যুদ্ধ পরিস্থিতি আসন্ন। অথচ তাদের সংস্কৃতি এক, ভাষা এক, ইতিহাস এক। একদা তাদের প্রতিপক্ষ ছিল অবিভক্ত সেই দেশের ওপর জাঁকিয়ে বসা শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিক শাসন। লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে বহু রক্তক্ষয়ে এসেছে তাদের স্বাধীনতা, কিন্তু স্বাধীনতা এল দ্বিখণ্ডিত আকারে। এক দেশের মানুষ হয়ে গেল দুই আলাদা আলাদা দেশের নাগরিক। ধর্মের নামে, ভাষার নামে বিভেদ হল সৃষ্টি। এখন তারা একে অন্যের শত্রু। এক দেশ আরেক দেশের জাতীয় পতাকাকে সহ্য করতে পারে না। বিদ্বেষের বিষাক্ত বায়ু সর্বত্র। এক দেশের সংখ্যাগুরু ধর্ম অন্য দেশের সংখ্যালঘু। ভাঙন এখন মানবতার সর্ব পর্যায়ে।
সেনাবাহিনীর এই ছাউনিতে বদলী হয়ে এসেছে নাজিব। সে আসলে তার দেশের গুপ্তচর বিভাগের লোক। দুই দেশই জানে একে অন্যের সেনাবিভাগে গুপ্তচরদের ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। গুপ্তচর আর বিশ্বাসঘাতকদের খুঁজে বের করতে দুই দেশই তৎপর। যুদ্ধ শুরুর আগে তাই ইন্টেলিজেন্সকে কাজে লাগিয়ে তারা তাদের লুকানো শত্রুদের নির্মূল করতে চায়। নাজিব আর আরমান একে অপরের আসল পরিচয় না জেনেই একে অপরের বন্ধু হতে শুরু করেছিল। তারই মধ্যে কাণ্ডটা ঘটালো আরমান। সেনাবিভাগে থাকা বেশ কিছু গোপন তথ্য সে হস্তগত করে ফেলল। সেইসব তথ্য তার দেশের সেনাবিভাগের হাতে পৌছালে এই দেশকে আক্রমণ করতে এবং নিজের দেশকে সুরক্ষিত করতে তাদের অনেক সুবিধা হবে। কিন্তু সেসব তথ্য পাচারের আগেই আরমানের আসল পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়ল। সেনা ছাউনি ছেড়ে আরমান পালালো। তাকে ধরার দায়িত্ব পড়ল নাজিবের ওপর।
নিজের দেশের বর্ডারের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছিল আরমান। কিন্তু বর্ডার সিল হয়ে যাওয়ায় সে সীমান্ত অতিক্রম করতে পারল না। নিজের দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করার উপায়ও নেই আরমানের। সে তাই বর্ডারের কিছুটা ভেতরের দিকের এক গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিল। সেই গ্রামই যে আবার নাজিবের পরিবারের বাসস্থল সেটা জানত না আরমান।
নাজিব এদিকে আরমানের সন্ধানে সর্বত্র তল্লাশি চালিয়ে বেড়াচ্ছে। নানাদিক থেকে সে খবর পেল যে আরমান ওরফে মীর হায়দার এইদিকের সীমান্তের দিকে এসেছে। সীমান্ত অঞ্চলে তল্লাশি চালিয়েও সে কোনও খোঁজখবর না পেয়ে নিজের গ্রামের দিকেই এগোলো তার লোকজনদের নিয়ে। তখনও নাজিব জানে না তার গ্রামেই লুকিয়ে আছে মীর হায়দার।
তবে মীর বেশিসময় নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারল না। গ্রামে পৌছানোর কিছু সময়ের মধ্যেই অতর্কিতে নাজিবের সামনে পড়ে গেল মীর ওরফে আরমান। কিছু হল ইঁদুর-বেড়ালের ধরপাকড় খেলা। অবশেষে গ্রামের একপ্রান্তে একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে আরমান আর নাজিব একে অপরের মুখোমুখি হল। তারপরেই শুরু হল দুজনের মধ্যে মরিয়া লড়াই। নাজিব একাই তাড়া করেছিল আরমানকে। তার লোকজন গ্রামের অন্যত্র রয়েছে, তাদেরকে ডাকার সুযোগ পায়নি সে। কারণ আরমানের সঙ্গে তার সামনাসামনি হওয়া অতর্কিতে। দীর্ঘসময় ধরে সমানে সমানে গজকচ্ছপের লড়াই চলল দুইজনের মধ্যে। লড়াইয়ের মাঝেই মুখেও তারা একে অন্যেকে, একে অন্যের দেশের উদ্দেশ্যে বিষোদ্গার করে গেল। মুখে মুখে গালাগাল করে একে অন্যের পিতৃপুরুষ উদ্ধার করতেও থাকল। অবশ্য তাদের এই লড়াই যেন আর শেষ হওয়ার নামই নিচ্ছিল না। দুইজনেই একে অন্যের সমতুল্য।
