজিক উৎসবে বা সঙ্কটে, নানা কাজের অনুষঙ্গে বা অবসরের নিভৃতিতে। বেশিরভাগ সময় এ গান যৌথ উচ্চারণ-ফলে একের অভিজ্ঞতা সবার মধ্যে জারিত হয়; আবার সবার কথা এক সুরে দানা বেঁধে বলিষ্ঠতা পায়,দৃঢ় হয় সামাজিক বন্ধন; যৌথতায় মিশে লঘু হয় উদ্বেগ, আর সবার পরশে আনন্দ হয় পল্লবিত - একসূত্রে বাঁধা পড়ে পল্লী রমণীর মন। অতীতের যৌথযাপনের সামূহিক স্মৃতিকে ধরে রাখার সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রতিকের দাবী অনুযায়ী নতুন বাণীও যুক্ত হয় এইসব গানে। এই সংরক্ষণ, সম্মার্জন ও পুনর্নির্মাণের প্রক্রিয়ায় ধরা থাকে ইতিহাস-প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলে গীত-ঐতিহ্য।
১৮৬০-এর দশকে জাতীয়তাবোধের উন্মেষের সময় থেকে দেশাত্মবোধক গান সৃজনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়, আর তাই অচিরেই নানা গুণিজন এই অভাব পূরণে এগিয়ে আসেন। বঙ্কিমচন্দ্রের 'বন্দেমাতরম্' গানটি আগেই লেখা হয়ে থাকলেও ১৮৮২-তে 'আনন্দমঠ' উপন্যাসের অংশ হিসেবে প্রকাশিত হয় ও তার পর থেকেই সুরারোপিত হয়ে গান হিসেবে গাওয়া শুরু হয়। ১৮৯৬ সালের কংগ্রেস অধিবেশনে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এ গান গেয়েছিলেন-একথা আমরা সবাই জানি। ১৯০১-এর কংগ্রেস অধিবেশন ছাড়াও সরলা দেবীর নেতৃত্বে এ গান গাওয়া হতে থাকে নানা উপলক্ষে-সে কথাও জানা যায়। কিন্তু ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ বিরোধিতার আবহে এ গান আন্দোলনের সমার্থক হয়ে ওঠে আর শুধু 'বন্দেমাতরম্' ধ্বনিটুকু স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে জনসাধারণের এক বিরাট অংশের মধ্যে। ১৮ বছর বয়সের লেখা 'একসূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন' গানটিতে 'বন্দেমাতরম্' ধুয়া সংযোগ করেন রবীন্দ্রনাথ এই সময়েই। ১৯০৬ সালে স্বদেশী যুবক চিত্তরঞ্জন গুহঠাকুরতার ওপর নির্মম পুলিশি নির্যাতনের কথা বা ১৯০৭-এ 'বন্দেমাতরম্' পত্রিকা নিয়ে মামলা চলাকালীন এই ধ্বনি উচ্চারণের কারণে যুবক সুশীল সেনের পুলিশি বিতণ্ডায় জড়িয়ে বেত্রাঘাত লাভের ঘটনা অনেকেরই জানা আছে। উদ্বেল করা নানা স্বদেশী গান আর সঙ্গে 'বন্দেমাতরম্' ধ্বনি, সত্যিই সেদিন মথিত করেছিল এক বিরাট অংশের বাঙালিকে।
