একই দিনে (ভারতে রাত বারোটা পেরিয়ে যাওয়ায় দুই পৃথক তারিখ হলেও কাতারের মাটিতে একই তারিখে, ২৮ নভেম্বর) দুই ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ থেকে বিশ্বকাপের শেষ ষোলোর রাউন্ডে পৌছে গেল ব্রাজিল আর পর্তুগাল। স্পেন আর আর্জেন্টিনার যে সম্পর্ক পর্তুগাল আর ব্রাজিলের সম্পর্কও তাই। নতুন বিশ্ব হিসাবে আবিষ্কারের পর লাতিন আমেরিকার ব্রাজিলে গড়ে উঠেছিল পর্তুগিজ উপনিবেশ। ফলে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি প্রভাবিত করেছিল ব্রাজিলের সামাজিক জনজীবনকে। পরে ইংরেজরা সেখানে পৌছলেও ব্রাজিলের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রায় সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে পর্তুগিজ প্রভাব। কাতার বিশ্বকাপের মঞ্চে সেই পর্তুগাল আর ব্রাজিল একই সাথে প্রায় দ্বিতীয় রাউন্ডের ছাড়পত্র আদায় করে নিল।
ধীরে কিন্তু কার্যকরভাবে এগোচ্ছে ব্রাজিল। ফ্রান্সের পর দ্বিতীয় দল হিসাবে কাতার বিশ্বকাপের মূলপর্বের দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার ছাড়পত্র আদায় করে নিল ব্রাজিল। পরপর দুটি ম্যাচে দুই লাল জার্সিধারী দুই ইউরোপীয় দলকে পরাজিত করে পরের ধাপে যাওয়ার প্রবেশপত্র পেয়ে গেল সেলেকাওরা।
নেইমারহীন ব্রাজিলকে অবশ্য সুইসদের বাধা টপকাতে বেশ কসরত করে ঘাম ঝরাতে হল। সার্বিয়া ম্যাচের নায়ক রিচার্লিসনকে সেভাবে জায়গাই নিতে দেয়নি সুইস ডিফেন্স। প্রায় সারাক্ষণই সুইস ডিফেন্ডারদের কঠিন পাহারায় বোতলবন্দী হয়ে রইলেন রিচার্লিসন। প্রথমার্ধে বারবার খেলার গতি শ্লথ করে দিয়ে ব্রাজিলের ছন্দবদ্ধ আক্রমণ করার প্রচেষ্টাকে বানচাল করে দিচ্ছিলেন সুইটজারল্যান্ডের খেলোয়াড়রা। যদিও তাদের মধ্যে খুব বেশী আক্রমণ তুলে আনার প্রবণতাও চোখে পড়েনি। আসলে ম্যাচ ড্র রাখার প্রচেষ্টাই ছিল সুইস কোচের রণনীতি। দ্বিতীয়ার্ধে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন আক্রমণ ছাড়া সেভাবে ব্রাজিল রক্ষণভাগকে পরীক্ষার সামনে পড়তে হয়নি। কিন্তু গোল পেতে বেশ বেগ পেতে হল ব্রাজিলকে। গোলমুখ ছোট করে আঁটোসাঁটো রক্ষণভাগ দিয়ে ব্রাজিলকে আটকাতে চেয়েছিল সুইসরা। তবে ব্রাজিলের হলুদ জার্সিতে এই ম্যাচে জ্বলে উঠলেন ভিনিসিয়াস জুনিয়র। সারা মাঠ জুড়ে খেললেন ব্রাজিলের কুড়ি নম্বর জার্সি। যেখানেই বল সেখানেই ভিনি জুনিয়র। গতিতে-স্কিলে-খেলা তৈরিতে মুগ্ধ করলেন ভিনিসিয়াস। পাওলিনহো আর থিয়াগো সিলভা যোগ্য দিলেন তাকে। ব্রাজিল বেশ কিচু সহজ সুযোগ নষ্ট না করলে আরও বড় ব্যবধানে জিততে পারত। নবনির্বাচিত ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি লুলার বামপন্থী আদর্শের মত ব্রাজিলের ফুটবলেও সাম্যবাদের