পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

আইনের শাসন, আইনের প্রহসন

  • 12 November, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1108 view(s)
  • লিখেছেন : অভিজ্ঞান সরকার
সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার তিনটি অঙ্গ, আইনসভা, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা। সংবিধানের বিধিনিষেধের মধ্যে থেকে আইন প্রণয়ন করতে পারে আইনসভা, সেই আইন অনুযায়ী কাজ করার কথা প্রশাসনের। সুপ্রিম কোর্টের মতাদর্শ নিরপেক্ষ ও নির্ভীক বিচারকেরাই পারেন দেশে আইনের শাসনকে কার্যকরী করে তুলতে, শাসকের রক্তচক্ষু ও প্রলোভনকে উপেক্ষা করে। অতীতে ভারতীয় বিচারব্যবস্থা তথা সুপ্রিম কোর্ট বিশেষ ক্ষেত্রে নতজানু হয়েছে শাসকের কাছে (যেমন জরুরি অবস্থার সময়ে), কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে, গত ৮ বছরে বিচারব্যবস্থা তথা সুপ্রিম কোর্ট ক্রমাগত শাসকের আদালতে পরিণত হচ্ছে, কোর্টে সলিসিটর জেনারেল সরকার পক্ষের হয়ে যা বলেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটাই রায় হিসেবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সম্প্রতি দায়িত্ব নেওয়া প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের আপাত প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গীর রায়গুলির বিপ্রতীপে রয়েছে বাবরি-অযোধ্যা সংক্রান্ত, বা বিচারপতি লোয়ার মৃত্যুর পুনর্তদন্ত সংক্রান্ত অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক রায়। সংবিধানের উপরে ফ্যাসিবাদি আক্রমণের এই সঙ্কটমুহূর্তে সুপ্রিম কোর্ট কী অবস্থান গ্রহণ করে তার উপরে ভারতীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ বহুলাংশেই নির্ভর করছে।

 

দিন কয়েক আগে The Wire সংবাদ মাধ্যমে একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট দুষ্যন্ত দাভের, নিয়েছিলেন করণ থাপার। ভারতের নতুন প্রধান বিচারপতি পদে শপথ নেবেন জাস্টিস ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়, দুই বছরের জন্য – সাক্ষাতকারের মূল বিষয় ছিল নতুন প্রধান বিচারপতি কি এই দেশের বিগড়ে যাওয়া বিচারব্যবস্থাকে কোনো আশার দিক দেখাতে পারবেন, এই হিন্দুত্ববাদের ভয়ংকর আধিপত্যের বিপরীতে? জাস্টিস চন্দ্রচূড় বিগত দিনে বাক-স্বাধীনতা বিষয়ে দুর্দান্ত সব প্রগতিশীল মন্তব্য করেছেন ও রায় দিয়েছেন। রাইট টু প্রাইভেসি, ৩৭৭ ধারাকে অপরাধমুক্ত করার ক্ষেত্রে, গর্ভপাতের অধিকার বা শবরীমালায় মহিলাদের প্রবেশের অধিকার ইত্যাদি উদারনৈতিক রায়, বাক স্বাধীনতা নিয়ে স্পষ্ট মতামত, ‘the blanket leveling of dissent as anti-national or anti-democratic strikes at the heart of our commitment to constitutional values’, জাস্টিস চন্দ্রচূড়ের প্রতি বহু মানুষের আস্থা তৈরি করেছে। অ্যাডভোকেট দাভেও সেরকম কিছু বলবেন এই আশায় সাক্ষাৎকার শুনতে বসলাম।

