পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

কেন এ হিংষা, দ্বেষ?

  • 21 January, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1607 view(s)
  • লিখেছেন : মনসুর মণ্ডল
ঘৃণা-বিদ্বেষের মুদ্রাটাকে উল্টে নিলে দেখা যাবে পুরুষোচিত কর্তৃত্ব-মনস্কতা। সামাজিকতা ও সংস্কারে ওতপ্রোত অথবা অনুশাসিত নারীর জীবনক্ষেত্রে আরোপিত পুরুষোচিত মাহাত্ম্য। তার প্রতি প্রীতি-মমতা-দায়-দায়িত্বে স্থিত পৌরুষেয় অনুগ্রহ। বিদ্বেষে পৌরুষ বিভীষিকাময়। পুরুষতন্ত্রের বিশেষত্ব এটা। সমাজে পিছিয়ে পড়া কিংবা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ-ভাবাপন্ন মানসিকতা ও অনিয়ন্ত্রিত পুরুষতন্ত্র পরস্পরে ঠিক মিলে যায়।

বুল্লি বাঈ। একটি ইন্টারনেট অ্যাপ। এতে বাছাই করা মুসলিম মহিলাদের, যাঁদের অ্যাপটির সঙ্গে কোন যোগ নেই, বিভিন্ন সমাজ মাধ্যম থেকে নাম-পরিচয়-ছবি নিয়ে নামে নামে দাম ধরে আপলোড করে অনুরাগীদের আকৃষ্ট করা হচ্ছিল। এক ভার্চুয়াল নিলামের কল্পলোকে আত্ম-রমণে মেতে ওঠা। মুসলিম মহিলাদের চরিত্রহনন করার নষ্টামি। শতাধিক মহিলার নাম এই নেট-মৃগয়ায় জড়ানো হয়েছিল। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থেকে লেখিকা, সমাজকর্মী, সাংবাদিক, সমাজে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব, যাঁরা ধর্মীয় ঘৃণা-অসহিষ্ঞুতা ও সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নে বাদ-প্রতিবাদে শামিল হন।

এবছরের শুরুতেই বুল্লি বাঈ-এর কুকীর্তি মানুষের নজরে এলে প্রতিবাদের ফলে এটি বন্ধ হয়েছে। গত বছর জুলাই মাসে ‘সুল্লি ডিল’ নামে একই রকম একটি অ্যাপ মুসলিম মহিলাদের নামে নেট-বাজারে দর হাঁকছিল। ইতিপূর্বে সমালোচনার মুখে সেটিও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মনে করা হচ্ছে, বুল্লি বাঈ সুল্লি ডিল-এর ক্লোন। ক’দিন আগে অ্যাপ দু’টির একজন করে চাঁইকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। দুজনেই সদ্য তরুণ। তদন্ত চলছে। বিষ-বৃক্ষের চারাতেই বিনাশ। কিন্তু ‘মরা হাতির দাম লাখ টাকা’র মতো এই নিয়ে প্রশ্ন কিছু থেকেই যায়।

কোন জনগোষ্ঠীকে দমনে সামাজিক অবদমন একটি হাতিয়ার। সামাজিক অবদমনে প্রথম নিশানা নারী। একটি ধর্ষণ একটি গণহত্যার মতো মানুষের মেরুদণ্ডে হিমস্রোত বইয়ে দিতে পারে। নারীর চরিত্রহনন সমাজকে সঙ্কুচিত করে তোলে। সুল্লি ডিল বা বুল্লি বাঈয়ের প্রাসঙ্গিকতা এইখানে। ভার্চুয়াল নিলামের মতো কুরুচিপূর্ণ কীর্তিকলাপ ভুক্তভোগী মহিলাদের আত্ম-সম্মানে আঘাত তো করেই, সেইসঙ্গে বাইরের জগতে তাঁদের অপদস্থ হওয়া, হেনস্থার মুখে পড়ার কারণও হয়ে দাঁড়াবে। দেখা যাচ্ছে, এসব মূলত কিশোর-তরুণদের কুকীর্তি। কিন্তু বয়সের ধর্মে ছেলে-ছেমড়াদের মাথায় এই জটিলতা জায়গা পাওয়ার কথা নয়। তা হলে কোন্ হীনতায় এই স্খলন? সাধারণভাবে মেয়েদের দিকে নয়, তাদের নজর পড়ল মুসলিম মেয়েদের দিকে। কেন?

কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা রদ হয়ে গেলে খোদ হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন, এবার কাশ্মীর থেকে মেয়ে নিয়ে আসা সহজ হবে। কথাটার নিহিতার্থ সহজেই মুসলমানে স্থিত হওয়ার মতো ছিল তখনকার পরিস্থিতি। সিএএ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রনেত্রী সফুরা জারগার অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় গ্রেফতার হলে তাঁর মুক্তির প্রশ্ন সামনে আসতেই তাঁর গর্ভধারণ সম্পর্কে কুৎসা করতে জিভ কাঁপেনি বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রের। এই রাজনীতির চক্রে ধর্মীয় নেতা-গুরুরা নারী সম্পর্কে হীন মানসিকতা কোন রাখঢাক ছাড়াই প্রকাশ করতে কুণ্ঠিত হয় না। নারী মাত্রই তাদের কাছে সেবাদাসী ও যৌনদাসী। মুসলিম নারী হলে সেখানে বিশেষ ভাবনা। মুসলিম নারীদের তারা অনিয়ন্ত্রিত যৌন-লালসার দৃষ্টিতে দেখে। এই মানসিকতার নির্মম ও কদর্য দৃষ্টান্ত কাঠুয়ার ঘটনা। কাশ্মীরের কাঠুয়ায় আট বছরের আসিফা বানুকে মন্দিরে এক পূজারী সহ ছ’জন দিনের পর দিন ধর্ষণ করে শেষে কেটে টুকরো করে হত্যা করেছিল। অভিযুক্তরা গ্রেফতার হলে গ্রেফতারির প্রতিবাদে সেখানে হিন্দু ধর্মধ্বজীদের নিয়ন্ত্রণে মিছিল হয়েছিল।

একটি ক্ষমতাগোষ্ঠী। ঘৃণা-সর্বস্ব, উদ্ধত। তার সামনে কোন-না-কোন জনগোষ্ঠী, যারা ধর্ম, ভাষা বা জাতিসত্তায় সংখ্যালঘিষ্ঠ । জীবনযাত্রায় বিড়ম্বিত। ঘৃণার আঁচে ঝলসে যাওয়া যেন তাদের নিয়তি। তাদের অবদমিত অস্তিত্বে সবচেয়ে নির্মম বাস্তবতা— দলিত হলে হাথরাস, মুসলিম হলে কাঠুয়া। ক্ষমতাগোষ্ঠীর বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে মুসলমান জনগোষ্ঠী প্রথম নিশানা। এটা এতদূর যে, মুসলমান গণহত্যা ঘটানোর দুরভিসন্ধির বল্গাস্রোতে হরিদ্বারের মতো তীর্থক্ষেত্রও ভেসে যায়।

অন্যদিকে এই দেশে শাহিনবাগ ঘটে যায়, যেখানে মুসলিম মেয়েরা গৃহস্থালি ছেড়ে বাস্তায় নেমে আসতে পারে। গুলফিশা ফাতিমা, সফুরা জারগার-রা নাগরিক অধিকার ও সামাজিক ন্যায়ের জন্য হাত মুষ্টিবদ্ধ করেন। তখন মুসলমান মেয়েদের দিকে ধর্মীয় বিদ্বেষের শ্যেন দৃষ্টি পড়বেই। সুল্লি ডিল অথবা বুল্লি বাঈ সেখানে পরিশীলিত অবস্থান্তর—ভ্রষ্ট শিক্ষিতদের ধর্ষকাম।

