পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ভোকাট্টা

  • 23 June, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 762 view(s)
  • লিখেছেন : বাসবদত্তা কদম
বাংলা নতুন বছর আসার আগেই মান্তু খাটে উঠে দু-পা উঁচু করে ক্যালেন্ডারের পাতা উলটে দেখে নেয়। এপ্রিল মাসের চোদ্দ কি পনেরো তারিখ হয় পয়লা বৈশাখ। ঐদিন সকাল সকাল বাথরুমে বাবার রাখা মলয় চন্দন সাবান দিয়ে চান করে ওরা সবাই। এরপর পরই মা তাড়া দেয় মামাবাড়ি যাবার জন্য। মামাবাড়িতে এইদিন ভোজ।

বাবা বাজার থেকে ফিরে এলেই ঠাকুমা জিজ্ঞেস করে, আম এনেছো তো বিনু?  

দাদু এইদিন আম দেবেন ঠাকুরকে। তারপর বাড়ির সবাইকে। এর আগে বাড়িতে পাকা আম এলেও ঠাকুমা দাদু কেউ খাবে না। ঠাকুমা বলে, এইসময় আমাদের গাছে কত আম; পাখিতে খায়, বাঁদরে খায় তাও খাটের তলা ভর্তি আম। এইখানে একটা আমও না কিনলে পাইবা না, কি কপাল।

মান্তু জানে ওদের দেশের বাড়িতে অনেকগুলো আম গাছ। কাঁঠাল গাছ। রান্নাঘরের পিছনের গাছটা থেকে ঠপ ঠপ করে আম পড়ে রান্নাঘরের টিনের চালে। ও গাছটায় কেউ উঠতে পারে না, পাকলে তবে পড়বে। গাছটাকে মাঝখানে রেখে রান্নাঘরটা তৈরী হয়েছে যে। এছাড়া আরো যে ছটা সাতটা আমগাছ, তার একটা কাছারি ঘরের পিছনে, টোকো আমগাছটা পেছনের পুকুরপাড়ে. এভাবে সব কটা গাছের অবস্থানই মান্তুর মুখস্ত। উঠোনের মাঝখানে গোলাপজাম গাছটা দাদুর বাবার লাগানো। গাছ ভরে গোলাপজাম আসে এইসময়। বাবা আর জেঠুর পড়ার ঘরের পিছনে জোড়া কাঁঠাল গাছ তার পিছনে সেই পাতলা খাল, যেখান থেকে নৌকা ভাসিয়ে দাদুকে দেখে বাবাও একবার বেরিয়ে বড় নদীর কাছে পৌঁছে আর ফিরতে পারছিল না। দুখু বাগদী ঠাকুর কর্তার ছেলেকে একলা নাওয়ে দেখে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে এসেছিল।

তার পরের বছর দুর্ভিক্ষের সময় সেই দুখু বাগদী লোকটা, দশ দিনের উপোষ পেটে অনেকগুলো ভাত খেয়ে বার বাড়ির আম গাছটার নীচে বমি করতে করতে মরে গেল। তখন চারিদিকে শুধু ফ্যান দাও মা! ফ্যান দাও! আওয়াজ...।

মান্তুর চোখটা ভিজে যায়। সে তো রোজ থালায় খানিক ভাত নষ্ট করে। 

-এখানে বসে আছিস! তৈরী হবি কখন? যেমন বাবা তেমন মেয়ে। রোদ্দুর মাথার উপর চড়ে গেল, কোনো খেয়াল আছে! মায়ের চিৎকারে চমকে ওঠে মান্তু। ঠিক এগারোটার সময় কালো কাকু রিক্সা নিয়ে প্যাঁক প্যাঁক করতে করতে ওদের গলির সামনে চলে আসে।

সিক্স সেভেন এইট পেরিয়ে কলেজে পৌঁছে যায় মান্তু। এরপর কলেজ, ল্যাব, খুচরো প্রেম সব সামলাতে সামলাতে ফ্রক থেকে শালোয়ার-কামিজ আর শালোয়ার-কামিজ পেরিয়ে শাড়ি। শাড়ি পরা সে, কলেজ সোস্যালে ইউনিয়নের পান্ডা হয়ে ফ্রেসারদের একটু আধটু র‍্যাগিং করে। র‍্যাগিং এর ফাঁকেও চোখটা থাকে অরিত্রর দিকে। অরিত্র অবশ্য টের পায় না। সত্যিই কি টের পায় না! না কি বুঝতে চায় না, এই দ্বন্দ্বটা ধন্দ্ব হয়েই থেকে যায়।