সাক্ষাৎকার শেষে বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে বুঝলাম, উদার মতামতে মুগ্ধ হয়ে যাওয়া আমাদের যুগের অসুখ। উকিল সুলভ যুক্তি বিস্তার করে অ্যাডভোকেট দাভে বোঝালেন জাস্টিস চন্দ্রচূড়ের রায় প্রগতিশীল সে সব কেসের ক্ষেত্রেই যেখানে শাসক দলের অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদির সরকারের সাথে স্বার্থের সংঘাত নেই। বিভিন্ন সংবেদনশীল রাজনৈতিক কেসের ক্ষেত্রে ওনার রায় ভুল বা পক্ষপাতযুক্ত। জাস্টিস লোয়ার রহস্য মৃত্যুতে তদন্ত কমিশনের দাবী খারিজ করা ( জাস্টিস লোয়া অমিত শাহের সিট মামলার রায় দানের কিছুদিন আগে মারা যান, তাঁর পরিবার তদন্তের দাবী করেছিলেন), হাদিয়ার কেসে ‘লাভ জিহাদ’এর মামলায় এনআইএকে তদন্তের অনুমতি দেওয়া,  বিসিসিআইএর সেক্রেটারি পদে অমিত শাহের পুত্র জয় শাহের পুনঃনির্বাচনে সম্মতিদান (জাস্টিস লোধার সুপারিশ অগ্রাহ্য করে), অর্ণব গোস্বামীর জামিন মঞ্জুর করার ক্ষেত্রে অতি-তৎপরতা – জাস্টিস চন্দ্রচূড়ের রেকর্ডে এইগুলিও রয়েছে। ২০১৯এ বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির তৈরির রায় দিয়েছিল যে বেঞ্চ তার অন্যতম ছিলেন জাস্টিস চন্দ্রচূড়। তার চেয়েও জটিল বিষয়, জ্ঞানব্যাপী মসজিদকে কেন্দ্র করে যে বিষাক্ত প্ররোচনার রাজনীতি শুরু করেছে হিন্দুত্ববাদীরা ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনকে মাথায় রেখে, সেই মামলাতেও জাস্টিস চন্দ্রচূড়ের রায় অতি হতাশাজনক। ২০২২ এর মে মাসে তার বেঞ্চ জ্ঞানব্যাপী মসজিদে শিবলিঙ্গ আছে কিনা তা সমীক্ষা করার চালাবার অনুমতি দিলেন। যদিও আমরা জানি ১৯৯১ সালে বাবরি ধ্বংসের পর ভারত সরকার একটি আইন প্রণয়ন করে যার নাম দি প্লেসেস অফ ওয়ারশিপ (স্পেশাল প্রভিশন) অ্যাক্ট, যার মোদ্দা বিষয় হল ১৯৪৭ এর আগে পূজিত ধর্মীয় স্থানের চরিত্র পরিবর্তন করা যাবে না। সেই আইন দেখিয়ে জ্ঞানব্যাপীর তলায় কোন ঘোড়ার ডিম রয়েছে তা নিয়ে বাজার গরম করার চেষ্টায় সুপ্রিম কোর্ট জল ঢেলে দিতে পারতো, কিন্তু জাস্টিস চন্দ্রচূড় জিইয়ে রাখলেন ইস্যুটিকে, আইনি ভাবে, আইনকে এড়িয়ে।

জাস্টিস চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চেই গত অক্টোবর মাসের ১৫ তারিখ জি এন সাইবাবা সহ মহেশ তিকরি, হেম মিশ্র, প্রশান্ত রাহী, বিজয় তিকরির মামলাটি ওঠে, ওই দিন মুম্বই হাইকোর্টের রায়ে তারা  বেকসুর মুক্তি পেয়েছিলেন। ওই দিনই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় মহারাষ্ট্র সরকার সুপ্রিম কোর্টে এই মুক্তি বাতিলের আবেদন করে, সরকারের পক্ষে উকিল ছিল সলিসিটার জেনারেল তুষার মেহেতা। জাস্টিস চন্দ্রচূড় ও জাস্টিস কোহলি সেইদিন বিবাদী পক্ষের কেউ উপস্থিত না থাকায় মামলাটি শোনেননি - আইনমাফিক সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারপর যা হল তা সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে অভূতপূর্ব, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রি পরে দিনই মামলার শোনার সময় ঠিক করলো - যে দিনটা ছিল শনিবার, সুপ্রীম কোর্টে ছুটির দিন। নব্বই শতাংশ প্রতিবন্ধী এক কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীর বন্দীদশা কায়েম রাখতে ছুটির দিনে কোর্ট খুলে রাখা হল। ভারতের বিভিন্ন গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ যারা সাইবাবা সহ অন্যান্যদের মুক্তির সম্ভাবনায় আশান্বিত হয়েছিলেন তাদের প্রত্যাশার ফানুস ফুটো করে সাইদের মুক্তির রায় বাতিল করল সুপ্রীম কোর্ট, পরের দিনই।

