নির্বাচন পরবর্তী ভারতেও বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকার তথা তার প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের পালে হাওয়া দেওয়া চলছেই। অধুনা উপলক্ষ্য হল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্মিত ভবন উদ্বোধন করতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদি সেই একই কথা বলেছেন যা বহুদিন ধরে সাম্প্রদায়িক হিন্দুমননে যত্মসহকারে চাষ করা হয়েছে। ভাবখানা এই যে, নালন্দা মুসলমানরা পুড়িয়েছে, আর আমরা আজ তাকে নতুনভাবে গড়ছি। পুরো কথাটাই বেবাক মিথ্যাচার। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের কারণ অন্য কিছু, বখতিয়ার খলজী অন্তত নয়। আর আজকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের লুপ্ত গরিমা ফিরিয়ে আনার কোনো ক্ষমতা বা ইচ্ছা কিছুই মোদিদের নেই।
নালন্দার ধ্বংস: যা জনপ্রিয় হল
মুসলমান বিদ্বেষের ওপর ভিত্তি করেই স্বাধীনতা-পরবর্তী নতুন ভারত তৈরি হয়েছিল। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের সেটাই পরিণাম। মুসলমান অধ্যুষিত পাকিস্তানে তৈরি হল ভারতবিদ্বেষ। আর ভারতে তৈরি হল মুসলমান-বিদ্বেষ তথা পাকিস্তান-বিদ্বেষ। মানুষের মন সাম্প্রদায়িক ভাবনাচিন্তায় ভয়ংকরভাবে কলুষিত হল। এমনিতে যারা মুসলমানদের ঘৃণা করে, মুসলমান লোকে যা বলে, যা করে, যা খায় তাতেই বিষ দেখে তারাই আবার যে মুহুর্তে মিনহাজ-ই-সিরাজের লেখাতে পেল যে, বখতিয়ার নালন্দা আক্রমণ করে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল তখন একবাক্যে নেচে উঠে তা চটপট বিশ্বাস করে ফেলল। মিনহাজ হয়ে গেল ‘'প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক”! কারণ এই বয়ান তার সাম্প্রদায়িক বিশ্বাসের সঙ্গে মিলে গেল। যে বিশ্বাস প্রতিনিয়ত তাকে এটাই বোঝায় যে, মুসলমানরা যেন ভারতে এসে আক্রমণ চালিয়েছিল বেছে বেছে “হিন্দু” ধর্মস্থান, গ্রন্থাগার, বিদ্যালয় ইত্যাদি ধ্বংস করতে, “হিন্দু” মানুষজনের ওপর অত্যাচার করতে। এটাই নাকি ছিল দলে দলে মুসলমান আক্রমণের প্রধান অনুপ্রেরণা, প্রধান লক্ষ্য। ফলে, নিশ্চয়ই বখতিয়ারই সেই লোক যে নালন্দা মহাবিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করেছিল, আগুন লাগিয়েছিল। এভাবেই রচিত হয় ইতিহাস!
কে এই মিনহাজ?