ছোঁয়া। তিতের ছেলেরা দ্বিতীয়ার্ধে যতই খেলা গড়িয়েছে ততই সম্মিলিত দলগত জোগো বোনিতোর ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন। তবে প্রবল সুইস রক্ষণভাগের বাধা অতিক্রম করে গোল পেতে ব্রাজিলকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ৮৩ মিনিট পর্যন্ত। কাসেমিরার দুর্দান্ত চকিত প্লেসিং-এ করা গোলের বলও কিন্তু তৈরি করে দিয়েছিলেন ভিনিসিয়াস জুনিয়র। ব্রাজিলের জয়ে একাত্মভাবে তাদের সমর্থকদের উল্লাস এবং অভিনবভাবে ব্রাজিল দলের তাদের অভিবাদন জানানোর মধ্যে একটা বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের ছায়া ফুটে উঠল। যেমন দেখা গেল প্রাক্তন ব্রাজিলীয় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দলের তারকারা-কাফু, কাকা, রবার্তো কার্লোস আর রোনাল্ডো নাজারিও দি লিমাকে শিশুসুলভ সারল্যপূর্ণ হাসিতে তাদের উত্তরাধিকারীদের এই জয়কে উপভোগ করতে দেখতে। সব মিলিয়ে ব্রাজিল দলে এখন একটা হাল্কা মেজাজ ফুটে উঠছে। তবে অভিজ্ঞ কোচ তিতে জানেন আগামী সময় আরও বড় চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হবে সেলেকাওদের ষষ্ঠবারের জন্য বিশ্বকাপ জিততে। তবে এই ব্রাজিলকে লম্বা রেসের ঘোড়া বলাই যায়।
অন্যদিকে গ্রুপের অপর ম্যাচে ক্যামেরুন আর সার্বিয়ার মধ্যে খেলা প্রচুর চড়াই-উতরাই-এর পর অবশেষে ৩-৩ গোলে অমীমাংসিতভাবে শেষ হল। তার ফলে ব্রাজিলের কাছ হারের পরও প্রথম ম্যাচে ক্যামেরুনের বিরুদ্ধে জয় পাওয়া সুইটজারল্যান্ডের পরে রাউন্ডে যাওয়ার সম্ভাবনা বহাল রয়ে গেল। তবে গ্রুপের শেষ ম্যাচে তাদের জয় পেতে হবে সার্বিয়ার বিরুদ্ধে।
অপরদিকে সৌদি আরব আর জাপানের পদাঙ্ক অনুসরণ করল দক্ষিণ কোরিয়া। উরুগুয়ের বিরুদ্ধে খেলা গোলশূন্যভাবে অমীমাংসিত রাখা কোরীয়রা হেরে গেল ঘানার কাছে ২-৩ গোলে। ঘানা আগের ম্যাচে পর্তুগালের কাছে পরাজিত হয়েছিল ২-৩ গোলে। এদিন তারা দক্ষিণ কোরীয়াকে হারালো একই ব্যবধানে অর্থাৎ ৩-২ গোলে। প্রথমার্ধ পুরোটাই ছিল ঘানার। ২-০ গোলে তারা এগিয়ে ছিল। দক্ষিণ কোরিয়া দারুণ জবাব দেয় ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে। ০-২ অবস্থা থেকে চো গিউ-সাং-এর পরপর হেড করে করা দুই গোলে খেলায় সমতা ফিরিয়ে আনে তারা। কিন্তু আবারও ঘানাকে জয়ের আস্বাদন এনে দেন মহম্মদ কুদুস যিন এই বিশ্বকাপে শুরু থেকেই নজর কাড়ছেন। ম্যাচের অন্তিম লগ্নে বারংবার ঘানার অর্ধে আক্রমণ শানিয়ে তুলেও আর খেলায় সমতা ফেরাতে পারেনি দক্ষিণ কোরিয়া। ফলে একটি ড্র আর একটি হার সহযোগে মাত্র এক পয়েন্ট নিয়ে জাপানের প্রতিবেশী দেশ দক্ষিণ কোরিয়া কাতার বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের দরজায় পৌছে গেল।