নিয়ম মেপে পয়লা বৈশাখ আসে প্রতিবারের মতো কিন্তু মান্তুর মামাবাড়ি যাওয়া হয় না। বেহালা ট্রাম ডিপোয় সাতাশ নম্বর ট্রাম মন খারাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বাবা এইদিন ধুতি পরে। সারাবছর প্যান্ট শার্ট পরে অফিস যাওয়া মান্তুর বাবা বিশেষ বিশেষ দিনে ধুতি পরলেই কেমন বদলে যায়। তার আগে ধুতিকে ধুয়ে টান টান করে মেলবে বাবা নিজে হাতেই। নীল জলে স্নান করিয়ে অবশ্য। এ কাজটা মা করলে কিছুতেই বাবার মনোমত হয় না। বাবার বিছানার চাদর থেকে ধুতি পাঞ্জাবি কিংবা রোজকার অফিসের জামাকাপড় সব বাবার নিজে হাতে ধোয়া চাই। ধুতি আর পাঞ্জাবির বেলায় পরিপাটিটা একটু বেশি। এরপর আছে ইস্ত্রি। তৈরী হয়ে বেরোবার সময় মান্তুকে বলে, তুই এবছরও যাবি না? তোর দিদার খুব মন খারাপ হবে কিন্তু। মা তো তার আগেই কয়েকবার চেঁচামেচি করে ফেলেছে তার এই না যাওয়া নিয়ে।  

সেদিনই কলেজে ইউনিয়নের কোর কমিটির মিটিং রেখেছে অরিত্র। অরিত্র ওদের জি এস। সে মিটিং ডাকলে না করার সাধ্যই নেই ওদের। মান্তুর তো নয়ই। মান্তু বুঝতে পারে ও একটু বেশিই দুর্বল হয়ে পড়ছে অরিত্র সেনগুপ্তের প্রতি। সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে কলেজে জি এসের পাশে পাশে ঘোরা, আর মিটিংগুলোতে মুগ্ধ হয়ে তার বক্তব্য শোনা, ঝকঝকে চেহারা না আরো ঝকঝকে কথা- কোনটা যে ওর বেশি পছন্দের সেটা ও নিজেও বুঝতে পারে না। বাবা তার অতি বড় বন্ধু হলেও এসব কথা কি কোনোভাবেই বাবাকে বলা যায়। তাই অকারণেই বাবার প্রতি রেগে ওঠে সে। চিৎকার করে ওঠে, বললাম তো ইউনিয়নের জরুরী মিটিং আছে। বুঝতে পারো না কেন? বাবা বলে, থাক থাক, যেটা ভালো বুঝিস, সেটাই কর। মাকে নিয়ে কালো কাকুর রিক্সায় উঠে বসে বাবা।  

মান্তুর মামাবাড়ির দুপাশে দুটো পুকুর। ছোটমামা মাঝে মাঝেই পুকুরে মাছ ধরে আর দিদা কলতলায় বসে মাছ কাটে। পুকুরপাড়ের আম গাছটা তখন মুকুলের গন্ধ ছড়ায় বাতাসে। মৌমাছিগুলো ওড়ে। নাক টানলেই মান্তু সেই গন্ধ পায় যখন তখন। বাড়িতে ঢুকলেই ভুলি কুকুর ছুটে এসে পায়ে মাথা ঘসে। গোয়ালে গরুটা হাম্বা ডাকে। মান্তুর কিরকম যেন ওদের দেশের বাড়ির মতো লাগে মামাবাড়িটাকে। কসবা কি কলকাতার বুকে এক টুকরো দেশ! মনেই হয় না সে দেশ ও কোনোদিন দেখেনি। শুধু শুনেছে।