সদর মফস্বলের এই আলোড়ন একটু একটু করে পৌঁছেছিল সুদূর গ্রামাঞ্চলের আপাত নিস্তরঙ্গ অন্দরমহলেও। 'বন্দেমাতরম্' ধ্বনি আর স্বদেশির আহ্বানকে শুধু গ্রহণ নয়, গভীরভাবে আত্মস্থ করেছিলেন গ্রামীণ মেয়েরা; আর তাই, নিজেদের ঐতিহ্যবাহী গানের মধ্যেই মিশিয়ে দিলেন মাতৃবন্দনার উচ্চারণ আর স্বদেশি ব্যবহারের আহ্বান।
বিয়ের দিন সকালবেলা, শ্রীহট্টের মেয়েরা যাবেন জল সইতে, গান ধরলেন-
'স্বদেশি ভাবেতে আমরা ভরি গঙ্গার জল এগো,
ঢেউ দিওনা নদীর জলে, কলসি হবে তল।
পুষ্করণির চাইরো পারে, চাম্পা, নাগেশ্বর-এগো, পাতায় পাতায় ল্যাখা আছে 'বন্দেমাতরম্।'
কুমিল্লা থেকে চলে আসা নারীদের স্মৃতিতেও সেই একই উচ্চারণ-
'বইলে বন্দে মাতারম্ কইলকাতাতে ভইরে গো আইনলাম কালিতলার জল-
বইলে বন্দে মাতারম্।।'
পাটি বিছিয়ে বসে মেয়েরা করবেন নানা কাজ, সেখানেও মেশে এ ধ্বনি-
'ও পাটি বিছাও মাইজ ঘরে-
বন্দে মাতরম্ বইলে-'
(ঢাকা)
গোল হয়ে বসে সবাই চাল বাছার কাজ করছেন- গলায় গান-
'পাটিতে ঢালিয়া চাল,
চাউল করে আলঝাল,
সবে বলে বন্দে মাতরম্।।'
( শ্রীহট্ট)
এরপরে আসে সাজনের পর্ব; গান চলতে থাকে-
'ও রাম সাজাও মার কুলে
বন্দে মাতার বইলে'-
( ফরিদপুর)
মৈমনসিংহের মেয়েরা গান ধরেন-
'স্বদেশী সেন্দুর দিয়ে করাব সাজন-
সিন্দুরের মদ্যি ল্যাখা
বন্দে মাতরম্ ভাইরে, বন্দে মাতরম্।'
সত্যি সত্যিই স্বদেশি সিঁদুর, আলতা তৈরি হতে শুরু করেছিল আর বন্দেমাতরম্ লেখা থাকত চুড়িতে ও কাপড়ের পাড়ে। দেশি কাপড় হাটে হাটে বিক্রি হওয়ার কথাও জানা যায়, নানা সূত্র থেকে। তারই প্রতিফলন দেখি গানে-
'সাজাও রে কৃষ্ণধন, স্বদেশী সাজন,
স্বদেশী সাজন, করহে ধারণ তাহার মদ্যি ল্যাখা-বন্দেমাতরণ।"
( কুমিল্লা)
অথবা-
'দে দে সুবল সাজাইয়া দে রে
দেশি শাড়ি পরতে ভালো
বেদেশি শাড়ির সরমান গ্যালো।'
(নোয়াখালি)
-একই রকম গান পাওয়া যায়, জেলায় জেলায়। স্বদেশী মন্ত্রের এই
উচ্চারণ বলিষ্ঠ ও নির্ভীক করেছিল মানুষের মনকে। নদী-খালে ভরা বাংলার গ্রামের ভেতর যেতে গেলে পানসি নিয়ে হাজির হতো গোরা পুলিশ। পুলিশ দেখলে অস্বস্তি লাগা বা ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল গ্রামের মেয়েদের কাছে। কিন্তু মাতৃবন্দনার অভয়মন্ত্র উজ্জীবিত করেছিল তাঁদেরও। জল নিতে গিয়ে ঘাটে হঠাৎ ইংরেজ পুলিশের উপস্থিতি, তাঁদের আর ভয় পাওয়ায় না-ফরিদপুরের মেয়েরা গান ধরেন-
'যে ঘাটে পুরাবো কলসি
সেই ঘাটে ঝ্যানো দেখি দারোগার পানসি
ও রাই কুন ঘাটে?
