যেখানে যেতে হবে সেখানে সন্ধ্যাতেই পৌঁছে কাজ মিটিয়ে রাতের ট্রেনে ফিরে আসতে পারবো এরকমটা আশা থাকলেও সহজে হওয়ার ছিল না। তাই সেখানকার অফিসের পাশেই একটা ঘরে আমার জন্য বা অন্য কেউ কাজে এলে যাতে রাতে থেকে যেতে পারেন এরকম একটা ব্যবস্থা করাই থাকে। কেবল কলিং বেল বাজালেই ওনারা দরজা খুলে দেন কিন্তু আমাকে নিতে আসতে যে পারবে না তা আগেই জানিয়ে দিয়েছিল। খাওয়ার ব্যবস্থাও ফোনালাপে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে আমার ঘরে খাবার ঢাকা দেওয়া আছে। ফলে খুব একটা চাপ নিইনি। কিন্তু বিপদটা টের পেলাম স্টেশনে নেমে। একটু বেরতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। লোডশেডিং চলছে, তার ওপর অমাবস্যা। দোকান যা আছে তার বেশিরভাগই বন্ধ। যে দু-চারটা খোলা আছে সেগুলোতে টিমটিমে আলোয় ঝাঁপগোটানোর পাট চলছে। আর বাইরে রিক্সা বা টোটো কিছুই নেই।
যদিও এই অঞ্চলের পথঘাট চিনি। তবুও ল্যাপটপের ব্যাগ নিয়ে আঁধার রাস্তায় বেরনো নিয়ে চিন্তায় পরে গেলাম। আর চোর ডাকাতের পাল্লায় পড়লে কেবল মালপত্র কেড়ে ছেড়ে দেবে এতটা আশা না করাই ভালো। আগে যখন এখানে থাকতাম তখন এখানকার এক মাতব্বর মাতাল অবস্থায় আরেকজন কলেজ ছাত্রকে চিনতে না পেরে উত্তমমধ্যম দিয়েছিল। এই বিভুঁইয়ে এসে এরকম হলে আর রক্ষে নেই। এদিকে এমন কিছু বড় স্টেশন নয় যে রাত কাটিয়ে দেয়া যাবে।
এই অবস্থায় অফিসে ফোন করবো কিনা ভাবতে ভাবতেই তাকে চোখে পড়লো। নাম মনে পড়লো না, ওর বাবা রিক্সা চালাতো। সে এখন টোটো চালায়। টোটোতে হয়তো কিছু সমস্যা হচ্ছিল, এই অন্ধকারে মোবাইলের আলোয় সেটাই মেরামত করে ওঠার উপক্রম করছিল।
এক হাঁক পেড়ে ওর দিকে ছুটে গেলাম। বিনা বাক্যব্যয়ে উঠে পড়লাম ওর টোটোতে। টোটোওয়ালার বাড়ি, আগে যেখানে থাকতাম, সেখানেই ছিল। তবে আমি এখন যেখানে যাবো তার চেয়ে সেই পাড়া বেশ কিছুটা দূরে আর শহরের অন্যদিকে। ফলে "কোথায় যাবে?" জিজ্ঞেস করাতে আমি যখন জানালাম তখন ও অফিসের পাড়ায় যেতে রাজি হচ্ছিল না। তখন তাকে সামনের মোড়ে যেখানে রাস্তা আলাদা হয়ে গেছে সেখানেই নামিয়ে দিতে বলায় সে রাজি হলো। সেখান থেকে অফিস হেঁটে খুব দূরে নয়। আসেপাশে অনেকেই পরিচিত। খুব বেশি অসুবিধা হবে না।
টোটোতে আলোর অভাব ছিল না। তবুও বড় রাস্তা না ধরে যখন ভেতরের রাস্তা ধরলো তখন একটু বিচলিতই হলাম। বুঝলাম শর্টকার্ট নেওয়ার জন্যই এই রাস্তা নিয়েছে। রাতের বেলা রাস্তা ফাঁকা, নইলে একটা টোটো সেখানে চললে খুব বেশি জায়গা বাকি থাকে না। আগে এই জায়গা পুরনো আমলের ছোটবড় বাড়ি আর কিছু ফাঁকা জায়গায় ভরা ছিল। এখন একের পর এক ফ্ল্যাট উঠে গেছে কেবল একচিলতে জমি একটা মাঠ হয়ে এখনো টিকে আছে। কাদা না থাকলে সেখান দিয়ে গাড়ি নিয়েও পার হওয়া যায়। আর এই মাঠ পেরনোর সময়ই ঘটলো ঘটনাটা।
মাঠ শুরু হওয়ার আগে একটা বাড়ি, হয়তো ফ্ল্যাট উঠছিল, অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। আর সেটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ই শুনতে পেলাম গোঙানির মত অস্পষ্ট কিন্তু আর্তনাদের তীব্র নারীকন্ঠের শব্দটা। পাশের কিছু কিছু বাড়িতে অল্পস্বল্প আলো জ্বললেও সেই জায়গাটা ছিল অন্ধকার। অন্যদিকে ব্যাপক আকারে লোডশেডিং চলায় সেদিকে তাকিয়ে কিছু দেখতেও পেলাম না। কিরকম যেন একটা অস্বস্তি হতে লাগলো। টোটোওয়ালার দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করলাম। সে দেখি টোটোর গতি হঠাৎ বাড়িয়ে দিল। একবার জোরে ডাকলামও, সে ভ্রূক্ষেপও করলো না। আমি বেশ কিছুটা আশ্চর্য্য আর কিছুটা ক্ষুণ্ণও হলাম। এ কেমনধারা ব্যবহার!