যে ঐতিহাসিকের বক্তব্য থেকেই সকলে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে বখতিয়ারই নালন্দা ধ্বংস করেছিল, একমাত্র যে ব্যক্তি এই কথা বলেছেন তাঁর নাম মিনহাজ-ই-সিরাজ জুঝানি। ১১৯৩ সালে মধ্য এশিয়ার বর্তমান আফগানিস্থানের ঘোর প্রদেশে তাঁর জন্ম। অর্থাৎ, যে সময়ে বখতিয়ার নাকি নালন্দায় আগুন লাগাচ্ছেন বলে অভিযোগ সেই সময়ে মিনহাজের জন্ম হচ্ছে নালন্দা থেকে বহুদূরে। কোনো অতি-উৎসাহী লেখাপত্তরে দেখলাম মিনহাজকে বখতিয়ারের আগুন লাগানোর প্রত্যক্ষদর্শী বলেও অভিহিত করা হয়েছে। গল্পের গরু শুধু কলতলাতেই গাছে উঠে না, ‘শিক্ষিত’ মানুষের স্টাডিরুমেও উঠে! মিনহাজ জুঝানির পেশা ছিল রাজারাজড়াদের ফরমায়েস অনুযায়ী যুদ্ধজয়ের ইতিহাস লেখা। ঘোর অঞ্চলের ঘুরিড রাজবংশের ওপরও তিনি লিখেছেন তাদের কাহিনী। ১২২৭ সাল নাগাদ তিনি প্রথমে বর্তমান পাকিস্তানে পঞ্জাবে এবং আরও পরে দিল্লি আসেন। দিল্লিতে সেই সময়ে সুলতান বংশের শাসন চলছিল। দিল্লির সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের ফরমায়েস অনুযায়ী এখানকার একটি ইতিহাস লেখেন যা তবাকাত-ই-নাসিরি নামে পরিচিত। এই বইটি লেখা হয় ১২৬০ সালে, অর্থাৎ মিনহাজের মৃত্যুর ৬ বছর আগে। অর্থাৎ, তিনি বাঙলা-বিহারে এসেছিলেন অন্তত ১২৫০-র পর। মানে, বখতিয়ারের তথাকথিত নালন্দা আক্রমণের অন্তত অর্ধশতক পর। স্বাভাবিকভাবেই, এখানে এসে লোকমুখে যা শুনেছিলেন তাতে সম্ভবত কিছু রঙ চড়িয়ে (সুলতানদের খুশি করার জন্যে) লিখে ফেললেন ইতিহাস। আর তার আরও কয়েকশ বছর পর হিন্দু সাম্প্রদায়িক মননে মননে তা-ই প্রকৃত ইতিহাস হিসাবে পুজিত হতে লাগল। এবং ২০২৪ সালে নালন্দায় একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন মোদি সেই ইতিহাস দিয়েই বাজার গরম করে এলেন!
ভারতে মুসলমান আক্রমণকারীরা
ভারতে মুসলমান আক্রমণকারীরা ছিল মূলত লুঠেরা। লুন্ঠনই ছিল তাদের লক্ষ্য। প্রথম প্রথম এখানে শাসন করা বা সাম্রাজ্য তৈরি করার বাসনাও তাদের ছিল না। কালে কালে এখানে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমে সুলতানী শাসন, পরে মোগল শাসন। বখতিয়ারেরও প্রধান লক্ষ্য ছিল লুন্ঠন। আধুনিক ঐতিহাসিকরা প্রায় একবাক্যে বলেছেন যে, বখতিয়ার যে রুটে বাঙলা এসেছিলেন তাতে নালন্দা পড়ে না। বখতিয়ারের নালন্দা যাবার কোনো কারণ নেই। একজন লুঠেরার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আক্রমণ করার কোনো স্বার্থও নেই। গ্রন্থরাজিতে তার কোনো আগ্রহ থাকতে পারে না। তার আগ্রহের জায়গা হল সোনা দানা মণি মাণিক্য! যা অনেক সময়েই বিখ্যাত মন্দিরগুলোতে থাকত। ভারতে মুসলমান লুন্ঠনকারীদের দ্বারা মন্দির আক্রমণের পেছনে একমাত্র এই লুঠের স্বার্থই ছিল। কোনো ধর্মীয় স্বার্থ ছিলনা। একথাও সবাই জানে। মিনহাজ তাঁর বইতে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে আক্রমণের কথা বলেছেন তা ওদন্তপুরী মহাবিহার, নালন্দা নয়, একথাও প্রায় সকল ঐতিহাসিকই বলেছেন। ওদন্তপুরীতে যে ভুল করে আক্রমণ হয়েছিল, সেনাশিবির ভেবে আক্রমণ হয়েছিল তা আবার মিনহাজই বলেছেন।
তাহলে নালন্দায় আগুন কেন?