ঠেইলে দ্যাও দারোগার পানসি
ভইরে উঠাও কাঙ্খের কলসি, ও রাই-"
বরিশালেও একই কথা বলেন মেয়েরা-
'যে ঘাটে ভরিব কলসি,
সেই ঘাটে ইংরাজের পানসি
ঠেইলে দ্যাও ইংরাজের পানসি
ভইরে উঠাও কাম্বের কলসি।'
সময় এগিয়ে যায়, বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। কিন্তু ঐতিহ্যে আশ্রয় পাওয়া গান, মেয়েরা গাইতেই থাকেন। বিশ্বযুদ্ধের আবহে 'জার্মানি' শব্দটি ঢুকে পড়ে সাঙ্গীতিক ভাষায়। ওপরের গানটি হয়ে যায়- 'যে ঘাটে ভরিব কলসী সেই ঘাটে জার্মানের পানসি।' বেশ কিছু ঠাট্টার গানও পাওয়া যায় জার্মানিকে নিয়ে-'নালো বিধুমুখী রাই, নালো পঞ্চমুখী রাই-
জার্মনিরে কানে ধরে, হারমুনি বাজাই।' (ঢাকা)
আরও একটি গান শুনি নোয়াখালি থেকে আসা দেবীরানী ভৌমিক দিদির কাছে। সন্ধ্যা নামার আগে মেয়েরা চলেছে পুকুরে-
'চলো সখি যমুনায়, বাঁশি ডাকে আয় আয়
দিনমণি ঘরে ফির্যা যায়-'
পানসি ঠেলার গানে যে শুদ্ধ গান্ধারের প্রয়োগের এখানে তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোমল পর্দায় নেমে কাফি রাগে রূপান্তরিত হয়। লোকনারী অজান্তে মার্গসঙ্গীতেও চলাচল করেন। গানের শেষে শুনি এক অদ্ভুত বাণী-
'মায়ে বলে ওগো ঝি, বউয়ে বলে ঠাকুরঝি
চলো আমরা জারফানি তুলি।
এই দ্যাশের বাবুরা জারফানি সব তুলে না
জারফানিতে দ্যাশ রাখলো না...'
ধন্দে পড়ি এই 'জারফানি' নিয়ে। অনুসন্ধান জানায়, অনেকেই বিশ্বাস করতেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি থেকেই এদেশে কচুরিপানা আসে; তাই কচুরিপানারই নাম হয়ে যায় 'জারমানি' বা 'জারফানি'।
এখানে মেয়েরাই জলাশয় পরিষ্কারের কথা ভাবছেন-এতটাই সচেতন ও সক্রিয় ছিলেন তাঁরা; গ্রামীণ নারীর নিজস্ব গান না শুনলে, তাঁদের এই বৈশিষ্ট্য সাক্ষর সমাজের কাছে পৌঁছত কিনা-সন্দেহ থেকে যায়।
গান্ধী এলেন। স্বদেশীর ডাক নতুন মাত্রা পেল। চরকা নিয়ে শুরু হল তুমুল হৈচৈ-উন্মাদনা কোথাও কোথাও ছাপিয়ে গেল বাস্তববোধকে। চরকাকে নিয়ে মাতামাতি প্রসঙ্গে একটু তির্যক কথা বলেই ফেললেন ৯২ বছরের বল্লভামাসি, তাঁর সিলেটীয় ভাষায়-
'শুনছনি স্বদেশের কাহিনি-
বাবু চাকরি ছাড়ি, যাইবা বাড়ি
চরকানিটা কিনি।
বাবু করবেন তুলার বাগান গো
তুলা ফলবে তখনি
ঘ্যার ঘ্যার করাই চরকা ঘুরাই
কাটবা সুতা রমণী।'
-যে ধৈর্য ও বাস্তববোধ থাকাটা যে কোনও কাজের জন্য জরুরি -এক্ষেত্রে তার অভাব দেখেছিলেন তিনি।
তবে জনমানসে গান্ধীজীর ভাবমূর্তি ছিল উজ্জ্বল। গান তারও প্রমাণ দেয়-
'দেশি সাজন চমৎকার, পরো বন্ধু একবার
বিলাতিতে মন দিও না-
গান্ধীরাজার মান মেরো না-।'
(ফরিদপুর)
গান্ধীজীর শিলচর গমনের স্মৃতিও ধরে রাখে শিলচরের গান-
'গান্ধী বড়ো লুক গো সখি, গান্ধী বড়ো লুক।'
অনক্ষর নারীর বলিষ্ঠ কণ্ঠ, সম্মান ও স্বীকৃতি পাবে, আশা করি।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
শ্রীনীহারবিন্দু সেন, শ্রীসন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীসুরেন মুখোপাধ্যায়।
উদ্ধৃত গানগুলি নিজস্ব সংগ্রহ থেকে।
নীচের সূত্রে কিছু গান থাকলো