এখন প্রশ্নটা হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের এই তৎপরতা কি অন্যান্য মামলাগুলিতে দেখা যাচ্ছে যেখানে নাগরিক অধিকারের প্রশ্ন ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে, সাংবিধানিক অধিকারগুলি দিনের আলোয় লঙ্ঘন করা হচ্ছে? এককথায় উত্তর হচ্ছে, না – ভারতের বিচার ব্যবস্থা (জুডিসিয়ারি) বর্তমানে শাসকদের (এক্সিকিউটিভ) তৃপ্ত করতে ও মান্য করতে ব্যস্ত। এই বিশেষ অবস্থা একটি বিশেষ রাজনৈতিক স্তরকেই ইঙ্গিত করে যাকে ফ্যাসিবাদ বলা হয়। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা একটি মৌলিক বিষয়, যা শাসকের দর্শনের প্রভাবের বাইরে থাকার কথা। যদিও এই কেতাবি কথাবার্তার বাস্তবতা প্রয়োগ কম, শাসক ও বিচার ব্যবস্থার দহরম মহরমের ইতিহাস ইন্দিরা গান্ধীর শাসনকালে নির্লজ্জ রূপ নিয়েছিল - সুপ্রিম কোর্ট এমার্জেন্সিকে আইনি বৈধতা দিয়েছিল। পরবর্তীকালে আবার একটা পর্যায় আসে যেখানে বিচার ব্যবস্থা নিজের স্বতন্ত্রতাকে বজায় রাখার জন্য নানান অভ্যন্তরীণ সংশোধন করে। বিশেষত সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় একজিকিউটিভের প্রভাব মুক্ত রাখার জন্য কলোজিয়াম প্রথা পরিপূর্ণভাবে চালু করে ১৯৯৮ সাল থেকে (যদিও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া খুবই অভিজাত স্বজনপোষণ ও উচ্চবর্ণের আধিপত্যের দোষে দুষ্ট, তবে এখানে তা আলোচ্য নয়)।

ঘটনা হচ্ছে, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতীয় বিচারব্যবস্থা ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারদানের যে গুণগত অবনমন ঘটেছে তা দেখার মত। বিচারব্যবস্থা বলতে আগে যা বোঝানো হত তা হল নিরপেক্ষতা, আগেকার দিনে সিনেমাটিনেমাতেও আদালতের দৃশ্যকল্প ছিল এক সাদা রঙের মহিলা চোখে কালো কাপড় বেঁধে হাতে দাঁড়িপাল্লা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, অর্থাৎ আন্ধা কানুন, বিচার সবার জন্য এক। আইন মানে যার নড়চড় হয় না, যেকোন পরিস্থিতিতে তার প্রয়োগ হবে অভিন্ন। কিন্তু আমরা কি দেখছি? উমর খালিদের কেসের যদি উদাহরণ নেই, গত অক্টোবর মাসে উমরের জামিন নাকচ করেছে দিল্লী হাইকোর্ট। উমর ২০২০ সালের দিল্লীর দাঙ্গায় উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে ইউএপিএ ধারায় অভিযুক্ত। যদিও অভিযোগগুলি অস্পষ্ট ও অসত্য, সেই নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ পেয়ে যাবেন ইন্টারনেটে। চমকের বিষয় হল এই দিল্লী হাইকোর্টের বিচারপতি ভাম্বানী ২০২১এ আসিফ ইকবাল তানহা, নাতাশা নারওয়াল ও দেবাঙ্গনা কালিতাদের জামিন দিয়েছিলেন – তারাও দিল্লীর দাঙ্গায় উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে ইউএপিএ ধারায় অভিযুক্ত ছিলেন। সেক্ষেত্রেও পুলিশের অভিযোগ ছিল ভুয়ো। একই ধারায় অভিযুক্তদের একই কোর্ট জামিন দিচ্ছে, অথচ উমরের জামিন হল না। তার জন্য কি তার ধর্ম পরিচয় দায়ী? নাকি শাসকের নির্দেশ রয়েছে উমর খালিদকে না মুক্তি দেবার? যাই কারণ হোক, উমরের জামিন নাকচের আদতে বিচারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। (আরো চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে জামিনের আবেদন খারিজ করতে গিয়ে বিচারপতিরা কিছু মন্তব্য করেন। উমর দিল্লী থেকে বহুদূরে কোন এক স্থানে কোন এক বক্তৃতায় ‘ইনকিলাবি সালাম’ ও ‘ক্রান্তিকারী ইস্তিকবাল’ বলেছিলেন, এই সব শব্দে বিচারপতিদ্বয় ইন্ধন যোগানোর উপাদান খুঁজে পেয়েছেন যা তার জামিনের বিরুদ্ধে গেছে)।