সে বুঝতে পারে না কেন অরিত্রকে পয়লা বৈশাখের দিনেই মিটিং রাখতে হলো। রবিবারও তো রাখা যেতো। কিন্তু সাহস করে জিজ্ঞেস করে উঠতে পারে না। ঠিক যেমন মনে মনে হাজারবার অরিত্র বললেও, দুবছরের সিনিয়রকে সামনে সেভাবে ডাকার সাহস পায় না। হয়তো অরিত্রই সেই সাহসটাও ওকে দেয় না।   

পয়লা বৈশাখ আর মামাবাড়ির গল্প শুনলে অরিত্র সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে এমন হাসবে তা ভাবলেই ওর লজ্জা করে। হাসতে হাসতে হয়তো বা বিষম খাবে। বলবে, যত্ত সব বুর্জোয়াগিরি। তোমার বাবা নাকি কমিউনিস্ট! এসব কথায় খারাপ লাগে মান্তুর, খুব খারাপ লাগে কিন্তু কিছুতেই বলা হয় না অরিত্রকে, এমন কথা বলার সাহস কে দিয়েছে তোমাকে!

দিদার হাতের পোলাউ কিংবা ক্ষীরের মতো পায়েস অথবা লাল টকটকে মাংসের ঝোল এগুলোর জন্য অত লোভ হয় না কারণ ও জানে যে এগুলো টিফিন ক্যারিয়ারে চড়ে উঠবে রিক্সায়। মা সামলে সুমলে বসবে এসব নিয়ে। তারপর চড়বে সেই ট্রামটায়, যেটাতে ওর’ও চড়বার কথা ছিল। কোনো এক পুরনো কন্ডাক্টার কাকু ঠিক জিজ্ঞেস করবে -মেয়ে কই?

বাংলাদেশ থেকে প্রায় প্রতিবছর দাদুর নামে, বিজয়ার প্রনাম জানিবেন লেখা চিঠি আসতো পোস্টকার্ডে। তলায় সই শ্রীযুক্ত নিশিকান্ত মজুমদার। তাতে ক্ষুদি ক্ষুদি অক্ষরে অজস্র কথা লেখা। ততদিনে এমন খোলা চিঠিতে ব্যক্তিগত কথা লেখা দেখলে মান্তুর বিরক্ত লাগে। তাতে লেখা থাকতো, বিনুর কি একটিই কন্যা রহিল? আর কোনো পুত্র সন্তান বধুমাতার কোলে আসিল না? কিংবা বড় শ্রীমানের পুত্র দেশ ত্যাগ করিবার বাসনা ত্যাগ করিল কি? আমার দুই নাতিও বিদেশে যাইবার জন্য অতীব ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছে ইদানীং। বারংবার উদ্বাস্তু জীবনে কিই বা সুখ পায় ইহারা তা আমার জানা নাই। উদ্বাস্তু হই নাই বলিয়া কত অত্যাচার সহ্য করিতে হইয়াছে সে কেবল আমরাই জানি। তুমি পর্যন্ত তাহা সহ্য করিতে পারিলে না। উহারা তো সেই সব দিন দেখে নাই। দাদু এ চিঠি হাতে নিয়ে চুপ করে বসে থাকবে। সে সময় দাদুকে দেখলে মনে হয় যেন কত কিছু তার চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে। ডাকলেও সাড়া দিত না।

শুনেছে মানিকগঞ্জ তেরশ্রী গ্রামে নিশিকান্ত মজুমদার ওদের প্রতিবেশী। গ্রামের স্কুলের হেড মাস্টারমশাই ছিলেন। সে স্কুলেই বাবা আর জেঠু পড়তো এ দেশে আসার আগে পর্যন্ত।

মান্তুর কলেজে ঢোকার পরের বছর বাংলাদেশ থেকে সেই নিশিকান্ত মজুমদার একদিন হঠাৎ এলেন ওদের বাড়ি। হাঁটু পর্যন্ত ধুলো নিয়ে ওদের বারান্দার দরজায় কড়া খড়খড় করে ডাকলেন ‘মনীন্দ্র মনীন্দ্র?’ দাদুর নাম ধরে চিৎকার শুনে মান্তুই দরজা খুলেছিল।

-কাকে চাইছেন?

-মনি, মনীন্দ্র আসে নি? উফফ তোমাগো এই বাড়ি খুঁইজ্যা পাইতে আমার যে পরিশ্রম গ্যাসে। তুমি বিনুর মাইয়া?