নালন্দায় খননকার্য থেকে এটা প্রমাণিত যে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় ধরণের অগ্নিকান্ড ঘটে। ছাইয়ের একটা অত্যন্ত পুরু স্তর সেখানে দেখা যায়। বোঝা যায় একটা ধ্বংসলীলা চলেছিল। খননকার্য থেকে এ সবই প্রমাণিত হয়। তাহলে এখন প্রশ্ন হল এই আগুন লাগালো কারা, এই ধ্বংস চালালো কারা? তাহলে কি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুধু বন্ধুই ছিল না, গোপন ও প্রকাশ্য শত্রুরাও ছিল যারা বাইরে থেকে নয়, দেশের ভেতর থেকেই উঠে এসেছিল? আসুন আমরা এবার অন্য এক ঐতিহাসিকের কথাও শুনি। ইনি বৌদ্ধ। তীব্বতদেশীয় পন্ডিত ঐতিহাসিক তারানাথ। তারানাথের খুব গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ History of Buddhism in India তে তিনবার নালন্দার ওপর হামলার কথা বলা আছে। বিংশতিতম অধ্যায়ের নাম, Account of the Period of the Third Hostility to the Doctrine and of its Restoration, অর্থাৎ, “মতবাদের ওপর তৃতীয় শত্রুতা ও তার পুনঃস্থাপনা কালের বিবরণী”। তারানাথ নালন্দা মহাবিহারকে Sri Nalendra বলে অভিহিত করেছেন। এটা পরিষ্কার যে, তারানাথ নালন্দার ওপর হামলাকে বৌদ্ধদর্শন, সংস্কৃতি ও শিক্ষার ওপর আক্রমণ বলেই মনে করেছেন, তাই “Hostility to the Doctrine” কথাটা ব্যবহার করেছেন। কী বলছেন তারানাথ এই অধ্যায়তে? আমি সরাসরি কয়েকটি লাইন ওঁনার গ্রন্থ থেকে হাজির করতে চাই।
“Kakutsiddha, a minister of the King, built a temple at Sri Nalendra. During its consecration he arranged for a great ceremonial feast for the people. At that time, two beggars with tirthika views came to beg. The young naughty sramanera-s threw slops at them, kept them pressed inside door panels and set ferocious dogs on them. These two became very angry. One of them went on arranging for their livelihood and the other engaged himself to the surya-sadhana…… Thus he attained siddhi through the endeavour of twelve years.
He performed a sacrifice (yajna) and scattered the charmed ashes all around. This immediately resulted in a miraculously produced fire. It consumed all the eightyfour temples, the centres of the Buddha's Doctrine.
The fire started burning the scriptural works that were kept in the Dharmajagga of Sri Nalendra, particularly in the big temples called Ratnasagara, Ratnadadhi, and Ratnarandaka, in which were preserved all the works of Mahayana pitaka-s…..Many temples in other places were also burnt and the two tirthika-s, apprehending punishment from the King, escaped to Ha-sa-ma [Assam] in the north.”