যেখানে লড়াই চলছিল সেখানে কিছু পুরনো আসবাব, দেওয়ালে টাঙানো কিছু পুরনো ছবিও ছিল। দুইজনের লড়াইয়ে সেগুলোও অস্থির হয়ে উঠল। দীর্ঘ লড়াইয়ে সেসবগুলোর অনেক কিছুই মাটিতে আছড়ে পড়ল দুই যোদ্ধার লড়াইয়ের আঘাতে। একটা সময় উভয়েই ক্লান্ত হয়ে ওই ঘরের দুই প্রান্তের দুই দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে পড়ল। দুইজনের শরীরই ক্ষতবিক্ষত, অঝোরে রক্ত ঝরছে দুইজনের শরীরের বিভিন জায়গা দিয়ে। তাও একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ তাদের যাচ্ছে না। নাজিব হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠল, ‘এখান থেকে নিস্তার পেয়ে পালাতে পারবে না, এই গ্রাম চারিদিক থেকে ঘিরে রয়েছে আমার লোকেরা। তুমি এখান থেকে কিছুতেই জীবন্ত নিজের দেশে ফিরতে পারবে না। তোমাকে এখানেই আমরা শেষ করে দেব’।
মীর ওরফে আরমান বলে উঠল, ‘তার আগে নিজের কথা ভাবো, আমি ঠিক বেরিয়ে যাবো কিন্তু আজ তুমি আমার হাত থেকে মুক্তি পাবে না। তোমাকে আগে শেষ করব তারপর আমি ঠিক আমার দেশের কাছে খবর পাঠাবো যে কি করে তোমাদের শায়েস্তা করতে হয়’।
নাজিব নিজের মুখের রক্ত মুছে বলল, ‘পরোয়া নেই, আমার যা হয় হোক, কিন্তু তোমার উদ্দেশ্য যাতে সফল না হয় সেট আমি দেখব। আমার সাথে আমার দেশের জাতীয় পতাকা সবসময় থাকে আর আমার স্বপ্ন সেইটেই আমার কফন হয়ে আমার মৃতদেহকে ঢেকে দেবে, যেদিন থেকে এই দেশের জন্য নিজেকে উতসর্গ করেছি সেইদিন থেকে আর মৃত্যুকে ডরাই না’।
আরমান নিজের ছিন্নবিচ্ছিন্ন জামার ভেতরে সযত্নে লুকিয়ে রাখা তার দেশের জাতীয় পতাকার উঁকি দেওয়া অংশটা দেখিয়ে বলল, ‘আমার দেশ আমার হৃদয়ের কাছে থাকে, তাকে রক্ষার জন্য আমি সব করতে পারি, জীবন দিতেও পারি আবার নিতেও পারি’, বলেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ল নাজিবের ওপর। নাজিবও চেষ্টা করল লড়াই দিতে কিন্তু তার শরীরে আঘাতের মাত্রা বেশি। আরমান কাছে ঘা খেয়ে সে ছিটকে পড়ল একদিকের দেওয়ালে আর সেখানে থাকা একটা বাঁধানো ছবি দেওয়াল থেকে খসে মেঝেতে পড়ে গেল। নাজিব তাড়াতাড়ি সেই ছবিটা তুলতে গেল আর আরমান ছুটে এল ছবিটাকে পায়ে মারিয়ে নাজিবের মুখের ওপর লাথি মারতে, কিন্তু কাছে এসে পড়ে থাকা ছবিটা দেখে সেও অপ্রস্তুত হয়ে পা সরিয়ে নিয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেল।
আরমানও যেন নাজিবের মতই ছবিটা হাতে করে উঠিয়ে নিতে চাইল। নাজিব নিজেও এতে কিছুটা অবাক হয়ে গেল। সে ছবিটা বুকে করে তুলে নিল। আরমান হতভম্বের মত কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে নাজিব বলল, ‘কি হল এই ছবিটা দেখে সরে গেলে কেন? আসো, মারো আমাকে’।
আরমান বলল, ‘এই ছবিটা, এই ছবিটা এখানে?’