মান্তুকে প্রায় ঠেলেই উনি ঢুকে পড়েন ভেতরে।

-দাঁড়ান। এতক্ষণে বৃদ্ধের হুঁশ হয় তিনি অন্য লোকের বাড়িতে ঢুকছেন।

তারপর অবশ্য ঠাকুমা এসে নিশিকান্ত দাদুকে উদ্ধার করেন মান্তুর হাত থেকে।

বৌদি নাতিন আপনের দারোগা হইবো দেইখেন। ‘খাড়ান’ কইয়া যা একখান হাঁক দিল না।

নিশিকান্ত দাদু আর দাদুর দুদিন ধরে সে কী গল্প, কী গল্প। বাবা বাজার খুঁজে খুঁজে কত কিছু নিয়ে আসলো ঠাকুমার রান্নার জন্য। মুগের পুলি, হলদি ইচা, ছানার পায়েস এরকম কত নতুন রান্না করলো ঠাকুমা।

দেশের বাড়ির আম সেই প্রথম দেখলো মান্তু। আর কতবার যে শুনলো বাড়ি দেখলা না। দ্যাশ চিনলা না মাইয়া। জন্ম উদ্বাস্তু তোমরা। দ্যাশ যার নাই তার আসে কি? শিকড় বিহীন গাছ।

আবার দাদুর দিকে ফিরে বলেন, একবার তো আসতেও পারো মণি, এহন যাতায়াত সুবিধা হইয়া গ্যাসে। দাদু উত্তর করে না। ঠাকুমা বলে দ্যাখেন না কি জিদ। যাইবো না আর কোনোদিন ঐ দ্যাশে। পোলাগো বারণ করসে ঐ দ্যাশে য্যান কেউ আর না যায়!

নিশিকান্ত অবাক চোখে দাদুকে দেখেন, তারপর বললেন বুঝছি বৌঠান বুঝছি। আর বলতে হইবো না। দাদুর চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। সবাই হঠাৎ কিরকম চুপ হয়ে যায়। মান্তুর অস্বস্তি হয়। সেই নৈঃশব্দ্য ভেঙে নিশিকান্ত উঠে ব্যাগ থেকে কয়েকটা আম বের করে দেন ঠাকুমার হাতে।   

আমগুলোর গায়ে ঠাকুমা কত সময় ধরে যে হাত বুলালো; তারপর দিল দাদুর হাতে। দাদু ঠাকুমাকে বলে, কাটো। দাও নাতিনরে। কথাটা বলেই দাদু মুখটা ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে।          

কলেজ পেরিয়ে ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছে গেল মান্তু। ইউনিয়নের সঙ্গেও ভালোই জড়িয়ে পড়লো। মুশকিল একটাই, ওর বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে ক্লাস আর অরিত্রর কলেজস্ট্রিটে। ছুঁতোয় নাতায় কলেজস্ট্রিট পৌঁছে যেত সে। যদিও জানতো না অরিত্রর সঙ্গে দেখা হবে কিনা, কিন্তু বন্ধুরা থাকতো। কোনো কোনোদিন অরিত্রকে খুঁজে পেত কফি হাউসে কিংবা কোনো বইয়ের দোকানে। ততদিনে কলেজস্ট্রিটে অরিত্রর ঠেকগুলো ভালোই জেনে গেছিল মান্তু। অবশ্য দেখা হয়ে গেলে যেন হঠাৎ করেই দেখা হয়ে গেছে এরকম ভাব দেখাতো সে। ইউনিয়নের মিটিংগুলোতে অবশ্য দেখা হতোই। মিছিলেও কতবার হেঁটেছে পাশাপাশি। ব্যাপারটা এমন অবস্থায় পৌঁছে গেল যে অরিত্র ছাড়া আর সবাই ওদের সম্পর্কটাকে স্ট্যাম্প দিতে শুরু করলো।