একটা বড় অংশ উদ্ধৃত করতে হল কারণ ইতিহাসের এত বিকৃতি এই নির্লজ্জ ফ্যাসিবাদীরা ঘটায় এবং তা দিয়ে বাজার গরম করে যে প্রয়োজন হয়ে পড়ে আসল সত্যকে তুলে আনার ও বোঝার খাতিরে কিছুটা কষ্ট স্বীকার করা। তা হলে, কী দাঁড়াল তারানাথের কথায়? মন্ত্রী কুক্কুটসিদ্ধ নালন্দা মহাবিহার চত্ত্বরে একটি বৌদ্ধমন্দির নির্মাণ করেছিলেন। সেই উপলক্ষ্যে একটি ভোজসভা চলছিল। সেখানে দুজন তীর্থিকও এসেছিলেন। অল্পবয়সী দুষ্টু শ্রমনরা তাদের গায়ে কাদা ছোঁড়ে, দরজার ফাঁকে আটকে রাখে, হিংস্র কুকুর লেলিয়ে দেয়। তাতে এই দুজন প্রচন্ড রেগে যান এবং একজন ভিক্ষার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব নেন, অন্যজন সূর্যসাধনা শুরু করেন। বারো বছরের সাধনায় সিদ্ধি আসে। তখন তারা মন্ত্রপূত ছাই দিয়ে একটা ভয়ংকর ঐন্দ্রজালিক আগুন তৈরি করেন। ঐ আগুন নালন্দা মহাবিহারের চুরাশিটি মন্দিরে ছড়িয়ে পড়ে যেখানে বিপুল গ্রন্থাগার ছিল। আর শাস্তির ভয়ে তীর্থিক দুজন আসামের দিকে পালিয়ে যান।
তীর্থিক কারা?
ভারতে মুসলমানদের আগমনের সময় থেকে এদেশের লোকেদের সামগ্রিকভাবে তারা হিন্দু নামে ডাকতে থাকে বলে অনেকেই অভিমত দিয়েছেন। এইসব লোকেরা নিজেদের অবশ্য তা বলত না। বৌদ্ধ, জৈন, শৈব, বিষ্ণুমতের বৈষ্ণব প্রভৃতি নানা কিছু তারা নিজেদের সম্পর্কে বলত। ইতিমধ্যে প্রাচীন বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্যধর্ম পৌরানিক ধর্মে অভিযোজিত হয়েছিল। আচার্য রামানুজের দ্বৈত বেদান্ত এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক ভিত্তি রচনা করেছিল। কালক্রমে এই পৌরানিক ধর্মানুসারীরাই হিন্দু নামে পরিচিত হন। তীর্থে তীর্থে ভ্রমণ করতেন বলে বৌদ্ধরা ব্যঙ্গ করে এদের তীর্থিক নামে অভিহিত করত। সন্মাত্রানন্দের তাত্ত্বিক উপন্যাস ‘'নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা’ থেকে নিচের কথাগুলি উদ্ধৃত করা যেতে পারে। ভারত থেকে নেপাল হয়ে তিব্বত যাওয়ার পথে অতীশ দীপঙ্করের শ্রমণ দলটির সাথে ভারতীয় সীমার মধ্যে পাহাড়ী অঞ্চলে দেখা হয়েছিল কয়েকজন হিন্দু সন্ন্যাসীর। তাঁদের কথোপকথন নিম্নরূপ:
“যাত্রীদল সেইসব গুহাসম্মুখে উপনীত হলে এক গুহামুখে জনৈক গৈরিক বাস পরিহিত মুন্ডিতমস্তক সন্ন্যাসী আবির্ভূত হলেন। মাঙ্গলিক বাক্য উচ্চারণ করে সেই ব্যক্তি বললেন, “ভদ্রমন্ডলী আপনারা কারা? কোথা হতে এলেন? এই দুর্গমপন্থায় কোথায়ইবা চলেছেন?”
পুরোবর্তী ক্ষিতিগর্ভ উত্তর দিলেন, “আমরা বৌদ্ধ শ্রমণ। সম্প্রতি নেপাল অভিমুখে চলেছি। আপনারা?”