সুল্লি ডিল নিয়ে ভুক্তভোগী মহিলারা, বিষয়টি যাঁদের নজরে আসে, তাঁরাও প্রতিবাদ করেছিলেন। কেউ কেউ পুলিশে এফআইআর করেছিলেন। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মাইক্রোসফ্টের সফ্টওয়্যার গিটহাব, যে প্ল্যাটফর্মে অ্যাপটি তৈরি করা হয়েছিল ও প্রদর্শিত হচ্ছিল, সেখান থেকে অ্যাপটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল মাত্র। এখন বুল্লি বাঈ নিয়ে জোরালো প্রতিবাদ, সোশ্যাল মিডিয়ায় নিন্দার বহর দেখে কেন্দ্র সরকারের টনক নড়েছে। তদন্ত নিয়ে গালভরা কথা বলছে। এদিকে একই রকম অপরাধের একই সহযোগী গিটহাব সম্পর্কে সরকারি প্রতিক্রিয়া এইমাত্র যে, অ্যাপটি ব্লক করা হয়েছে। অতঃপর ব্যাপারটা ধামচাপা পড়বে, এ নিয়ে কোন সন্দেহ থাকে কি? সুল্লি ডিল বা বুল্লি বাঈ-এ এই ক্ষমতাগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ যোগ নাও থাকতে পারে। তা না থাকুক, ঘৃণা-বিদ্বেষের ক্ষমতাবৃত্ত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুই দিক নিয়েই।

ঘৃণা-বিদ্বেষের মুদ্রাটাকে উল্টে নিলে দেখা যাবে পুরুষোচিত কর্তৃত্ব-মনস্কতা। সামাজিকতা ও সংস্কারে ওতপ্রোত অথবা অনুশাসিত নারীর জীবনক্ষেত্রে আরোপিত পুরুষোচিত মাহাত্ম্য। তার প্রতি প্রীতি-মমতা-দায়-দায়িত্বে স্থিত পৌরুষেয় অনুগ্রহ। বিদ্বেষে পৌরুষ বিভীষিকাময়। পুরুষতন্ত্রের বিশেষত্ব এটা। সমাজে পিছিয়ে পড়া কিংবা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ-ভাবাপন্ন মানসিকতা ও অনিয়ন্ত্রিত পুরুষতন্ত্র পরস্পরে ঠিক মিলে যায়।

কাঠুয়া, হাথরাস অথবা বুল্লি বাঈ-এর প্রতিবাদ হয়। প্রতিবাদে বাইরের বিভীষিকাকে ভাঙতে চাওয়া। ভাঙার শক্তি নারীর অন্তরের আর্তি ও ভিতরের সেই পৌরুষেয় অনুগ্রহ। যতটুকু সোচ্চার নারী-কণ্ঠস্বর, তা সময়ের বিস্ময়। সফলতা সমসাময়িক। আবার সময়ে ‘হাথরাস’ অথবা ‘সুল্লি ডিল’ ফিরে আসে নতুন নামে, নতুন চেহারায়। অনুষঙ্গে ভুক্তভোগী সমাজ নারীর সম্মান-নিরাপত্তার কথা ভেবে নারীর চারপাশে ঘেরাটোপ বাড়ায়।

কাঠুয়ার বিভীষিকা কিংবা বুল্লি বাঈ-এর অবমাননার প্রতিবাদ মুসলমান সমাজ থেকে যে হয়েছে, মহিলা ও পুরুষ উভয় দিক থেকেই হয়েছে; আবার পাশাপাশি রক্ষণশীল সংস্কার বশে ‘ঘর বাঁচনোর’ রক্ষণাত্মক ভাবনাও গেড়ে বসছে সমাজ-সংসারে। সামাজিক উৎকণ্ঠায় পারিবারিক নজরদারি তীক্ষ্ম হচ্ছে। হিজাব নিয়ে যেখানে যা-ই প্রথা থাকুক, ভারতে তার গ্রহণযোগ্যতা নিতান্ত আভিজাত্যের স্মারক হিসেবে। কিন্তু ইদানিং হিজাবের কদর বাড়ছে। সাইকেল চড়ছে, হিজাবও পরছে, এমন মেয়ের সংখ্যা বাড়ছে।

প্রচলিত সামাজিকতায় নারীর পীড়ন ও প্রকাশ্য অবমাননায় প্রতিবাদ কখনও ফিকে হবে না। কিন্তু এভাবে তার সীমাবদ্ধতাকে কি অতিক্রম করা যাবে? আমাদের বোধহয় অপেক্ষা করতেই হবে, একদিন মুক্ত নারীকণ্ঠের সমাবেশে নারীর এইসব পীড়ন-অবমাননার ক্ষেত্রগুলি অবরুদ্ধ হবে।

0 Comments

Post Comment