ফ্রান্স আর ব্রাজিলের পর তৃতীয় দল হিসাবে শেষ ষোলোয় নিজেদের স্থান নিশ্চিত করে নিল সিআর সেভেনের পর্তুগাল। যদিও আরেক লাতিন আমেরিকীয় ফুটবল মহাশক্তি উরুগুয়ের বিরুদ্ধে এদিন পর্তুগালকে জয়ের রাস্তায় নিয়ে আসতে যিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিলেন তিন সিআর সেভেন নন বরং বিএফ এইট অর্থাৎ ব্রুনো ফার্নান্ডেজ যার জার্সি নম্বর আট। সারা মাঠ জুরে খেললেন ব্রুনো। আক্রমণ তৈরি করলেন, সেট-পিস মুভ নিলেন এবং দু’দুটি গোল করে সবুজ-মেরুন জার্সির শেষ ষোলোয় জায়গা পাকা করে দিলেন। উরুগুয়ে দলটাকে দেখে মনে হচ্ছে তারা বয়সের ভারে জর্জরিত। কাভানি, সুয়ারেজের মত খেলোয়াড়রা তাদের সোনালী সময় পেরিয়ে এসেছেন। তারা এখন নিজেদের সেরা সময়ের ছায়া মাত্র। প্রথমার্ধে ম্যাচের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কাছে রাখলেও গোল পায়নি পর্তুগাল। দ্বিতীয়ার্ধের ৫৪ মিনিটে গোল করে যান ব্রুনো। যদিও রোনাল্ডো ব্রুনোর তোলা বলে মাথা ছোঁয়ানোর চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু বল উরুগুয়ের জালে জড়িয়ে যায় তার ছোঁয়া ছাড়াই। তারপর ষাট মিনিট থেকে আশি মিনিটের মধ্যে উরুগুয়ে গোলশোধের জন্য মরিয়া হয়ে আক্রমণের ঝড় তোলে, এই সময় পার্তুগাল কিছুটা রক্ষণাত্মক হয়ে গুটিয়ে যায়, কিন্তু পর্তুগালের রক্ষণভাগ তাদের কর্তব্য ভালোভাবেই পালন করে। একবার উরুগুয়ের খেলোয়াড়ের শট পোস্টে লেগে ফিরেও আসে কিন্তু আশি মিনিটের পর থেকে ব্রুনো ফার্নান্ডেজ আর রাফায়েল লিয়াও-এর দৌলতে পর্তুগাল আবার ধীরে ধীরে খেলায় ফিরে আসে। নির্ধারিত সময়ের ৯০ মিনিট অতিক্রান্ত হওইয়ার পর উরুগুয়ের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়ের তাদের পেনাল্টি বক্সের মধ্যে হাতে বল লাগলে পর্তুগাল পেনাল্টি পায়। ব্রুনো ফার্নান্ডেজই পেনাল্টি থেকে গোল করে দলের জয় সুনিশ্চিত করেন। তারপরেও তার আরো একটি শট পোস্টে লেগে প্রতিহত না হলে ব্রুনোর হ্যাটট্রিক সম্পন্ন হয়ে যায়। ফলে এই গ্রুপ থেকে পর্তুগাল নিশ্চিতভাবে পরের রাউন্ডে চলে গেল। অন্যদিকে উরুগুয়ের হারের ফলে কিছুটা সুবিধে হল ঘানার। উরুগুয়ের শেষ ম্যাচ আবার ঘানার বিরুদ্ধেই। একদিকে পর্তুগাল যখন পরের রাউন্ডে নিজেদের জায়গা পাকা করে নিল তখন অন্যদিকে দুটি ম্যাচের পর দক্ষিণ কোরিয়ার মতই মাত্র এক পয়েন্ট নিয়ে ফিফা বিশ্বকাপের প্রথম আয়োজক দেশ (১৯৩০) এবং দুইবারের প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন (১৯৩০ এবং ১৯৫০) উরুগুয়ে একদম কাতার বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌছছে, এখন কোনও মিরাকলই তাদের এনজো ফ্রান্সেসকলি আর দিয়েগো ফোরলানের দেশকে এই বিশ্বকাপে টিকিয়ে রাখতে পারে।