নাজিব বলল, ‘আমার নানাজানের ছবি, এই বাড়িটা ছিল আমার নানার। এখন আর কেউ থাকে না এখানে, কি হল দাঁড়িয়ে কেন? আমার নানার ছবির সামনে আমি শহীদ হতে প্রস্তুত, মারো আমাকে’।
আরমান বলল, ‘সৈয়দ আবদুল্লা মির্জা, তাই ত?’
নাজিব আরও অবাক হয়ে বলল, ‘আমার নানাজানের নাম তুমি কি করে জানো?’
আরমান বলল, ‘ইনি আমার নানা, তুমি কি করে………ইনি আমার নানা, আমাদের বাড়িতে এনার ছবি আছে, আমার আম্মি এখনও চোখের জল ফেলেন, নানাকে শেষ সময়ে দেখতে পারেননি, তার জানাজায় সামিল হতে পারেননি বলে’।
নাজিব হতবাক হয়ে রইল, তারপর বলল, ‘তুমি, তুমি আমিনা খালার ছেলে, কিন্তু আমি যেন শুনেছিলাম আমিনা খালার ছেলের নাম আরমান’।
আরমান বলল, ‘আমিই সেই আরমান, এখানে মীর হায়দার পরিচয় নিয়ে ছিলাম, আমার আসল নাম আরমান এহসান, আর আমি যদি ভুল না হই তুমি ফতেমা খালার ছেলে, আম্মি সবসময় ফতেমা খালার কথা বলেন, আর কোনও খবর পাই না ওনার আমাদের দুই দেশের মধ্যে এইরকম রেষারেষির পরিবেশের জন্য। কেমন আছেন ফতেমা খালা?’
নাজিব বলল, ‘আম্মির এন্তেকাল হয়েছে বছর দুই হল, আম্মিও সবসময় আমিনা খালার কথা বলতেন। যমজ বোন ছিলেন দুইজন, শেষসময়ে আমিনা খালাকে একবার চোখের দেখা দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা সম্ভব ছিল না, আমাদের দুই দেশের অবস্থা ত ভালো করেই জানো’।
আরমানের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল, ‘আম্মি নানার জানাজাতে আসতে পারেননি বলে এখনও কাঁদের আর এখন যদি তার যমজ বোনের মৃত্যুর খবর শোনের, তাহলে যে কি হবে?’
নাজিব বলল, ‘আমি আম্মির মুখে সব শুনেছি, আমিনা খালা নিকাহ হওয়ার পর ওই শহরে চলে যান। আম্মির নিকাহ এখানেই হয়। তারপরেই আসে স্বাধীনতা আর সেইসঙ্গে দেশভাগ। এক দেশের লোক দুই দেশে ভাগ হয়ে যায়। আমরা রয়ে গেলাম এপারে তোমরা রয়ে গেলে ওপারে। নানা তার ভিটে ছেড়ে কোথাও যেতে চাননি, এই মাটিতে তিনি ভালোবাসতেন কিন্তু তোমরাও ওদেশ থেকে এদিকে আসোনি, তাই আমরা একই পরিবারের হয়েও দুই দেশে ভাগ হয়ে গেলাম’।
আরমান বলল, ‘আব্বুও একইভাবে তার শিকড়কে ভালোবাসতেন, আমাদের বিষয় আশয় সব ওপারে, অনেকে আব্বুকে বলেছিল চলে আসতে এইদিকে, কিন্তু আব্বুও তার মাটিতে জান্নাত বলে মনে করতেন। আব্বু নিজের শিকড় ছাড়েননি আর আম্মিও জান দিয়ে ভালোবাসতেন আব্বুকে, তাই তুমি হলে এদেশের আর আমি হলাম ওদেশের। দেশভক্তির রক্ত আমাদের দুইজনের রক্তেই আছে, কিন্তু আমরা এখন আলাদা আলাদা দেশের সৈনিক আর দুর্ভাগ্য যে আমাদের দুই দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে লড়তে চাইছে’।
নাজিব বলল, ‘আমাদের কাজ হুকুম তামিল করা ভাইজান, কিন্তু আমি জানি আমার দেশের জনতা যুদ্ধ চায় না’।
আরমান বলল, ‘সে ত আমার দেশের মানুষও যুদ্ধ চায় না, এসব ত রাজনীতির খেলা’।
নাজিব বলল, ‘ঠিকই বলেছ ভাইজান, সিয়াসি কর্মকাণ্ড সব আর আওয়াম সিয়াসি নেতাদের হাতের পুতুল’।
আরমান বলল, ‘এবার তবে কি?’