মান্তু তখন একদিকে পড়াশুনা করছে আর মনে মনে রোজ ভেবে চলেছে কিভাবে অরিত্রর পাশে থেকে ছাত্র আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। করবে না সে বড় চাকরি, সে’ও জেঠুর মতো পার্টির হোলটাইমার হবে। ঠিক এমন সময়ে অরিত্র ব্যাঙ্কের প্রবেশনারি অফিসারের পরীক্ষায় র‍্যাঙ্ক পেলো। খবরটা শুনে মান্তু কিরকম হকচকিয়ে গেল, জিজ্ঞেস করলো, তাহলে আমাদের আন্দোলনের কী হবে? ততদিনে সে ভালো মাপের ছাত্র নেত্রী। অরিত্র বললো, তোমরা তো থাকলে, আন্দোলনটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য...। মরিয়া সে এবারে বলেই ফেললো, কিন্তু আমাকে রাস্তা দেখাবে কে? ঠিক ভুল বুঝবো কিভাবে, তুমি পাশে না থাকলে? অরিত্র হাসলো। বললো, নিজেই ঠিক ভুল বুঝতে পারবে কমরেড। এখানে কেউ কারুর নয়। রাস্তায় আমরা সবাই একা; কিন্তু চলেছি একসাথে। হাঁটতে থাকো।

অরিত্র চলে গেল তার ট্রেনিং এ। সেখান থেকে সে ডাইরেক্ট চলে যাবে পোস্টিং এ। বাবা মা হীন অরিত্র থাকতো ঢাকুরিয়ায় তার কাকার বাড়িতে।

কলকাতা হঠাৎ করেই কিরকম অসহ্য লাগে মান্তুর। লাগামছালা রোদ্দুর, নাহলে প্যানপ্যানানি বৃষ্টি। বাড়ি থেকে বেরোতেই ভীষণ বিরক্ত লাগে তার। কলেজস্ট্রিটে যাওয়া একেবারেই বন্ধ করে দিল। কিন্তু নিজের এই কাজগুলোর কোনো যুক্তিই খুঁজে পায় না সে। নিজেকেই নিজে ধমকায়। যতবার অরিত্রর নাম মনে আসে মান্তুর, ততবার সে আরো বিরক্ত হয়। ইউনিয়নের সবাই বলে বলেই সম্পর্কটাকে প্রেম বলে চালানোর চেষ্টায় ছিল! নাহলে সেই বা কবে  অরিত্রর প্রেমে পড়েছিল! ওসব নেহাত ইনফ্যাচুয়েশন।

খবর পেল, অরিত্রর পোস্টিং হয়েছে ডিব্রুগড়ে।

এর কিছুদিন পরেই খবর পেল অরিত্রর বিয়ের। মেয়েটি ওর কলিগ। অহমীয়া।

খবরগুলো কিভাবে যেন ঠিক পৌঁছে যেত ওর কাছে। সব সময় যে খুব ইচ্ছে থাকতো, খবর সংগ্রহের তা নয়, কিন্তু পেত। 

বাবা ততদিনে একটা জমি কিনেছে। বাবা মায়ের যৌথ লোনের টাকায় ঐ জমিটায় একটার পর একটা ইঁট জড়াজড়ি করে আস্তে আস্তে ঘর হয়ে উঠছে। ভাড়া বাড়ি থেকে হাঁটাপথে মিনিট পনেরোর দুরত্ব। কিন্তু বাসা বাড়ির বাড়ি হওয়া ঠাকুমা দাদু কারুরই দেখা হল না। জমিটা কেনা হয়েছে এটা ঠাকুমা দেখেছিল। দাদু তার দুবছর আগেই ফাইনাল রিজার্ভেশন পেয়ে গেছে। জমিটা দেখতে ঠাকুমা যেদিন এলো, অনেকক্ষন ধরে বসে বসে ঘাসের উপর হাত বুলালো। যেন আদর করছে। দেড় কাঠা জমিতে আম, কাঁঠাল লাগানোর জায়গা নেই। কোনোমতে দুটো ঘর। লোনের ঝামেলায় বছর তিনেক লাগলো বাড়ি হতে। ঢালাইয়ের আগে বাবা আর ছোটমামা গেল পাকুড় থেকে স্টোনচিপ আনতে। এর আগে আচিপুর থেকে অনেকবার গেছে ইঁট আনতে। রাত সাড়ে তিনটের সময় উঠে দুজনে রওনা হত। মা, জ্যেঠিমা দরজায় দাঁড়িয়ে দুর্গা, দুর্গা জপ করতো।