উত্তর এল, “আমরা হিন্দু সন্ন্যাসী। এ আমাদিগের মঠ। আপনারা আমাদিগকে ব্যঙ্গ ভরে ‘তীর্থিক’ উপাধিতে ভূষিত করেন।” শেষ বাক্যটি উচ্চারণকালে সন্ন্যাসীর কন্ঠে পরিহাস ও বিরুদ্ধতার ঝাঁজ ফুটে উঠল।”
নালন্দায় আগুন লাগানোর যে ঘটনাটি তারানাথ বলেছেন তা খুবই আগ্রহোদ্দীপক। তীর্থিকদের সাথে বৌদ্ধদের সংঘাত কতটা বিদ্বেষপূর্ণ ছিল তা উক্ত ঘটনায় দেখা যায়। সন্মাত্রানন্দও উক্ত বিদ্বেষের কথা পুনরুক্ত করেছেন। পারষ্পরিক এই বিদ্বেষ এবং প্রতিযোগিতা এতটাই তীব্র ছিল যে বৌদ্ধদের ভোজসভায় দুজন তীর্থিক এসে হাজির হলে অল্পবয়সী (ফলত অবিবেচক) শ্রমণরা তাদের উত্তক্ত করে। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় তীর্থিকরা যা করলেন তা আপাতদৃষ্টিতে লঘু পাপে গুরু দন্ড বলেই প্রতীয়মান হয়। তারা গোটা নালন্দা মহাবিহারে, বিশেষ করে নালন্দার গ্রন্থাগার অবস্থিত ছিল যে মন্দিরগুলিতে, তাতে এক ভয়ংকর অগ্নিকান্ড ঘটালেন। এই অগ্নিকান্ড কিন্তু সাধারণ অগ্নিকান্ড নয়। এর জন্যে তাদের বারো বছর অপেক্ষা করতে হল। তথাকথিত সূর্যসাধনা বলে যা বলা হয়েছে তা আসলে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা এক কুটিল ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। নিশ্চিতভাবেই এই অনুমান করা যায় যে, এর পেছনে বহু লোক যুক্ত হয়েছিলেন। এমনভাবে আগুন লাগানো হয়েছিল যে তা সহজে নির্বাপিত করা সম্ভব হয় নি। নালন্দার সুবিখ্যাত বিপুল গ্রন্থাগারের অধিকাংশই ধ্বংস হয়ে যায়। এই শত্রুতাও শুধু একদিনের কিছু কিশোর শ্রমনের দুষ্টুমির প্রতিক্রিয়ায় ঘটতে পারে না। এর পেছনে দুটি শত্রুতাপূর্ণ শিবিরের দীর্ঘদিনের সংঘাতের ইতিহাস রয়েছে।
বৌদ্ধদের প্রকাশ্য ও গোপন শত্রুরা
ভারতের ইতিহাস যারাই কমবেশি চর্চা করেছেন তারা জানেন যে, এদেশের দার্শনিক-তাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রধান সংঘাত বেধেছে ব্রাহ্মণ্যপন্থার সাথে শ্রামণ্যপন্থার। ব্রাহ্মণ্যপন্থার উৎপত্তিস্থল হল বেদ বা বৈদিক ভাবধারা। শুরুতে এই ভাবধারার যে চেহারাই থাকুক না কেন ক্রমশ তা বিবর্তিত হয় ব্রহ্মবাদে যেখানে মূল ধারণা হল ব্রহ্মের ধারণা। সকলই ব্রহ্ম। সকলেরই উৎপত্তি হয়েছে ব্রহ্ম থেকে। এই ভাবধারা অতি সত্ত্বর ভারতের শাসক সম্প্রদায় ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের দার্শনিক-রাজনৈতিক ভাবধারায় পরিণত হয়। অন্যদিকে, শ্রামণিকপন্থা বা শ্রামণ্যপন্থার মূল ধারণা ছিল শ্রমের ধারণা। শ্রমণরা বেদের কর্তৃত্ব মানতে অস্বীকার করেন। গুরুবাক্যকে বা শাস্ত্রবাক্যকে জ্ঞানলাভের সর্বোত্তম পথ হিসাবে দেখতে অস্বীকার করেন। প্রত্যক্ষ ও অনুমান (যুক্তি) -এর ভিত্তিতে প্রকৃতি ও সমাজের অবলোকন, পরীক্ষণ, পর্যালোচনা ও তত্ত্বায়নই হল জ্ঞানলাভের একমাত্র পন্থা এই ছিল তাঁদের