আমরা সিদ্দিক কাপ্পানের মামলা স্মরণ করতে পারি যেখানে এলাহাবাদ হাইকোর্ট কাপ্পানের জামিন খারিজ করে মন্তব্য করে তার হাথরাসে কোন কাজ নেই, ‘Siddique Kappan had no work in Hathras’ - কাপ্পান হাথরাসে একটি দলিত মেয়ের ধর্ষণ ও হত্যার সংবাদ সংগ্রহে যাচ্ছিলেন, একজন সাংবাদিকের যা কর্তব্য তাই তিনি পালন করছিলেন। কাপ্পানকে গ্রেপতার করে ইউএপিএ আইনে দুইবছরের বেশি সময় আটকে রাখা হল। এই নির্লজ্জ গ্রেপ্তারির নিয়ে হাইকোর্টের উপরোক্ত বক্তব্য স্তম্ভিত করবার মত শুধু নয়, বিচারকের মনোভাবকেও স্পষ্ট করে। হিন্দুত্ববাদী শাসক মুসলিমদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে গন্য করে, মুসলিমদের স্বাধীন মতপ্রকাশ ও চলাচলের উপর লাগাম লাগাতে চায়, হাইকোর্টের উক্ত বিচারকও তাই চান। হিন্দুত্ববাদের মতাদর্শ বিচারবিভাগের এজলাসকে প্রভাবিত করছে।