ভোরে উঠে পড়া কোনোদিনই মান্তুর ধাতে ছিল না, বরং রাত জাগতো। তবুও ঐসব দিনে ভোরে ওর ঘুম ভেঙে যেত। সে নিজেও দরজায় এসে দাঁড়াতো। অন্ধকারে বাবা আর ছোটমামার মিলিয়ে যাওয়া দেখতো।  

দাদাভাই বহুবছর ধরেই জার্মানীতে। ওখানকার মেয়েই বিয়ে করেছে, ওদেশের সিটিজেনশিপ পেয়ে গেছে। জেঠু, জেঠি কেউই ওদেশে গিয়ে থাকতে রাজি হয়নি। জার্মান বৌমার সঙ্গে কিছুতেই ভাব হলো না তাদের। জেঠু আরো বেশি করে পার্টির কাজে ঢুবে গেছে। ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটবে, তবু রিক্সায় উঠবে না।  

নিজেদের বাড়ির ভিত পুজোর কিছুদিন পরেই ঠাকুমাও চলে গেছে হঠাৎ করেই।

নিশিকান্ত দাদুর চিঠি বন্ধ হয়ে গেছে এসবের অনেক আগেই। দেশের বাড়ির গল্প বলারও আর কেউ নেই।

মান্তু কিভাবে যেন কলেজ সার্ভিস কমিশন ক্র্যাক করে ফেললো।

বাবা অবশ্য বললো, আমি জানতাম তুই পারবি! জেঠু খুশির চোটে পার্টি কমরেডদের একদিন শিঙাড়া আর দরবেশ খাইয়ে এলো।

শিলিগুড়িতে একটা কলেজে পোস্টিং হল ওর। সেখানে ওর ছোট্ট বাসায় দুএকবার বাবা মা এলো। এখানেও এক রিক্সাওয়ালা রোজ ওকে কলেজে নিয়ে যায়। অবাক কান্ড তার নামও কালো। একা একাই হাসে মান্তু। বাসা বাড়ির সঙ্গে কালোদের কিছু একটা সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় ওর।   

সেবার পয়লা বৈশাখের ছুটির সঙ্গে আরো দুচারদিন জুড়ে কলকাতায় গেল। খুব ইচ্ছে করছিল মামাবাড়ি যেতে। কিন্তু পয়লা বৈশাখে মামাবাড়ি যাবার জন্য আর কেউ বলে না। মামাবাড়িটা আছে কিন্তু দিদাও নেই, ছোট মামাও নেই। তবু একদিন গেলো। গাছগুলো আছে। জামরুল গাছের ফুল আর আমের মুকুল মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে তখন ভরিয়ে রেখেছে উঠোনটা।  দেখলো একটা পুকুর বন্ধ করে পার্ক হয়েছে। অন্যটার পাড় বাঁধিয়ে দিয়েছে কর্পোরেশন থেকে। একদিকে গড়িয়া মেট্রো, অন্যদিকে বাইপাস। পাড়াটায় উঠেছে গুচ্ছের ফ্ল্যাট। মায়ের কাছে শুনেছে, জমিটার জন্য একজনের পর একজন প্রোমোটার যোগাযোগ করছে।      

ফেরার পথে উবারের জন্য অপেক্ষা করছিল, একটা স্পর্শে চমকে উঠলো। রাস্তাটা প্রায় অন্ধকার। অন্যমনস্ক হয়ে অন্য পার্টির পতাকা ওড়া দেখছিল। দেওয়ালে ওদের লেখা ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক’ কবেই বৃষ্টির জলে ধুয়ে গেছে।

অরিত্র!

-যাক চেনা গেছে! যেভাবে চমকে উঠলে আমি তো ভাবলাম মার না খাই!

কষ্ট করে একটু হাসলো মান্তু। যে স্পর্শের অপেক্ষায় সে থাকতে পারতো একটা দুটো তিনটে জীবনও, অরিত্র কী জানে না তা ফুরিয়েছে?