নাজিব বলল, ‘আমিনা খালার ছেলেকে আমি নানার ভিটেতে মেরেছি সেটা জানলে আমার আম্মির আত্মা কোনওদিন শান্তি পাবে না’।
আরমান বলল, ‘আমার হাতে ফতেমা খালার ছেলের জান গেছে শুনলে আমার আম্মিও এমনিতেই মারা যাবে’।
নাজিব বলল, ‘কিন্তু আমি ত আমার দেশের ওফাদার সৈনিক ভাইজান, মুলুকের ক্ষতি আমি হতে দেব না, দিতে পারি না’।
আরমান বলল, ‘আমার দেশের জন্য আমিও তাই, তবে একটা চেষ্টা আমরা করতেই পারি, যাতে যুদ্ধ না হয়, যাতে শান্তি ফিরে আসে’। কথা শেষ করে নিজের জামার মধ্যে লুকানো একটা পকেট থেকে একতারা কাগজ বের করে আনল আরমান, তার থেকে কিছু কাগজ বের করে সে নাজিবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এগুলোতে তোমার দেশের সুরক্ষার বিবরণ রয়েছে, এগুলো ফিরিয়ে দিচ্ছি আমি, আর বাকিগুলোতে রয়েছে তোমার দেশ আমার দেশের ওপর কিভাবে আক্রমণ করতে চাইছে তার বিশদ পরিকল্পনা, এগুলো আমি সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি যাতে আমার মাতৃভূমিকে আমি বাঁচাতে পারি। রাজি থাকলে বল?’
নাজিব হাত বাড়িয়ে কাগজগুলো নিয়ে বলল, ‘মনজুর ভাইজান, আমিও আমার ওপরওয়ায়ালদের জানিয়ে দিচ্ছি যে গুপ্তচরকে আমি ধরে তার কাছ থেকে কাগজ উদ্ধার করেছি, কিন্তু তাকে ধরে রাখতে পারিনি সে সীমান্ত পেরিয়ে চলে গেছে তার দেশে, সীমান্তে তাহলে পাহারা কিছুটা শিথিল হবে, সেই সুযোগে সরহদ পেরিয়ে তুমি নিজের মুলুকে চলে যেতে পারবে’।
আরমান বলল, ‘তাই হোক, আমিও আমার দেশে গিয়ে চেষ্টা করব যাতে যুদ্ধ না হয়, চলি তাহলে ভাই’।
নাজিব বলল, ‘আর কি দেখা হবে না ভাই?’
আরমান বলল, ‘যুদ্ধ হলে হয়ত আবার শত্রু হিসাবে একে অন্যের মুখোমুখি হব, আর শান্তি পুরোপুরি ফিরে এলে আত্মীয়ের মত, ভাইয়ের মত একে অন্যের দেশে অতিথি হয়ে যাতায়াত করব, তখন একসাথে বসে উৎসবে সামিল হব সবাই, একটা পরিবার হয়ে উঠব আমরা’।
‘ইনশাল্লাহ, তাই যেন হয় ভাই, আমিও এদিক থেকে সেই চেষ্টাই করব, আমিনা খালাকে আমার সেলাম জানিও’। আরমান বিদায় জানালো নাজিবকে তারপর তার নানার ছবিতে শেষ সেলাম জানিয়ে সে বেরিয়ে গেল সেই বাড়ি থেকে।
তারপর অনেক বছর কেটে গেছে। আমরা জানি না কি পরিণতি হয়েছিল আরমানের, আমরা জানি না নাজিবই বা কতটা কি করে উঠতে পেরেছিল। যুদ্ধ আর সামনাসামনি হয়নি, কিন্তু পুরোপুরি শান্তিও ফিরে আসেনি, সময়ে সময়ে এখনও পরিবেশ পরিস্থিতি উত্তেজনা পূর্ণ হয়ে ওঠে। বাতাসে এখনও ভেসে আসে সীমান্ত থেকে বারুদের গন্ধ, কখনও আবার শোনা যায় সৌহার্দের বাসন্তী সঙ্গীত। কিন্তু আরমান আর নাজিবের মত দুই দেশের জনতা আজও রয়েছে পূর্ণ প্রতীক্ষায় চিরশান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কবে আবার তারা একে অন্যের আত্মীয় হয়ে উঠবে সেই আশায়।