মত। স্বাভাবিকভাবেই, ব্রহ্মবাদীরা যেখানে গুরুর আশ্রমে (বেদান্ত) শাস্ত্র পাঠের মধ্যে দিয়েই জ্ঞানচর্চা করত, সেখানে বৌদ্ধরা দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, মহাকাশবিদ্যা, আয়ুর্বেদ, স্থাপত্যকলা প্রভৃতি জ্ঞানের সকল শাখায় বিপুল অগ্রগতি ঘটাতে সমর্থ হন। যেহেতু শ্রমই হল সকল জ্ঞানের জননী তাই শ্রমভিত্তিক শ্রামণ্যপন্থা জ্ঞানেবিজ্ঞানে অগ্রসর হয়। তাত্ত্বিক-দার্শনিক-সাংস্কৃতিক জগতের এই শিবির বিভাজন বাস্তবের শ্রেণিবিভাজনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিল। ব্রাহ্মণ্যপন্থা কড়াকড়িভাবে বর্ণজাতি বিভাজনকে মেনে চলত। অন্যদিকে শ্রামণ্যপন্থা সকল মানব সমান, সুতরাং সবেতেই সকলের সমান অধিকার এই মত প্রচার করত। স্বাভাবিকভাব, শাসক ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের বিপরীতে ভারতের শ্রমজীবি সম্প্রদায় বৈশ্য-শুদ্র-অন্তজরা ব্যাপকভাবে শ্রামণ্যপন্থার সমর্থক ছিল। আর ব্রাহ্মণ্যবাদের অধিপতিরা ছিল শ্রামণ্যপন্থার ঘোষিত শত্রু।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে এক একটি রাজত্ব তার মতাদর্শ হিসাবে হয় ব্রাহ্মণ্যপন্থা অথবা শ্রামণ্যপন্থাকে বেছে নিয়েছে। ফলত, রাজ্য পরিচালনাও হয়েছে দুভাবে। ব্রাহ্মণ্যপন্থা এবং শ্রামাণ্যপন্থা ছিল দুটি শিবির। এক একটি শিবিরের মধ্যে অনেকগুলি শক্তি জড় হয়েছিল। ব্রাহ্মণ্যপন্থার অধীনে যেমন বেদান্তপন্থীরা (উত্তর মীমাংসাবাদী), জৈমিনেয়রা (পূর্ব মীমাংসাবাদী), নৈয়ায়িকরা প্রভৃতি ছিল, তেমনি শ্রামাণ্যপন্থার অধীনে বৌদ্ধ, জৈন, চার্বাক, অজীবক প্রভৃতিরা ছিলেন। ব্রাহ্মণ্যপন্থার নেতা হিসাবে একদিকে যেমন বেদান্তবাদীরা উঠে এসেছিলেন, অন্যদিকে তেমনি শ্রামাণ্যপন্থার নেতা হিসাবে বৌদ্ধদের উত্থান ঘটে৷ গৌতম বুদ্ধের সময়কালে ছিল হর্যঙ্ক বংশের রাজত্ব। বিম্বিসার বৌদ্ধ হয়ে যান। বিম্বিসারের পুত্র অজাতশত্রু বিম্বিসারকে বন্দী করে পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ্য পুনরভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন। ফলে হর্যঙ্ক বংশ কখনও শ্রামণ্যপন্থা, কখনও ব্রাহ্মণ্যপন্থার মধ্যে দোল খেতে থাকে। পরবর্তীতে অশোকের সময় থেকে দেশের প্রধান রাজবংশ আবার বৌদ্ধ চেহারায় ফিরে আসে। কিন্তু শেষ মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথকে হত্যা করে ন্রাহ্মণ সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ ফের ব্রাহ্মণ্যবাদী অলিন্দ অভ্যুত্থান ঘটান। ফের শুরু হয় ব্রাহ্মণ্যবাদের কাল। আরও পরে গুপ্তসাম্রাজ্য ব্রাহ্মণ্যপন্থা আর শ্রামণ্যপন্থার মাঝামাঝি অবস্থান নেয়। গুপ্ত সম্রাটরা বৌদ্ধ ছিলেন না, আবার কট্টর ব্রাহ্মণ্যবাদীও ছিলেন না। বৈশ্য সাম্রাজ্য হিসাবে তাঁরা মূলত কৌটিল্যবাদী রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতির অনুগামী ছিলেন।
