আমার এক বন্ধু ঘর নিয়ে ভেবেছে অনেক, কিন্তু রান্নাঘর নিয়ে ভাবেনি কখনও। সেটা চেতনার গভীরে থাকা পিতৃতন্ত্র, নাকি কখনও না করার জন্য, জানি না। এখন, এই করোনার সময়, ব্যাপারটা কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। সকালে উঠে নিজে চা করা, বিস্কুট ক'টা রইল দেখা, তারপর ব্রেকফাস্ট তৈরি, গাছে জল দেওয়া, ঘর মোছা, পড়াশোনা বা লেখালিখি, ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ানো, শুনশান রাস্তা দেখা.. মাঝেমধ্যে একজন চেনা কালো কুকুর উল্টোদিকের সরকারি অফিসের লম্বা পাঁচিলের নীচে ঘুরঘুর করছে, তাকে বিস্কুট দেওয়া.. বেলা বাড়লে দুপুরের রান্না নিয়ে ভাবা, চাল ধোয়া, ডাল ধোয়া, আলুর খোসা ছাড়ানো.. ডিম করবে কি করবে না ভাবা, করলে রসদে টান পড়বে না তো.. এসব ভাবতে ভাবতে রোদ চড়ছে.. দড়িতে মেলা কাপড়জামা শুকিয়ে এল প্রায়, তুলতে হবে। তারপর স্নান, খাবার বেড়ে খাওয়া, বাসন মাজা... আস্তে আস্তে বিকেল এল.. আকাশে মারকাটারি রঙের খেলা.. রাস্তা শুনশান, প্রচুর পাখির ডাক, আগে এত পাখির ডাক শোনা যেত না ও পাড়ায়.. একটা বাচ্চা কেঁদে উঠল কোথাও, টিভি চলছে.. লিখতে বসা.. একঘেয়েমি.. আবার চা বানিয়ে খাওয়া.. আস্তে আস্তে রাত, দু-একটা ফোন..আবার রান্না, বাসন মাজা...এই গোটা ব্যাপারটা হয়তো একটা লার্নিং প্রসেস হতে চলেছ ওর জন্য। একটা গোটা থ্রি বিএইচকে ফ্ল্যাটে ও একা। সারভাইভ করছে করোনায়। প্রিয়জনদের জন্য চিন্তা, খুব চেনা গরীব পাড়াগুলোর জন্য টেনশন, নিজের আপাত নিশ্চিন্ত অবস্থানের জন্য তৈরি হওয়া অপরাধবোধ আর অসহায়তার নৌকোয় ভাসতে ভাসতে কেটে যাচ্ছে দিন।
আমাদের মধ্যে তো একইসঙ্গে অনেকগুলো সত্ত্বা বেঁচেবর্তে থাকে। তার কোনওটা হয়তো অসম্ভব গতিময়, এক শহর থেকে অন্য শহরে, এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে দৌড়ে বেড়াতে চায়। ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সমকালের ভরকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে টাল খেতে খেতে বুঝে নিতে চায় চারপাশকে। আবার তার পাশাপাশিই হয়তো অবস্থান করে অন্য একটি সত্ত্বা- শান্ত, নিস্তরঙ্গ এক জীবন। ঢেউ নেই, বয়ে চলা আছে। গ্রামের বাড়ির উঠোন থেকে দু'পা এগিয়ে দেখা ছোট পুকুরটার মতো, দুপুরবেলা আচমকা গুবগুব, নীচু হয়ে আসা ডাল থেকে হয়তো একটা পাতা পড়ল জলে.. জল যেন চমকে উঠল আর গোল গোল হয়ে সরে গেল, ঠিক যেন লজ্জাবতী পাতার মতো, নরম আর লাজুক। পাতাটা ভাসছে। শুধুই ভাসছে। এগোচ্ছে না, ভেসে আছে।
ঘরবন্দি থাকার দিনগুলি আমার বন্ধুটিকে কি ওর এই অপ্রকট সত্ত্বাটির মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ দেবে? যে ছেলেটি মগ্ন হয়ে থাকে ফেলে আসা ভিটের স্মৃতিতে, পূর্বপুরুষের রক্তাক্ত, মাটিমাখা পা যাকে ঘুমোতে দেয় না রাতের পর রাত, সে কি কখনও সেভাবে পূর্বনারীদের কথাও ভেবেছে? কলকাতার শহরের রাস্তায় রাস্তায় বারবার সে হেঁটে গিয়েছে কখনও না দেখা ঠাকুরদার সঙ্গে। প্রজন্মের দেওয়াল পেরিয়ে হাতড়ে হাতড়ে দেখেছে অভাব আর ভিটে হারানোর শোকে পাগল হয়ে যাওয়া এক প্রৌঢ়ের জীবন। সেই আধপাগল বাঙালের হাত ধরে সে পৌঁছে গিয়েছে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের গ্যালারিতে, লালশালুর মিছিলে... কিন্তু যে ঠাকুমা, যে প্রপিতামহী বা তারও আগের পূর্বনারীরা প্রতিদিন রান্না করতেন, সংসার সামলাতেন.. যুদ্ধের সময়, মড়কের সময়, দেশভাগের সময় এক একটা ভাতের দানার হিসেব করতেন যে মহামাতৃকুল, তাঁরাও তো আছেন রক্তের গভীরে কোথাও... তাঁরাও ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন রাষ্ট্রবিপ্লবে, মহামারীতে, দুর্ভিক্ষে। তাঁদের লড়াই হয়তো ছাপিয়ে গিয়েছে পূর্বপুরুষদেরও। আচমকা জুটে যাওয়া এই নির্জনতায় আমার বন্ধুটি কি তাঁদের খুঁজে পাবে নিজের সত্ত্বায়? তার কি দেখা হবে পূর্ববঙ্গের নদনদী-গাছপালা-ঝোপঝাড় পেরিয়ে আসা কালোপাড় সাদাশাড়িদের সঙ্গে? তাঁরা কি শিখিয়ে দেবেন কেমন করে বাঁচিয়ে রাখতে হয় রসদ, এই মড়কের দিনগুলিতে তাঁরা কি ভাগ করে নেবেন মন্বন্তরের অভিজ্ঞতা?
পাশের বাড়ির প্রেশার কুকারে আরেকটা সিটি পড়ল।