নিম্ন আদালতগুলি নিয়ে বেশি কালি খরচ করার প্রয়োজন নেই, আমরা বরং মোদির আমলে সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা কেন্দ্রীভূত করি। সুপ্রিম কোর্ট ভারতীয় সংবিধান রক্ষার জিম্মাদার, সংবিধানে যে মৌলিক অধিকারগুলি ভারতীয় নাগরিকদের দেওয়া হয়েছে তাকে রক্ষা করার দায় সুপ্রিম কোর্টের। নির্বাচিত শাসক যদি নাগরিকের অধিকার কেড়ে নেবার চেষ্টা করে সেক্ষেত্রেও সুপ্রিম কোর্ট ঢাল হয়ে দাঁড়াবে এইটা গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের আশা। কিন্তু কার্যত আমরা কি দেখছি? একের পর এক প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে নরেন্দ্র মোদীদের সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে গত আট বছরে। আমরা স্মরণ করতে পারি অরুণাচলের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কালিখো পলের সুইসাইড নোটের কথা – সেই চিঠিতে কালিখো পল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জেএস খেহর ও অন্যান্য বিচারপতিদের বিরুদ্ধে ঘুষের চাওয়ার অভিযোগ এনেছিলেন। বিচারপতি জেএস খেহর তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিজেই বাতিল করে দেন। বিচারপতি জেএস খেহরের পরবর্তী প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের আমলে এমন একটি ঘটনা ঘটে যা ভারতের বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে আগে ঘটেনি - সুপ্রীম কোর্টের চার জন সিনিয়র বিচারপতি প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সাংবাদিক সম্মেলন করে বসলেন, গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলি প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র নিজের পছন্দের বেঞ্চে পাঠাচ্ছেন এই অভিযোগে। (যেমন ছিল বিচারপতি লোয়ার রহস্যমৃত্যু নিয়ে মামলাটি)।  প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের বিরুদ্ধেও ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। পরবর্তী প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ তার বিরুদ্ধে ওঠা শ্লীলতাহানির অভিযোগ বিচারের সময় নিজেই সেই বেঞ্চের মাথা হয়ে রায়দান করলেন, রাম মন্দির মামলায় মন্দির নির্মাণের রায় দিলেন ও অবসরের পর বিজেপির রাজ্যসভার সদস্য হয়ে গেলেন। পরবর্তীতে আসা প্রধান বিচারপতি বোবদে প্রকাশ্যেই সংবিধানের ৩২ নম্বর ধারার ব্যবহার নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এই ধারায় প্রতিটি নাগরিককে সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন হলে সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন হবার অধিকার দেওয়া হয়েছে।

প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র থেকে শুরু করে বোবদের সময় অব্ধি সুপ্রীম কোর্ট বিভিন্ন মামলা শুনতে অনীহা প্রকাশ করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় – সিটিজেনস অ্যামেন্ডমেন্ড অ্যাক্টের মামলা, কাশ্মীরের ৩৭০ বিলোপের মামলা ইত্যাদি। কাশ্মীরের সিপিএম নেতা তারিগামির অবৈধ আটক নিয়ে করা হেবিয়াস কর্পাস মামলায় রঞ্জন গগৈ যে রায় দিয়েছিলেন তাতে গোটা ভারত জুড়ে অবৈধ ধরপাকড় মান্যতা পাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এনআরসি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় লক্ষ লক্ষ মানুষকে জীবন জীবিকার অধিকার কেড়ে নেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করেছে, অধিকার সুরক্ষিত করবার বদলে। ইলেক্টরাল বন্ড নিয়ে মামলা পাঁচ বছরে পাঁচজন আলাদা আলাদা প্রধান বিচারপতি শুনেছেন, আজও শুনে যাচ্ছেন, কোনো রায় দিচ্ছেন না – ওদিকে বিজেপি হাজার হাজার কোটি টাকার চাঁদা তুলছে বন্ডের সাহায্যে। সিদ্দিক কাপ্পানের জামিনের মামলা শুনতে বছর লাগিয়ে দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট, আর নিম্ন আদালতে কেস ওঠার আগেই অর্ণব গোস্বামীর জামিন দিয়ে দিলেন বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ। যে বিতর্কিত কৃষি বিল লোকসভা বা রাজ্যসভায় পাস না করিয়েই আইনে রূপান্তরিত করেছিল মোদি সরকার, প্রধান বিচারপতি বোবদে সেই আইন রদ করা আদেশ জারি করেছিলেন বটে, একটি কমিটিও গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন যা আইনটির বাস্তবতা বিবেচনা করবে – মজার ব্যাপার হল কমিটির সদস্যও বিচারপতি বোবদে নির্বাচন করে দিয়েছিলেন, যারা প্রকাশ্যে কৃষি বিলের সমর্থক, মোদি সরকারের ঘনিষ্ঠ। কোভিড কালে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরাবস্থা ও কেন্দ্রীয় সরকারের অকর্মন্যতা নিয়ে যে মামলাগুলি হয়েছিল তাতে সুপ্রিম কোর্টের রায়গুলি ছিল অমানবিক ও হতাশাজনক। এরই মধ্যে মধ্যে থেকে থেকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অরুণ মিশ্র, এম আর শাহরা নরেন্দ্র মোদির প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন প্রকাশ্যে। সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের বিচারপতিদের কাছ থেকে যা কাম্য নয়। তিস্তা শিতলাবাদের মামলায় বিচারকরা তিস্তাকে রীতিমত হুমকি দিয়েছেন গুজরাত গণহত্যা নিয়ে নরেন্দ্র মোদির পিছনে লেগে থাকার জন্য। তিস্তার গ্রেফতারের পথ মসৃণ করে দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট।