নালন্দার মত আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা প্রথম করেছিলেন সম্রাট অশোক। কিন্তু তাঁর সময়ে তা বাস্তবায়িত হতে পারে নি। গুপ্ত সম্রাটরা তা রূপায়িত করেন। বৌদ্ধ সঙ্ঘও ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর যথেষ্ট পরিপক্ক হয়ে উঠেছিল। গুপ্ত সম্রাট কুমারগুপ্ত ৪৩৬ সাল নাগাদ যখন বিশ্ববিফ্যালয় শুরু করলেন তখন তার পরিচালনভার দিলেন কিন্তু বৌদ্ধসঙ্ঘকে। নিজেরা অবৌদ্ধ হয়েও এই সিদ্ধান্ত তাঁরা নিয়েছিলেন কারণ তাঁর জানতেন যে ব্রাহ্মণ্যবাদী জ্ঞানচর্চার ধরণ এতটাই অবৈজ্ঞানিক যে তা দিয়ে শিক্ষাদীক্ষার কাজ চলবে না। খেয়াল করবেন যে, সাতশো বছরে অধিক কাল বিশ্ববিদ্যালয় চলেছে দেশবিদেশের বিভিন্ন ধর্মের ও বিশ্বাসের লোকেদের, বিশেষ করে, রাজা ও বণিকদের অর্থানুকূল্যে। কিন্তু কখনই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনভার অবৌদ্ধদের হাতে যায় নি, তা করার কথা কেউ কল্পনাও করতে পারে নি। এর কারণ নিহিত ছিল বৌদ্ধদের জ্ঞানের উৎকর্ষতার মধ্যে। একে একে বৌদ্ধরা ওদন্তপুরী মহাবিহার এবং বিক্রমশীলা মহাবিহারেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসাবে একাধিক বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষমতা একমাত্র বৌদ্ধদেরই ছিল কারণ তাঁদের জ্ঞানচর্চার ধরণটাই ছিল বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই নালন্দায় সেই সময়ে জ্ঞানের যে যে শাখাগুলি আবিষ্কৃত হয়েছিল তার সবগুলিই চরম উৎকর্ষতায় অধ্যয়ন হত। দর্শন, তত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, স্থাপত্যবিদ্যা, মহাকাশবিদ্যা, ভেষজবিদ্যা প্রভৃতি সকল কিছু। সেই টানেই দেশবিদেশের জ্ঞানী, মেধাবী পন্ডিত ও ছাত্রের দল ভারতে ছুটে আসতেন।
স্বাভাবিকভাবেই, এটা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কাছে ছিল ভয়ঙ্কর ঈর্ষার কারণ। সমাজে জ্ঞানের পরাকাষ্ঠা বলে পরিচিত ছিলেন ব্রাহ্মণরা। অথচ তারাই রইল কি না নাম যশ প্রতিপত্তি আর আলোকবৃত্তের বাইরে! সারা বিশ্ব ধন্য ধন্য করছে শুদ্র-বৈশ্যের মত ছোটলোকদের মদতকারী বৌদ্ধ শ্রমণদের। এ জিনিস ছিল তাদের সহ্যের বাইরে। ফলে কালে কালে, নালন্দার গোটা সময়কাল জুড়ে তৈরি হয়েছে বৌদ্ধদের তথা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়েরও অজস্র গোপন শত্রু। তারা কুটিল ষড়যন্ত্র করেছে, বিভিন্ন রাজশক্তিকে বিশ্ববিদ্যাল্যগুলিকে আক্রমণ করতে প্ররোচিত করেছে। বেদান্তগুরু আচার্য শংকর আর মীমাংসকগুরু কুমারিল ভট্টরা করেছে গোপন পরিকল্পনা। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল শত্রু ছিল দেশের মধ্যেই। বহিরাগত লুন্ঠনকারীরা লুঠপাঠ করতে এদেশে এসেছিল। তা তারা করেছেও। কিন্তু বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শত্রুতা তাদের ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ধনরত্ন থাকত না। তা তারাও জানত।