মান্তুকে অবাক করে ওর উবারেই উঠে বসলো সে। বললো বেহালায় কি যেন কাজ আছে ওর। ম্যান্টনে নেমেও বেশ খানিকক্ষণ বকবক করলো।  

এরপর, পরপর কয়েকদিন এলো ওদের বাড়িতে। মান্তুর মনে পড়লো কলেজের সময় অজস্রবার অনুরোধ করেও একদিনের জন্যেও অরিত্রকে ওদের বাড়িতে আনতে পারেনি। ওর বাবা, জেঠু দুজনেই পার্টির একনিষ্ঠ ভক্ত, আলাপ করলে ভালো লাগবে, এসব কথাতেও অরিত্রর আচরণে কোনো প্রতিক্রিয়া চোখে পড়েনি মান্তুর।

শুনলো, ওর বৌ ওকে ছেড়ে চলে গেছে। ও আসাম ছেড়ে পোস্টিং নিয়েছে কলকাতায়।

এরপর একদিন বললো, মিথ্যে বলবো না, নিজের দোষ ঢাকারও চেষ্টা করবো না, তোমার প্রতি আরেকটু মনোযোগী হওয়া উচিত ছিল আমার। বন্ধুরা অনেকেই আমাকে খুব গালাগাল দিয়েছে কলকাতায় ফিরে আসার পর। শুনলাম অনেকদিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে ওদের ভালোই যোগাযোগ ছিল। একদিন চলো কলেজস্ট্রিট। ওদেরকেও আসতে বলবো। আমাদের পুরনো গল্পগুলো আবার ঝালিয়ে নিতে পারবো না মন্দাক্রান্তা?

মন্দাক্রান্তার বুকে রক্তের ঝলক ওঠে। চোখের সামনে হাজার সূর্য আবার জ্বলে উঠতে চায়। মন্দাক্রান্তা ওরফে মান্তু বুঝতে পারে তার মুখে চোখে রক্তপ্রবাহ হঠাৎ করেই খানিক বেড়ে গিয়েছে।

অরিত্র খাবার টেবিলে তবলার বোল তোলে। চায়ের কাপে চুমুক দেয় তৃপ্তির।

-কলেজস্ট্রিট যাওয়া যেতেই পারে। মা, তুমি বলছিলে না ওদিকের কোন দোকান থেকে শাড়িগুলো কিনবে?

অরিত্র অবাক চোখে তাকায়। তার ঝকঝকে বুদ্ধিও খানিক ঘোল খায় যেন।

-হ্যাঁ। তিনমাস পরেই ডেট, তবু এখন থেকেই খানিকটা কেনাকাটি করা ভালো; তাই না অরিত্র?

কথাটা বলেই বাথরুমে ঢুকে দুম শব্দে দরজা বন্ধ করে কল খুলে দেয় মন্দাক্রান্তা। ফাঁকা লোহার বালতি আর জলের শব্দের ছন্দে হাউ হাউ কান্নার শব্দ বাইরে আসে না।

যে বারিধারার অপেক্ষায় চাতকের কাল কেটেছে তার, পেরিয়ে এসেছে কত না দিন, মাস,  বছর, সে মধুমাস আজ বারিসিঞ্চন করছে নতজানু হয়ে, সে কেন পারছে না ছুঁতে? সময় কি তবে নক্ষত্র দূরত্ব পেরিয়েছে?

হাতের মুঠির ধাক্কায় বালতি উলটে পড়ে। আর্তনাদ করে ওঠে সে। হাত খানিক রক্তাক্ত হয়।

-মান্তু, পড়ে গেলি?

-না মা।

-আর কতক্ষণ লাগবে তোর? তোর বন্ধু বসে আছে তো। 

বেরিয়ে অরিত্রকে দেখতে পায় না। বোঝে সে চলে গেছে।

অবহেলা আর অনাদরেরও যে টান আছে অরিত্র সেনগুপ্ত তা বুঝতে পারে না। বোঝা সম্ভবই নয় একথা মান্তু জানে। ছুটি ফুরিয়ে আসছে। বাড়ানো যেত, কিন্তু দুদিন পরের ট্রেনের টিকিট পেয়ে যায় তৎকালে। মান্তু বুঝতে পারে না কেন সে উত্তরবঙ্গে ফিরতে চাইছে এত হুড়োতাড়ায়, সে কি কলেজের টান? না কি একটা ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো সে খালি পালিয়ে বেড়াচ্ছে- বাঁচতে চাইছে শিকড়বিহীন উদ্বাস্তু অস্তিত্বে!       

0 Comments

Post Comment