উপরের অনুচ্ছেদে যে সকল মামলার কথা উল্লেখ করা হয়েছে (অনেকগুলিই করা হয়নি) সেগুলি প্রতিটিই ভারতবর্ষের রাজনৈতিক সামাজিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, প্রায় ইতিহাসের মোড় ঘোরানো বিষয়। প্রতিটি ইস্যুতে লাভবান হয়েছে নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপি আরএসএস, প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা সাহায্য পেয়েছে বিচারবিভাগের, কখনো সরাসরি, কখনো এড়িয়ে। আইন বিশেষজ্ঞরা এই অবস্থাকে বর্ণনা করছেন এক্সিকিউটিভ কোর্ট বলে, অর্থাৎ শাসকের কোর্ট। বিচারপ্রক্রিয়ার তথাকথিত নিরপেক্ষতা ও আইনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার আয়োজন ক্রমে কমে আসছে, শাসকের প্রতি বিশ্বস্ততা ফুটে উঠছে।

এটা ঘটনা যে সুপ্রিম কোর্ট ও অন্যান্য কোর্টের বহু বিচারপতি বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে চিন্তিত, বুর্জোয়া ব্যবস্থায় এই আগ্রাসন যতখানি ঠেকানো যায় তার জন্য তারা চেষ্টা করছেন। বিচারপতি রামান্না প্রশংসিত হয়েছেন বিভিন্ন জামিনের মামলায় তৎপরতা দেখিয়ে, পেগাসাস মামলায় তদন্তের অনুমতি দিয়ে, তার স্বল্প সময়ের প্রধান বিচারপতি কালে। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ও আইন বিশেষজ্ঞরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের গতিপ্রকৃতি দেখে ও ক্রমাগত লিখে চলেছেন সতর্ক থাকার বিষয়ে। মুশকিল হল, হিন্দুত্ববাদ, আরএসএস, মোদিদের নির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিটি বিষয়ে, বিচারব্যবস্থা নিয়েও – কী করে ভিতর থেকে দখল করা যায়। বিচারব্যবস্থা যদি পুরোদমে শাসক মোদীদের বিরুদ্ধে থাকে, সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ থাকে তাহলে সংবিধান সংশোধন, হিন্দুরাষ্ট্র গঠন, দীর্ঘস্থায়ী ক্ষমতা দখলের বিষয়গুলি অপূর্ণ রয়ে যাবে। তাই বিচারব্যবস্থায় আরএস এস মতাদর্শকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি অবসরকালে বিচারকদের রাজ্যসভার সিট, রাজ্যপালের পদ ইত্যাদি টোপ দেওয়া চলছে সমস্ত নির্লজ্জতার মাথা খেয়ে। যে কলেজিয়াম সিস্টেম খানিক হলেও বিচারক নিয়োগে সুপ্রিম কোর্টের কিছুটা হলেও স্বাধীনতা বজায় রেখেছে তার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় আইন প্রতিমন্ত্রী কিরণ রিজিজু কদিন আগেই তোপ দেগেছেন। মোদিদের পছন্দের বিচারপতি (পড়ুন আরএসএসের লোক) নিয়োগ করার ক্ষমতা চাই।

আরএসএসের হিন্দুরাষ্ট্রের গঠনের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে শেষতম বাধা রূপে সুপ্রিম কোর্টকে গন্য করেন বহু গনতন্ত্রপ্রিয় মানুষ। দেখা যাক, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ভারতীয় জনতার বাস্তিল দুর্গ হয় কিনা।   

 

0 Comments

Post Comment