সে চালাচ্ছে আর আমি সওয়ারী। অন্যদিকে আমারও পৌঁছনোর তাড়া ছিল তাই আর বেশি তর্কে যেতে ভরসা হলো না। কে জানে বেশি বললে হয়তো নামিয়ে দিয়ে বলবে, "তোমার যেতে হলে চলে যাও। আমি চললাম।" একসময় টোটো সেই মোড়ে পৌছল। এখান থেকে আমার গন্তব্য বেশি দূরে নয়।
নামিয়ে দিয়ে ভাড়া মিটিয়ে সে বললো,
"ওই ভাঙা বাড়ির কথা আর বোলো না দাদা!
আগেও একবার ওই শব্দ শুনে গিয়ে ফেঁসে গেছলাম। এই বছর খানেক আগেই হবে। এরকমই রাত করে ফিরছিলাম। সাথে আমার দুজন বন্ধুও ছিল। তুমি চিনবে হয়তো। আজিজ আর পলাশ। সেই যে ইলেক্ট্রিকের দোকানে কাজ করে। ওদের নিয়ে ঘরে ফিস্টি করার কথা ছিল।
এরকমই এক শব্দ শুনে থমকে গেছলাম। ওরাও শুনেছিল শব্দটা। টোটো থামিয়ে তিনজনেই নেমে গেলাম ব্যাপারখানা কি দেখতে।
তখনও এরকমই হয়েছিল জায়গাটা। এখন অবশ্য অনেকটা আগাছা গজিয়ে গেছে সামনে পেছনে। তো নেমে কোথাও কিছু পেলাম না। ভেতরেও গেলাম সেখানেও কিছু নেই। তখনও সিঁড়ি একটা ছিল। সেটা ধরে উপরে গেলাম, তবুও কিছু পেলাম না। তবুও শব্দটা হয়েই চলেছে। এবার ব্যাপারটা ঠিক লাগলো না। এখানে আর থাকতে ইচ্ছা করলো না। এদিকে লোহালক্কড় সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একটাতে পা পড়ে কেটে গেল। ওদেরকে ডেকে দেখাতে ওরাও বললো তাড়াতাড়ি ঘরে যেতে। পরের দিন টিটেনাসও নিয়েছিলাম একটা।
তারপর ওই পাড়া দিয়ে গেলেও এরকম শব্দ শুনেও যাইনি কোনদিন। কে জানে কি ব্যাপার! পরে শুনেছিলাম যে ওই প্লটে প্রোমোটার কাজ করতে চেয়েও পারেনি। কাজ চলার সময় একটার পর একটা অ্যাক্সিডেন্ট হতে থাকলো। কখনো পিলার ফেটে যায় তো কখনো ঢালাই ধসে যায়। আর খুচরো চোট আঘাত তো লেগেই থাকতো। এক মিস্ত্রি পড়ে গিয়ে দুদিন হাসপাতালে থেকে মারাই গেল। আরও কয়েকজন হয় হাত নয় পা ভেঙে পড়েছিল। একটা সময় আসলো যে কেউ আর ওখানে কাজ করতে রাজি হত না। এমনকি বাইরে থেকে লোক আনলেও এর বদনাম ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগতো না। প্রোমোটারও একসময় হাল ছেড়েই দিল। এতে যে ভালোই লোকসান খেয়েছিল, সে তো জানা কথা। এখনো সিমেন্ট-বালু রাখার দরকার হলে এখানেই রেখে যায়, কিন্তু অন্য কাজ আর শুরু করে নি।
এরকম অনেকেরই হয়েছে শুনেছি। কেউ এর কারণ সেভাবে বলতে পারেনি। তবে শোনা যায় এর আগের বাড়ি যখন ভাঙা হচ্ছিল তখন ওই পাড়ারই একটা কাজের মেয়ে, বিহার না কোথায় ছিল তার আসল বাড়ি তবে মালিকদের বাড়িতে থেকেই কাজ করতো, সে হঠাৎ গায়েব হয়ে যায়। মালকড়ি কিছু গেছল কিনা সেভাবে কেউ বলতে পারেনি, পুলিশ খুব খুঁজেছিল। বাড়ির লোকও কম হাঙ্গামা হুজ্জুত করেনি। যে শব্দটা আসে সেটা নাকি ওই মেয়েটার গলার মতই।"
এতটা শুনে বললাম, "আশেপাশে যেসব বাড়ি আছে তাদের এনিয়ে কোনও অসুবিধা হয়না?"
"না। শব্দটা যে সবদিন শোনা যায় তা নয়। কখনো কখনো এরকম মাঝরাতের বেলা শোনা যায়। একদিকে তো মাঠ আছে জানোই। অন্যদিকে যেসব বাড়িগুলো আছে সেগুলোতেও এত রাতে খুব বেশি লোক জেগে থাকে না। যেসব দারোয়ানরা নতুন আসে তাদের কেউ কেউ খোঁজ নিতে আসে। কিছু না পেয়ে আবার ফিরে চলে যায়। তাই এনিয়ে কেউ আর বিশেষ মাথা ঘামায় না।"
ওদিকে আমার ফোনটা বেজে উঠলো। যে বাড়িতে আজ রাতে থাকার কথা সেখান থেকে ফোন করেছে। টোটোওয়ালাও "এবার এগোচ্ছি।" বলে গাড়ি ছেড়ে দিল