শেষের কথা
আজকাল নরেন্দ্র মোদিরা এমন হাবভাব করছেন যে মনে হচ্ছে বুঝিবা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় নতুনভাবে গড়ে তোলাটা বিজেপির পরিকল্পনা। কিন্তু আসলে সে পরিকল্পনা পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের। প্রকৃতপ্রস্তাবে এই পরিকল্পনা শুধু ভারত সরকারেরও নয়। ২০০৭-এ অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়া শীর্ষ বৈঠকে ভারতের বিহার রাজ্যে প্রাচীন নালন্দা মহাবিহারের কাছেই নালন্দার নামে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা আলোচনা হয়। দক্ষিণ এশিয় দেশগুলি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। ২০০৯ সালের বৈঠকে তার চূড়ান্ত রূপদান করা হয়। সেই মত ২০১০ সালে ভারত সরকার নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ তৈরি করে। সেই মোতাবেক কাজ শুরু হয়। আর ২০২৪ সালে একটা ভবন উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী হিন্দু-মুসলমান খেলতে শুরু করে দিলেন। ভাষণ দিলেন নালন্দা গৌরব তারা ফিরিয়ে আনবেন। এদিকে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ক্রমাগত শিক্ষায় বাজেট কমানো হচ্ছে। উচ্চশিক্ষার দ্বার সাধারণ ঘরের ছাত্রছাত্রীদের কাছে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সংরক্ষণ ব্যবস্থা তুলে দেওয়া আর ক্রমাগত বেসরকারীকরণ করার ফলে তথাকথিত পিছিয়ে পড়া অংশগুলি থেকে ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। সিলেবাস থেকে বাদ পড়ছে সঙ্ঘ পরিবারের অপছন্দের জিনিস। আর জবরদস্তি ঢোকানো হচ্ছে জ্যোতিষবিদ্যা, পুরোহিতবিদ্যার মত অবৈজ্ঞানিক বিষয়বস্তু। ইতিহাস থেকে বাদ যাচ্ছে ইসলামের ইতিহাস। বিজ্ঞান থেকে বাদ যাচ্ছেন স্বয়ং ডারউইন। উত্তর ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের পড়াতে হচ্ছে ভয়ে ভয়ে। কী বলতে কী বলে ফেলে শেষে গণধোলাই খেয়ে মরতে হয় নাকি চাকরি যায় সেই ভয়ে সবাই কাঁটা। ইতিহাসের ক্লাসে রাম কোনো ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন না এমন কথা বলার দুঃসাহস আজ করবেন না কোনো শিক্ষক। মুক্তচিন্তার সলিল সমাধি হয়ে গেছে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে। এই যেখানে অবস্থা সেখানে শিক্ষাদীক্ষার কোন গৌরব ফেরৎ আনবেন মোদিরা? গুপ্ত রাজারা তো এই কারণেই ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ভার দেন নি। আর আজ ব্রাহ্মণ্যবাদী ফ্যাসিবাদীরাই দেশের পরিচালক, শিক্ষার পরিচালক। তাই এদের হাতে নালন্দা পুনর্গঠিত হতে পারে না। তা সম্ভব নয়।